আবেদন
নয়া কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে ২৬ নভেম্বর গ্রামীণ ধর্মঘট সফল করে তুলুন
nnn

কেন্দ্রীয় সরকারের নয়া কৃষি আইনে রাষ্ট্রপতি সন্মতি দিয়েছেন। অথচ রাজ্যসভায় এই আইন নিয়ে বিধিসন্মত কোনো আলোচনাই হলো না! সংখ্যা বা বলা ভালো গায়ের জোরে তড়িঘড়ি তিনটি বিল পাশ করিয়ে নেওয়া হলো। এখন কর্পোরেট কোম্পানিরা নাকি সরাসরি কৃষকের থেকে ফসল কেনা শুরু করে দিয়েছে, এবং তারা সরকারী সহায়ক মূল্যের থেকে বেশি দামে ফসল কিনছে! মোদী সরকারের গোয়েবলসীয় প্রচারযন্ত্র এ জাতীয় মিথ্যা প্রচার ছড়িয়ে দিচ্ছে। বলা হচ্ছে নতুন ব্যবস্থায় চাষিরা নাকি “ফড়েরাজ” থেকে মুক্তি লাভ করবে, তারা “স্বাধীন” হয়ে উঠবে,ইত্যাদি ইত্যাদি! কিন্তু এই সময়কালে উঃপ্রদেশসহ বিভিন্ন রাজ্য থেকে খবর পাওয়া যাচ্ছে যে দালালরা চাষির থেকে কম দামে ধান কিনে রাইস মিলে নিয়ে যাচ্ছে কুইন্টালে প্রচুর পরিমান কমিশনের বিনিময়ে। এখন মৌলিক যে প্রশ্ন উঠে আসছে তা হলো কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত কৃষিপণ্যের বাজারে চাষির কাছ থেকে কত দামে ফসল কেনা হবে? নয়া কৃষি আইনে তার কোনো গ্যারান্টি আছে কি? আদৌ নেই। বাস্তবে কর্পোরেট বাজারে চাষির অধিকার রক্ষায় কোনো আইন থাকবে না, কোনো তথ্য পাওয়া যাবে না,লেনদেনে চলবে চরম অস্বচ্ছতা! ফসলের দাম নিয়ে কোন বিরোধ বা ক্ষোভ বিক্ষোভ দেখা দিলে সেটা নিরসনের কোনো আইনি সংস্থান থাকবে না। এভাবে কৃষি ও কৃষকদের তুলে দেওয়া হবে সম্পূর্ণ কর্পোরেটদের নিয়ন্ত্রণে।

কৃষি বিপনন ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারী ব্যবস্থায় যে চরমতম অকর্মন্যতা- দুর্নীতি - বঞ্চনার দিকগুলি রয়েছে তাকে কাটিয়ে তোলার কথা বলা হচ্ছে না। অনেকেই সেই চিরপরিচিত গল্পটা তুলে ধরছেন যে, গামলায় শিশুর স্নানের জল খারাপ হয়ে গেলে জলসহ শিশুটিকেও ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হচ্ছে! বলা বাহুল্য শিশুর সাথে তুলনা করা হচ্ছে কৃষকদের! যেমন শিল্পজাত বিভিন্ন পণ্যদ্রব্যের গায়ে লেখা থাকে এমআরপি অর্থাৎ ম্যাক্সিমাম রিটেল প্রাইস। কিন্তু চাষির ফসলে কোনো নির্দিষ্ট দাম লেখা থাকে না। সরকার নির্ধারণ করে এমএসপি বা মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস (ন্যূনতম সহায়ক মূল্য)। এটাকে এক ধরনের বীমা ব্যবস্থা বলা যায়। প্রকৃত উৎপাদকরা যাতে ফসলের ন্যয্য দাম পায় সে জন্য বাজারকে খানিকটা নিয়ন্ত্রণ করার বন্দোবস্ত! এর লক্ষ্য হলো চাহিদা কমে গেলে উৎপাদক চাষিদের লোকসান বা অভাবী বিক্রির হাত থেকে রক্ষা করা। এর সাথে গণবন্টন বা রেশনে খাদ্য সরবরাহ তথা খাদ্য সুরক্ষার প্রশ্ন অঙ্গাঙ্গী ভাবে যুক্ত। একটা থাকলে অন্যটা থাকবে,উঠিয়ে দিলে দুটোই উঠে যাবে। কিন্তু কাগজে কলমে এমএসপি বা ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের কথা লেখা থাকলেও সেই দামে সরকার চাষির থেকে ফসল কেনে না। মাঠে চাষি ফসলের যে দাম পায় বাজারে সেটা বিক্রি হয় চারগুন দামে। কারও “পৌষ মাস আর কারও সর্বনাশ”! এ রাজ্যে সাম্প্রতিক আলু পিঁয়াজের আগুন দামে সে জিনিস আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি যে আগামী দিনটা কোথায় চলেছে! কি ভাবে শাসকদল- দালাল মহাজন চক্র কাজ করে চলেছে। অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন সংশোধন করে দিয়ে মজুতের উর্ধ্বসীমা তুলে দেওয়ার ফল কি হতে পারে! একটা সরকারী তথ্য দেওয়া হচ্ছে যে মাত্র ৩০ ভাগ চাষি নাকি সরকারী দর পেয়ে থাকে। দেশ জুড়ে প্রতিবাদের চাপে মোদী সরকার এখন বলছে এমএসপি নাকি থাকবে! কিন্তু এটা সম্পূর্ণ মিথ্যাচার। বাস্তবে বিগত দিনে সরকার এটাকে ধাপে ধাপে তুলে দিতেই চেয়েছে। মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পরবর্তী সময়কালে চাষের খরচ বিপুল পরিমানে বেড়ে গেছে কিন্তু এমএসপি বা সহায়ক মূল্য বৃদ্ধির হার ক্রমাগত কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। যথা ২০১৩-১৪ সালে ধান ও গমের ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার ছিলো ১৪ শতাংশ ও ৯ শতাংশ। ২০১৫- ১৬ সালে ছিলো ৫ ও ৫.৫ শতাংশ,২০২০-২১ সালে ২.০৯ ও ২.৬ শতাংশ! এছাড়া এমএসপি নির্ধারণে কারচুপি করা হচ্ছে। উৎপাদন খরচের দেড়গুন দাম সঠিক ভাবে হিসাব না করে প্রতি কুইন্টালে ৪০০-৫০০ টাকা কম করে ধরা হয়েছে। যেমন ধানের সহায়ক মূল্য হওয়া উচিত ২৩৫০ টাকা অথচ রয়েছে ১৮৬৫ টাকা কুইঃ।

দেশের বিভিন্ন রাজ্যে নিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থায় (এপিএমসি) সরকারঘোষিত সহায়ক মূল্যে চাষির ফসল কেনার একটা ব্যবস্থা রয়েছে। নয়া কৃষি আইনে সেটা কার্যত তুলে দেওয়া হবে। অর্থাৎ মান্ডি থেকে কোম্পানীরা আর ফসল কিনবে না। কেননা তারা সরকারকে ট্যাক্স বা সেস দেবে কেন? মান্ডির বাইরে থেকে কিনবে। এতে রাজ্য সরকারের আয় কমে যাবে। শুধু তাই নয় কৃষিক্ষেত্রে রাজ্যের কোন অধিকারই আর থাকবে না। বলা হচ্ছে “ফড়ে রাজ” নাকি বিলুপ্ত হবে। কিন্তু বড় সংখ্যক চাষিদের সাথে কর্পোরেট পুঁজিপতিদের সরাসরি লেনদেন অনেক বেশি ব্যয়বহুল। তাই কোম্পানিরা মধ্যস্বত্বভোগীদের উপর নির্ভর করতে বাধ্য। এ কারণেই সৃস্টি হবে নতুন রূপের কর্পোরেট ফড়েরাজ! পাঞ্জাব, হরিয়ানা রাজস্থানে ঐ মান্ডি ব্যবস্থা ছিলো। সংখ্যাগরিষ্ঠ চাষিরা সেখানে ফসলের সরকারী দর পেতো। স্বভাবতই সেটাকে তুলে দেওয়ার বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে চাষিদের তুমুল আন্দোলন। আগামী ২৬ নভেম্বর হাজার হাজার ট্রাক্টরে করে তারা রাজধানী অভিমুখে প্রতিবাদী অভিযান করবে। এখন বলা হচ্ছে পঃ বাংলায় তেমন বড় মাপের কোনো আন্দোলন দেখা যাছে না। বাংলা সহ ভারতের অন্যান্য রাজ্যে সরকারী নিয়ন্ত্রিত বাজারে ফসল বিক্রি করার কোনো বাধ্যতা বা ব্যবস্থা নেই। এ রাজ্যে ইতিমধ্যেই আইন সংশোধন করে চুক্তিচাষ বৈধ করে দেওয়া হয়েছে,কৃষি পণ্যের ব্যাবসায় পুঁজিপতিদের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তাই এ রাজ্যে নয়া কৃষি আইনের নাকি কোনো প্রাসঙ্গিকতাই নেই। কিন্তু সারা দেশে ক্ষুদ্র কৃষির বিকাশের রাস্তাটা সরকার ক্রমশ বন্ধ করে দিচ্ছে। তাই কৃষি সংকটের সাধারণ চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে চাষিদের অভাবী বিক্রি! অপরদিকে চাষের খরচের বিপুল ব্যয় বৃদ্ধি,সরকারী সহায়ক মূল্য নির্ধারণে সরকারের কারচুপি, ফসল ক্রয়ে সরকারের তঞ্চকতা! তাই কৃষি উপকরণ যথা সার, বীজ, জল, বিদ্যুৎ-এর সুলভে সরবরাহ করা, দালাল বাদ দিয়ে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে ফসল কেনার দাবিতে সারা দেশেই চলছে কৃষক আন্দোলন।

এই আন্দোলনের অন্যতম দাবি হয়ে উঠেছে সমস্ত রকম ফসলের এমএসপি গ্যারান্টি আইন করতে হবে। পঃ বাংলায় যা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। কেবল পঃ বাংলা নয়, বিহার, কেরল সহ বিভিন রাজ্যে দীর্ঘদিন ধরে এপিএমসি তুলে দেওয়া হয়েছে। সরকার নিয়ন্ত্রিত শস্যক্রয় ব্যবস্থা যদি কৃষি ক্ষেত্রে বেসরকারী পুঁজি বিনিয়োগের পথে বাধা হয়ে থাকে তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে ঐ সমস্ত রাজ্যের কৃষি বিপননে বেসরকারী পুঁজি ঝাঁপিয়ে পড়লো না কেন? আসলে বাজারের কাঠামোর উপর ফসলের দাম নির্ভর করে না। সরকারের হস্তক্ষেপ অর্থাৎ ভর্তুকি বা সরকারী সংগ্রহ যদি না থাকে কৃষকের চরম অভাবী বিক্রি ও দারিদ্র্য বাড়বে। ঋণগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যার মিছিল বাড়বে। দেশে প্রতি ৩০ মিনিটে একজন চাষি আত্মহত্যা করছে। এই হার কমার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। পঃ বাংলাতেও প্রতিবছর আলু চাষির আত্মহত্যার খবর পাওয়া যাচ্ছে। এ বছর সরকারের কোন হস্তক্ষেপ না থাকায় আলু বীজের দাম বিপুল। চাষিরা বড় আশা করে,ঋণ নিয়ে আলুচাষে খরচ করছেন। কিন্তু খবর পাওয়া যাচ্ছে হিমঘরে আলুর বন্ডের ৮০ ভাগই নাকি বড় ব্যবসায়ীরা কিনে নিয়েছে। তাহলে চাষিরা আলুর ন্যায্য দাম পাবে কি? এ নিয়ে রয়েছে চরম অনিশ্চয়তা! পঃ বাংলায় এমএসপির যদি কোনো প্রাসঙ্গিকতাই না থাকে তাহলে সরকার কেন ঢাক ঢোল পিটিয়ে সরকারী দরে ধান কেনার কৃতিত্ব জাহির করে? তথ্যে জল মেশানো হয় সেটা আলাদা বিষয়, কিন্তু চাষি দরদী মুখোষ পড়ে সরকার কতটা সক্রিয় তার প্রমান দিতে ফসল কেনার বড় বড় হিসাব দেওয়া হয় কেন? তাই সারা দেশেই নয়া কৃষি আইনের যে ভয়ংকর প্রভাব রয়েছে বাংলা তার কোনো ব্যাতিক্রম নয়। এখানে ব্লকে ধান কেনার কৃষক মান্ডিগুলিতে বড় ব্যবসায়ী মহাজনেরা নানারকম কারসাজি করে নিয়ন্ত্রণ কায়েম রাখছে। তাই গ্রামে ক্যাম্প করে কিংবা গ্রামীণ সমবায়ের মাধ্যমে ধান না কিনলে চাষিরা সরকারী দর ১৮৬৫ টাকার বদলে ১১০০-১২০০ টাকা দাম পাচ্ছে। সেই ধান কিনে মধ্যস্বত্বভোগীরা সরকারী দর হাতিয়ে মুনাফা করে নিয়ে চলেছে।

বলা হচ্ছে চুক্তিচাষে নাকি চাষির লাভ হবে। কিন্তু চুক্তি চাষের নতুন আইনে মারাত্মক যে দিকটা রয়েছে তা হলো কোম্পানির সাথে চাষির কোন বিরোধ দেখা দিলে চাষিরা আদালতে যেতে পারবে না। প্রশাসনই নাকি সেই বিচার করবে। স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন ওঠে এটা করা হলো কেন? কাদের স্বার্থে? আসলে এই ভাবে কৃষকের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে তাঁকে কোম্পানির গোলামে পরিণত করা হবে। এ রাজ্যে বা অন্যত্র পেপসি কোম্পানির আলুর চুক্তি চাষে চাষির তথাকথিত “লাভ” এর কথা তুলে ধরা হচ্ছে। কিন্তু বাজারে চরম মন্দা, মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়ছে না, শিল্পে গতি নেই। তাই এ রাজ্যে চুক্তি চাষে চাষির সুদিন আনার গল্প বেশি দুর এগোতে পারেনি। কার্যত এটা ক্ষুদ্র প্রান্তিক চাষির জমি ঘুরপথে হাতিয়ে নেওয়ার চক্রান্ত! তাই কেন্দ্রীয় সরকারের নয়া কৃষি আইনের বিরুদ্ধে এবং রাজ্য সরকারের কৃষক বিরোধী ভুমিকার বিরুদ্ধে আগামী ২৬ নভেম্বর সংগঠিত হবে গ্রামীণ ধর্মঘট।

-- জয়তু দেশমুখ   

খণ্ড-27
সংখ্যা-41