সম্পাদকীয়
রাজ্যপালের রাজনীতি
radd

অতি সক্রিয়তার মূর্তি ধারণ করে চলছেন রাজ্যের রাজ্যপাল জগদীপ ধনকর। দিল্লী গেলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর কাছে। উদ্দেশ্য চাপা থাকেনি। আগে-পরের মন্তব্যে ধরা পড়েছে পরিষ্কার। রোষ বর্ষণ করেছেন বিস্তর। এরাজ্যে সাংবিধানিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে! মহিলারা রাস্তায় বেরোতে পারেন না, আক্রান্ত হচ্ছেন পথে-ঘাটে, নিরাপত্তা মেলে না থানা-পুলিশের সাহায্যের। এখানে আল কায়দা বাড়ছে, দাঁত-নখ বার করছে! অথচ পুলিশ-প্রশাসন টের পায় না। যোগসাজশে তৈরি হয়েছে পুলিশ রাষ্ট্রের পরিস্থিতি! আইএএস-আইপিএস’রা শাসকদলের প্রথম শ্রেণীর কর্মীর মতো আচরণ করছেন। এখানে তাই ৩৫৬ ধারা প্রয়োগ করা প্রয়োজন! এই সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচন অবাধ, পরিচ্ছন্ন ও ভয়শূন্য পরিবেশে হওয়া সম্ভব নয়।

রাজ্যপাল যা যা প্রশ্ন তুলছেন তার সবটাই ভিত্তিহীন নয়। কিন্তু ধরা পড়ছে গূঢ় উদ্দেশ্য। হিম্মৎ দেখাচ্ছেন বটে, খতিয়ে দেখতে হবে এতসব লম্ফঝম্ফ কীসের স্বার্থে, কাদের স্বার্থে!! মদত দিচ্ছেন কারা! রাজ্যপাল হঠাৎই ছুটে গেলেন রাজধানীতে, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে সমস্ত রিপোর্ট দিলেন। ওপরতলায় নিয়মিত রিপোর্ট দেওয়ার নিয়মগত বাধ্যতা থাকে। সাধারণভাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকে, কখনও কোন বিশেষ জরুরি পরিস্থিতিতে সরাসরি রাষ্ট্রপতির কাছে, এটাই দস্তুর। কিন্তু কী এমন মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল যে সশরীরে যেতে হল! মিলেছে খবর, এসেছিল তলব। সময় নিয়ে আলোচনা হয়েছে উভয়ের মধ্যে। মূলত কী চর্চা হয়েছে তা পরে খোলসা হয়ে গেছে অমিত শাহর মুখ হা-করার মধ্যে। শাহর মন্তব্য হল, বাংলায় বিজেপি নেতাদের ৩৫৬ কায়েমের দাবি খুব ন্যায়সঙ্গত। এই দাবির সপক্ষে সোরগোল তুলে আপন বাজার গরম করার একটা চেষ্টা বিজেপির আছে। বোঝার অভাব রাখে না, ঐ দাবিতেই ধুনো দিয়ে এসেছেন রাজ্যপাল। শুধু তাই নয়, নিশ্চিত পরবর্তী করণীয় কী কী সেই কাজ বুঝে নিয়ে এসেছেন। এসেই প্রায় তুরন্ত ছুটলেন দার্জিলিং। যেখানেই কোনো ঘটনায় বিজেপি-র টক্কর লাগার সংকেত অনুভূত হচ্ছে সেখানেই রাজ্যপাল পৌঁছে যাচ্ছেন। গোর্খাল্যান্ড রাজনীতির বহুপাক্ষিক সংঘাতে এবং কিছু হত্যার রাজনীতিতে জড়িয়ে প্রায় ৩ বছর আত্মগোপনে ছিলেন বিমল গুরুং। রাজ্যের শাসক টিএমসি-র সাথে তাঁর সম্পর্ক গড়ায় অহি-নকুলে। গত লোকসভা নির্বাচনে গোর্খাল্যান্ড ও মামলা-মোকদ্দমা থেকে মুক্তি পাইয়ে দেওয়ার ‘প্রতিশ্রুতি’র ধোঁকা দিয়ে গুরুং-গোষ্ঠীর সমর্থনের সুবিধা জোগার করতে সফল হয়েছিল বিজেপি। তারপর এতদিনেও প্রত্যাশা ফলপ্রসূ হল না বুঝে পরিত্রাণ পাওয়ার আশায় গুরুং ফের মুখ ফেরালেন মুখ্যমন্ত্রীর দিকে। এই পরিবর্তিত ঘটনার মধ্যে পাহাড়ে বিজেপি বিরোধী মেরুকরণের পুনরুত্থানের আঁচ পেয়ে আগেই ছুটলেন রাজ্যপাল। পথে আইন-শৃংখলা বিষয়ে মালদায় নিয়েছেন বিজেপি প্রতিনিধিদের ডেপুটেশন। আর পাহাড়ে গিয়ে তলব করেছেন জেলা শাসক ও পুলিশ সুপারকে। তাদের সামনে উগরে দেন বিষোদগার। বললেন, বিমল গুরুং গণতন্ত্রের পক্ষে বিপজ্জনক! পুলিশ-প্রশাসনের বড় কর্তারা আচরণে নাকি শাসকদলের আজ্ঞাবহ হয়ে যা করা উচিত নয় তাই করছেন, ‘নিরপেক্ষতা’ বিসর্জন দিচ্ছেন। রাজ্যপালের এইসব আচরণ-বিচরণে একমাত্র উৎফুল্ল রাজ্য বিজেপি। অন্যান্য সক্রিয় বিরোধীদল সব রাজ্যপালের এই দাদাগিরির বিরুদ্ধে সরব।

আসা যাক রাজ্যপালের মূল মূল অভিযোগ ওঠানোর কথায়। রাজ্যপাল বস্তুত সংবিধানের ৩৫৬ ধারার বিকৃত স্বেচ্ছাচারী প্রয়োগ চাইছেন। কোনোভাবেই ধোপে টেঁকে না রাষ্ট্রপতি শাসন জারীর ওকালতি। তেমন বিরল সাংবিধানিক সংকট দেখা দেওয়ার ভূত দেখিয়ে লাভ নেই। রাষ্ট্রপতি শাসনের দাবি একমাত্র তখন অপরিহার্য হয় যখন একদিকে ক্ষমতাসীন সরকার প্রবল গণবিস্ফোরণে নিজের পতন ঘটিয়ে ফেলে, অন্যদিকে পরবর্তী নির্বাচন সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন করার জন্য প্রয়োজন হয় কিছু সময়ের, পরিস্থিতির খোলামেলা বিকাশের। পশ্চিমবাংলায় শাসক ও বিরোধী পক্ষগুলোর মধ্যে সংঘাতের পরিস্থিতি চলছে, কিন্তু রাষ্ট্রপতির শাসন জারী করার কেন্দ্র-বিজেপি-রাজ্যপাল যোগসাজশের অভিসন্ধির এখানে কোন জমি পাওয়া উচিত নয়। পশ্চিমবাংলায় যথেচ্ছ পুলিশী উৎপীড়ন চলে, তবে এখনও ঠিক ‘ধরো-মারো’ মার্কা পুলিশ রাষ্ট্রে পরিণত হয়নি, অবশ্য রাশ না টানলে সেদিকেই যাবে, যেমনটা পরিণত হয়েছে বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশ। বাংলার বিজেপি নেতারাই বরং হুমকি দেন এখানে ক্ষমতায় “উত্তরপ্রদেশ বানিয়ে দেব। রাজ্যপাল এসব শুনেও ভান করেন না-শোনার। তিনি উগরে দিচ্ছেন দুমুখো অসত্য। একইসাথে বলছেন এখানে চলছে ‘পুলিশী রাষ্ট্র’, আবার বলছেন ‘আল কায়দা বাড়ছে, পুলিশের নাকের ডগায়’! কি বিচিত্র স্ববিরোধিতা! আসলে পশ্চিমবাংলায় বিজেপি-র মুসলিম-বিদ্বেষের রাজনীতি আর কেন্দ্রের ‘নিয়া’র হানা দেওয়াকে কি অজুহাতে গিলিয়ে দেওয়া যায় সেটাই তাঁর মতলব। আর তা করতে গিয়ে তিনি ছুটছেন উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে, দিচ্ছেন অনেক উল্টোপাল্টা বিবৃতি। রাজ্যপাল করছেন রাজ্যপালের রাজনীতি।

খণ্ড-27
সংখ্যা-39