বিহারের রায় এবং ভারত জুড়ে তার অনুরণন
ann

কোভিড ১৯ ও তার পরবর্তীতে, নিষ্ঠুর লকডাউন ও তার বিধ্বংসী পরিণামের আবহে অনুষ্ঠিত প্রথম বড় নির্বাচন এক চমকপ্রদ ফলাফলের জন্ম দিয়েছে। অক্টোবরের প্রথমে যখন নির্বাচনের জন্য মনোনয়ন দাখিল হচ্ছে, তখন ওপিনিয়ন পোল-এ বিহারে এনডিএ-র পক্ষে এক প্রবল সংখ্যাগরিষ্ঠতার কথা উঠে এল। নরেন্দ্র মোদী এবং নীতীশকুমার অনায়াসে ভোট যুদ্ধ উৎরে যাবেন বলেই ধরে নেওয়া হয়েছিল। কেউ বিরোধীদের জয়ের এমনকি ক্ষীণতম সম্ভাবনার কথাও বলেনি। আবার একমাস পর বেশিরভাগ একজিট পোল আরজেডি-বাম-কংগ্রেসের বিরোধী জোটের সংখ্যাগরিষ্ঠতার একটা স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছিল। কিন্তু চূড়ান্ত ফলাফলে এনডিএ প্রায় নিশ্চিত পরাজয়ের গ্রাস থেকে কান-ঘেঁষা জয়কে ছিনিয়ে নেওয়ার আকস্মিক সুযোগ পেয়ে গেল। এনডিএ আর মহাজোটের মধ্যে চূড়ান্ত ব্যবধান ছিল মাত্র ১২০০০ ভোটের — এনডিএ প্রায় এক ডজন আসনে এক চুলের ব্যবধানে জিতেছে।

নির্বাচনকে জনগণের এক অমোঘ আন্দোলনের রূপ দেওয়ার কৃতিত্ব বিহারের যুব সম্প্রদায়ের যারা জাতপাতের বেড়াকে চমৎকার ভাবে অতিক্রম করে এনডিএ-র বিরুদ্ধে বিপুলভাবে ভোট দিয়েছে। ১৯টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী সিপিআই(এমএল) সহ মোট ২৯টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী বামেদের সঙ্গে আরজেডি-বাম-কংগ্রেসের জোটগঠন —নিশ্চিত ও মর্যাদাপূর্ণ কর্মসংস্থান ও জনস্বাস্থ্য, শিক্ষা, রুটি-রুজি, কৃষি, মজুরি এবং সামাজিক নিরাপত্তার মত আশু ও মৌলিক দাবিগুলিকে মূল নির্বাচনী অ্যাজেন্ডা হিসেবে গুরুত্ব দেওয়া — গোটা নির্বাচনী আবহাওয়াকে পাল্টে দিয়েছিল। জোট সংখ্যাগরিষ্ঠতার সংখ্যা থেকে সামান্য পিছিয়ে পড়লেও, এক বলিষ্ঠ বিরোধীশক্তির উত্থান হয়েছে এবং সেই শক্তিকে বিজেপি'র বিরোধিতা-মুক্ত গণতন্ত্র এবং একদলীয় শাসন কায়েমের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে এক বলিষ্ঠ প্রত্যাঘাত হিসাবেই দেখতে হবে। আর এই ফলাফলের প্রভাব ইতিমধ্যেই বোঝা গেছে। নতুন মন্ত্রীসভার শপথ গ্রহণের অল্প পরেই নরেন্দ্র মোদী এবং নীতীশ কুমারকে এক দুর্নীতি-কলঙ্কিত বিধায়কের মন্ত্রিত্ব খারিজ করতে হয়েছে যাকে তারা শিক্ষামন্ত্রী হিসাবে বিহারের উপর চাপাতে চেয়েছিল।

বিজেপির প্রচারকরা বিহারের ফলাফলকে 'মোদীর পক্ষে রায়' বলে বোঝাতে চেয়েছিল। ঠিক যেমন তারা ২০১৭-র উত্তর প্রদেশ নির্বাচনের ফলকে নোটবন্দির বিপর্যয়ের প্রতি 'জনতার অনুমোদন' বলে চালাতে চেয়েছিল, সেভাবেই তারা আমাদের বিশ্বাস করাতে চাইছে যে বিহারের ফলাফল—মোদী সরকার যেভাবে কোভিড ১৯-এর মোকাবিলা করেছে, কৃষিকে পুরোপুরি কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য নতুন আইনগুলো পাস করেছে এবং শিল্প, পরিকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিষেবা ও অন্যান্য গণ পরিষেবাগুলোর আগ্রাসী বেসরকারীকরণের পথে হাঁটছে — সবটাই নাকি ভোটদাতাদের অনুমোদনকেই তুলে ধরছে! সত্যের নামে এর চেয়ে বড় প্রহসন আর আছে! বিহারের রায় শুধু যে নীতীশ কুমারের প্রতি গণ প্রত্যাখ্যানকে তুলে ধরেছে তা-ই নয়, এটা মোদী সরকারের ধ্বংসাত্মক, বিপর্যয়সৃষ্টিকারী নীতিগুলোর বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান গণক্রোধকেও প্রতিফলিত করছে। এটা মনে রাখতে হবে যে, ২০১০ সালে মোদীরাজ কায়েমের চার বছর আগে, বিজেপি বিহারে ৯১টি আসনে জিতেছিল। ২০১৫-তে যখন বিজেপি'র পক্ষে নীতীশ কুমারের সমর্থন ছিল না — তখন সেই সংখ্যা নেমে আসে ৫৩-তে। আর এইবার নতুন করে জেডিইউ-এর হাত ধরে এবং আরও দুই সঙ্গীর সমর্থন পেয়েও আসন সংখ্যা ৭৪, ২০১০-এর শীর্ষ সাফল্য থেকে ১৭ টি আসন কম। যাই হোক, এই জেডিইউ-কেই জনরোষের মূল ধাক্কা সইতে হয়েছে আর আগের থেকে অনেকটাই হীনবল নীতীশ কুমার এখন বিজেপি'র দয়ায় মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন যে বিজেপি ক্রমশ আরও উৎসাহিত আর আগ্রাসী হয়ে উঠছে।

vic

 

বিহার ফলাফলের একটি অত্যন্ত উৎসাহজনক রাজনৈতিক ইঙ্গিত হল – সিপিআই(এমএল)-এর নির্বাচনী সম্প্রসারণ ও পুনরুত্থান এবং বিহার বিধানসভায় ১৬ সদস্যের বাম বাহিনীর উত্থান। বিজেপি'র শীর্ষ নেতৃত্ব সিপিআই(এমএল)-কে 'দেশদ্রোহী' শক্তি হিসাবে নিশানা করে, সিপিআই(এমএল)-এর তরুণ প্রার্থীদের 'টুকরে টুকরে গ্যাং' অপবাদে চিহ্নিত করে বেলাগাম বিষাক্ত কুৎসা প্রচার শুরু করে। আর প্রথম পর্যায়ে আমাদের আটজন প্রার্থীর মধ্যে সাতজন এই বিদ্বেষপূর্ণ মিথ্যার গোলাবর্ষণের মুখে দাঁড়িয়েও বিপুলভাবে জয়ী হয়েছেন। কমরেড অমরজিৎ কুশাওয়া, বিপ্লবী যুব অ্যাসোসিয়েশন-এর সাম্মানিক সভাপতি, যিনি এক মিথ্যা মামলায় ২০১৫-র নির্বাচন থেকে জেলে রয়েছেন এবং জেল থেকেই যাকে নির্বাচন লড়তে হয়েছে, এক প্রত্যয় জাগানো ব্যবধানে জিতেছেন। আইসা নেতা এবং জে এন ইউ-এর ছাত্র সংসদের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক সন্দীপ সৌরভ পালিগঞ্জ, পাটনা থেকে, আরওয়াইএ-র সর্বভারতীয় সভাপতি কমরেড মনোজ মঞ্জিল আগিয়াঁও (এস সি) ভোজপুর থেকে, বিহার আর ওয়াই এ-সভাপতি কমরেড অজিত কুশাওয়া দুমরাঁও, বক্সার থেকে জয়ী হয়েছেন — পরিবর্তনকামী ছাত্র ও যুব আন্দোলনের নেতাদের এই জবরদস্ত জয় এসেছে শ'য়ে শ'য়ে স্থানীয় কর্মীদের যুক্ত করে আবেগদীপ্ত প্রচণ্ড উদ্দীপনাময় প্রচার অভিযানের মধ্য দিয়ে। আর এই জয় মোদী সরকারের ফ্যাসিবাদী আক্রমণের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ যুব আন্দোলনের এক মহান সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিয়েছে।

বিহার – বিজেপিকে নির্বাচনী ক্ষেত্রে রোখা এবং তার মতাদর্শগত ও রাজনৈতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার প্রচণ্ড প্রয়োজন ও গুরুত্বকে বিশেষ ভাবে তুলে ধরেছে। বিহার ভারতের এবং ভারতীয় গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের জন্য এই লড়াইয়ে বিপ্লবী বামেদের গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক ভূমিকাকেও নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করেছে। আর গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামে কম্যুনিস্টদের শুধু মতাদর্শগত সাহস, স্বচ্ছতা ও ধারাবাহিকতার পরিচয় দিলেই হবে না, নীচুতলায় বিজেপির অবক্ষয়ী প্রভাব এবং ধ্বংসাত্মক রাজনীতিকে রুখতে সমান গুরুত্বপূর্ণ হল সাংগঠনিক শক্তি ও তৃণমূল স্তরে অনুশীলনের সংস্থান ও বিকাশ। আরএসএস তার বিদ্বেষ,মিথ্যা ও গুজব মেশানো মতাদর্শগত মগজ-খোরাকে মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য কম্যুনিস্টদের অনুশীলন ও সংগঠনের রীতিকে নকল করেছে। কম্যুনিস্টদের অবশ্যই মাটি থেকে বিজেপি ও সঙ্ঘ বাহিনীর বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে নীচুতলায় তাদের কাজ ও গণ রাজনৈতিক সংযোগের নেটওয়ার্ককে শক্তিশালী করে তুলতে হবে। নির্বাচন-যুদ্ধের পরবর্তী পর্যায়, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং বিজেপিকে রুখতে, বামেদের শক্তিশালী করতে এবং গণতন্ত্র বাঁচাতে আমাদের অবশ্যই বিহারের শিক্ষাকে কাজে লাগাতে হবে।

(এম এল আপডেট সম্পাদকীয় ২৩ নভেম্বর ২০২০)      

খণ্ড-27
সংখ্যা-42