প্রতিবেদন
কর্মচারিরা দুর্দশায় : কলকাতার বইপাড়া চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে
kkkk

কলেজ স্ট্রিট বইপাড়ায় বহু দোকান কর্মচারি কোভিড মহামারী পর্বে কাজ খুইয়েছেন। বড় ও ছোট দোকান মালিকরা কর্মচারিদের দূর্দশা লাঘবের প্রশ্নে একই অবস্থানে বিরাজ করেন না। লকডাউনের প্রথম পর্যায়েই দীপ প্রকাশনের মালিক শংকর মন্ডল মার্চ মাসের বেতন দিয়ে বেশ কয়েকজন কর্মচারিকে ছাঁটাই করেন। তাদের কলেজ স্ট্রিটের শো-রুমে দু’জন কর্মচারির একজন দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত, তাঁকে প্রথমে ছাঁটাই করা হয়, তারপরে অন্য জনকেও। বিধান সরণীতে আর্য কন্যা বিদ্যালয়ের উল্টোদিকে প্রকাশনা সংস্থার কার্যালয় থেকেও শ্রীমন্ডল বেশ কয়েক জনকে ছাঁটাই করেছেন। দীপ প্রকাশন মালিকের ব্যবসার বৃদ্ধি হয়েছে এইসব কর্মচারিদের নিরলস শ্রমেই। মালিক মাঝেমধ্যেই সপরিবারে বিদেশ ভ্রমণে যান। দোকান কর্মচারি ও ছাপাখানার শ্রমিকদের সদিচ্ছা থাকলে সবাই দু’বছর বসিয়ে বেতন দিতে পারেন। তাঁর ব্যবসার মুনাফা যে শীর্ষ বিন্দুতে পৌঁছেছে সেই অবস্থায় এটুকু করা এমন কিছু ব্যাপার নয়। তা সত্ত্বেও প্রকাশন সংস্থার মালিক লকডাউনের প্রথমেই নির্মমভাবে ছাঁটাইয়ের রাস্তা বেছে নেন। দীপ প্রকাশনের পাশেই ফুটপাথে বই বিক্রি করেন ক্রেতাদের কাছে ‘পন্ডিত’ নামে পরিচিত একজন। আনলক পর্ব শুরু হওয়ার পর দেখা মিলল রুগ্ন শীর্ণ পন্ডিতের। জানা গেল তাঁর দিন কাটছে অর্দ্ধাহারে, কোনোভাবে একবেলার খাবারের সংস্থান করতে পারছেন। প্রায় একইরকম দুরবস্থা প্রেসিডেন্সী কলেজের গা-ঘেঁষা সারিবদ্ধ বই বিক্রির ছোট দোকানগুলোর। খোঁজ নিতে জানা গেল ব্যবসা ঠেকেছে দশ থেকে পঁচিশ শতাংশে। রাজ্যের হেরিটেজের অন্তর্ভুক্ত এইসমস্ত দোকানে বিকেল-সন্ধ্যে ক্রেতা গিজগিজ করত। এখন অধিকাংশ দোকানই মাছি তাড়াচ্ছে। সোদপুরের বাসিন্দা মৌসুমী দে এসেছিলেন তাঁর মেয়ের পড়ার বই কিনতে, মেয়ে পরের বছর উত্তীর্ণ হবে সপ্তম শ্রেণীতে। তিনি বেশ কিছু দোকান ঘুরে ভবানী দত্ত লেনে সারদা বুক স্টলে বই পেলেন। দাম জানতে চাইলে দোকানদার বললেন ১৫০ টাকা, লেখা আছে দেখালেন ৩০৫ টাকা, ক্রেতা দিতে চাইলেন ১০০ টাকা, দোকান মালিক দিয়ে দিলেন সেই দামেই। বললেন, বিক্রি-বাট্টা একেবারেই হচ্ছে না, তাই না দিয়ে পারেন কি করে! ক্রেতা এলেই বিক্রেতারা আঁকড়ে ধরছেন।

কলেজ স্ট্রিট, বঙ্কিম চ্যাটার্জী স্ট্রিট, কলেজ রো, ভবানী দত্ত লেন, কলেজ স্কোয়ার, মহাত্মা গান্ধী রোড, রমানাথ মজুমদার স্ট্রিট, টেমার লেন, বেনিয়াটোলা ইত্যাদি সব মিলিয়ে যে বিশাল বইপাড়া, সেখানে রয়েছে সহস্রাধিক ছোট-মাঝারি ও বড় বইয়ের দোকান। বছরে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেচাকেনা হয়ে থাকে। এখনও স্কুল-কলেজ বন্ধ, তাই স্কুল-কলেজের বই বিকোচ্ছে না। গত মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত বই বিক্রি যা হওয়ার হয়েছে। তারপর থেকে বিক্রি আগের তুলনায় দশ শতাংশও হচ্ছে না। কফি হাউসের ওপরে রূপা, চক্রবর্তী এ্যান্ড চ্যাটার্জীতে গিয়ে দেখা গেল কর্মচারিদের হতাশ মুখ। কর্মচারিদের বেতন ঠিকঠাক হচ্ছে কীনা জানতে চাইলে কোনও  উত্তরই তাঁরা দিলেন না। বিক্রি কেমন জানতে চাইলে বললেন, “দেখতেই তো পাচ্ছেন”। সুধাংশু দে’র পুত্র শুভঙ্কর দে’র কাছে জানা গেল ওদের ব্যবসা হচ্ছে প্রায় ৬০ শতাংশ। ওদের দোকানে পুরানো মুখগুলো দেখে আশ্বস্ত হওয়া গেল অন্তত ছাঁটাই হতে হয়নি। কাউন্টারে ভীড় এখন অর্দ্ধেক, আগে যেখানে লেগে থাকত ১৫-২০ জন, এখন সেখানে ১০-১২ জন ক্রেতা। আনন্দ পাবলিশার্স, মিত্র এ্যান্ড ঘোষ-এ ভীড় না থাকলেও ক্রেতা মিলছে। বিষ্ণুপ্রিয়ায় কোনো কর্মচারির দেখা মিলল না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্ণধার একরাশ ক্ষোভ উগরে দিলেন গিল্ড ও পুস্তক বিক্রেতা সমিতির উপর। “শাহরুখ খান ১০ লক্ষ টাকা অনুদান দিয়েছিলেন, কিন্তু কে পেলেন সেই টাকা? খোঁজ নিয়ে লিখুন। শুনেছি আমফানে ক্ষতিপূরণে গিল্ড ছোট প্রকাশন সংস্থা আর ফুটপাতের বই বিক্রেতাদের টাকা দিয়েছে। কে কত টাকা পেয়েছে তার হিসাব আছে? লিস্ট কি তারা দেখাতে পারবেন?” ছোট বিক্রেতা ধ্যানবিন্দু’র মালিক শুভ জানালেন আমফান বা অন্য কোনো অনুদান খাতে কোনও টাকা পাননি, পাওয়ার জন্য আবেদনও করেননি। আর বললেন, বিক্রি ফিরেছে ২৫ শতাংশ মাত্র। আমফানে কিন্তু ধ্যানবিন্দু সমেত বহু ছোট বই দোকানে জল ঢুকে কয়েক লক্ষ টাকার বই নষ্ট হয়েছে। বিশ্বভারতী স্টলে গিয়েও অভিজ্ঞতা একই। দোকান মালিক জানালেন বিক্রি মোটেই আশাব্যঞ্জক নয়। পারুল প্রকাশনা কিছু কর্মচারিকে ছাঁটাই করেছে।

সব মিলে অবস্থা হল, কলেজ স্ট্রিট বইপাড়া পড়েছে তীব্র সংকটে। বিশেষ করে ছোট দোকান এবং ফুটপাথের বই বিক্রেতাদের দুর্দশা চোখে পড়ার মতো। এই দুরবস্থা কবে দূর হবে তা ভীষণ অনিশ্চিত। যেমন অনিশ্চিত দেশ কোভিড থেকে কবে মুক্ত হবে? টিকার আশায় মানুষ হাপিত্যেশ করে বসে আছে। টিকা তাড়াতাড়ি আসবে কিনা বা কতটা কার্যকরী হবে সেই সন্দেহ থেকেই যায়। অতীতে দেখা গেছে কোনো ভাইরাস ঘটিত রোগের টিকা বের হতে কয়েক বছর লেগে গেছে। সুতরাং কোভিডের সংক্রমণ যতদিন চলবে ততদিন বই ব্যবসার দোকান বাজার স্বাভাবিক হবে না। এই অস্বাভাবিক অবস্থায় ক্ষয়ক্ষতি, ছাঁটাই, শোষণ, বঞ্চনা, মন্দা, বিশেষ করে ছোট দোকান কর্মচারি ও ফুটপাথের বিক্রেতাদের জীবনধারণের আর্থিক দুর্গতি আরও বেড়ে গেছে। বইয়ের বাজার কবে নতুন ছন্দে ফিরবে বলা মুশকিল। দুর্দশার মধ্যেই কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়া চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে।

- নিত্যানন্দ ঘোষ   

খণ্ড-27
সংখ্যা-45