সিদ্ধান্ত
সিপিআই(এমএল) লিবারেশন কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকের রিপোর্ট
cc

মার্চ মাসের পর কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক হয় ৩-৪ ডিসেম্বর পাটনায় বিহার রাজ্য অফিসে। আলোচনা ও সিদ্ধান্ত যা গৃহীত হয়েছে তা সংক্ষেপে উল্লেখ করা হল।

(১) শোক প্রস্তাব

কেন্দ্রীয় কমিটির শেষ অনলাইন বৈঠকের পর থেকে প্রয়াত কমরেড এবং বিশিষ্ট প্রগতিশীল ব্যক্তিত্বদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে নীরবতা পালন করে কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক শুরু হয়। বিশেষত, ৩ মাস ধরে চলা পাঞ্জাবের দীর্ঘ কৃষক আন্দোলনের প্রতি এবং দিল্লী অবরোধের সময় মারা যাওয়া কৃষকদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। এছাড়া বিহারের কমরেড ধ্রুব ভগত, হরিবংশী রাম, রাজমতী, সুশান্ত কিশোর, ডাঃ বিজয় প্যাটেল, দেবমুনি যাদব এবং ইউপি-র মারদুজি, ওড়িশা রাজ্য কমিটির সদস্য কমরেড নীলাঞ্জন ভট্টাচার্য, পাঞ্জাবের আমরিক সিং সামাওন ও মুখতার কৌর, পশ্চিমবঙ্গের প্রবীর বল, বন্ধনা ওরাঁও, রহিম শেখ, অমিতাভ সরকার, কেতকী ব্যানার্জী, তরুণ প্রকাশ কুণ্ডু, বিশ্বনাথ সরেন, স্বপন বড়ুয়া, ভোলানাথ লাহিড়ী, মিহির রায়চৌধুরী এবং সুনীল বসু; দিল্লির বেদপাল, পুদুচেরীর অয়নার, তামিলনাড়ুর কুজান্দাইভেলু, ঝাড়খণ্ডের বীরেন্দ্র চৌধুরী, রণধীর সিং এবং অখিলেশ্বর ভার্মা এবং কর্ণাটকের সিপিআই(এম)’র প্রবীণ নেতা কমরেড মারুথি মনপুডের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়।

(২) বিহার নির্বাচন এবং তারপর

(ক) সদ্য সমাপ্ত বিহার নির্বাচনে পার্টির উৎসাহজনক ভূমিকার জন্য কেন্দ্রীয় কমিটি বিহারের রাজ্য কমিটি এবং বিহারের সমস্ত সদস্যদের অভিনন্দন জানায়। আমাদের সকল প্রার্থীদের উৎসাহপূর্ণ লড়াইকে উষ্ণ শুভেচ্ছা জানায়। সমগ্র পার্টিকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করার সাথে সাথে মহারাষ্ট্রের লাল নিশান পার্টি (লেনিনবাদী)-কে এবং পার্টির সকল শুভাকাঙ্ক্ষীদের বিহারে নির্বাচনী প্রচারে আন্তরিক সমর্থন করার জন্য ধন্যবাদ জানায়। প্রতিবেশী কয়েকটি রাজ্য ও পার্টির সদর দফতরের বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় কমরেড এবং ছাত্র-যুব ও শ্রমিক ফ্রন্টের কর্মীরা তাঁদের দিনরাত সপ্তাহ এক করে  ব্যাপকভাবে কাজ করেছেন।

(খ) বিহার নির্বাচনে পার্টি যে ফল করেছে তা দেশজুড়ে ব্যাপক প্রশংসা পেয়েছে। আমাদের বিজয় বেশিরভাগই বেশ নির্ধারক ধরনের, খুব বিশ্বাসযোগ্য ব্যবধানে। আর যে সমস্ত জায়গায় আমাদের পরাজয় হয়েছে তার বেশিরভাগই অত্যন্ত কম ব্যবধানে। আমাদের নিজস্ব জায়গাগুলিকে ভালো মাত্রায় একত্রিত করতে পারা, আমাদের জোটের শরিকদের উৎসাহজনক সমর্থন, বিশেষত আরজেডির (মুজাফফরপুরের আওরাই ব্যতীত, যেখানে আরজেডির যাদব ভোটাররা আমাদের মুসলিম প্রার্থীকে ভোট দেয়নি) এবং এমনকি বরাবরকার বিজেপি-জেডিইউ ভোটারদের ভোটও পাওয়া (অনেক কেন্দ্রে ভালো সংখ্যক যুব সম্প্রদায়, পরিযায়ী শ্রমিক, কৃষক যারা উঁচু জাতের তারাও আমাদের জন্য প্রচার করেছেন এবং ভোট দিয়েছেন) আমাদের বিশাল বিজয়ে অবদান রেখেছে। কমরেড মেহবুব আলম ১,০৪,৪৮৯ ভোট পেয়েছেন (এই নির্বাচনের তৃতীয় সর্বোচ্চ প্রাপ্ত ভোট) এবং মোট ভোটের পরিপ্রেক্ষিতে সর্বোচ্চ ৫৩,৫৯৭ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন। কমরেড মনোজ মঞ্জিল ৬১.৩৯% ভোট পেয়েছেন (বিজয়ী প্রার্থীদের মধ্যে সর্বোচ্চ ভোট শেয়ার), জয়ের ব্যবধান শতকরা হিসাবে (৩৪.৫২%) যা বিজয়ীদের মধ্যে সর্বোচ্চ ব্যবধান।

(গ) বিহারের নির্বাচনের গতিপ্রকৃতি এনডিএ-কে পরাজিত করার সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলেছিল। নির্বাচনের প্রথম পর্যায়ে (দক্ষিণ বিহারের বিস্তীর্ণ অঞ্চল, সম্পূর্ণ সাহাবাদ ও মগধ অঞ্চলের অনেকটা অংশ) মহাগটবন্ধন প্রায় ৭০% আসন জিতেছে এবং এই প্রথম পর্বে আমরা যে আটটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছি তার মধ্যে ৭টি আসন জিতেছি। তবে শেষ দুটি পর্যায়ে এনডিএ অপ্রত্যাশিতভাবে ম্যানেজ করতে সক্ষম হয়, বিশেষত মিথিলা-কোশী-সীমাঞ্চল বলয়ে, যার ফলে কোনোরকমে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে ক্ষমতা অর্জন করেছে। এই অঞ্চলে বামেদের দুর্বল উপস্থিতির কারণে এনডিএ ইসলাম-ফোবিয়াকে কাজে লাগিয়ে মহাগটবন্ধনকে কোণঠাসা করতে সক্ষম হয় এবং আরজেডি-র বিরুদ্ধে জনগণকে প্রভাবিত করে।

(ঘ) শক্তিশালী বিধায়কদের একটি বড় টিম নিয়ে বিহারের রাজনীতিতে আমাদের হস্তক্ষেপের মাত্রা বিধানসভার অভ্যন্তরে ও বাইরে উভয়তই বাড়াতে হবে। আমাদের ১২টি আসনের মধ্যে সাতটিতে প্রার্থীরা জেডিইউ মনোনীত প্রার্থীদের পরাজিত করেছেন এবং পাঁচটি বিজয় হয়েছে বিজেপি (৪) এবং ভিআইপি (১) এর বিরুদ্ধে। বিজেপি যত তার জোটের শরিকদের প্রান্তিককরণ করবে, আমাদের ততই সামাজিক ভিত্তি, রাজনৈতিক প্রভাব এবং নির্বাচনী নেটওয়ার্কের প্রসার ঘটাতে প্রবল প্রচেষ্টা করতে হবে। আমাদের বিধায়কদের তাদের জেতা আসনগুলিতে আমাদের জোটের শরিকদের পাশাপাশি জেডিইউ এবং এলজেপি’র মতো প্রতিপক্ষদের ভোটারদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করতে হবে।

(৩) বিধানসভা নির্বাচনের পরবর্তী পর্যায়

আমাদের বিহারের ফলাফল এবং আমাদের সাহসী বিজেপি-বিরোধী অবস্থান পশ্চিমবঙ্গে বাম-উদারপন্থী শিবির দ্বারা ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। সিপিআই(এম) নেতৃত্বের প্রভাবশালী অংশটি যদিও খুব নেতিবাচক এবং গোঁড়ামিপূর্ণ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। পশ্চিমবঙ্গে সিপিআই(এম) মূলত টিএমসি’কে টার্গেট করে কংগ্রেসের সাথে একটি জোট বেঁধে ফেলার জন্য প্রস্তুত। আমাদের কৌশলগত লাইন এবং আমাদের নির্বাচনী কৌশলের মধ্যেকার বিতর্কটি আসন্ন দিনগুলিতে স্বাভাবিকভাবেই তীক্ষ্ণ হবে। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি’কে ক্ষমতায় আসা আটকাতে পার্টি সুস্পষ্ট জোর দিয়ে বাছাই করা কয়েকটি নির্বাচনী এলাকায় প্রার্থী দেবে। আসামেও আমরা প্রতিযোগিতার জন্য কয়েকটি আসন চিহ্নিত করেছি। কার্বি আংলংয়ের কমরেডরা জেলার চারটি আসনেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার পরিকল্পনা করছেন। আমাদের নীচুস্তরের প্রস্তুতি বাড়ানোর সাথে-সাথে, প্রধান বিরোধী জোটের সাথেও কোনও সম্মানজনক আসন ভাগাভাগির ব্যবস্থার সম্ভাবনাগুলির অনুসন্ধান করতে হবে। পশ্চিমবঙ্গ ও আসাম উভয় ক্ষেত্রেই আমাদের বিভিন্ন লড়াইয়ের শক্তির সহযোগিতায় নির্বাচনের জন্য জনগণের সনদ তৈরি করার চেষ্টা করা উচিত। তামিলনাড়ু ও পুদুচেরিতে এবং সম্ভব হলে কেরালায়ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার পরিকল্পনা রয়েছে।

(৪) কৃষক বিরোধী কৃষি আইনের বিরুদ্ধে কৃষকদের প্রতিরোধ

কৃষক বিরোধী কৃষি আইনের বিরুদ্ধে কৃষকদের আন্দোলন একটি ঐতিহাসিক উত্থানে পরিণত হয়েছে। সরকারের দমন ও গুজব ছড়ানো প্রচারাভিযান কৃষকদের নিরস্ত করতে বা আন্দোলনকে বিভক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে। এই আন্দোলনের পক্ষে দেশজুড়ে সমর্থন বাড়ছে এবং ৮ ডিসেম্বর ভারত বন্ধের সমর্থনে বেশিরভাগ বিরোধী দল ব্যাপক প্রচার করতে সমর্থ হয়েছে। আমাদের পাঞ্জাবের কমরেডরা এই আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন। সরকারের সঙ্গে আলোচনায় যে দলটি অংশ গ্রহণ করছে তার মধ্যে আছেন আমাদের কমরেড রুলদু সিং, পাঞ্জাব কিষাণ ইউনিয়নের সভাপতি এবং অল ইন্ডিয়া কিসান মহাসভার সদস্য। দিল্লি ও পাঞ্জাবের ক্ষেত্রে আমাদের ভূমিকা জোরদার করার সময় কৃষকদের সমর্থনে আমাদের একটি বৃহত্তর সংহতি অভিযান গড়ে তোলা উচিত। ট্রেড ইউনিয়ন, ক্ষেতমজুর সমিতি, মহিলা সংগঠন এবং ছাত্র-যুব সংগঠনের সকলকেই এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া উচিত। কৃষকদের প্রতি সংহতি কর্মসূচীর পাশাপাশি কৃষক এবং জনগণের অন্যান্য অংশের কর্পোরেট-বিরোধী, সরকার-বিরোধী সংগ্রামকে আরও তীব্র করার জন্য আমাদের এই সুযোগটি নেওয়া উচিত যেখানে তা আমাদের পক্ষে করা সম্ভব।

(৫) ৬-১১ ডিসেম্বর সংবিধান রক্ষা, ভারত রক্ষা করার প্রচার কর্মসূচী

এ বছর ৬ ডিসেম্বর (বাবরি মসজিদ ধ্বংসের আঠাশতম বার্ষিকী) এবং ১১ ডিসেম্বর (সিএএ আইনটির প্রনয়ণের প্রথম বার্ষিকী) ‘দেশ বাঁচাও, সংবিধান বাঁচাও’ আহ্বানের সাথে পালন করা হচ্ছে। কৃষকদের আন্দোলনের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে, ৬ ও ১১ ডিসেম্বর উপলক্ষে পৃথক কর্মসূচী অনেক জায়গায় সম্ভব নাও হতে পারে, তবে আমাদের বর্তমান সন্ধিক্ষণে যে সমস্ত প্রতিবাদ ও আন্দোলন গড়ে উঠেছে তাতে সাধারণ ফ্যাসিবাদ বিরোধী বিষয়বস্তুকে জোরের সাথে উত্থাপিত করতে হবে।

(৬) ১৮ ডিসেম্বর সঙ্কল্প দিবস

কমরেড বিনোদ মিশ্র-র ২২তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে সমগ্র পার্টির কাছে কেন্দ্রীয় কমিটি একটি আহ্বান রেখেছে। ১৮ ডিসেম্বরের আহ্বানটি ব্যাপকভাবে প্রচারিত করা ও সেটি অধ্যয়ন করা এবং সমগ্র পার্টিকে তাতে উদ্বুদ্ধ হয়ে নতুন সুযোগগুলি উন্মোচনে সচল হতে হবে। এই বছর নবীকরণ কর্মসূচী অবশ্যই নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে পরিচালিত হতে হবে এবং বিহার ও পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলিতে পার্টি কমিটি অবশ্যই পার্টির সদস্যপদ বৃদ্ধির জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবে। বর্তমান সন্ধিক্ষণের পুরোপুরি ব্যবহার করতে আমাদের অবশ্যই বিভিন্ন ভাষায় দলীয় প্রকাশনাগুলির নিয়মিত প্রকাশ নিশ্চিত করতে হবে এবং বিশেষত লোকযুদ্ধের জন্য একটি বড় সংখ্যক গ্রাহক সংগ্রহ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

খণ্ড-27
সংখ্যা-45