প্রতিবেদন
হেঁটে মানচিত্র পেরিয়ে যায় যারা ...
hret

হাজার হাজার পরিযায়ী শ্রমিক হাঁটছেন। রাষ্ট্রীয় পরিবহণ বন্ধ। তাই তাঁরা হেঁটেই রওনা দিয়েছেন। শত শত মাইল দূরে তাঁদের গ্রামের বাড়িতে পৌঁছাতে। আশ্রয়ের আশায়, খাবারের আশায় এবং তাঁদের পরিবারের সঙ্গে মিলিত হওয়ার আশায়। ১৯৫০ সালে পূর্ববঙ্গ থেকে আসা মানুষের স্মৃতিকথা অথবা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ থেকে শরণার্থী আসা মানুষের ছবি অথবা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ছবির সঙ্গে কোভিডকালে পথহারা শ্রমিকদের দৃশ্য মিলেমিশে যায়। বিশ্ব অভিবাসী দিবসে এসব ছবিগুলোই মনকে বড্ড নেড়েচেড়ে দেয়।

বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ব্যাপক হারে অভিবাসন ও বিপুলসংখ্যক অভিবাসীদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়াদিকে ঘিরেই দিবসটির সূচনা। ১৯৯৭ সাল থেকে ফিলিপাইন এবং অন্যান্য এশীয় অভিবাসী সংগঠনগুলো দিবসটি পালন করতে শুরু করে। শুরুর দিকে ‘আন্তর্জাতিক ঐক্য দিবস’ হিসেবে পালন করা হোত। ১৯৯০ সালে অভিবাসী শ্রমিক ও দেশে ফেলে আসা তাদের পরিবারের নিরাপত্তা রক্ষায় আন্তর্জাতিক সম্মেলন করেছিল রাষ্ট্রসংঘ। এরই প্রেক্ষাপটে ১৮ ডিসেম্বরকে লক্ষ্য করে মাইগ্রেন্টস রাইটস ইন্টারন্যাশনাল, ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন অন মাইগ্রেন্টস রাইটস সহ বিশ্বের অনেক সংগঠন অভিবাসীদের স্বার্থ রক্ষার্থে বিশ্ব জুড়ে প্রচার চালায়। ১৯৯৯ সালের শেষের দিকে অনলাইনে ব্যাপক প্রচারের ফলে, ২০০০ সালের ৪ ডিসেম্বর রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ পরিষদ অভিবাসী শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় পর্যাপ্ত নিরাপত্তা এবং তাদের পরিবারের ন্যায্য অধিকার রক্ষায় আন্তর্জাতিক চু্ক্তি-৪৫/১৫৮ প্রস্তাব আকারে গ্রহণ করে ১৮ ডিসেম্বরকে ‘আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। অভিবাসী শ্রমিকরা যেন কোনোরূপ শোষণ, বঞ্চনা ও হয়রানির শিকার না হন, তা নিশ্চিত করতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

অভিবাসনের ইতিহাসও মানব সভ্যতার মতো সুপ্রাচীন। প্রাচীনকাল থেকেই জীবিকার সন্ধান, আর্থ-সামাজিক, জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানা কারণে মানুষ পাড়ি জমিয়ে আসছে দেশ থেকে দেশান্তরে। গন্তব্য দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন ছাড়াও নিজ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অভিবাসীদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। বিশ্বের বিপুল সংখ্যক অভিবাসী জনগোষ্ঠী পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে মেধা ও শ্রমের মাধ্যমে তাদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনমান উন্নয়নের পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছেন। কিন্তু যুদ্ধ-বিগ্রহ ও ভূ-রাজনৈতিক নানা কারণে অভিবাসন আজ কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। অভিবাসীদের অধিকার ও স্বার্থ রক্ষায় বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইন, কনভেনশন ও সনদসমূহে বর্ণিত বিধানবলীর যথাযথ প্রতিপালন অত্যন্ত জরুরি। অভিবাসন প্রক্রিয়াটি পৃথিবীতে মানবসভ্যতা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গেই যে শুরু হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। পরবর্তীতে রাষ্ট্রীয় কাঠামো সৃষ্টি হওয়ার কারণে জীবনধারণের জন্য এক স্থান থেকে আরেক স্থানে মানুষের অবাধ যাতায়াতে আসে নানা নিয়ম-কানুন আর বাধা-বিপত্তি। তবে মানুষের অভিবাসন কখনো থেমে থাকেনি। শুধু যে অর্থনৈতিক কারণেই অভিবাসন ঘটে তা নয়। রাজনৈতিক, ধর্মীয়, যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সংস্কৃতি ইত্যাদি কারণেও অভিবাসন ঘটে থাকে। পৃথিবীর এমন কোনো অঞ্চল নেই, যেখানের মানুষ কোনো না কোনো সময় অন্য দেশে অভিবাসিত হয়নি। অভিবাসন প্রক্রিয়াটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হওয়ার পর অভিবাসী কর্মীদের (যারা অস্থায়ী অভিবাসী) স্বার্থ ও অধিকার রক্ষার বিষয়টি গুরুত্ব লাভ করে। বিপুল সংখ্যক অভিবাসী জনগোষ্ঠী পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে মেধা ও শ্রমের মাধ্যমে তাদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনমান উন্নয়নের পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছেন। তাদের পাঠানো রেমিট্যান্স জাতীয় অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। অথচ কোভিডকালের দুনিয়া অভিবাসী জনগোষ্ঠীর যে চিত্র দেখিয়ে দিল তাকে স্মরণ করে আরও একবার এই জনগোষ্ঠীর কথা নতুন করে ভাবার সময় এসেছে বলেই মনে হয়।

- সুতপা ভট্টাচার্য চক্রবর্তী   

খণ্ড-27
সংখ্যা-45