খবরা-খবর
কৃষকের জনজোয়ার দিল্লী আর কলকাতার রাজপথ করে দিল একাকার
del

গত ১৬ ডিসেম্বর কলকাতার বুকে বিপূল সংখ্যক কৃষকের জনজোয়ার দিল্লী আর কলকাতার রাজপথকে যেন একাকার করে দিলো। পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উঃ প্রদেশের কৃষকের সাথে একযোগে গ্রামবাংলার কৃষকরাও জানান দিলো, নয়া কৃষি আইন সম্পূর্ণ বাতিল করতেই হবে। টুকিটাকি সংশোধন করে কৃষকদের ধোঁকা দেওয়া চলবে না। কৃষকদের কর্পোরেটের ক্রীতদাসে পরিণত করার চক্রান্ত বন্ধ করো। কর্পোরেটদের মজুতদারী কালোবাজারি, জমি লুঠের ছাড়পত্র দেওয়া চলবে না। পাঁচতারা হোটেল আর চাষের মাঠে বিদ্যুৎ একদর করে দেওয়ার নয়া বিদ্যুৎ বিল প্রত্যাহার করো। দিল্লিতে প্রবল শীতের মধ্যে লক্ষ লক্ষ কৃষক যখন রাজপথে ২১ দিন ধরে বসে রয়েছে, রাজধানীর পার্শ্ববর্তী কৃষক আন্দোলনস্থল হিসাবে সুপরিচিত সিংঘু আর টিকরির পর খবর আসছে সাজাপুর আর পালওয়াল জেগে উঠছে, সেখানে বিভিন্ন রাজ্য থেকে আগত হাজার হাজার কৃষক নতুন করে আন্দোলনে যোগ দিচ্ছে, অচল হতে চলেছে দিল্লী জয়পুরের সড়ক যোগাযোগ। তখন কলকাতায় ধর্মতলায় রাসমনি রোডের রাজপথকে কয়েক ঘন্টার মহড়ায় অবরুদ্ধ করে দিয়ে বাংলার কৃষকরা আওয়াজ তুলে ধরলো – আমরাও আছি তোমাদের সাথে, সংগ্রামের ময়দানে। এ লড়াই দেশের লড়াই, বাঁচার লড়াই, এ লড়াই জিততে হবে।

কলকাতার বুকে দীর্ঘ কৃষক মিছিলের কলতানে যেন ভেসে উঠলো সেই গান “লড়াই করো, যতদিন না বিজয়ী হও”। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সমস্বরে কৃষকরা বলে উঠলো, আমরা চাই কৃষকের আইন-মোদী বানালো কোম্পানি আইন-এ আইন মানছি না, মানবো না। আজ ঐক্যবদ্ধ ভাবে দেশের অন্নদাতারা দাবি তুলেছে – আমাদের রক্ত জল করা শ্রমে ঘামে তৈরি ফসলের দাম গ্যারান্টি করার আইন চাই। ধান গম ভুট্টা পাট থেকে শুরু করে আখ তুলা সহ লঙ্কা থেকে লাউ (কিষাণ সংগঠনের মতে প্রায় ১২৯টি) সমস্ত ফসলের দর সরকার নির্ধারণ করুক। সংরক্ষণের ব্যবস্থা করুক। কম দামে অভাবীবিক্রি বন্ধ করুক। সরকার ক্ষুদ্র- মধ্য চাষিদের পাশে দাঁড়াক। ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নিশ্চিত করার আইন তৈরি হোক। কিন্তু মোদী সরকার এর বিপরীতে কর্পোরেটদের স্বার্থে আইন করলো। একে কোন মতেই মেনে নেওয়া যাবে না। কৃষি সংকট এক। দাবি এক, শত্রুও এক। তাই কলকাতার বুকে সমাবেশ থেকে বাংলার কৃষকরা জানান দিলো একই মাটির সন্তান আমরা,আমাদের দাবি একটাই – নয়া কৃষি আইন সম্পূর্ণ বাতিল করো। লকডাউনের পর বিগত নয় মাসে কলকাতার বুকে এতো বিশাল সংখ্যক মানুষের বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ ঘটলো এই প্রথম।

দঃ বঙ্গের হাজার হাজার কৃষক শিয়ালদা ও হাওড়া স্টেশন থেকে সুদীর্ঘ মিছিল করে ধর্মতলায় রাণী রাসমনি রোডে এসে সমাবেশিত হলো রাজভবন অভিযানে। কিন্তু রাজ্যপাল কৃষকের দাবির কথা শুনতে আদৌ রাজি হলেন না। আগাম খবর জানানো হয়েছিলো দাবিসনদ দেওয়া হবে,তা স্বত্বেও তিনি রাজভবন ছেড়ে চলে গেলেন। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠলো কৃষকের ন্যায়সঙ্গত যুক্তির সামনে কি তাঁর কিংবা কেন্দ্রীয় সরকারের দাঁড়ানোর সাহস নেই? তাই কি তিনি পালিয়ে গেলেন? এই প্রশ্ন তুলে ধরে এআইকেএসসিসি’র এক প্রতিনিধি দল রাজভবনে স্মারক লিপি জমা দিয়ে আসেন। প্রতিনিধি দলে ছিলেন সুভাষ নস্কর, অভীক সাহা, জয়তু দেশমুখ, হরিপদ বিশ্বাস প্রমূখ।

kol

 

রাসমনি রোডে একটি গাড়ির উপর মঞ্চ করা হয়েছিলো। সেখানে বেলা ২টায় অনুষ্ঠিত হলো বিক্ষোভ সমাবেশ। শুরুতে আহ্বায়ক অমল হালদার বলেন, গ্রামে গ্রামে জাঠা করতে হবে। গ্রামের মানুষ অনেকেই কৃষি আইনের বিপদটা বুঝতে পারছেন কিন্তু বিপদটা যে কতটা সেটা হয়তো উপলগ্ধি করতে পারছেন না৷ তাই আমাদের কর্পোরেটের দালাল মোদীর মুখোস খুলে দিতে হবে। এ রাজ্যের তৃণমূল সরকারের সমালোচনা করে তিনি বলেন, বিধানসভায় কেন বিরোধীতার প্রস্তাব গ্রহণ করা হচ্ছে না। রাজ্য সরকার কেন বিকল্প আইন প্রণয়ন করছে না? এ রাজ্যে কৃষকরা ধানের সরকারী দাম পাচ্ছে না। বস্তায় মাত্র ৭০০/৭৫০ টাকা পাচ্ছে (৬০ কেজি বস্তা। সরকারী দর ১৮৬৫ টাকা কুইঃ) ফড়ে মহাজনরা কৃষকদের ঠকাচ্ছে।

এআইকেএসসিসির সাংগঠনিক সম্পাদক কার্তিক পাল বলেন, প্রধানমন্ত্রী নানা ধরনের মিথ্যা প্রচার ও কূৎসা করে কৃষকদের অপমান করছেন। কৃষকের অপমান দেশের অপমান। সর্বস্তরের মানুষ এর প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন। বিগত সাধারণ ধর্মঘট ও গ্রামীণ বনধের মধ্য দিয়ে দেশের কৃষকরা এই নয়া কৃষি আইন বাতিল করে দিয়েছে, একে ছেঁড়া কাগজে পরিণত করেছে। তাই একে প্রত্যাহার করতেই হবে। আমাদের গ্রামে গ্রামে কৃষক আন্দোলনকের বার্তা ছড়িয়ে দিতে হবে, কৃষকদের পথে নামাতে হবে। এআইকেএসসিসি-র সর্বভারতীয় নেতা দিল্লীর আন্দোলনের ময়দান থেকে আগত হান্নান মোল্লা বলেন, দিল্লীর এই ঐতিহাসিক আন্দোলন স্বাধীনতার পর অন্যতম সর্ববৃহৎ কৃষক আন্দোলন। শুরুতে সরকার একে নিছক পাঞ্জাবের আন্দোলন বলে তুচ্ছ করে দেখানোর চক্রান্ত চালিয়েছে। কিন্তু যে কোনো আন্দোলনেই দেখা যায় কোনো রাজ্যের অগ্রণী ভূমিকা থাকে। যত দিন গেছে ক্রমশ আন্দোলনটা সর্বভারতীয় চেহারা নিচ্ছে। আন্দোলনের নেতৃত্বে রয়েছে এআইকেএসসিসি সংগ্রামী মঞ্চর সাথে যোগদান করা মোট ৫০০টি কৃষক সংগঠন। এই সংগ্রামী ঐক্য নজিরবিহীন। আন্দোলনের চাপে সরকার এই আইন প্রত্যাহার করতে বাধ্য হবে। ইতিমধ্যে আন্দোলনে যোগদান করতে আসা ৩০ জন কৃষক নানা কারনে মারা গেছে। তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আগামী ২০ ডিসেম্বর সারা দেশে শহীদ দিবস পালন করা হবে। কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্বের সাথে সরকার এজেন্ডা ছাড়া মিটিং করছে। ইতিমধ্যে পাঁচ বার মিটিং হয়েছে৷ আমরা বলেছি আইনটা কত ভালো এসব আমাদের বোঝাতে হবে না। সংশোধন করে বদলানো যাবে না। কসমোটিক পরিবর্তন মানবো না, মিটিং এর নামে তামাসা নয়। আইন প্রত্যাহারের দাবিতে আন্দোলন চলবে। সরকার গোটা এলাকা মিলিটারী নিয়ে ঘিরে রেখেছে। যেন কৃষকদের বিরুদ্ধে একটা যুদ্ধের পরিস্থিতি সৃস্টি করা হয়েছে। তাই আমাদের স্বতস্ফূর্তভাবে নয়, দিকে দিকে সচেতন আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে, সেটা এই সমাবেশে অংশ নেওয়া কর্মীদের দায়িত্ব।

raj

 

এআইকেএসসিসি নেতা অভীক সাহা বলেন, সুপ্রীম কোর্ট এক উপদেষ্টা কমিটি গঠনের রায় দিয়েছে। কিন্তু আমরা বলেছি, এই কমিটি কার্যকরী হবে তখনই যখন কৃষি আইন প্রত্যাহার করা হবে। সুপ্রীম কোর্টের এই রায় কৃষক আন্দোলনের নৈতিক জয়। এছাড়াও বক্তব্য রাখেন সুভাষ নস্কর, অজিত মুখার্জি, গোবিন্দ রায়, সুশান্ত ঝা প্রমূখ কৃষক নেতৃবৃন্দ।গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন গণসংস্কৃতি পরিষদের নীতীশ রায়। মিছিলের সামনে সারিতে থেকে আইসার ছাত্রীদের উত্তাল স্লোগান শহর কলকাতার গোটা যাত্রাপথকে উদ্দীপনাময় করে তোলে। ভারতীয় গণনাট্য সংঘের শিল্পীরা মিছিলের সামনে পথ হেঁটে গণসঙ্গীত গাইতে গাইতে তুলে ধরেছেন কৃষকদের পাশে দাঁড়ানোর সংগ্রামী ঐতিহ্যকে। বিভিন্ন কেন্দ্রীয় ট্রেডইউনিয়নের এক যুক্ত মিছিল সমাবেশে অংশগ্রহণ করে। এছাড়া রেল, বিদ্যুৎ সহ বিভিন্ন কর্মচারী সংগঠন, শিক্ষক, ছাত্র যুব, আদিবাসী সংগঠন, ঋণমুক্তি আন্দোলনের সংগঠন সহ সমাজের নানান স্তর থেকে আগত মানুষেরা কৃষক আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানাতে সমাবেশে যোগ দেন।

- জয়তু দেশমুখ   

খণ্ড-27
সংখ্যা-45