প্রতিবেদন
দিল্লীর কৃষক রণাঙ্গন থেকে ফিরে
dddeee

ইতিহাসে পড়েছি ঘাঁটি গেড়ে রাজায় রাজায় যুদ্ধের কথা। এ যুদ্ধ সেরকম যুদ্ধ নয়, নিজের চোখে দেখা কৃষকের আত্মরক্ষার এক ক্ষমতার যুদ্ধ। প্রকৃতির চরম প্রতিকুলতাকে অমান্য করে প্রচন্ড ঠান্ডা ও বৃষ্টির প্রকোপকে হজম করে নেওয়ার ক্ষমতা। হলুদ, লাল, সবুজ, সাদা, নীল – হরেক রকমের পতাকার মাঝে লাঙ্গল চিহ্ন নিয়ে উড়ছে মিছিলে, ট্রাক্টর-ট্রলিতে, সভাস্থলে –  আওয়াজ উঠছে, মোদী সরকার “তিন কালা আইন” অবিলম্বে প্রত্যাহার কর। উত্তপ্ত জনসমুদ্রে ঠান্ডায় অন্ধকারে কাঠের আগুনের সেকা মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে মুহুর্মুহু ধ্বনিত হচ্ছে এ লড়াই দেশের স্বার্থে অন্নদাতার লড়াই চলছে চলবে, এ লড়াইয়ে জিততে হবে। এই ইচ্ছাশক্তি কোথা থেকে জেগে উঠলো? প্রশ্ন সবার মুখে মুখে ঘুরলেও চিন্তায় কপালে ভাঁজ ফেলে দিয়েছে মোদী সরকারের।

প্রথম সবুজ বিপ্লবের কারসাজিতে বিধ্বস্ত ক্ষতবিক্ষত পাঞ্জাব, হরিয়ানার সৈনিক কৃষক বুঝে গেছে পুঁজির চরম কৃষক শোষণের মর্মবস্তুকে। এবার তাকে আরো পরিপুষ্ট করতে মোদী তৈরি করেছে দ্বিতীয় সবুজ বিপ্লব ঘটানোর জন্য কোম্পানি রাজের স্বার্থে তৈরি করা তিন কৃষি আইন। ভারতের আকাশে অসাংবিধানিক এই সিঁদুরে মেঘ অনতিবিলম্বে অন্নদাতাদের ধ্বংস করে দেওয়ার আগেই তাকে নির্বিষ করে দিতে হবে, চাই কালা আইনের প্রত্যাহার!

ইতিমধ্যে টিকরি, সিংঘু, গাজীপুর সীমানার যুদ্ধ স্থল থেকে কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্ব এআইকেএসসসি’র অনুমোদন ক্রমে কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রীর সাত সাত বার সন্ধি আলোচনার বৈঠক ব্যর্থ হয়েছে। আন্দোলনকে বিপথগামী করার জন্য, কখনো মাওবাদী, খালিস্তানপন্থী, পাকিস্তানি, চীনাপন্থী, কট্টর বামপন্থী, ইত্যাদি অপপ্রচার চালিয়ে, কালক্ষয় করেও আন্দোলনকে ব্যর্থ করে দিতে মোদী সরকার ব্যর্থ হয়েছে। এদিকে ক্রমাগত দিল্লীর যুদ্ধের সীমানায় ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে একের পর এক কৃষক জমায়েত বৃদ্ধি পাচ্ছে। কৃষক নেতৃত্ব সংকল্প করেছে এই আন্দোলন দেশের সমস্ত গ্রাম-গ্রামান্তরে ছড়িয়ে দিতে হবে।

৪ থেকে ৬ জানুয়ারী তিন দিন দিল্লীর কৃষক আন্দোলনের পীঠস্থানে সারা ভারত কিষান মহাসভার পক্ষ থেকে স্রেফ শিক্ষা নেওয়ার জন্য গিয়েছিলাম। টিকরি সীমানায় সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক কমরেড রাজা রাম সিংয়ের সাথে গিয়ে উপস্থিত হলাম এক বিশাল সমাবেশের মধ্যে। একদিকে বড় মঞ্চে উপস্থিত নেতৃবৃন্দ একের পর এক বক্তৃতা দিচ্ছেন, পরে জানলাম মঞ্চটি ওই দিনের জন্য সংগ্রামী মহিলা কৃষকদের জন্য উৎসর্গ করা হয়েছে। পাঞ্জাবের কৃষক নেতা কমরেড গুরনাম সিং আমাদের মঞ্চের পাশে ডেরায় বসার ও বক্তব্য রাখার ব্যবস্থা  করলেন। শৃংখলাবদ্ধ কবে সব চলছে একের পর এক, কখনো হাততালি, কখনো উঠে দাঁড়িয়ে “কালা আইন ওয়াপাস লো” শ্লোগান উঠছে। হরিয়ানা, কর্ণাটক থেকে জনপ্রিয় সঙ্গীত পরিবেশন হল। ভাষার কারণে কর্ণাটকী সংগীত হাততালি না পেলেও তাদের উপস্থিতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। বক্তব্য রাখলেন রাজা রাম সিং, যুক্তিগ্রাহ্য আবেগঘন বিহার আন্দোলনের প্রেক্ষাপটের বক্তব্য শুনে হাততালি পরল, প্রায় শেষ মুহূর্তে ডেকে উঠল আকাশ, নেমে গেল বৃষ্টি। বক্তার তালিকায় নাম থাকলেও প্রাকৃতিক কারণে এই প্রতিনিধির সুযোগ পাওয়া গেল না। দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে, লঙ্গরখানায় পুরি-তরকারি জলখাবার খওয়ার সময় পরিচয় হল উত্তরাখণ্ড থেকে আসা শিখ প্রাক্তন সেনাকর্তা ও তার পরিবারের সাথে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কৃষকদের ক্ষতি করছেন এই বলে ক্ষোভ উগরে দিচ্ছিলেন। রাজারাম সিং-এর প্রস্তাব মতো সকলে ভগৎ সিংয়ের নামাঙ্কিত পাঠাগারের যাবার জন্য সাথী হলেন। রাস্তার উপরে বৃষ্টির জলে প্যাচপ্যাচে কাদায় প্রায় এক কিলোমিটার উপস্থিত হলাম সারা ভারত কিষান মহাসভার তৈরি পাঠাগারে। উল্টো দিকে রাস্তার পাশে বড় আকারে ত্রিপল খাটানো আস্তানা, ব্যানারে সংগঠনের নাম ফোন নাম্বার জুড়ে দিয়ে তিন কৃষক নেতা কমরেড রুলদু সিং, গুরনাম সিং, যশবীর কৌরের ছবি। সারি সারি ট্রাক্টর টলিতে কৃষকের মিছিল থেকে অনেকে চলে আসছে কৃষক সংগঠনের পতাকা নিতে, যাবার সময় মোবাইলের সংযোগ নাম্বার আদান প্রদান করছে। এআইএসএ, আরওয়এ ছাত্র-যুবরা তৎপরতার সাথে একদিকে বই বিক্রিতে ব্যস্ত, অন্যদিকে বৃষ্টি ঠেকাতে অসংখ্য ত্রিপল মজুদ করছে আবার টাঙ্গিয়ে দিচ্ছে। পরিচয় হল কমরেড সুখদর্শন সিং নাট, যশবীর কৌর, নবকিরণ সহ অনেক কমরেডদের সাথে। বাংলার কৃষক আন্দোলন, পাঞ্জাবের কৃষক আন্দোলন নিয়ে আধো আধো হিন্দি ভাষায় মত বিনিময় করলাম। ট্রলি টাইমস নামে পাঞ্জাবি ভাষায় পত্রিকা ভালোই সাড়া জাগাচ্ছে, ভগৎ সিং লাইব্রেরীর ঠিকানায় পোস্ট অফিসের পার্সেল আসতে দেখে রাজারামের তো খুব উচ্ছাস। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে, দিল্লি অফিসে ফিরে যেতে হবে আগামীকাল সিঙ্ঘু সীমানায় যেতে হবে।

ggt

 

৫ জানুয়ারী সিংঘু যাবার আগে খবর পেলাম কমরেড রুলদু সিং, প্রেম সিং আসছেন কমরেড রাজা রাম সিংয়ের সাথে কিছু আলোচনা সেরে নিতে। কেন্দ্রের কৃষিমন্ত্রীর সপ্তম দফা বৈঠক বুঝিয়ে দিল তারা কৃষি আইন প্রত্যাহার করবে না। এরকমই একটা পরিস্থিতিতে আন্দোলনকে আরো জোরালো করবার জন্য সারা ভারত কিষান মহাসভার পক্ষ থেকে নেতৃত্বের ভূমিকা যোগ্যতার সাথে রাখা দরকার। আলোচনা সেরে উপস্থিত পাঁচজন রওনা দিলাম সিংঘু সীমানার দিকে। বেলা ২টায় এআইকেএসসিসি’র যৌথসভা অনুষ্ঠিত হবে। সীমানার ঢোকার আগে বড় রাস্তা ব্যারিকেড দিয়ে পাঁচিল তুলে দাঁড়িয়ে আছে সরকারের সশস্ত্র বাহিনী। খানাখন্দে ভরা রাস্তা ধরে চলছি মোটর গাড়িতে। গন্তব্যস্থলে পৌঁছে গেছি, বাইরে টুপ টাপ বৃষ্টি। আন্দোলনের নেতা যোগেন্দ্র যাদবের সভাপতিত্বে শুরু হল সভা। আলোচনার বিষয় আগামী আন্দোলনের কর্মসূচী। আইনজ্ঞ মাননীয় প্রশান্ত কিশোর জানালেন উচ্চ বিচারালয়ে আবেদন করা প্রস্তাবের কয়েকটি তথ্য। সর্বসম্মতিক্রমে এবিষয়ে মতামত জানাবার জন্য তিনি আবেদন করলেন। সাথে সাথে তিনি একটি সতর্কবার্তা দিলেন কৃষক আন্দোলনের উদ্দেশ্য। দেশের সরকার এই আন্দোলনকে বেআইনি তকমা দেওয়ার জন্য আইনি পথ নিচ্ছে। তাই এমন কিছু না করা যাতে তাদের সেই ফাঁদে আন্দোলন পড়ে যায়! আলোচনায় অনেক কৃষক সংগঠনের প্রতিনিধির বক্তব্য শোনা গেল, তার মাঝে সারা ভারত কিষান মহাসভার পক্ষ থেকে কমরেড রাজারাম সিং বিহারে কৃষক আন্দোলনের সাম্প্রতিক রিপোর্ট সহ আন্দোলনের আগামী পরিকল্পনা পেশ করলেন, দেখলাম অনেকেই খুশি। আমিও কিছু বলবার জন্য পশ্চিমবঙ্গের প্রতিনিধি হিসেবে সুযোগ পেলাম, কৃষি আইনের বিরুদ্ধে নিচুতলায় প্রচার, কলকাতার সমাবেশ, বিধানসভায় কৃষি আইন প্রত্যাহারের প্রস্তাব পেশ নিয়ে রাজ্য সরকারের টালবাহানা ইত্যাদি সংক্ষেপে বললাম। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে, যুক্তিসংগত, সংক্ষিপ্ত আলোচনার মাধ্যমে ২৬ জানুয়ারী প্রজাতন্ত্র দিবস উপলক্ষে ৭ জানুয়ারী সিংঘু, টিকরি সীমানা জুড়ে মহড়া দেওয়ার জন্য কৃষকদের ট্রাক্টর মিছিল করার সিদ্ধান্ত হয়। ১৩ জনুয়ারী তিন কালা কৃষি আইন পুড়িয়ে প্রতিবাদ জানানোর কর্মসূচী সহ আরো কিছু কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়। সভা শেষে নির্দিষ্ট সময়ে হয় প্রেস কনফারেন্স। অসংখ্য বিভিন্ন ধরনের মিডিয়ার সামনে নেতৃত্ব হাজির হলেন। রাজারাম সিং ও জম্মু-কাশ্মীর কৃষক সংগঠনের এক প্রতিনিধিকে সাদরে ডেকে নেওয়া হলো। সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে দৃঢ়তার সাথে কৃষি আইন প্রত্যাহারের বিষয়টিকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে আগামী দিনের কর্মসূচী ঘোষণা করলেন।

প্রেস কনফারেন্স শেষ, সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে, সবাই যে যার জায়গায় ফিরে যেতে ব্যস্ত। আমি একটু দ্বিধাগ্রস্থ ছিলাম কি করে ফিরব? ইচ্ছা প্রকাশ করলাম রাত্রিটা এখানে কাটাব, কিন্তু আগামীকাল গাজীপুর যেতে হবে, সেটা বহুদূর। প্রেম সিংহ সাহস জোগালন, একজন যুবক কমরেডকে সঙ্গে দিয়ে সিঙ্ঘু বর্ডারে পৌঁছে দেওয়ার জন্য বললেন। যথারীতি রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি, সারিবদ্ধ ট্রাকটারের মাঝখানে সরু রাস্তা দিয়ে অসংখ্য মোটর সাইকেলসহ বিভিন্ন ধরনের যানবাহন চলছে দ্রুত গতিতে। অন্ধকার নেমে আসছে, হঠাৎ একজন মোটরসাইকেল চালক যুবককে ডেকে বলল, এনাকে সিংঘু বর্ডারে পৌঁছে দিতে হবে। যথারীতি উঠে পড়লাম। কখনো আস্তে, কখনো একটু গতি নিয়ে মোটরসাইকেল ছুটে চলেছে। আমি মোবাইলে ভিডিও তুলতে লাগলাম। কোথাও কাঠে আগুন জেলে চারিদিকে বসে আছে, কোথাও ট্রলিতে টিমটিমে আলোতে কথা চলছে, লঙ্গরখানাতে খাবার তৈরি হচ্ছে, খাচ্ছে; হাঁটতে পারে বাচ্চা নিয়ে মা পাশ কাটিয়ে নিজের ডেরায় ফিরতে ব্যস্ত, কোথাও ট্রলিতে বসে কয়েকজন মিলে পাঞ্জাবি ভাষায় গান গাইছেন, বিশাল জ্যাম ছাড়াবার জন্য আন্দোলনের কর্মীরা ঠান্ডা মাথায় কাজ করে যাচ্ছেন। আমার চালক মাঝে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপ কাহা তক জায়েঙ্গে? ম্যায় কিষাণ আন্দোলনকা সাথী হু, সিংঘু বর্ডার মে জায়েঙ্গে, উহাসে বাস পাকরেঙ্গে”। নির্বিঘ্নে পৌঁছে দিল সেই যুবক। রাত্রে মেট্রো ধরে ফিরলাম দিল্লিতে।

৬ জনুয়ারী, সকাল এগারোটায় গাজীপুর বর্ডারে পৌঁছে গেলাম। কাছাকাছি সারা ভারত কিষান মহাসভার ব্যানার লাগানো, এমনি ছোট্ট বইয়ের তাক সাজান স্টল, কমরেড শ্যামকিশোর ভিতরে আছেন, পাশে মহিলারা তাদের ছোট ছোট শিশুদের নিয়ে বসে আছেন। নিজের পরিচয় দিলাম, কিছুক্ষণ বসে স্বল্প কিছু কথা বললাম, পরিস্থিতি জানলাম। তিনটি বড় চওড়া রাস্তার ধরে দু’কিলোমিটার পর্যন্ত কৃষক আন্দোলনের জন্য আসা ট্রাক্টর টলি আর জমায়েত। বামপন্থী ও অন্যান্য কৃষক সংগঠনের উপস্থিতি জানিয়ে দিচ্ছে তাদের ব্যানার ও পতাকা, বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা একটা ডেরায় জমায়েত হয়েছেন, সকালের দিকে নাস্তা সারতে ব্যস্ত অনেকেই, আমিও সামিল হলাম। গরিব শিশুরা বিনা পয়সায় খাবার পেয়ে খুব খুশি, তাদের উৎসাহ দেখে মনে হচ্ছিল, তারাও এই আন্দোলনের অংশীদার। কাছেই একটা বড় মঞ্চ, সেখানে সাজানো-গোছানো চলছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘোষণা হতে শুরু করল আগামী ৭ জানুয়ারী ট্রাক্টর মিছিলের প্রস্তুতি। দু’একটা ছোট ছোট মিছিল আসতে শুরু করেছে মঞ্চের কাছাকাছি। এখানে আন্দোলনের কর্মীদের দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে তৎপরতা কিছুটা মন্থর গতি সম্পন্ন বলে মনে হচ্ছিল। কিষান মহাসাগর অবস্থানস্থলে ফিরে এসে আরো কিছুক্ষণ উপস্থিত মহিলাদের সাথে কথা বলে কাটালাম। তারা বেশিরভাগই বিহার থেকে আসা, কৃষক আন্দোলনের প্রশ্নে তৎপরতার সাথে তাদের দুঃখ-দুর্দশা সমস্যা তুলে ধরলেন, মোদী, শাহের বিরুদ্ধে তীব্র ধিক্কার জানালেন।সন্ধ্যার আগেই এখান থেকে ফিরলাম পার্টির দিল্লীর সেন্ট্রাল অফিসে। পরের দিন ৭ তারিখ রওনা দিলাম বাংলার উদ্দেশ্যে।

- কৃষ্ণ প্রামানিক 

খণ্ড-27
সংখ্যা-2