প্রতিবেদন
বেকারির হার নয় শতাংশ ছাড়িয়েছে, ৭ জন ভারতীয় অর্বুদপতির সম্পদ সাড়ে চার লক্ষ কোটি টাকা বেড়েছে
gggeeaaa

গত নভেম্বরে ভারতের শিল্পোৎপাদন ১.৯% কমেছে। শিল্পোৎপাদনের সূচক অনুসারে ওই মাসে ম্যানুফাকচারিং ক্ষেত্রের উৎপাদন ১.৭% কমেছে। খনিজ উৎপাদন কমেছে ৭.৩%, বিদ্যুত উৎপাদন বেড়েছে ৩.৫%। ২০১৯ সালের মভেম্বর মাসে শিল্পোৎপাদনের সূচক ২.১% বেড়েছিল। এমনটা যখন ঘটছে ও কোভিড অতিমারির ফলে যখন জিএসটি, আয়কর আদায় কমেছে। ঠিক তখনই এপ্রিল-নভেম্বর, ২০২০ সময়কালে উৎপাদন শুল্ক বা এক্সাইজ ডিউটি আদায় বেড়েছে ৪৮%, ২০১৯ সালের ওই সময়কালের ১.৩৩ লক্ষ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ১.৯৬ লক্ষ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। যদিও ওই ৮ মাসে ডিজেলের বিক্রি কমেছে ১ কোটি টনের থেকেও বেশি, পেট্রলের বিক্রিও কমেছে ৩০ লক্ষ টন। ডিজেলে ও পেট্রলের বিক্রি যথাক্রমে ৫.৫৪ কোটি টন ও ২.০৪ কোটি টন থেকে কমে ৪.৪৯ কোটি টন ও ১.৭৪ কোটি টনে পৌঁছেছে। কেন্দ্রীয় সরকার মূলত পেট্রল ডিজেলকে আয় বাড়ানোর অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে সেই ২০১৪ সাল থেকে। আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের মূল্য তলানিতে ঠেকলেও তেলের উপরে ক্রমাগত এক্সাইজ ডিউটি বাড়িয়ে এদেশে তেলের দামকে ক্রমাগত বাড়ানোই সরকারের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। লকডাউনের প্রথম পর্যায়েই সরকার গত মার্চথেকে মে মাসের মধ্যে পেট্রল ও ডিজেলের উপর এক্সাইজ ডিউটি যথাক্রমে প্রতি লিটারে ১৩ টাকা ও ১৬ টাকা বাড়িয়েছিল। যার ফলে পেট্রল ও ডিজেলের উপরে এক্সাইজ ডিউটি বেড়ে ৩২.৯৮ টাকা ও ৩১.৮৩ টাকা প্রতি লিটারে দাঁড়িয়েছিল। মোদি সরকার যখন ক্ষমতায় এসেছিল তখন তা ছিল যথাক্রমে প্রতি লিটারে ৯.৪৮ টাকা ও ৩.৫৬ টাকা। নভেম্বর, ২০১৪ থেকে জানুয়ারী, ২০১৬ এই ১৫ মাসে ৯ বার এক্সাইজ ডিউটি বাড়ানো হয়। অক্টোবর, ২০১৭ ও তার একবছর পরে এক্সাইজ ডিউটি যথাক্রমে ২ টাকা ও ১.৫০ টাকা কমানো হয়েছিল। কিন্তু জুলাই, ২০১৯ এ আবার লিটারে ২ টাকা বাড়ানো হয়; মার্চ, ২০২০তে তা লিটারে ৩ টাকা ও গত মে মাসে এক ধাক্কায় পেট্রলে লিটারে ১০ ও ডিজেলে লিটারে ১৩ টাকা বাড়ানো হয়েছিল। কন্ট্রোলার অফ গভর্নমেন্ট একাউন্টসের তথ্য অনুযায়ী ২০১৯ এর এপ্রিলনভেম্বর এই আট মাসে সরকারের কর রাজস্ব আদায় ৪৫.৫% কমে ৬.৮৮ লক্ষ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। ২০২০-২১ অর্থ বর্ষে সরকারের বাজেটে কর রাজস্বের পরিমাণ ১৬.৩৫ লক্ষ কোটি টাকা ধরা হয়েছিল। কোম্পানি আয় কর কমেছে ৩৫%, আয কর কমেছে ১২%।

বোঝাই যাচ্ছে, ভারতের অর্থনীতি বিরাট ধাক্কা খেয়েছে। সরকারি তথ্য বলছে যে ভারতের অর্থনৈতিক কাজকর্মবিপুল সঙ্কুচিত হয়েছে। যদিও বলা হচ্ছে যে, চতুর্থত্রৈমাসিকে ধনাত্মক বৃদ্ধি দেখা যাবে। কিন্তু পূর্বের এধরনের অর্থনৈতি কসঙ্কটকে যদি বিবেচনায় আনা যায় তাহলে দেশের অর্থনীতি দীর্ঘকালীন ক্ষতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমাদের জীবনযাত্রার সবদিকেই – সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক – একধরনের জটিলতা এসে উপস্থিত হচ্ছে। কিন্তু নীতিগত স্তরের আলোচনায় মনে হচ্ছে যেন কিছুই হয়নি। সব কয়েকদিনেই ঠিক হয়ে যাবে। সরকারী আমলা ও শাসক রাজনীতিবিদরা ভারতের V আকৃতির বৃদ্ধির কথা বলেই চলেছেন। লকডাউনের সময়কার প্রথম ত্রৈমাসিকে (২০২০-২১-এর প্রথম ত্রৈমাসিকে) অর্থনৈতিক কাজকর্মের হ্রাস তার আগের ত্রৈমাসিকের তুলনায় প্রায় ৩০% হয়েছিল। পরের ত্রৈমাসিকে যখন লকডাউনকে শিথিল করা হয়েছিল তখন আগের ত্রৈমাসিকের তুলনায় অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ঘটেছে প্রায় ২১%। ফলে ছবি আঁকলে অমন আকৃতির কথা বলাই যেতে পারে।

কিন্তু বিষয়টা তেমন নয়। শাসক দল ও আলোচকরা মূলত ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রের সমস্যা, মুদ্রাস্ফীতি, কর্মসংস্থানে হ্রাস, দুর্বল বিনিয়োগের বৃদ্ধি ইত্যাদি নিয়েই কথা বলছে। এগুলি গুরুত্বপূর্ণবিষয় সন্দেহ নেই। কিন্তু এসব নিয়ে তো আমরা প্রতি বছরেই আলোচনা করি, কিন্তু প্রতি বছরে তো অতিমারি হয় না। বিশ্ব জোড়া তান্ডব তো দেখা যায় না যাতে সব মিলিয়ে ১০ লক্ষ কোটি ডলারের ক্ষতি হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে, যে অনুমানকেও ‘দি ইকোনোমিস্ট’ কমিয়ে দেখানো হযেছে বলেছে; কারণ কেবল আমেরিকাতেই এই অতিমারীর ফলে ১৬ লক্ষ কোটি টাকার ক্ষতি হবে বলে ‘দি ইকোনোমিস্টের’ অনুমান। এরকম একটা ঘটনাকে হজম করা সহজ নয় যা বেশ কয়েক গন্ডা নতুন অর্বুদপতি সৃষ্টি করে, এক হাজারের থেকেও কম সংখ্যক অতিধনীর হাতে অতিরিক্ত লক্ষ কোটি ডলার পৌঁছে দেয়, একইসাথে কোটি কোটি সাধারণ মানুষ নতুন করে গরিবে পরিণত হয়। ভারতে ৭ জন অর্বুদপতি তাদের সম্পদ সাড়ে চার লক্ষ কোটি টাকা বাড়িয়েছে এই অতিমারীতে। ওদিকে নভেম্বরে সরকার যখন নুতন করে অর্থনৈতিক উৎসাহের জন্য প্যাকেজ ঘোষণা করছে তখন ‘দি ইকোনোমিস্ট’ জানাচ্ছে সব মিলিয়ে নতুন খরচ হল ৩ লক্ষ কোটি টাকার কম। বাদ বাকি হল ঋণ। এটি দুর্ভাগ্যজনক যে ভারত সরকার ১৩৮ কোটি লোকের জন্য যে টাকা বরাদ্দ করছে তার থেকে দেড় গুণের বেশি টাকার সম্পত্তি বাড়ছে ৭ জন অর্বুদপতি ভারতীয়ের।

কোভিড-১৯ বেশিরভাগ অর্থনীতিতে গভীর ক্ষত তৈরি করবে। বিশ্বের ভবিষ্যৎ অনুমানের পরামর্শদাতা “অক্সফোর্ড ইকোনোমিকস”-এর অর্থনৈতিক ভাঙ্গন প্রবণতা নিয়ে বিশ্লেষণ অনুসারে ভারতের ক্ষত বিশ্বের মধ্যে সব থেকে গভীর হতে পারে। অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য সীমিত রকারি সাহায্য, কাঠামোগত গোঁড়ামি, অর্থলগ্নি ক্ষেত্রে ভারসাম্যহীনতার ফলে অর্থনীতির অতিমারী পূর্ববর্তী অবস্থানে পৌঁছতে অনেক সময় লাগতে পারে।

কিন্তু দেশের সর্বজ্ঞানী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এসব কথা মানতে নারাজ। তার কথায় ভারত কোভিড মোকাবিলায় দারুণ কাজ করেছে। যার ফলে এদেশে কোভিড জনিত মৃত্যু হার সব থেকে কম মৃ্ত্যুহারের দেশগুলির মধ্যে অন্যতম এবং অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবনের পথে তা দ্রুতই পৌছে গেছে। কিন্তু বিশ্ব ব্যাঙ্কের প্রাক্তন মুখ্য অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু আইএমএফ-এর ২০২০ সালের অনুমিত জিডিপি বৃদ্ধি ও প্রতি ১০ লক্ষ জনসংখ্যায় কোভিড থেকে মৃত্যুহার নিয়ে বেশ কয়েকটি তুলনাযোগ্য এশিয় দেশের মধ্যে প্রতি-তুলনা করেছেন। অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুর সেই তথ্য, মোদিজির দাম্ভিক ঘোষণা যে ভারত কোভিড-১৯ অতিমারীর মোকাবিলায় অত্যন্ত সফল কারণ এদেশে মৃত্যু হার অন্য সব দেশের তুলনায় খুবই কম – এই দাবিকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। মনে রাখা দরকার এর পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী মে মাসে বলেছিলেন যে ভারত বিশ্ব অর্থনীতির পুনরুজ্জীবনকে নেতৃত্ব দেবে তা তথ্যের আলোকে রসিকতায় পর্যবসিত হয়েছে।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী কোভিডের ফলে মৃত্যু হারের নিরীখে ভারত দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্ব ও পূর্ব এশিযার দেশগুলির মধ্যে সব থেকে খারাপ অবস্থানে রয়েছে, অর্থাৎ ভারতে দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্ব ও পূর্ব এশিযার দেশগুলির মধ্যে মৃত্যুহার সর্বোচ্চ। এবং ভারতের জিডিপি বৃদ্ধির আনুমানিক হার সর্বনিম্ন। উভয় ক্ষেত্রেই ভারতের ভূমিকা হতাশাব্যঞ্জক। আজ (২০ জানুয়ারী, ২০২১) প্রতি মিলিয়ন (দশ লক্ষ) জনসংখ্যা পিছু মৃত্যুহারগুলি দেখা যাক। ভারতে প্রতি মিলিয়নে ১১০ জন, ইন্দোনেশিয়ায় ৯৭, মালদ্বীপে ৯০, নেপালে ৬৭, আফগানিস্তানে ৬০, মায়ানমারে ৫৫, পাকিস্তানে ৫০, বাংলাদেশে ৪৮, জাপানে ৩৬, দক্ষিণ কোরিয়ায় ২৫, মালযেশিয়ায় ১৯, শ্রীলঙ্কায় ১৩, মরিশাসে ৮, সিঙ্গাপুরে ৫, চীনে ৩, ভূটানে ১, তাইওযানে ০.৮ ও ভিয়েতনামে ০.৪। অন্যদিকে বৃদ্ধির অনুমিত হারে ইন্ডিয়ার বার্ষিক জিডিপি হ্রাস ঘটবে ১০%-এর মতো, কিন্তু চীন, বাংলাদেশ বা ভিযেতনামের জিডিপির ধনাত্মক বৃদ্ধি ঘটবে বলে অনুমান করা হচ্ছে।

পরিসংখ্যান যাই বলুক না কেন, প্রধানমন্ত্রী ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা যতই অর্থনীতির দূরবস্থাকে উড়িয়ে দিক না কেন, সমস্ত ছবিটাই সাধারণ মানুষের কাছে দূর্বিসহ যাতনা হয়ে উঠছে।কোটি কোটি ছাত্র গত ১ বছর ধরে বিদ্যালয় শিক্ষার বাইরে থেকে গেল। রাস্তাঘাট, পরিবহণ, বাস, অটো, ট্রেন, চায়ের দোকান, অসংগঠিত ক্ষেত্রের সর্বত্র আর্থিক অসহায়তা প্রকট হচ্ছে। গত বছরের মার্চথেকে প্রায় বছর ঘুরতে চলল বহু মানুষ কাজের বাইরে চলে গেছে বা অর্ধেকেরও কম আয়ে নতুন কাজ খুঁজছে। সিএমআইই তথ্য অনুসারে বেকারির হার গত ডিসেম্বরে পুনরায় ৯% ছাড়িয়ে গিয়েছে। ফলে যে অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবনের গল্প ফাঁদা হয়েছে তা যে ফাঁকা আওযাজ তা বোঝা যাচ্ছে।

- অমিত দাশগুপ্ত   

খণ্ড-28
সংখ্যা-4