সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীদের জন্য নতুন আইন — গণতন্ত্রের কন্ঠরোধ?
New Law for Social Media Users

এই মুহূর্তের অন্যতম গুরুত্বপুর্ণ যে খবর, তা হল কৃষক আন্দোলন প্রায় ৩ মাস অতিক্রান্ত হয়েছে, এবং এই কৃষক অবস্থানে ইতিমধ্যেই প্রায় ২০০ জন কৃষক মারা গেছেন। এই খবরটা যদি খেয়াল করা যায়, কটা প্রথম সারির দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে? ত, তাহলেও বোঝা যেত, কিন্তু তার বদলে এই কৃষক আন্দোলনের খবর আন্তর্জাতিক মহলে ছড়িয়ে পড়ে। পরিবেশ আন্দোলনের তরুণ মুখ গ্রেটা থুনবার্গথেকে শুরু করে বার্বাডোজের গায়িকা রিহানা এই কৃষক আন্দোলন নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে লেখেন, কেন আমরা এই বিষয়ে আলোচনা করছি না? এরপরেই সরকার নড়েচড়ে বসে। তড়িঘড়ি সরকারের হয়ে নামিয়ে দেওয়া হয় দেশের বিভিন্ন সেলিব্রিটি থেকে খেলোয়াড় প্রায় সবাইকে। সবাই মোটামুটি প্রায় একই রকমের ধরনের বক্তব্য লেখেন যে কোনও রকম দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে কেন আন্তর্জাতিক মহল থেকে নাক গলানো হবে? এইখানেই সরকার থেমে থাকেনা, তারপর তারা টুইটার এবং ফেসবুককে বলে যে অন্তত ১,৮০০ অ্যাকাউন্ট অবিলম্বে বন্ধ করে দিতে হবে। টুইটার প্রাথমিকভাবে সম্মত হলেও পরে প্রবল চাপে ঐ অ্যাকাউন্ট আবার ফিরিয়ে দেয়। এই শুরু হয় এই বড় প্রযুক্তির সংস্থা টুইটার এবং ফেসবুক সহ অন্যান্য ছোট ছোট খবরের পোর্টালদের কি করে নিয়ন্ত্রণে আনা যায় তার প্রক্রিয়া।

বলা হয়েছে যে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে হবে তাই এই সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ করাটা খুব জরুরি। কোনও কোনও মানুষ দেশের সুরক্ষা বিঘ্নিত করছেন এবং তাঁদের চিহ্নিত করা জরুরি। যদি খেয়াল করা যায় তাহলে দেখা যাবে, এর কিছুদিন আগেই দেশের গৃহমন্ত্রক থেকে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়, বলা হয় যে গৃহমন্ত্রক বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করতে চায়, যারা সামাজিক মাধ্যমে কারা ভুয়ো এবং মিথ্যে খবর ছড়াচ্ছেন তা চিহ্নিত করবেন। তারপরেই আসে এই আইন। ভুয়ো খবরের বাড়বাড়ন্ত অবশ্যই চিন্তার কারণ, কিন্তু তা আটকাতে যে আইন কেন্দ্রীয় সরকার আনল তা দিয়ে কি সত্যিই উদ্দেশ্য সফল হবে? যখন আমরা জানি যে শাসকদলের যে আইটি সেল আছে তারা কিভাবে ভুয়ো এবং মিথ্যে খবর ছড়িয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অশান্তি তৈরি করেছে তখন এই আইনে কি আদৌ কোনও লাভ হবে? বলা হয়েছে যে একজন সচিবকে নিযুক্ত করা হবে, এবং ঐ প্রযুক্তির সংস্থা, অর্থাৎ ফেসবুক এবং টুইটারকে সেই সচিবের কাছে জানাতে হবে ভুয়ো খবরের উৎস কি? ধরা যাক জানানো হল যে দিল্লীর দাঙ্গার পিছনে বিজেপি নেতা কপিল মিশ্রের সক্রিয় মদত রয়েছে এবং তাঁর করা ফেসবুক পোস্টেই দিল্লীতে দাঙ্গা হয়েছে, তখন কি সরকার তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে? নাকি এই আইন করে আসলে গণতন্ত্রের কণ্ঠই রোধ করা হবে?

প্রথমত যা বলা হয়েছে তাতে এমনিতেই বেশ কিছু প্রশ্ন আসছে। ডিজিটাল সংবাদমাধ্যম, বিনোদনমূলক স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম যার পোশাকি নাম ওটিটি প্ল্যাটফর্ম এবং সামাজিক মাধ্যমকে একই বন্ধনীর মধ্যে ফেলা হয়েছে। এর পিছনে তাহলে কি অন্য কোনও উদ্দেশ্য আছে? ডিজিটাল সংবাদমাধ্যম কিন্তু ইতিমধ্যেই মুদ্রণ এবং টেলিভিশনের যে প্রচলিত আইন আছে তা মেনে চলে। যার ফলে এই ছোট ছোট ওয়েব পোর্টালের সম্পাদক ও সাংবাদিকেরা ইতিমধ্যেই এই বিষয়ে দায়বদ্ধ। এরসঙ্গে সামাজিক মাধ্যমের একটা গুণগত তফাৎ আছে, সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত কোনও খবরের কোনও সত্যতা কেউ যাচাই করে না, ফলে সেখানে যা লেখা,ছবি বা ভিডিও প্রকাশিত হয়, তার দায় একমাত্র প্রকাশকের, সুতরাং এই বিষয়ে সামাজিক মাধ্যম সংস্থাগুলোরও কোনও দায়িত্ব নেই। ফলে এর মাধ্যম দিয়েই অনবরত ভুয়ো খবর প্রচারিত হয়। তার বিরুদ্ধে এমনিতেই বেশ কিছু স্বাধীন সংস্থা বেশ কিছুদিন ধরে কাজ করছে, সরকারের কি উচিৎ ছিল না, সেই সংস্থাদের সঙ্গে কথা বলে তবে এই ধরনের কোনও আইন আনা? একদিকে মোদী সরকার বলছেন যে তারা গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করার পক্ষপাতী নন, অন্যদিকে একটি টুইট করার জন্য তারা বেঙ্গালুরু থেকে ২১ বছর বয়সী একজন পরিবেশ আন্দোলনের কর্মী দিশা রভিকে গ্রেপ্তার করে। একদিকে জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর হামলাকারী শাসক দলের ঘনিষ্ঠ হবার সুবাদে কেউ কেউ বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াবেন, অন্য দিকে কোনও রাজ্যে না ছড়াতে পারে, সেটার জন্যেই এই ব্যবস্থা নেওয়া হল? সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীদের পায়ে বেড়ী পরিয়ে কি নরেন্দ্র মোদী পূর্বসূরীকেই অনুসরণ করতে চাইলেন?

- সুমন সেনগুপ্ত   

খণ্ড-28
সংখ্যা-8