শীতলকুচি রাষ্ট্রীয় গণহত্যা : পার্টির তদন্তকারী দলের রিপোর্ট
Report of the party's investigation team

গত ১০-০৪-২০২১ শনিবার পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা সাধারণ নির্বাচনে (৪র্থ দফা) কোচবিহার জেলার ৫-শীতলকুচি (তপশীলি জাতি) বিধানসভা ক্ষেত্রের বুথ নং- ৫/১২৬-এ মোট চারজন সাধারণ ভোটারের রাষ্ট্রীয় বাহিনীর দ্বারা হত্যাকান্ডের পরিপ্রেক্ষিতে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন-এর পক্ষ থেকে ৬ জনের একটি প্রতিনিধিদল ১৮-০৪-২০২১ রবিবার উপরোক্ত বুথ এবং তৎসংলগ্ন এলাকাগুলিতে গিয়ে আহত ও নিহত সহনাগরিকদের বাড়ি যাওয়ার পাশাপাশি স্থানীয় মানুষজনের সাথেও সাক্ষাত করে।

প্রতিনিধিদলে ছিলেন বাবুন দে, মুকুল বর্মন, দর্পহরি রায়, প্রজাপতি দাস (এঁরা প্রত‍্যেকেই পার্টির কোচবিহার জেলা কমিটির সদস‍্য), কমরেড সুনীতা বর্মন এবং পার্টি রাজ‍্য কমিটির তরফে কোচবিহার জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত রাজ‍্য কমিটি সদস্য কমরেড চঞ্চল দাস।

ঘটনাস্থল :
আমতলী মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্র (আমতলি এমএসকে এলাকার বাসিন্দাদের কাছে “মাদ্রাসা” নামেই বেশি পরিচিত), গ্ৰাম+পোঃ- জোড়পাটকী, মাথাভাঙ্গা ১নং ব্লক। জেলা-কোচবিহার‌। বিধানসভা ক্ষেত্র — ৫-শীতলকুচি (তপশীলি জাতি), বুথ নং-৫/১২৬

শীতলকুচি বাজার থেকে রওয়ানা হয়ে মাথাভাঙ্গা যাওয়ার রাস্তায় প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে কাউয়ার ডেরা (অধুনা গোলকগঞ্জ) স্টপেজ থেকে ডানদিকে প্রায় ৪ (চার) কিলোমিটার গণহত্যার অকুস্থল “আমতলী মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্র (বুথ নং- ৫/১২৬)”। রাস্তার ডানদিকে অবস্থিত মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্রের শুধুমাত্র রাস্তা বরাবর ডানদিক লাগোয়া অংশটুকুই পাকা পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। গেটের উল্টো দিকে অর্থাৎ রাস্তার বামদিকে একদল পুলিশকে (চারচাকা গাড়িসহ) বসে থাকতে দেখা গেল। ঘটনার পর থেকে ঐ এলাকায় নিয়মিত পুলিশি টহল দেওয়া হয় বলে জানা গেছে। বলে রাখা দরকার যে, রাস্তাটাকে সীমানা ধরে ডানদিকের এলাকা অংশ নং-৫/১২৬ এবং ডানদিক বরাবর কিছুদূর এগিয়ে গেলেই অংশ নং-৫/১২৫-র এলাকা শুরু।

অংশ নং-৫/১২৬-এলাকার ভোটগ্ৰহণ কেন্দ্র এই এমএসকে-টি এলাকার প্রায় শেষ সীমানায় অবস্হিত।

এমএসকে-র উল্টোদিকে অর্থাৎ রাস্তার বামদিকে রয়েছে অংশ নং-৫/১১৮ এবং অংশ নং- ৫/১১৯-র এলাকা। ফলে স্বভাবতই ঐ MSK-সংলগ্ন এলাকায় (ছোট্ট গঞ্জ মতো, কয়েকটি দোকানও রয়েছে) সবসময় পার্শ্ববর্তী সব এলাকার মানুষজনের ওঠাবসা, আড্ডা ইত্যাদি হয়ে থাকে। এলাকায় প্রধানত সংখ‍্যালঘু মানুষের বসবাস। প্রায় প্রতিটি পরিবারের কোনো না কোনো সদস‍্য পরিযায়ী শ্রমিক। হিন্দু-মুসলমান প্রত‍্যেকেই পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে একসাথে বসবাস করে আসছেন।

গোলকগঞ্জ থেকে আমাদের পথপ্রদর্শক রতন দাসের বাড়ি ও দোকান এমএসকে-র উল্টোদিকে (রাস্তার বামদিকে) অবস্থিত। প্রতিনিধিদলের আমরা সবাই প্রথমে রতন দাসের বাড়িতে গিয়ে বসি এবং কথাবার্তা বলতে থাকি। ইতিমধ্যে সেখানে স্থানীয় ব‍্যবসায়ী আলিজার রহমান আসেন এবং আমাদের পরিচয়, উদ্দেশ্য ইত্যাদি বিষয়ে জানতে চান। আলোচনা চলাকালীন তিনি পরিস্কারভাবে জানান যে বাইরে থেকে আসা বিজেপির কোনো লোককে তারা এলাকায় ঢুকতে বাধা দিচ্ছেন এই কারণে যে, ইতিপূর্বে বিজেপির লোকজন এসে উদ্দেশ‍্যপ্রণোদিতভাবে এলাকায় অশান্তি লাগানোর চেষ্টায় ভিডিও তৈরি করে নিয়ে গিয়ে বাইরে গুজব ছড়াচ্ছে। তিনি জোরের সাথে এও দাবি করেন যে এযাবতকাল এই এলাকায় হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে কোনো হিংসার ঘটনা তো ঘটেইনি এমনকি সাম্প্রতিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেও সেরকম কোনো অপচেষ্টা এলাকার সকল বাসিন্দা মিলে যে কোনো মূল্যে রুখবেন।

সেখান থেকে বেরিয়ে এসে আমরা সবাই একে একে ঐ দিনের (১০-০৪-২০২১) ঘটনায় নিহত এবং আহতদের পরিবারের সাথে দেখা করতে তাদের বাড়িতে যাই এবং প্রত‍্যক্ষদর্শীদের সাথেও কথা বলি।

এলাকার মানুষজনের সাথে কথা বলে ঘটনাক্রম যা জানা গেল তা নিম্নরূপ:

ঘটনার সূত্রপাত ১০ এপ্রিল ২০২১ শনিবার সকাল আনুমানিক ৯টা নাগাদ। বুথ নং-৫/১২৬-র ভোটারদের জন্য টিএমসি-র পক্ষ থেকে যে ক‍্যাম্প করা হয়েছিল (পার্শ্ববর্তী কাজীর মোড় এলাকায়) সেই ক‍্যাম্পে ইসিআই-নির্ধারিত লোকসংখ্যার চেয়ে বেশি লোক জমায়েত হয়েছে এই অজুহাতে স্থানীয় বিজেপি দলের অভিযোগের ভিত্তিতে বিজেপির কর্মী সমর্থকদের উপস্থিতিতে পুলিশ সেক্টর থেকে আসা জংলী পোশাক পরিহিত কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানরা মৃদু লাঠিচার্জ করে ও ক‍্যাম্পে ভাঙচুর করে। সেখান থেকে ফেরার পথে রাস্তায় অষ্টম শ্রেণীর পড়ুয়া জাহিদুল হক (১৪ বৎসর, পিতা-মজিদ মিঞা)-কে অযাচিতভাবে বেধড়ক মারধর করে (ছেলেটিকে মেরে রাস্তায় ফেলে দেওয়া হয় এবং তার মুখ দিয়ে গ‍্যাঁজলা বেরোতে থাকে)। বিনা প্ররোচনায় কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদের দ্বারা এই ছেলেটিকে নিগ্রহের প্রতিবাদ করে ঘটনাস্থলে উপস্থিত কয়েকজন স্থানীয় যুবক। সেখানে উপস্থিত কয়েকজন ভদ্রমহিলাও যুবকদের সাথে সামিল হয়ে নির্দোষ নাবালক জাহিদুলকে নিগ্ৰহের প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদের সামনে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। মোবাইলে এই সমস্ত ঘটনার ভিডিওগ্ৰাফি করতে গেলে কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানরা মোবাইল কেড়ে নেওয়ারও চেষ্টা করে।

বিক্ষোভ চলাকালীন সময়ে অ্যাম্বুলেস ডেকে এনে আহত ছাত্রটিকে কেন্দ্রীয় বাহিনীর তরফে প্রকৃত অভিভাবকদের ছাড়াই হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয়‌। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সাময়িক উত্তেজনা দেখা দিলে জওয়ানরা লাঠি উঁচিয়ে জনসাধারণের দিকে তেড়ে যায় এবং উত্তেজনা প্রশমনের চেষ্টা করে।

এই ঘটনাস্থল ভোটগ্ৰহণ কেন্দ্র (৫/১২৬, MSK) থেকে আনুমানিক ৩০০/৩৫০ মিটার দূরে।

সেই সময় ভোটগ্ৰহণ কেন্দ্রে (৫/১২৬) ভোট নির্বিঘ্নেই চলছিল বলে জানা গিয়েছে। অর্থাৎ বাইরের ঘটনার কোনোরকম প্রভাব ভোটগ্ৰহণ কেন্দ্রে উপস্থিত লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ভোটারদের মধ্যে ছিল না।

ইতিমধ্যে আনুমানিক বেলা ৯:৪৫ নাগাদ হঠাৎ করে চারচাকা গাড়িতে চড়ে আসা কুইক রেসপন্স টিম (কিউআরটি)-র জংলী পোশাক পরিহিত কয়েকজন কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ান এসে গাড়ি থেকে নেমে এমএসকে-র মূল গেট দিয়ে না ঢুকে পাঁচিলের শেষাংশের ফাঁকা জায়গা দিয়ে হেঁটে MSK-র মাঠে ঢোকে এবং বিনা প্ররোচনায় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ভোটারদের দিকে লক্ষ‍্য করে গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। বেশ কয়েক রাউন্ড গুলি ছোঁড়া হয় বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে।

একটি গুলি লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা স্থানীয় সফরুদ্দিন-এর কাঁধ ঘেঁষে বেরিয়ে যায়। গুলিতে আহত সফিরুদ্দিন সেই অবস্থাতেই এমএসকে-র পাকা দেওয়াল ঘেঁষে পড়ে থাকাতেই প্রাণে বেঁচে যায় বলে জানা গিয়েছে। এরপরই ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ভোটারদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়।

এই অবস্থায় পলায়নরত ভোটারদের লক্ষ্য করে আরও গুলি ছোঁড়া হয় এবং গুলিবিদ্ধ দুজন (মনিরুল ইসলাম ও হামিদুল মিঞা, দুজনেরই বয়স-২৮ বৎসর) মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।

ইতিমধ্যে পার্শ্ববর্তী এলাকার (অংশ নং-৫/১২৫) বাসিন্দা নুর আলম (১৯ বৎসর, এবারের নির্বাচনে নতুন ভোটার) নিজের ভোট তার নির্দিষ্ট বুথে (৫/১২৫) দিয়ে এসে উপরোক্ত এমএসকে (বুথ নং-৫/১২৬)-র পার্শ্বস্থ জমিতে (জ্যেঠতুতো দাদা ও তার নিজের যৌথভাবে লিজ নেওয়া) কাজ করার জন্য জ‍্যেঠতুতো দাদার বাইক নিয়ে জমির সামনে এসে পৌঁছোলে তাকে জংলী পোশাক পরিহিত কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদের মধ্যে একজন আগ্নেয়াস্ত্র উঁচিয়ে হুমকি দিতে থাকে। ভয়ে নুর আলম বাইক ফেলে সেখান থেকে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করলে তাকেও গুলি করা হয় এবং গুলিবিদ্ধ নুর আলম সেখানেই লুটিয়ে পড়ে।

এছাড়াও জংলী পোশাক পরিহিত কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদের ছোঁড়া গুলিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় কলেজ পড়ুয়া সামিউল হক (১৯ বৎসর, এবারের নির্বাচনে নতুন ভোটার)। সে তার দিদি (আঞ্জুমা খাতুন, স্নাতক) ও একমাত্র ভাই (সাহিদুল হক, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী, এবারের নির্বাচনে প্রথম ভোটার) সহ ভোটের লাইনে দাঁড়িয়েছিল। তার ছোটোভাই সাহিদুল ভোট দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় মাঠের মধ্যে কিউআরটি-র জংলী পোশাক পরিহিত কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদের মধ্যে একজন তাদের হাতে থাকা ফাইবার গ্লাসের লাঠি দিয়ে সাহিদুলের মাথায় আঘাত করে এবং সে তৎক্ষণাৎ মাঠেই লুটিয়ে পরে। সেই অবস্থাতেই তাকে লাঠি দিয়ে আরো মারা হয়। সেটা দেখে বড়ভাই সামিউল ছুটে আসে এবং সংশ্লিষ্ট জওয়ানের পা জড়িয়ে ধরে ছোটোভাই সাহিদুলকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য কাতর অনুরোধ করতে থাকে। এরকম অবস্থায় ঐ জওয়ান সামিউল হক-এর বুক-গলা বুটসহ পা দিয়ে চেপে ধরে এবং গুলি করে মেরে ফেলে।

সুপরিকল্পিতভাবে সম্পূর্ণ ঘটনাটি ঘটানোর (আনুমানিক ৪০-৪৫ সেকেন্ড) পরপরই উক্ত গুলিচালনার ঘটনায় অভিযুক্ত ক্যুইক রেসপন্স টিম (কিউআরটি)’র পোশাক পরিহিত কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানরা যে চারচাকা গাড়িতে চড়ে এসেছিল সেই গাড়িতে চড়েই ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়। উল্লেখ্য যে ওই জওয়ানেরা মাঠে ঢুকে গুলি চালিয়ে ফিরে আসা পর্যন্ত ওই চারচাকা গাড়ির ইঞ্জিন চালু অবস্থায় ছিল।

ঘটনার আকস্মিকতায় ঐ বুথে (৫/১২৬) ভোটগ্ৰহণ স্হগিত হয়ে যায়। গুলিবিদ্ধ দুজনকে স্থানীয় লোকেরাই নিজেদের ব‍্যবস্থাপনায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে পুলিশের বাধা এবং অহেতুক হেনস্থার শিকার হতে হয়। বাকি দুজন ঘটনাস্থলেই মারা যান বলে জানা গেছে। পরবর্তীতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তরফে সবাইকেই মৃত বলে ঘোষণা করা হয়‌।

এদিকে এই ডামাডোলের মধ্যেই পুলিশ সেক্টরের অধীন কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ান এবং পোলিং বুথে কর্তব্যরত চারজন জওয়ানও ভোটকর্মীদের ফেলে রেখে পালিয়ে যায়। এরপর জনরোষ উক্ত বুথে কর্তব‍্যরত ভোটকর্মীদের উপর গিয়ে পড়ে এবং তার ফলে ভোটকর্মীরাও আহত হয়েছেন। পাশাপাশি এটাও ঘটনা যে স্থানীয় কিছু মানুষ উত্তেজিত জনতার হাত থেকে ভোটকর্মীদের রক্ষা করেছেন। প্রায় দেড়ঘন্টা বাদে প্রশাসনিক লোকজন এসে ভোটকর্মীদের সেই বুথ থেকে নিয়ে চলে যায়।

নিহত চারজন সহনাগরিকের সংক্ষিপ্ত পরিচয়সহ অন‍্যান‍্য তথ্য :

১) মনিরুল ইসলাম (২৮)‌। পিতা - আমজাদ হোসেন। তিন ভাই, এক বোন, বাবা-মা, স্ত্রী এবং একমাত্র শিশুকন্যা (বয়স-৪৫দিন) নিয়ে পরিবার। গরিব কৃষক পরিবারের সন্তান মনিরুল পেশায় রাজমিস্ত্রি, বর্তমানে গ‍্যাংটক (সিকিম)-এ কর্মরত। ভোটের দুইদিন আগে বাড়িতে এসেছেন। কন্যাসন্তান জন্মগ্ৰহণের খবর কর্মক্ষেত্রে বসেই পেয়েছিলেন কিন্তু সেসময় বাড়িতে আসার সুযোগ হয়নি। এবারে ভোট দেওয়ার জন্য বাড়িতে আসার পাশাপাশি নিজের মেয়ের সাথেও সর্বপ্রথম সাক্ষাত হয়।

২) হামিদুল মিঞা (২৮)। পিতা - দিল মহম্মদ মিঞা। দিল মহম্মদ মিঞা'র বড়ছেলে স্ত্রী ও কন‍্যাসন্তান রেখে একবছর আগে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছে। মেজ ছেলে বিবাহিত, ছোটোছেলে হামিদুল মিঞা (বিবাহিত) পেশায় রাজমিস্ত্রি।

গরিব কৃষক পরিবারের সন্তান হামিদুল-এর বাড়িতে চার বৎসর বয়সী এক কন‍্যাসন্তান এবং নয়মাসের সন্তানসম্ভবা স্ত্রী এবং বাবা-মা রয়েছে।

৩) সামিউল হক (১৯)। পিতা - আফসার আলি মিঞা। আর্থিক অনটনের কারণে নিজে নিয়মিত কলেযে ভর্তি না হয়ে দূরশিক্ষার মাধ্যমে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিলো। এর পাশাপাশি একটি ব‍্যাঙ্কের অধীনে ব‍্যাঙ্কের কিয়স্ক-এর বিভিন্ন কাজকর্মসহ অন্যান্য টুকিটাকি কাজকর্ম করে পরিবারকে স্বচ্ছল করার চেষ্টায় ব্রতী সামিউলের বাড়িতে বাবা-মা ছাড়াও স্নাতকোত্তীর্ণ দিদি (আঞ্জুমা খাতুন) ও উচ্চমাধ্যমিক পরিক্ষার্থী ভাই (সাহিদুল হক) রয়েছে। সামিউল নিজে এবং ভাই সাহিদুল দুজনেই এবারের নির্বাচনে প্রথম ভোটার।

উপরোক্ত মৃত তিনজন সহনাগরিকই বুথ নং-৫/১২৬-এর ভোটার।

৪) নুর আলম মিঞা (১৯)। পিতা - জোবেদ আলি মিঞা। চার বোন এবং একমাত্র ভাই নুর আলম মিঞা। বাড়িতে বাবা-মা ছাড়াও স্বামীপরিত‍্যাক্তা এক দিদি এবং তিনজন ছোটোবোন রয়েছে যার মধ‍্যে এক বোন বিবাহিতা। বাবা শারীরিকভাবে সুস্থ নন। পরিবারের অন‍্যতম প্রধান উপার্জনক্ষম সদস্য ছিলো নুর আলম।

অংশ নং-৫/১২৫-এর বাসিন্দা নুর আলমের পরিবারের ছোটোবড়ো সকলেই বছরের অর্ধেক সময় পার্শ্ববর্তী রাজ‍্য বিহারে ইঁটভাটায় শ্রমিক(পরিযায়ী) হিসেবে কাজ করে। ঐ সময় বাড়ি তালাবন্ধ অবস্থায় থাকে। ঘটনার দিন বাড়িতে ছিলেন কেবলমাত্র নুর আলম (এবারের নির্বাচনে প্রথম ভোটার) এবং তার বাবা (ভোটদানের জন্য কয়েকদিন আগেই বিহার থেকে বাড়িতে এসেছেন)। নুর আলমের মৃত‍্যুসংবাদ (মৃতদেহ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর) বর্তমানে কেরল রাজ‍্যে কর্মরত এক পরিচিত লোকের ফোন মারফত বাড়িতে থাকা অসুস্থ বাবার কাছে অনেক দেরী করে পৌঁছায়। (তার বাবাসহ অন‍্যান‍্য আত্মীয়স্বজন এবং প্রতিবেশীরা জানতেন যে নুর আলম জমিতে চাষাবাদের কাজে ব‍্যস্ত রয়েছে)। নুর আলমের মৃত‍্যুসংবাদ পেয়ে বিহার রাজ‍্যে ইঁটভাটায় শ্রমিক হিসেবে নিযুক্ত মা, দিদি ও বোনেরা বাড়ি ফিরে আসেন। এটি একটি ভূমিহীন পরিবার। ধরলা নদীর চর এলাকায় বিগত ৩০-৪০ বছর ধরে বসবাস করা সত্ত্বেও এখনও জমির পাট্টা হয়নি।

উপরোক্ত গুলিকান্ডে নিহত সহনাগরিকদের পরিবার এখনও কোনো সরকারী সাহায্য পায়নি। নিহতদের মধ্যে কারো কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে সখ্যতা আছে বলে জানা যায়নি।

পরিবারের সদস্যরা ছাড়াও এলাকার গরিব মেহনতি মানুষসহ প্রত‍্যেকেই উপরোক্ত গুলিকান্ডের সঠিক তদন্তসাপেক্ষে অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তির দাবি করেছেন।

অনুসন্ধানকারী দলের পক্ষে
বাবুন দে, জেলা কমিটি সদস্য,

সিপিআই(এমএল) লিবারেশন, কোচবিহার জেলা কমিটি

খণ্ড-28
সংখ্যা-15