বিহারকে পুলিশরাজে পরিণত করছে বিজেপি-জেডিইউ সরকার
turning Bihar into a police state

রাজ্যব্যাপী প্রতিবাদ সত্ত্বেও নীতিশ কুমার সরকার গত ২৩ মার্চবিহার বিধানসভায় ‘বিহার স্পেশ্যাল আর্মড পুলিশ অ্যাক্ট’ বিল পাশ করাল। এই আইনের বলে পুলিশ যে কোনো স্থানে যে কোনো ব্যক্তিকে তল্লাশি করতে পারবে। বিহার মিলিটারি পুলিশকে আরো নখ-দাঁত যুগিয়ে এই আইনের মাধ্যমে নতুন রূপে যে পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলা হবে, তাদের অধিকার থাকবে যে কোনো স্থানে আদালতের অনুমতি ছাড়াই হানাদারি চালানো এবং শুধুমাত্র সন্দেহের বশেই কাউকে গ্ৰেপ্তার করার (বিলের ধারা ৭ ও ৮)। পুলিশ অন্যায় করেছে বলে মনে করলে আদালতেরও এক্তিয়ার থাকবেনা নিজের বিবেচনায় স্ব-উদ্যোগে বিচার প্রক্রিয়া শুরু করার (বিলের ধারা ১৫)।

বিরোধীপক্ষের বিধায়করা বলেছেন, এই বিল সাংবিধানিক আইনি ব্যবস্থার লঙ্ঘন এবং সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক রাজ্যকে পুলিশিরাজে পরিণত করার উদ্যোগ। পার্শ্ববর্তী রাজ্য উত্তরপ্রদেশেও এই ধরনের আইন তৈরি করে রাজ্যটাকে পুলিশের সংঘর্ষরাজে পরিণত করা হয়েছে এবং এই আইনকে ব্যবহার করেই সমস্ত বিরোধী ও গণতান্ত্রিক কণ্ঠকে দমন করা হচ্ছে। বিজেপি সরকারের জনবিরোধী নীতি ও পদক্ষেপের ফলে জনগণের মধ্যে যে ক্রোধের সৃষ্টি হচ্ছে, তাকে দমন করার লক্ষ্যে এই বিল একটা ফ্যাসিবাদী ষড়যন্ত্র ছাড়া অন্য কিছু নয়। সরকার প্রথমে ১৯ মার্চবিধানসভায় বিলটা পেশ করার কথা ভাবলেও বিরোধীপক্ষের বিধায়কদের তীব্র বিরোধিতার মুখে সেদিন তাদের পক্ষে তা সম্ভব হয়নি। পরে ২৩ মার্চ বিধানসভার অধিবেশন শুরু হলে বিরোধী পক্ষের বিধায়করা পুলিশিরাজ বিলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করেন। বিকাল ৫টার সময় সেদিনের মত অধিবেশন যখন শেষ হতে যাচ্ছে, স্পিকার বিজয় কুমার সিনহা পুলিশ ডাকেন। প্রায় ১০০ পুলিশ বিধানসভায় ঢোকে, সঙ্গে বিহারের ডিজিপি, পাটনার এসএসপি ও জেলা শাসক। পুলিশ ও প্রশাসনের এই কর্তারা বিধানসভার অভ্যন্তরে প্রতিবাদকারী বিধায়কদের নির্যাতনে নেতৃত্ব দেন। বিধায়কদের প্রহার করে, লাথি মেরে, চুলের মুঠি ধরে পুলিশ তাদের টেনে নিয়ে যায়। এসএসপি ও জেলা শাসকও বিধায়কদের নির্যাতনে হাত লাগান বলে অভিযোগ। সিপিআই(এমএল) বিধায়ক মেহবুব আলমকে মারধর করে হাত মুচড়ে দেওয়া হয়, বিধায়ক সুদামা প্রসাদকে ধাক্কা দিতে দিতে নিয়ে গেলে তিনি সিঁড়িতে পড়ে গিয়ে আঙুলে গুরুতর আঘাত পান। সিপিআই(এম)-এর এক বিধায়ককে এমন প্রহার করা হয় যে তিনি সংজ্ঞা হারান। মহিলা বিধায়করাও পুলিশি বর্বরতা থেকে রেহাই পাননি। অবশেষে বিরোধী বিধায়ক শূন্য বিধানসভায় বিল পাশ হয়।

বিল পেশ হওয়ার উদ্যোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিরোধী দলগুলো প্রতিবাদ আন্দোলন শুরু করে। বিলের দানবীয় চরিত্র সম্পর্কে জনগণকে সতর্ক করা হয় এবং বিল বিরোধী প্রতিবাদে শামিল হওয়ার আহ্বান জানানো হয়। সিপিআই(এমএল) ২২ মার্চ বিলের বিরুদ্ধে সারা রাজ্যের ব্লকে-ব্লকে প্রতিবাদ সংগঠিত করে। আরোয়াল, সুপৌল, বক্সার, জাহানাবাদ, ভোজপুর, সিওয়ান, বেগুসরাই এবং অন্যান্য জেলার ব্লক সদরে বিলবিরোধী প্রতিবাদ সংগঠিত হয়। সেদিন রাজধানী পাটনা সহ ফতুয়া, পালিগঞ্জ, নওবতপুর এবং গ্ৰামীণ পাটনার ফুলওয়ারি ব্লকে সংগঠিত হয় প্রতিবাদ মিছিল।

বিল পাশ হওয়ার পরদিন ২৪ মার্চ বিরোধী বিধায়করা বিলের বিরুদ্ধে বিধানসভায় বিক্ষোভ দেখান, সিপিআই(এমএল) বিধায়করা কালো ব্যাণ্ড পরে বিধানসভায় ঢোকেন। দিনটি সারা রাজ্যে ধিক্কার দিবস হিসাবে পালিত হয়। সিপিআই(এমএল) সারা বিহারেই প্রতিবাদ সংগঠিত করে এবং মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের কুশপুতুল পোড়ানো হয়। বিক্ষোভকারীরা অসাংবিধানিক ও দানবীয় বিলটি প্রত্যাহারের দাবি জানান। সিপিআই(এমএল)-এর বিহার সম্পাদক ও পলিটব্যুরো সদস্য কমরেড কুনাল বিধানসভার অভ্যন্তরে বিধায়কদের নিগ্ৰহকে ভারতের সংসদীয় ইতিহাসে এক কালো দিন রূপে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, এই ঘৃণ্য অপরাধ দেখিয়ে দিচ্ছে, নীতীশ-বিজেপি সরকার বিহারকে এক ফ্যাসিস্ত রাজ্যের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। বিহার বিধানসভায় পুলিশের হাতে বিধায়কদের নিগ্ৰহের বিরুদ্ধে সারা দেশই ধিক্কার জানিয়েছে। যিনি পুলিশ ডেকেছিলেন সেই স্পিকার বিজয় কুমার সিনহার ওপরই নিগ্ৰহের দায় চাপছে সবচেয়ে বেশি। ঘরে-বাইরে চাপের মুখে পড়ে স্পিকার পুলিশ বাড়াবাড়ি করেছে কিনা তার তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।

বিরোধী বিধায়করা ২৩ মার্চের ঘটনার প্রতিবাদে আরজেডি বিধায়ক ভূদেব চৌধুরীকে স্পিকার নির্বাচিত করে বিধানসভার বাইরে ছদ্মরূপের বিধানসভার অধিবেশন পরিচালনা করেন।

উল্লেখ্য, বিহার বিধানসভায় এনডিএ সরকারের অত্যন্ত সামান্য ব্যবধানের সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে। বিহার বিধানসভার মোট সদস্য সংখ্যা ২৪৩, আর এনডিএ-র নির্বাচিত বিধায়ক সংখ্যা হল ১২৫। এই নগণ্য সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সমস্ত বিরোধিতাকে উপেক্ষা করে নীতীশ-বিজেপি সরকার পাশ করাল দানবীয় আইনকে। কিছুদিন আগেই গণতন্ত্র নিয়ে গবেষণা করা সুইডেনের সংস্থা ভি ডেম ইনস্টিটিউট ভারতকে ‘নির্বাচন ভিত্তিক স্বৈরতন্ত্র’ আখ্যা দিয়েছে এবং বলেছে যে, ভারতীয় রাষ্ট্র পাকিস্তানের মতোই স্বৈরাচারী এবং তার গণতান্ত্রিক অন্তর্বস্তু নেপাল ও বাংলাদেশের চেয়েও খারাপ। ‘বিরোধীদের অশ্রদ্ধা’ ভারতীয় রাষ্ট্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য বলেও গবেষণা সংস্থার রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। ভারতের শাসক দলগুলো প্রতিদিনই এই পর্যবেক্ষণকে যথার্থ বলে প্রতিপন্ন করে চলেছে। গায়ের জোরে দানবীয় বিল পাশ করিয়ে এবং বিধানসভার অভ্যন্তরে বিরোধী বিধায়কদের ওপর পুলিশি নির্যাতন চালিয়ে নীতীশ-বিজেপি সরকার ভি ডেম ইনস্টিটিউটএর পর্যবেক্ষণের সঠিকতাকেই প্রমাণ করল।

খণ্ড-28
সংখ্যা-12