অতিমারীর ছোবলে দেশ ছারখার, নির্লিপ্ত প্রধানমন্ত্রী
The-country-is-ruined-by-Epidemic-touch

আবার কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ ক্রমে ক্রমে সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। ইতিমধ্যেই বেশ কিছু রাজ্যে তীব্র স্বাস্থ্য সংকট মাথা চাড়া দিয়েছে। হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত শয্যা সংখ্যা, কোভিড মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় কিট, প্রাণদায়ী ওষুধ, অক্সিজেন এমনকি টিকার বিস্তর অভাব দেখা দিতে শুরু করেছে। অসমের ডবল ইঞ্জিনের বিজেপি সরকার তো জানিয়েই দিল যে, কোভিড চিকিৎসার ওষুধ রেমডেসিভিয়ার এপিএল রোগীদের আর বিনামূল্যে সরবরাহ করা যাবে না, ফলে গ্যাঁটের কড়ি ফেলে  তা কিনতে হবে। ওই ইঞ্জেকশন কিনতে হবে ১৬৫২ টাকা খরচ করে। বিমানবন্দরেও কোভিড পরীক্ষার জন্য বাধ্যতামূলকভাবে সব যাত্রীর কাছ থেকে নেওয়া হচ্ছে মাথাপিছু ৫০০ টাকা। রাজনৈতিক ক্ষমতার নিরঙ্কুশ কেন্দ্রীভবনের মতোই কোভিড টিকা নিয়েও মোদী সরকার শুরু করেছে অমানবিক ব্যবসা, রাজনৈতিক খেলা। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোকে দুহাতে বিলোনো হচ্ছে টিকা, কিন্তু মারাত্বকভাবে আক্রান্ত অ-বিজেপি রাজ্য, যেমন, মহারাষ্ট্র, সেখান থেকে রীতিমতো বঞ্চিত হচ্ছে।

ইতিমধ্যেই পরিযায়ী শ্রমিকরা আবার নিজ নিজ গ্রামে ফিরে আসতে শুরু করেছেন। আবার রুটি রুজি হারানোর আতঙ্ক গ্রাস করেছে গরিব খেটে খাওয়া মানুষদের। আজ থেকে একবছর আগের দেশব্যাপী লকডাউন, থালা বাজানো ও মোমবাতি জ্বালানোর ভূয়া আশ্বাসে করোনা তো নির্মূল হয়নি, বরং গরিবগুর্বোদের অর্থনৈতিক সামাজিক জীবনে নামিয়ে আনে দুঃসহ যন্ত্রণা ও হাহাকার। সমাজের সবচেয়ে বিপন্ন ও প্রান্তসীমায় থাকা জনগোষ্ঠীর মধ্যে মহিলা ও শিশুরা কল্পনাতীত যন্ত্রণার কবলে পড়েন।

গত বছর লকডাউনে সাধারণ মানুষের সর্বনাশা প্রভাব নিয়ে একাধিক প্রতিষ্ঠান অনেক বিশ্বাসযোগ্য সমীক্ষা চালায়। কিছুদিন আগে এরকম আরেকটা সমীক্ষার রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। ইন্ডিয়ান স্কুল অফ ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজমেন্ট ও আইইম্প্যাক্ট ১০টি রাজ্যের ৩১টি জেলায় ৯৪২টি গ্রামে ৪৮১৯টি পরিবারের মধ্যে এক সমীক্ষা চালায় গতবছর মে-জুন মাসে। রাজ্যগুলো হচ্ছে, রাজস্থান, বিহার, হরিয়ানা, হিমাচল প্রদেশ, উত্তারাখন্ড, উত্তর প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, পশ্চিম বাংলা ও ঝাড়খন্ড। তারা এই সমীক্ষাটি প্রকাশ করেন, “এমার্জিং চ্যালেঞ্জেস ইন দ্য পোস্ট কোভিড কন্টেক্স্ট” শিরোনামে। সমীক্ষায় দেখা গেছে, গ্রামীণ ভারতে রুটি-রুজি খোয়ানো, খাদ্য ও পানীয় জলের সংকট এবং শিশু সন্তানদের শিক্ষার উপরই সবচেয়ে বড় আঘাত নেমে এসেছে। প্রায় ১৭ শতাংশ গ্রামীণ শ্রমজীবী কোনোক্রমে লকডাউনের সময়ে তাঁদের আয় ঠেকিয়ে রাখতে সমর্থ হলেও, ৯৬ শতাংশ পরিবার চার মাসের বেশি নিজের পায়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনি।

কেন্দ্রীয় সরকারের বহু ঘোষিত ‘প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ যোজনা’ নিদারুণ ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। মাত্র ১৯ শতাংশ পরিবার উক্ত প্রকল্প অনুযায়ী রেশন পেয়েছেন, আর ওই প্রকল্পের আওতায় অন্যান্য যে সুবিধা পাওয়া যায়, যেমন, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী প্রবীণ নাগরিকদের জন্য ভাতা ইত্যাদি তা পেয়েছে মাত্র ৩ শতাংশ পরিবার। সমীক্ষা থেকে জানা যায়, নিশ্চিত রোজগারের জন্য ৯২ শতাংশ মজুর নরেগার উপরই নির্ভরশীল। দেখা গেছে, ১০ টার মধ্যে ৯ টি পরিবারই অসংগঠিত ক্ষেত্রর উপর রোজগারের জন্য নির্ভরশীল আর ১০টার মধ্যে ৬ টি পরিবার দৈনিক মজুর বা অন্য রাজ্যে কাজের উপর নির্ভর করে থাকেন।

দেখা গেছে, শিক্ষাব্যবস্থায় যত উপর দিকে একজন উঠছে, ততই বেড়ে চলেছে স্কুল ছুটের সংখ্যা। অর্থাৎ, বেশিদিন আর পড়াশুনো চালিয়ে যাবার সামর্থ বহু পরিবারের নেই। দশটার মধ্যে একটা পরিবারে সর্বোচ্চ শিক্ষিত হল স্নাতক। ৪৪ শতাংশ পরিবারের সদস্য মাধ্যমিকের গন্ডি পার করতে পারেনি। দুই শতাংশ পরিবারের সদস্য কোনোদিনই স্কুলের চৌকাঠ মাড়ায়নি। এই তথ্য ২০১১-র সেন্সাসের তথ্যকেই প্রতিষ্ঠিত করে, যা দেখিয়েছিল, মাত্র ৮ শতাংশ ভারতীয় স্নাতক স্তর পর্যন্ত পড়ার সুযোগ পেয়েছে। এটাও দেখা গেছে, যারা যারা উচ্চ মাধ্যমিক বা কলেজ শিক্ষা সম্পূর্ণ করেছে তাঁদের জন্য স্থানীয় শ্রমবাজারে দৈনিক মজুরের কাজ ছাড়া আর কোনো সুযোগই নেই। প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন স্নাতক স্থানীয়ভাবে কারুর বাড়িতে পারিবারিক সহায়ক, দৈনিক মজুর বা অন্য রাজ্যে কাজের সন্ধানে পাড়ি দেয়।

এদিকে এই কোভিডকালে, মাত্র এক বছরের মধ্যে আর্থিক বৈষম্য কদর্য হারে বেড়েছে। একশ জন সবচেয়ে ধনী ভারতীয় গত এক বছরে যে সম্পদ কুক্ষিগত করেছে, তার দশ শতাংশ দেশের দরিদ্রতম মানুষদের মধ্যে বিতরণ করলে প্রত্যেকেই পেতেন ৯৪,০০০ টাকা। একদিকে এই অতি ধনীদের বিপরীতে ৩.২ কোটি মানুষ দারিদ্রের কবলে পড়েছেন আর ৭.৫ কোটি মানুষ নতুন করে যুক্ত হয়েছেন দারিদ্র সীমার নীচে। মাত্র এক বছরের এই করোনা কালে ভারতে অর্বুদপতিদের সংখ্যা ১০২ থেকে এক লাফে বেড়েছে ১৪০-এ। যে বছরে ভারতের জিডিপি ৭.৭ হারে সংকুচিত হয় সেই বছরেই এই অতি ধনীদের সম্মিলিত সম্পদের পরিমান লাফ দিয়ে বাড়ে ৯০.৪ শতাংশ হারে।

গত বছরের নজীরবিহীন মানবিক সংকট থেকেও সরকার কোনো শিক্ষাই নিল না। না রাজ্য না কেন্দ্র। আবার কোভিডের নতুন প্রকোপের সাথে সাথে পরিযায়ী শ্রমিকেরা ফিরতে শুরু করেছেন, তা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু, যে বিষয়টা সামনে আসছে না তা হোল, মহিলা পরিযায়ী শ্রমিকদের ভয়ঙ্কর বিপন্নতা। পরিযানের সময়ে মহিলা পরিযায়ীদের বিশেষ সমস্যা ও সংকটের প্রতি চোখ বন্ধ করেই রয়েছে সরকার। মহিলা জাতীয় কমিশনের তরফ থেকে কেন্দ্রীয় নারী ও শিশু বিকাশ মন্ত্রকের কাছে গত বছরই এক অ্যাডভাইজারী পাঠানো হয়, যাতে বিশেষ করে নারী শ্রমিক ও শিশুদের জন্য একপ্রস্থ কল্যাণমূলক পদক্ষেপের সুপারিশ করা হয়। মা ও শিশুদের নিশ্চিত খাদ্য, আশ্রয়স্থল থেকে বাড়িওয়ালা যাতে উচ্ছেদ না করে, সন্তানসম্ভবা মায়েদের জন্য পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহ, যৌন নির্যাতনের হাত থেকে সুরক্ষিত রাখা, প্রভৃতি সুপারিশগুলো প্রায় কোনো রাজ্য সরকারই বিন্দুমাত্র সাড়া দিল না। রাষ্ট্রনায়কদের অপরাধসম উদাসীনতা ও নির্লিপ্তি পরিস্থিতেকে আরও ঘোরালো করে তুলছে। সরকারী নির্লিপ্তির জন্য উত্তর প্রদেশে লাগামহীন কোভিড সংক্রমণের বিস্তার দেখে এলাহাবাদ হাই কোর্ট রাজ্য সরকারকে তুলোধোনা করে ৫টি শহরে লকডাউন ঘোষণা করে দিল আগামী ২৬ এপ্রিল থেকে। ১৩৫ কোটির বেশি জনসংখ্যার দেশ এই ভারতবর্ষে এখনো পর্যন্ত মাত্র ১.১৯ শতাংশ মানুষ টিকা নিতে পেরেছেন। অক্সিজেনের আকালের জন্য সরকারি হাসপাতালগুলোতেও কোভিড আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু হচ্ছে। কোভিডের এই মারাত্বক দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় মোদী সরকার প্রত্যাহার করে নিল ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য ৫০ লক্ষ টাকার জীবনবীমা প্রকল্পটি। এর আগে কেন্দ্র চুপিসাড়ে বন্ধ করে দিয়েছে ‘প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ যোজনা’য় পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য বিনামূল্যে বাড়তি রেশনের প্রকল্প। এদিকে, রেমডেসিভিয়ার ওষুধ নিয়ে যে কালোবাজারি শুরু হয়েছে তাতে এবার হাতে নাতে ধরা পড়লো মহারাষ্ট্রের প্রাক্তন বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী।

রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোকে আরও মজবুত করা, সরকারী চিকিৎসাকে আরও বিস্তৃত করে ব্যাপকতম নাগরিককে তার আওতায় নিয়ে আসা, কাজ হারানো মানুষ ও আয়কর আওতার বহির্ভূত মানুষদের জন্য আর্থিক সাহায্য প্রদান প্রভৃতি একগুচ্ছ ত্রাণ প্রকল্প ঘোষণা করার বদলে মোদী সরকার উল্টো পথে হেঁটে দেশের সমস্ত সম্পদকেই বিক্রি করে দিতে শুরু করলো কর্পোরেটদের হাতে।

গোটা দেশ যখন অতিমারির দ্বিতীয় ঢেউতে বেসামাল, দেশের প্রধানমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী তখন দেশবাসীর এই চরম দুর্দিনে নিজেদের দায়িত্ব থেকে সরে বাংলা দখল করতে মরিয়া হয়ে যুদ্ধে সামিল হয়েছে। সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করার এই জঘন্য খেলার পরিণতি যে কোথায় নিয়ে যাবে, তা ভবিষ্যতই বলবে।

-- অতনু চক্রবর্তী 

খণ্ড-28
সংখ্যা-15