নারী-বিদ্বেষ বিজেপি আরএসএস-এর মূল মতাদর্শ
ideology of the BJP

পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনের প্রথম পর্ব অতিক্রান্ত। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার নিজের সব শক্তি প্রয়োগ করে এই নির্বাচন জিততে বদ্ধপরিকর। নির্বাচনের কিছুদিন আগে বিজেপি নিজেদের ম্যানিফেস্টো প্রকাশ করেছে। আমাদের আজকের আলোচনা পশ্চিমবঙ্গের সেই সব মানুষের জন্য যারা মহিলাদের সহনাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেন এবং মহিলাদের সমানাধিকার কামনা করেন। এই সময় দাঁড়িয়ে আমাদের আলোচনা বিজেপির মহিলাদের প্রতি মনোভাব এবং এবিষয়ে তাদের ট্র্যাক রেকর্ড নিয়ে।

ঐতিহাসিকভাবে এবং বর্তমানেও মহিলারা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছেন, নিজেদের অধিকার সম্বন্ধে সোচ্চার থেকেছেন। বিজেপি পরাজিত হলেই শুধুমাত্র আগামীদিনেও মহিলারা স্বেচ্ছায় নিজেদের জীবনের সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন এবং নিজেদের অধিকার রক্ষা করতে পারবেন।

বিজেপির ম্যানিফেস্টোয় “এবার বিজেপি” স্লোগানে ২০১৪ সালের প্রতিশ্রুতিই আবারো ঘুরে এসেছে। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলির জনতা সেই “সুশাসন”-এর ভুক্তভোগী। বিজেপির ম্যানিফেস্টোয় “এবার মহিলা, এবার বিজেপি” স্লোগানের আড়ালে বিজেপির আসল চেহারা তাদের ম্যানিফেস্টো থেকেই বুঝে নেওয়া যাক। ম্যানিফেস্টোয় বিজেপি লিখেছে তারা চাকরির ক্ষেত্রে মহিলাদের ৩৩ শতাংশ সংরক্ষণ দেবে। বিধানসভা, লোকসভা, চাকরিক্ষেত্র মিলিয়ে প্রত্যেকটি রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে মহিলাদের ভাগিদারী বাড়াতে এসবক্ষেত্রে মহিলাদের জন্য সংরক্ষণের দাবি মহিলামুক্তি সংগঠনগুলি বহুদিন থেকে তুলে এসেছে। কিন্তু, বিজেপির এরকম প্রতিশ্রুতি ভাঁওতাবাজি ছাড়া আর কিছুই না। কারণ কেন্দ্র সরকার সহ উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট, ত্রিপুরা ইত্যাদি বহু রাজ্যেই বিজেপি শাসনে রয়েছে কিন্তু কোন ক্ষেত্রেই মহিলাদের জন্য সংরক্ষণ করেনি বিজেপি। ২০১৪ সাল থেকে এই সাত বছরের শাসনে বিগত ৪৫ বছরের তুলনায় বেকারত্বের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি হয়েছে। সরকারি তথ্য ও বিভিন্ন সার্ভেথেকে পরিষ্কার, এর মধ্যেও মহিলাদের বেকারত্বের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। লকডাউনে চাকরি হারিয়েছেন যারা তাদের মধ্যে ৫০ শতাংশের বেশি মহিলা। কেজি থেকে পিজি পর্যন্ত সব মহিলাকে বিনামূল্যে পড়ানোর কথাও ম্যানিফেস্টোয় লিখেছে বিজেপি। বিনামূল্যে শিক্ষার অধিকার এদেশের সব নাগরিকের। গত বছর জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা ফি বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলে এবং দিল্লী পুলিশ ও এবিভিপি এই ছাত্রছাত্রীদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালায়। হামলায় ঘায়েল হন জেএনইউএসইউ-এর তৎকালীন সভাপতি কমরেড ঐশী ঘোষ সহ আরও বহু ছাত্রছাত্রী। তিনি সেই ক্ষতচিহ্ন মাথায় নিয়েই জামুড়িয়া থেকে নির্বাচনে লড়ছেন। বিজেপির নয়া শিক্ষানীতি বহাল হলে দেশের সরকারী কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে তালা পড়বে। সরকারী স্কুলকলেজ বন্ধ হলে ভুক্তভোগী হবেন মূলত মহিলারা কারণ সাধারণ পরিবারের মহিলাদের জন্য বেসরকারী কলেজে পড়ার খরচ বরাদ্দ থাকে না। সুতরাং, শিক্ষাক্ষেত্রে মহিলাদের প্রাধান্য দেওয়ার বিজেপির এই দাবি সম্পূর্ণ মিথ্যে। মহিলাদের রাষ্ট্রায়ত্ত যানবাহনের খরচ মুকুব করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বিজেপি তার ম্যানিফেস্টোয়। কিন্তু দিল্লীতে কেজরিওয়াল সরকার এই কাজ করায় সোচ্চার আপত্তি জানিয়েছেন শুধুমাত্র বিজেপি নেতারাই। তাদের দাবি এর ফলে সরকারের বহু অদরকারী খরচ বেড়ে যাবে।

মহিলাদের ক্ষুদ্র ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে তারা। কিন্তু লকডাউন পর্বে চাকরি চলে যাওয়া, দৈনন্দিন জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ক্ষুদ্রঋণের বোঝায় জর্জরিত বাংলার মহিলারা। তারা বারবার এই ঋণ মুকুবের দাবি জানিয়ে বিফল হয়েছেন। এই ঋণ যে সংস্থাগুলি দিয়েছে, তাদের দালালরা এখন বাড়ি বাড়ি গিয়ে শারীরিকভাবে হেনস্থাও করছে মহিলাদের। বিজেপির ম্যানিফস্টোর ভাঁওতাবাজি সামনে আসবে যখন ঋণমুক্তি কমিটি বিজেপির প্রচারদলের কাছে জবাব চাইবে। আশা-অঙ্গনবাড়ি সহ আমাদের দেশের বেশিরভাগ স্কিম কর্মীরাই মহিলা। কিন্তু তাদের মজদুরের অধিকারটুকু দেয়নি কেন্দ্রের বিজেপি সরকার।

নির্বাচনী প্রচারে বাংলায় এসেছিলেন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। আজ থেকে ৩ মাস আগে তার রাজ্যের হাথরাসে ধর্ষিতা দলিত বালিকার শরীর তার পরিবারের অনুমতি না নিয়েই পুড়িয়ে ফেলে উত্তরপ্রদেশ পুলিশ। এই ঘটনা ঘটে যোগীর নির্দেশে, ধর্ষণের প্রমাণ লোপাটের জন্য। উত্তরপ্রদেশের উন্নাওয়ে বিজেপির নেতা কূলদীপ সিং সেঙ্গারের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনেন এক যুবতী। পরিণতিতে তাঁর বাবাকে পুলিশি হেফাজতে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। জম্মুর কাঠুয়ায় আট বছরের বালিকার ধর্ষকের সপক্ষে মিছিল বের করে বিজেপি। ধর্ষকের সপক্ষে মিছিল করা, ধর্ষিতার পরিবারকে রাষ্ট্রীয় হেনস্থা ও নির্যাতনই বিজেপি শাসনের স্বরূপ। নরেন্দ্র মোদীর নিজের লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত বারানসিতে বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটির এক ছাত্রী ২০১৭ সালে তার বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ আনলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোক্টর জানান সন্ধ্যে ছটার সময় বাইরে গেলে এরকম ঘটনাই স্বাভাবিক। এর পরিপ্রেক্ষিতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ব্যাপক আন্দোলন গড়ে ওঠে। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ নতুন ছাত্রীদের দিয়ে মুচলেকা লেখায় যাতে তারা পড়াশোনার বাইরে অন্য কোনো কাজ না করে, তাদের ওপর যত যৌন হেনস্থাই হোক না কেন তারা যাতে প্রতিবাদ না করে। প্রসঙ্গত উল্ল্যেখ্য, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শুধুমাত্র মেয়েদের হোস্টেলে সম্পূর্ণ নিরামিষ খাবার দেওয়া হয়, কারণ নরেন্দ্র মোদী সহ বিজেপি সরকার মনে করেনা মহিলারাও পুষ্টিকর খাবারের অধিকারী। আশারাম বাপুর ওপর ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও টুইট করে তাকে সমর্থন জানান বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতা সুব্রমনিয়ম স্বামী। হরিয়ানার ধর্মগুরু বাবা রামরহিমের বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও যৌন নিগ্রহের অভিযোগ এনেছেন বহু মহিলা। কিন্তু এই বাবার সাম্রাজ্য বিস্তারের পেছনে পূর্ণ মদত দিয়েছে বিজেপি। এমনকি হরিয়ানা নির্বাচনের আগে মঞ্চে উঠে তার কাছে আশীর্বাদ নিয়ে যান খোদ নরেন্দ্র মোদী।

এর পরেও কারোর মনে হতে পারে এই ঘটনাগুলি সেই রাজ্যের নেতৃত্ব ও শাসনতন্ত্রের গাফিলতি। কিন্তু বিজেপির কেন্দ্রীয় মতাদর্শ ভয়ানকভাবে মহিলাবিরোধী। যোগী আদিত্যনাথ একটি প্রবন্ধে লেখেন মহিলারা স্বাধীনভাবে সমাজে বেঁচে থাকার যোগ্য নন। কারণ মহিলারা বিয়ের আগে তার বাবার অধীন, বিয়ের পর স্বামীর অধীন এবং বৃদ্ধ বয়সে ছেলের অধীন। মনুসংহিতার বিধান। আদিত্যনাথের এই মতো বিজেপি-আরএসএসের কেন্দ্রীয় মতাদর্শ। ১৯৫০ সালে বাবাসাহেব আম্বেদকর যখন হিন্দুকোড বিলের মাধ্যমে বিবাহিত মহিলাদের পৈতৃক সম্পত্তির ওপর অধিকার দেওয়ার জন্য আইন আনার চেষ্টা করেন, তখন দেশ জুড়ে তার বিরোধিতা করেছিল আরএসএস। আজকের ধর্ষকদের নিরাপত্তা প্রদানকারী, চূড়ান্ত মহিলাবিরোধী মোদী-যোগী-দিলীপ ঘোষ এই আরএসএস-এরই বংশজ। আরএসএস-এর পূর্ব সভাপতি মোহন ভাগওয়াতের মতে হিন্দু মহিলাদের একমাত্র কাজ অজস্র সন্তানকে জন্ম দেওয়া, যাতে হিন্দুদের সংখ্যা মুসলিমদের থেকে বেশি হয়। এই মতাদর্শের সূত্রও পাওয়া যায় আজ থেকে হাজার বছর আগে লেখা মনুস্মৃতি থেকে। যেখানে লেখা আছে, শূদ্র এবং মহিলারা সমান মর্যাদাসম্পন্ন মানুষ নন, তারা পুরুষের পায়ের তলায় থাকারই যোগ্য। মনুস্মৃতিবাদী বিজেপি তাই আজকেও অনলাইনেও কোনো মহিলা নিজের অধিকারের স্বপক্ষে বক্তব্য রাখলে তাকে অশ্রাব্য গালিগালাজ করে।

বাংলার মহিলারা সরকারী স্কুলে কলেজে পড়বেন, নিজের ইচ্ছায় নিজের পেশা বাছবেন, নিজের সাথী খুঁজবেন। কোনো মোহন ভাগওয়াত, দিলীপ ঘোষ বা নরেন্দ্র মোদী মহিলাদের ভাগ্য নির্ধারণ করে দেবে না। বিজেপি নিজের ম্যানিফেস্টোর মিথ্যে প্রতিশ্রুতি নিয়ে প্রচারে এলেও বাংলার মহিলারা জবাব চাইবে, বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে মহিলাদের এই দুরবস্থা কেন। তারা সোচ্চারে ঘোষণা করবে বাংলায় মহিলা-বিরোধী বিজেপির ঠাঁই হবে না।

- সুচেতা দে 

খণ্ড-28
সংখ্যা-12