বাংলার ঐতিহাসিক গণ রায়, শিক্ষা ও কর্তব্য
Historical mass verdict

বাংলার বিধানসভার নির্বাচন রাজনৈতিক ও সামাজিক ভাবে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। টানটান উত্তেজনা এবং অনেক ধরনের বিচার বিশ্লেষন, হুমকি, ভয়ভীতি প্রদর্শন করা সবই চলেছে। নির্বাচন কমিশন, সমগ্র কেন্দ্রীয় সরকার, কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার প্রধান প্রধান মন্ত্রী, সিবিআই, গোয়েন্দা বিভাগ, কেন্দ্রীয় বাহিনী সকলকে কাজে লাগানো হয়েছে। ৮ দফা নির্বাচন, সবকিছু করেও আরএসএস ও বিজেপি বাংলা দখল করতে পারেনি। বাংলার জনগণের গণরায় ঐতিহাসিক এবং যা বাংলার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ফুটিয়ে তুলেছে। রাজনৈতিক বোধ ও পরিপক্বতার স্ফুরণ ঘটেছে। রায়ে, আমাদের বামপন্থী বন্ধুদের বিমূর্ত ও জোর করে সূত্রায়ন করা জমাটবন্ধ একটা ভুল ধারনা বাংলার জনগণ সম্পূর্ন প্রত্যাখ্যান করেছে। তা হল “মোদী ও মমতা” এক এবং “বিজেমূল” শব্দবন্ধের মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ভীষণ ভাবে ছোট করে দেখা হয়েছিল। দুঃখের বিষয় এবারেও বামপন্থী জনগণ ও কর্মীদের ২০১৯-এর মতো বিজেপির কোলে অনেক জায়গায় ঠেলে দেওয়া হয়েছে। কিছু জায়গায় অল্প ভোট হয়ত ফিরে এসেছে। আরও চিন্তার বিষয় তূণমূল কংগ্রেস বিরোধী প্রচার করেও তাদের গণভীতের একটা অংশ বিজেপিকে রুখে দিতে তূনমুল কংগ্রেসকেই ভোট দিয়েছেন। আমরা সিপিএমের নির্বাচনী দিশায় ও নেতৃত্বের ভাষণের মধ্যে বিজেপি-বিরোধী জোরালো অবস্থান দেখতে পাইনি বা তার কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি। নতুনতর জোট বা মোর্চা গঠনের ফলে কি হল তার কোন মূল্যায়ন এখনো অবধি দেখিনি। এই সব নিয়ে গভীর আত্মানুসন্ধান করা দরকার। বামপন্থার স্বার্থে তা প্রয়োজনীয়। কেন একজনও সিপিএমের প্রতিনিধি বা কংগ্রেসের প্রতিনিধি বিধানসভায় যেতে পারলো না। এত বড় ধরাশায়ী অবস্থা হবে তা কেন সিপিএমের নেতারা বুঝতে পারলেন না। আমরা বারবার বলেছিলাম বিজেপি বাংলায় মূল শত্রু, তারা তা মানেনি। বাংলায় তারা ক্ষমতায় আসতে চলেছে এই দিবাস্বপ্ন দেখানো হল। আজ তার অনুসন্ধান নীচের কমিটিগুলির ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা নীতিগত ভাবে বামফ্রন্টের ২০১৬ জয়ী আসনগুলিতে সমর্থন করেছিলাম। ভবিষ্যতে বামপন্থী আন্দোলনকে বাড়ানোর স্বার্থে। আমরা কখনোই সংকীর্ণতা দেখাইনি। আমরা তৃণমুল কংগ্রেসের সাথে কোনো আঁতাত করিনি। তা স্বত্বেও কিন্তু আমাদের বিরুদ্ধে বামপন্থীদের কাছ থেকে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে অনেক ধরনের নেতিবাচক পোস্ট দেখতে হয়েছে। যা অবশ্যই ভালো নয়। এত অনীতিনিষ্ঠ বিতর্ক ও ব্যক্তিগত আক্রমণ বামপন্থী বিতর্কে আমরা কখনোই দেখিনি। কোন কোন সিপিএমের কর্মী ও সমর্থক যেভাবে আমাদের পার্টির প্রতিটি কথার ওপর বিরুপ মন্তব্য করছেন, তা বামপন্থী অভিধানে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আজকে অনেক কিছু ভাবতে হচ্ছে, বামপন্থী সংস্কৃতিকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হলো। দায়িত্বহীনভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় এই সব কেন করতে হচ্ছে তারাই বলতে পারবেন। জানি না বাংলার গণরায়কে কেন ইতিবাচক হিসাবে দেখা হবে না। জনগণের কাছে থেকে কিছু নেওয়ার থাকে না বলে মনে করছেন। তা না দেখলে কোন শিক্ষা নিতেপারা যায় না। বামফ্রন্টের ক্ষমতায় থাকার চশমা যতদিন না সরাবে, ততদিন পরিস্কার ও স্বচ্ছ ভাবে দেখতে পারবেন না বাস্তব জীবনে কি হচ্ছে।

যে সমস্ত ভুল পদক্ষেপের জন্য ২০১১ সালে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। ২০০৬ সালের বিজয়, আমরা ২৩৫, বলপূর্বক কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর স্বার্থে জমি অধিগ্রহণ ও তার পরিণতি ২০১১ বিধানসভা নির্বাচনে আমরা দেখলাম। আজও তার গভীরে গিয়ে আত্ম সমালোচনা হল না। নির্বাচন হল আমাদের নীতিমালা ও কাজের বিচারের আয়না। যেখানে আসল ছবি উঠে আসে। শুধু ‘চক্রান্তের তত্ব’ কথা বলে অনুসন্ধানকে কানাগলিতে নিয়ে যাওয়া যায়। যাক সে কথা। আমরা সবাই দেখলাম জনগণ এবং একমাত্র জনগণই ইতিহাস সৃষ্টি করে তা আবারও আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে। মোদীর "আসল পরিবর্তনের" আহ্বান বা তাদের “ভেক গনতন্ত্রের” দাবি ধোপে টেকেনি। ছল চাতুরী করে, কৃত্রিম ভাবে বা মিথ্যার বেসাতি করে কোনো মহৎ কাজ করা যায় না। আমাদের বাংলার এই নির্বাচনের ফলাফলে এটাও বোঝা দরকার কংগ্রেসের ‘জরুরী অবস্থা’ জারীর পর ৭৭ সালের নির্বাচনে কংগ্রেসের জাতীয় বিপর্যয়ের পালা শুরু হয়েছিল। কংগ্রেস তার জাতীয় ভাবমূর্তি হারিয়ে ফেলেছিল। সেই অবস্থা থেকে কংগ্রেস আর ফিরে আসেনি। বর্তমানে বিজেপির বাংলায় নির্বাচনী রায় এই রকম একটা সুদূর প্রসারি প্রভাব ফেলবে। ইতিমধ্যে তার প্রকাশ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। গত বিহার বিধান সভার নির্বাচন থেকে শুরু, সাথে সাথে ত্রিপুরা ও উওরপ্রদেশের স্থানীয় পঞ্চায়েত নির্বাচন। একই প্রবনতা দেখা যাচ্ছে। কয়েক মাস পর কয়েকটি রাজ্যে নির্বাচনে মোদী ও শাহ ম্যাজিক আর কাজ করবে না। ইতিমধ্যে মোদী ভাবমূর্তি ধাক্কা খেতে শুরু করেছে। তা মেরামত করা শুরু করতে হয়েছে। মোদীর কুমিরের কান্নাকেও মানুষ চিনতে ভুল করেনি। ভারতবর্ষের কৃষি ও কৃষককে কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া, শ্রমিক-কর্মচারীদের লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে অর্জিত অধিকার কেড়ে নেওয়া, জাতীয় সম্পদ কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়া এবং সর্বপরি দেশের স্বকীয়তা ও গণতান্ত্রিক কাঠামোগুলো ভেঙে দেওয়া, সংবিধানকে নিজের মতো ব্যবহার করা, প্রভৃতি দিকগুলির জন্য দেশের জনগণ আর মোদী ও বিজেপিকে মেনে নিতে পারছেন না। নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর সোশ্যাল মিডিয়াতে এবং বিভিন্ন বুদ্ধিজীবিদের লেখাতেও মোদীর পদত্যাগের আওয়াজ উঠেছে। এই গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক রায় থেকে আমাদের সবার শিক্ষা নেওয়া উচিৎ।

বাংলার জনগণের এই ঐতিহাসিক রায়কে ইতিবাচক হিসাবে বিচার করা উচিৎ। যে সমস্ত রাজনৈতিক পার্টি এবং জাতীয় সংযুক্ত কৃষক মোর্চার নেতৃত্ব বাংলায় কলকাতা, নন্দিগ্রাম, সিংগুর, শিলিগুড়ি সহ বাংলার বিভিন্ন জেলায় বিজেপিকে ভোট না দেওয়ার আবেদন করে গেছেন। সাংবাদিক সন্মেলন করেছেন। বিভিন্ন বিপ্লবী সংগঠন, লিবারেল বাম, বিভিন্ন ধরনের বিজেপি বিরোধী শক্তি সংগঠন, ব্যক্তি এই প্রশ্নে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন তাদের অভিনন্দন জানিয়ে আগামী দিনের জন্য কথা হোক। এই গণরায়ের ফলে নতুনভাবে যে সরকার এসেছে তাতে যে সমস্ত শক্তি যারা বিজেপির বিরুদ্ধে প্রচার করেছে তাদের প্রচারের ভোটও আছে। মূলত বিজেপি বিরোধি ভোটই তূণমুল কংগ্রেস পেয়েছে। এটা মনে রাখা দরকার এবার বিধানসভায় বিরোধী পক্ষ একমাত্র বিজেপি, তারা ৩ জন থেকে ৭৭ বিধায়ক হয়েছে। তাদের দিক থেকে ভালো। যারা তূনমুল কংগ্রেস বিরোধী প্রচার করে এবং নতুন ধরনের জোট করেও ব্যর্থ হয়েছে, কংগ্রেস ও বামপন্থীদের কোন প্রতিনিধি নেই। গভীর চিন্তার বিষয়। কিন্তু বিজেপির ফ্যাসিবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে লাগাতার প্রচার করে একটা শক্তি হিসাবে নিজেদের তুলে ধরেছে, আজকে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে হবে। এবং বিধানসভার বাইরে সক্রিয় বিরোধী ভূমিকা নিতে তাদের অবশ্যই এগিয়ে আসতে হবে। বিশেষ করে বিজেপি বাংলায় ক্ষমতা না পাওয়ার জন্য গণরায়ের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসামূলক রাজনীতির পথে নেমেছে। গভীর ষড়যন্ত্র করে কখনো সিবিআই দিয়ে, কখনো প্রশাসনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারকে বিভিন্নভাবে অসুবিধায় ফেলে দেওয়ার প্রচেষ্টা চলছে। বিজেপির বাংলা দখল খুবই পরিকল্পিত ছিল হিন্দু ও মুসলিমদের ভোটে মেরুকরণ করানো, তার জন্য বাংলার সংস্কৃতিকে অবজ্ঞা করা, বাংলার ঐতিহ্যপূর্ন বিভিন্ন দিককে হেয় করা, বাংলার প্রতিষ্ঠিত কবি, লেখক, বুদ্ধিজীবীদের সরাসরি আক্রমণ করা আমরা লক্ষ্য করেছি। এর সাথে সাথে কিছু জিনিস আমাদের ভাবতে হবে। যেমন, বাংলার ভোটের কিছু দিক অস্বীকার করা যায় না। তপশিলী ভোটে বিভিন্ন জেলায় (যারা একটা সময়ে বামপন্থীদের ভোট ব্যাঙ্কে ছিল) বিজেপি বড় থাবা বসিয়েছে। উত্তরবাংলার রাজবংশী জনগণের ভোটও ভালো পরিমাণে বিজেপির দিকে গেছে। যদিও মতুয়াদের ভোট নাগরিকত্ব দেওয়ার ইস্যুকে সামনে নিয়ে এসে বিজেপিতে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা অনেকটা ভেস্তে গেছে। ইতিমধ্যে ঠাকুর বাড়ি দুটো ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। তূণমুল কংগ্রেসের মথুয়াদের মধ্যে ভালোই ভোট বৃদ্ধি হয়েছে। সংখ্যালঘুদের ওপর তূণমূলল কংগ্রেসের প্রভাব বরাবরই ছিলো, বিজেপির ফ্যাসিবাদী রাজনীতির হামলার প্রেক্ষিতে সংখ্যালঘুরা আরও ঐক্যবদ্ধ হয়ে উঠে। যদিও তাদের বিভাজিত করার চেষ্টা করে আমাদের বামপন্থী বন্ধুরা, কিন্তু করেও তাতে কিছু লাভ হয়নি। ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে আদিবাসী জনগণের ভালো অংশকে বিজেপি টেনে নিতে সমর্থ হলেও এবারে তৃণমূলের কিছু সংস্কার কর্মসূচী ও সোশ্যাল কাজের জন্য তৃণমূল কংগ্রেস নিজেদের দিকে আদিবাসী জনগণকে বেশ কয়েকটি জেলায় টেনে নিতে সমর্থ হয়। ঝাড়গ্রামের তৃণমূল কংগ্রেস সাফল্য তা দেখিয়ে দিচ্ছে। মালদা এবং মুর্শিদাবাদে কংগ্রেসের ভিত বা ভোট তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে চলে গেছে। এবারের ভোটে মহিলাদের অংশ গ্রহণ বেশ লক্ষ্যণীয়ভাবে বেড়েছে। ভোটার সংখ্যা মহিলা ও পুরুষের প্রায় সমান। মোদী বিভিন্ন সময় মমতা ব্যানার্জিকে অসন্মান, ও ব্যঙ্গ করে “দিদিও দিদি” এবং তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছে। এবারে তৃণমূল কংগ্রেসের দিকে মহিলাদের ভোট ভালো পরিমাণে বেড়েছে। আমরা যদি আসন সংখ্যার দিকে তাকাই তাহলে দেখা যাচ্ছে, ভোটের ফলাফলে ২০১৬, বামফ্রন্টের আসন সংখ্যা ছিল ৩২, সেখান থেকে ৯টাতে জয়ী বিজেপি , আর তৃণমূল কংগ্রেসে চলে গিয়েছে ২৩টা। আর কংগ্রেসের আসন সংখ্যা ছিলো ৪৪, তার মধ্যে বিজেপি পেয়েছে ১৫টা। তৃণমূল কংগ্রেস পেয়েছে ২৯টা। অন্যদিকে গতবারের তৃণমূল কংগ্রেসের ২০৯ এর মধ্যে থেকে ধরে রাখতে সমর্থ হয়েছে ১৬০টা আসন। বাকি যে সাফল্য পেয়েছে মূলত বাম জোটের থেকে ৫২ আসন পেয়ে। ২০১৪ ও ২০১৯ সালে বামফ্রন্টের হারানো আসন থেকে বিজেপি ও তৃণমুল কংগ্রেস সমান সমান, মহিলা ভোটের ৫০% তৃণমূল কংগ্রেস পেয়েছে, বিজেপি ৩৬%. এই ধরনের ছবি দেখা যাচ্ছে। বাংলার ভোটে এই বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দিকগুলো ছাড়াও বাঙালির ভাবাবেগ কাজ করেছে। তার যথেষ্ট কারণ আছে। বিজেপি যেভাবে বাংলার ঐতিহ্যকে লাগাতার আক্রমণ করেছে তাতে সেটাই স্বাভাবিক। সঙ্ঘ’র মুখপত্র, স্বীকার করে নিয়েছে “মোদী ও অমিত শাহ বাংলায় বাঙালির সাথে খাপ খাওয়াতে পারেনি।” বাংলার জনগণের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বোধ এবং রাজনৈতিক চেতনা বিজেপির সাথে মিলবে না। তাই ফ্যাসিবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়াই জোরদার করতে, যে সমস্ত ইতিবাচক দিক আমরা লক্ষ্য করেছি তাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে আমাদের পরিকল্পিত ভাবে কাজ করতে হবে। বিজেপি এখনো ষড়যন্ত্র করে চলেছে যাতে বাংলায় আইনশৃঙ্খলা অবনতি ঘটেছে এটা দেখানো যায়। নতুন সরকার যাতে কাজ শুরু করতে না পারে।

তাই আগামী দিনের লক্ষ্যে আমাদের কি কি করণীয় কাজ করতে হবে, তা নির্ধারণ করা খুবই জরুরী। ইতিবাচক চর্চা শুরু হয়েছে, পথে নামাও শুরু হয়েছে। কেন্দ্র সরকার বাংলায় কোভিড পরিস্থিতিতে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা বজায় রেখে, মৃত্যুর সংখ্যা বাড়িয়ে, মানুষকে বিপদে ফেলে, গণরায়কে নস্যাৎ করতে তৎপর। আমরা এখনো দেখছি, আমাদের কিছু বন্ধুরা এই রায়কে ইতিবাচক হিসাবে নিতে পারেনি। কিছু কিছু মন্তব্য বিজেপির সাথে মিলে যায়, তবে হ্যাঁ, তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের কয়েকজন নেতা ও মন্ত্রীদের সিবিআইএর গ্রেফতারি নিয়ে, কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিহিংসা মূলক রাজনীতির বিরুদ্ধে সিপিএম নেতৃত্ব বক্তব্য তুলে ধরেছে। ভালো, বোধদয় ঘটবে আশা রাখি। বিধানসভার বাইরে বিরোধী হিসাবে বড় ভূমিকা আমাদের মতো পার্টিকে, অন্যান্য ইতিবাচক দল ও শক্তিগুলিকে নিতে হবে। রায়ের বৈশিষ্ট্যগুলো বিচার করে দেখা যাচ্ছে, বিজেপি গরিবের মধ্যে কিছু জায়গা করেছে। ২০১৯-এর পর থেকে শুরু হয়েছে। বিজেপির মুসলিম বিদ্বেষ রাজনীতি ও হিন্দুত্ববাদী প্রচার ও কমিউনিস্ট বিরোধী প্রচার।

কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার বিরোধী জনগণের জীবন্ত দাবি দাওয়া যুক্ত করে কৃষক জনগণের আন্দোলনে ইতিবাচক গুরুত্ব দেওয়া দরকার। আমরা দিল্লির কৃষক আন্দোলনে দেখলাম, ইউপির যারা একসময় দাঙ্গায় জড়িয়ে পড়েছিলেন, তারাই এই কৃষক আন্দোলনে সামনে এসে মোদী ও বিজেপি বিরোধী আন্দোলনে রাজনৈতিক শক্তি হয়ে উঠে এসেছে। আমরা আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখি, কৃষক তার ইস্যু নিয়ে লড়াইয়ের ময়দানে হিন্দু ও মুসলিম বিচার করে না। বাংলার কৃষক আন্দোলন ও শহর-গ্রামে, শ্রমিক মেহনতী জনগণকে শক্তভাবে সামিল করে এগিয়ে যেতে হবে। শ্রেণির মানুষের মধ্যে যে জায়গা আরএসএস ও বিজেপি করেছে, তাকে শ্রেণীগতভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলনের মাধ্যমে তাকে প্রতিহত করতে হবে। যা বাংলায় জরুরি। বাংলায় এই ঐতিহ্য আছে, তাকে জাগিয়ে তুলে সচেতন প্রচেষ্টার বিস্তার ঘটাতে হবে। আজকের পরিস্থিতিতে বামপন্থীদের আন্দোলনকে এই দিশায় পরিচালিত করা ও সময়োপযোগী। প্রয়োজনবাদী দিক থেকে বা জনবিচ্ছিন্ন কোনো আন্দোলনে ইতিবাচকভাবে জনগণের সাড়া পাওয়া যায় না।

দ্বিতীয়ত, জেলায় জেলায় বিভিন্ন ধরনের, প্রগতিশীল শক্তি, লিবারেল বাম ও বামমনস্ক ব্যক্তি ও সংগঠন এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও দল, যারা প্রগতিশীল কাজকর্ম করেন, এই ধরনের মানুষজনকে নিয়ে কেন্দ্র ও বিজেপি বিরোধী আলোচনা সভা ও আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার। জনমত গড়ে তোলার জন্য আজই ও এখনই উদ্যোগ দরকার। একটি গুরুত্বপূর্ণ রায় বাংলা দিয়েছে, এটাকে ধরে বিভিন্ন ইস্যুতে সচেতন প্রচেষ্টা না থাকলে মানুষের মন অন্য খাতে বয়ে যায়। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে তাকে এখনই একটা বাস্তবে রূপ দিতে হবে।

তৃতীয়ত, এবারের নির্বাচনে মহিলাদের ব্যাপক অংশ গ্রহণ হয়েছে। বিজেপি মহিলাদের যেভাবে সামন্ততান্ত্রিক দৃষ্টিতে বিচার করে তাতে বিজেপিকে দেওয়া মহিলাদের ভোটের হার খুবই কম। স্বাভাবিক ভাবেই এই মহিলাদের সংগঠিত করা উচিৎ। শুধু মহিলা ইস্যু নয়, অন্যান্য বিষয়ে মহিলাদের সামিল করার মনোভাব নিতে হবে। সমাজে মহিলাদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বিজেপিকে বাংলায় রুখে দিতে মহিলাদের সক্রিয় ভূমিকা থেকেছে। মূখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে গ্রামে গ্রামে মহিলাদের অবমাননা করার যোগ্য জবাব বিজেপি পেয়েছে।

চতুর্থত, বাংলার কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক দল ও ব্যাক্তিদের বিজেপি বিরোধী বড় ভূমিকা দেখা গিয়েছে। বিজেপি নেতাদের কাছ থেকে এদের সরাসরি অপমানিত হতে হয়েছে। এই গণরায়ের ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা অস্বীকার করতে পারি না। আমরা কবি শঙ্খ ঘোষ ও ডক্টর অমর্ত্য সেনকে বিজেপির ফ্যাসিবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে সরাসরি কথা বলতে দেখেছি। নাট্যকার কৌশিক সেনের প্রতিবাদী ভূমিকাও নজর কাড়ে। বাংলার এই ঐতিহ্য আজও সচল-সজাগ। বাংলায় একুশের ডাকে সাড়া দিয়ে নাট্যকার, কবি ও সাংস্কৃতিক সংগঠন সহ অনেকেই সামিল হয়েছেন। তাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সচেতন প্রচেষ্টা খুবই দরকার। এই সমস্ত উপাদানগুলি বাংলার ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এবং বিজেপি বিরোধী ভূমিকাকে সামাজিক রূপ দিতে পারে। আমাদের বাংলার এই ধরনের আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যেতে হবেই। বিজেপির সংবিধান বিরোধী ও দেশের জনগণের শত্রুর মতো কাজ করে, তারাই আন্দোলনকারী নেতা ও কর্মীদের দেশদ্রোহী হিসাবে চিহ্নিত করে। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে যাদের কোনো যোগসূত্র নেই, তারাই নিজেদের দেশপ্রেমিক হিসাবে ঘোষণা করে। বাংলার জনগণ স্বাধীনতা যুদ্ধের সাথে ঐতিহাসিক ভাবে যুক্ত। যেখানে বিজেপির কোনো স্থান নেই।

পঞ্চমত, বিজেপি-বিরোধী প্রচারে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছেন ছাত্র ছাত্রী সহ যুব সমাজের বড়ো অংশ। এই ধরনের আন্দোলনে তাদের অগ্রনী ও সচেতন প্রচেষ্টায় এই আন্দোলনে নতুন মাত্রা দিয়েছে। রায় থেকে শিক্ষা নিয়ে তারা এখন কোভিড অতিমারীতে সেবায় নেমে পড়েছে। রাতদিন তারা কোভিড যুদ্ধের সৈনিক হিসেবে সক্রিয়। ফ্যাসিবাদের রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাথে সাথে মানুষের সেবায় এগিয়ে যাওয়ার রাস্তায় সংকল্পবদ্ধ হওয়া দরকার। পরিশেষে, আবারও বলতেই হয় বাংলার গণরায় ঐতিহাসিক এবং বাংলা বিজেপিকে রুখে দিয়েছে, কিন্তু ওরা ৩ থেকে ৭৭ হয়েছে। সেটা মাথায় নিয়েই আমাদের এগুতে হবে। বাংলার গণরায় আমাদের দায়িত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। বামপন্থী আন্দোলন নবরুপে উত্থান জরুরী। রাজ্যে গণরায়ে যে সরকার এসেছে, তার সাথে জনগণের দাবি দাওয়া নিয়ে লড়াইকে জারী রাখতে কোনো দ্বিধার জায়গা নেই। কেন্দ্র সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই জারি রেখে, আন্দোলনকারী বিরোধী পক্ষ হয়ে উঠতে হবে।

-- কার্তিক পাল 

খণ্ড-28
সংখ্যা-19