প্রতিবেদন
দাবি একটাই : ক্যাম্পাস খোলা চাই
The demand is the same

আজকের দিনে দাঁড়িয়ে মাথায় রাখতে হবে, ২০২০ সালের ১৬ মার্চ থেকে শুরু করে এখনও পর্যন্ত স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় সহ এই দেশের অধিকাংশ শিক্ষাক্ষেত্র বন্ধ হয়ে আছে। এক অপরিকল্পিত লকডাউন যা দেশের মানুষের জন্য মহামারীর থেকেও ভয়ানক বিপর্যয় ডেকে এনেছে তাতে আমরা দেখেছি সবথেকে দুর্যোগের মুখে পড়েছে এই দেশের খেটে খাওয়া মানুষ। পরিবারের সাথে হাজার হাজার মাইল পায়ে হেঁটে পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরার ছবি আমাদের সকলের কাছে স্পষ্ট। কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকা ফ্যাসিস্ট বিজেপি সরকার যার দায় এড়িয়ে গেছে প্রথম থেকেই। এই লকডাউনের বিপর্যয় থেকে বাদ পড়েনি দেশের পড়ুয়ারাও। বিশেষজ্ঞেরা বলছেন শিক্ষাক্ষেত্রে এই অব্যবস্থা লকডাউন নয়, আদতে রাষ্ট্রীয় মদতে চলা ‘লকআউট’। লকডাউনের হাত ধরে নিউ নর্মালে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থা, যা এদেশের শিক্ষাক্ষেত্র এবং শিক্ষার্থীদের কোমরে সজোরে বাড়ি মেরেছে।

সমীক্ষা বলছে, পশ্চিমবঙ্গে ২০২১’র মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের মধ্যে লক্ষাধিক ছাত্রছাত্রী ফর্মই ভরেনি। তাদের নাম নথিভুক্ত হয়েছে স্কুলছুটের খাতায়। গ্রামীণ ভারতের ৭০ শতাংশ মানুষ এখনও সরাসরি ইন্টারনেটের সুবিধা থেকে বঞ্চিত। গ্রামীণ এলাকায় গত এক মাসে ৬০ শতাংশ ছাত্রছাত্রী নিজেদের শিক্ষকদের মুখই দেখেনি। তাহলে এই অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থা কার সুবিধার্থে প্রণীত তা বলাই বাহুল্য!

২০১৮ সালের ছবিটা যদি একটু মনে করা হয়, তাহলে দেখা যাবে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্কুলছুটের হার ৩.৩ শতাংশ ছিল। ঠিক একই সময়ে দেশের পরিসংখ্যান বলছে স্কুলছুটের হার ছিল ৪ শতাংশ। যেটা ২০২০ সালে বেড়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৫.৫ শতাংশ। এর দায় কার? উপর থেকে আমাদের মাথায় চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে নয়া শিক্ষানীতি, যে শিক্ষানীতি পিছিয়ে পড়া বর্গের পড়ুয়াদের শিক্ষার মৌলিক অধিকারকে সুনিশ্চিত করেনা। বরঞ্চ শিক্ষাক্ষেত্রে এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে তৈরি করে বৈষম্যমূলক পরিবেশ। আর ফলে ডিজিটাল ইন্ডিয়ার সাফল্যের তালিকা থেকে বাদ পড়ে যায় ৫০ লক্ষেরও বেশি দলিত পড়ুয়া।

সমাজের একাংশের মানুষ লকডাউনের ফলে বিগত দু’বছর ধরে কাজ হারিয়ে পথে বসেছেন! গণপরিবহন ব্যবস্থা বন্ধ রাখার কারণে শহরের সাথে অন্যান্য অঞ্চলের যোগাযোগ একেবারেই বিচ্ছিন্ন। কেন্দ্র ও রাজ্যে বসে থাকা সরকার যারা মানুষের দু’বেলা খাদ্য সুরক্ষার অধিকার সুনিশ্চিত করতে অক্ষম, তারাই আবার অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থাকে মান্যতা দিয়ে স্কুল-কলেজ বন্ধ করে রেখেছে দিনের পর দিন। নয়া শিক্ষানীতিকে হাতিয়ার বানিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার এখন কায়দা করে ৬০:৪০ ব্লেন্ডেড মোডের শিক্ষা ব্যবস্থাকে স্বীকৃতি দিচ্ছে। ভারতের মতো দেশে যেখানে অর্ধেকের বেশি জনসংখ্যার কাছে এখনও ইন্টারনেটের সুবিধা নেই, সেখানে অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থা কতটা শিক্ষার্থীদের পক্ষে সুবিধাজনক, এই নিয়ে বারবার প্রশ্ন করে চলতে হবে!

একটু চারপাশটা চোখ রাখলেই বোঝা যাবে আমাদের মধ্যে এমন অনেক বন্ধুরাই আছে যাদের কাছে অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থায় টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় ফোন এবং পর্যাপ্ত ডেটাপ্যাক নেই। পরিবারের ৬ থেকে ৭ জন সদস্যের জন্য থাকার জায়গা হয়তো একটা ঘর। সেক্ষেত্রে পড়াশোনা করার জন্য যে সুষ্ঠ পরিবেশ প্রয়োজন তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে প্রান্তিক অংশের এরকম বহু ছাত্রছাত্রী। তাই এরকম এক অবস্থায় যখন তৃতীয় ঢেউ দরজায় কড়া নাড়ছে, তখন যদি কোভিড বিধি মেনে ক্যাম্পাস খোলার কথা না বলা হয়, তাহলে বিগত দু’বছরের মতো আবারও বৈষম্যের দিকে ঝুঁকবে লক্ষাধিক ছাত্রছাত্রী।

তাই আইসা (এআইএসএ) মনে করে ছাত্রছাত্রীদের মৌলিক শিক্ষার অধিকারকে সুনিশ্চিত করার জন্য অবিলম্বে সমস্ত করোনা বিধি মেনে হোস্টেল খুলতে হবে। হোস্টেলের ইন্টারনেট (ওয়াই-ফাই) ও সপ্তাহে পাঁচ দিনের জন্য লাইব্রেরী খোলার ব্যবস্থা ছাত্রদের পড়াশুনার সুযোগকে সহজ ও সুনিশ্চিত করবে। পাশাপশি যত দ্রুত সম্ভব ক্যাম্পাস খোলার সমস্ত সম্ভাবনাকে বাস্তবায়িত করার দিকে উদ্যোগ নিতে কর্তৃপক্ষকে তৎপর হতে হবে।

ক্যাম্পাস খোলার দাবিতে গোটা দেশজুড়ে ছাত্রছাত্রীরা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ও এই ব্যাপারে বিচ্ছিন্ন নয়, আইসা সহ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন এবং মঞ্চ, ক্যাম্পাস খোলার দাবিতে তাদের স্পষ্ট বক্তব্য রেখেছে বিগত দিনগুলিতে। চলমান আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে কয়েকটি কথা আরও স্পষ্ট করে এই সময়ে বলা উচিত — যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এযাবৎকাল ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগের মধ্য দিয়ে আন্দোলনের রাস্তাকে প্রশস্ত করার বার্তা দিয়ে এসেছে সমাজের কাছে। এমতাবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত গণতান্ত্রিক শক্তির একত্রিত হওয়া ও আন্দোলনের রাস্তাকে আরও প্রশস্ত করাই এই সময়ের দাবি। এই ঐক্যের ভিত্তি হোক বহুমাত্রিকতা। এমন এক অবস্থায় যখন বিজেপির মতো ফ্যাসিস্ট সরকার দাঁত নখ বার করে থাবা বসিয়েছে এদেশের শ্রমিক, কৃষক ও শিক্ষার্থীদের উপর; তখন গণতন্ত্র রক্ষার রসদ হয়ে উঠুক বহুমাত্রিকতা। শুভবুদ্ধি সম্পন্ন সমস্ত গণতান্ত্রিক শক্তির কাছে যাদবপুর আইসা শাখার আহবান — ক্যাম্পাস খোলার দাবিতে আন্দোলনে শামিল হয়ে আন্দোলনকে আরও জোরালো আকার দেওয়ার জন্য।

দাবি,
    • অবিলম্বে কোভিড বিধি মেনে হোস্টেল খুলতে হবে।
    • অবিলম্বে লাইব্রেরী সপ্তাহে ৫ দিন খুলতে হবে।
    • সমস্ত ল্যাব খুলতে হবে।
    • ক্যাম্পাস খুলতে হবে।

খণ্ড-28
সংখ্যা-33