জনগণের অংশগ্ৰহণে স্বাধীনতার ৭৫ বছর উদযাপন
75 years of independence

বিহারে স্বাধীনতার ৭৫ বছর উদযাপনের শুরু হল পাটনায়, মহান বিপ্লবী এবং ভগৎ সিং’এর কমরেড বটুকেশ্বর দত্তর জন্মদিন ১৮ নভেম্বর। এই উদযাপনের অঙ্গ হিসাবে সেদিন এক অনুষ্ঠানের ডাক দেন ঐতিহাসিক, বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক কর্মীবৃন্দ এবং নাগরিক সমাজের লোকজন। অনুষ্ঠানটি আয়োজিত হয় ভারতীয় নৃত্য কলা মন্দিরে। এর আগে জক্কনপুরে বটুকেশ্বর দত্ত লেনে একটা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় এবং বিধানসভার মূল ফটকে মহান বিপ্লবীর মূর্তিতে মাল্যদান করা হয়।

সেদিনের ভারতীয় নৃত্যকলা মন্দিরের অনুষ্ঠানে একটি আলোচনাসভা সংগঠিত হয় যার বিষয় ছিল স্বাধীনতার ৭৫ বছরের স্বপ্ন ও চ্যালেঞ্জসমূহ। সেই কনভেনশনে বক্তব্য রাখেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ওপি জয়সওয়াল, সিপিআই(এমএল)-এর সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য, কবি অরুণ কমল, পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রাক্তন প্রধান অধ্যাপক ভারতী এস কুমার, এএন সিনহা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক বিদ্যার্থী বিকাশ, পাসমন্দা মহাজ নেতা ও প্রাক্তন সাংসদ আলি আনোয়ার ও অন্যান্যরা। আলোচনাসভা সঞ্চালনা করেন কুমার পারভেজ এবং সভায় পাটনার বহু বিশিষ্ট নাগরিক ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের উপস্থিতি দেখা গিয়েছিল।

আলোচনাসভায় তাঁর বক্তব্যে অধ্যাপক ওপি জয়সওয়াল বলেন, স্বাধীনতা আন্দোলনে আরএসএস ও হিন্দুত্ব বাহিনী বিশ্বাসঘাতকতার ভূমিকাই পালন করেছিল। ওরা মনুস্মৃতিকে ওদের সংবিধান মনে করায় ভারতীয় সংবিধানের বিরোধী ছিল। তিনি আরো বলেন, আরএসএস নেতৃবৃন্দ এমনকি সকলের, অর্থাৎ, সর্বজনীন ভোটাধিকারেরও বিরোধিতা করেন। আরএসএস’এর লোকজন আজ ইতিহাসের বিকৃতিসাধন করছে, মিথ্যা উপস্থাপনা ঘটাচ্ছে। আমাদের সমষ্টিগত দায়িত্ব হল এর বিরুদ্ধে এক বিস্তৃত ঐক্য গড়ে তোলা এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের বুনিয়াদি মূল্যবোধগুলোকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।

সিপিআই(এমএল)-এর সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বলেন, বটুকেশ্বর দত্ত এবং সাভারকারের নাম কখনই একসাথে উচ্চারণ করা যায় না। আন্দামানের জেলে সাভারকারের ইতিহাস হল ব্রিটিশদের কাছে মার্জনা ভিক্ষার ইতিহাস, আর বটুকেশ্বর দত্ত জেলে নিরবচ্ছিন্নভাবে লড়াই চালিয়ে গেছেন। আজ আমাদের লড়াইটা হল বিজেপি যে মেকি ইতিহাস তৈরি করছে, ইতিহাসের যে বিকৃতি ঘটাচ্ছে তার বিরুদ্ধে। আমরা স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে অনুপ্ররণা গ্ৰহণ করি এবং এই আন্দোলনের বিভিন্ন দিকগুলোকে স্মরণে রাখি, যার মধ্যে রয়েছে স্বাধীনতার জন্য ১৮৫৭’র লড়াই, ১৯৪২’র ভারত ছাড়ো আন্দোলন এবং স্বাধীনতা আন্দোলনে মুসলিম, দলিত, পশ্চাদপদ অংশ এবং নারীদের অংশগ্ৰহণ। এঁদের সংগ্ৰাম আমাদের উত্তরাধিকার এবং আমাদের দায়িত্ব হল এই উত্তরাধিকারকে লালন করা এবং ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়া।

কবি অরুণ কমল, ভগত সিং ও তাঁর কমরেডদের লড়াইয়ের কথাকে তুলে ধরেন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মূল্যবোধগুলিকে লালন ও রক্ষা করার কথা বলেন। যে বটক মিঞা গান্ধীজির জীবন রক্ষা করেছিলেন, তাঁর বীরোচিত কীর্তিকলাপের কথা বিশদে বর্ণনা করেন বিদ্যার্থী বিকাশ। স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে যাঁদের প্রান্তিক করে রাখা হয়েছে তাঁদের লড়াইগুলোকে আমাদের প্রকাশের আলোয় উদ্ভাসিত করতে হবে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন প্রাক্তন সাংসদ আলি আনোয়ার। তিনি জানান, বিজেপি ও আরএসএস বিষ ছড়াচ্ছে এবং প্রজ্ঞা ঠাকুর ও কঙ্গনা রানাউতদের উৎসাহিত করছে যারা স্বাধীনতা সংগ্ৰামের সমস্ত শহীদদের অপমানিত করেছেন এবং পরম কাম্য স্বাধীনতাকে ‘ভিক্ষা’ বলে অভিহিত করেছেন।

জনগণের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে স্বাধীনতার ৭৫ বছর উদযাপনের অভিযান দু’বছর ধরে চলবে বলে সভায় জানানো হয়। জনগণের মধ্যে স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল্যবোধ এবং স্বপ্নকে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে গণউদযাপন অভিযান দু’বছর ধরে, ২০২৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত চলবে।

এই কনভেনশন দাবি জানাচ্ছে যে, সেক্রেটারিয়েট হল, রেলস্টেশন এবং গারদানিবাগ গেট গ্ৰন্থাগারকে মহান বিপ্লবী বটুকেশ্বর দত্তর নামে নামকরণ করতে হবে এবং জনগণের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে গড়িয়া মঠে বটুকেশ্বর গেট নির্মাণ করতে হবে।

এই কনভেনশন উদযাপন অভিযানকে ব্যাপক বিস্তৃত গণঅভিযানে রূপ দেওয়া এবং নিম্নলিখিত কর্তব্যকর্মগুলি সম্পন্ন করার আহ্বান জানাচ্ছে।

১৮৫৭: প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ

১৮৫৭’র আগে বিহারে চলা স্বাধীনতা সংগ্ৰামের অকথিত আখ্যানগুলোকে প্রকাশের আলোয় নিয়ে আসা; কুনওয়ার সিং এবং ভোজপুরের নিশান সিং, হরকিসান সিং এবং বিশেষভাবে নারীদের ভূমিকার ওপর আলোকপাত করা, তাঁদের অবদানকে গ্ৰন্থিত করা এবং তাঁদের নিয়ে কর্মসূচি সংগঠিত করা।

১৮৫৭’র স্বাধীনতা যুদ্ধের মহান যোদ্ধা জীবধার সিং’এর স্মৃতিতে আরোয়ালে একটা পার্ক নির্মাণ করা।

পাটনার গুলজারবাগে শহীদ পীর আলি স্মৃতিসৌধকে নবরূপে সজ্জিত করা।

১৮৫৭’র পর নওয়াদা জেলায় দশবছর ধরে চলা রাজওয়ার বিদ্রোহের প্রামাণ্য আখ্যান নির্মাণ করা এবং এই বিষয়ে কর্মসূচি সংগঠিত করা।

চম্পারণ সত্যাগ্ৰহ

গান্ধীজির সত্যাগ্ৰহের কর্মীদের ইতিহাসকে পরিচিতির আলোয় নিয়ে আসা, যাঁদের মধ্যে বিশেষভাবে রয়েছেন শেখ গুলাব, বটক মিঞা ও অন্যান্যরা এবং গান্ধী চলে যাওয়ার পরও জমিদারদের বিরুদ্ধে চলতে থাকা কৃষক আন্দোলনের প্রামাণ্য আখ্যান নির্মাণ করা।

১৯৪২’র আন্দোলন

১৯৪২’র আন্দোলনে নিহত সমস্ত শহীদদের (প্রায় ৫০০) তালিকা তৈরি করা এবং তাঁদের স্মৃতিতে এক স্মারকস্তম্ভ নির্মাণ করা এবং বিহারে যে সমান্তরাল সরকার গঠিত হয়েছিল তার ইতিহাস প্রকাশ করা।

participation of the people

আদিবাসী আন্দোলন

অবিভক্ত বিহারে আদিবাসীদের উদ্দীপণাময় আন্দোলন আমাদের ইতিহাসে এক স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায়। আমাদের লক্ষ্য হল, ভাগলপুর-পূর্ণিয়া অঞ্চলের আদিবাসী আন্দোলনের ইতিহাসকে, বিশেষভাবে আজ পর্যন্ত অনুল্লেখিত দিকগুলোকে প্রকাশের আলোয় নিয়ে আসা।

স্বাধীনতা আন্দোলনে কৃষকদের ভূমিকা

শাহাবাদ, মগধ, সারান এবং মিথিলায় ঘটা কৃষকদের ঐতিহাসিক আন্দোলনের প্রামাণ্য আখ্যান তৈরি করা এবং গয়ায় যদুনন্দন আশ্রমকে নতুন করে নির্মাণ করা।

স্বাধীনতা সংগ্ৰামী

বিহারের যে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আন্দামানের জেলে কারারুদ্ধ করা হয়েছিল তাঁদের জীবন ও কর্মকে উন্মোচিত করা এবং তাঁদের স্মৃতিকে সুরক্ষিত করতে উদ্যোগ নেওয়া।

নাচ্ছাতার মালাকার (আরারিয়া), বিসমিল আজিমাবাদী (পাটনা), বদরি আহীর (ভোজপুর), টাকি রহিম (পাটনা), পৃথ্বীরাজ সিং (জাহানাবাদ), রামাকান্ত দ্বিবেদী রামতা (ভোজপুর), জুব্বা সাহানি (মুজাফ্ফরপুর), তারামুণী দেবী (সারান), শেখ গুলাব (চম্পারণ), বটক মিঞা (চম্পারণ) ও অন্যান্যরা।

পদ্মশ্রী পুরস্কার প্রাপক এবং বিজেপি সমর্থক কঙ্গনা রানাউত ঘোষণা করেছেন যে ১৯৪৭ সালে পাওয়া স্বাধীনতা ছিল ভিখিরিকে দেওয়া ‘ভিক্ষা’, এবং দেশ প্রকৃত স্বাধীনতা পায় ২০১৪ সালে। তাঁর এই বিবৃতি স্বাধীনতা লাভের পরপরই আরএসএস’এর প্রকাশ করা মনোভাবেরই অনুরূপ এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের শহীদদের প্রতি অপমান। আমরা রানাউতের এই মন্তব্যকে তীব্র ধিক্কার জানাচ্ছি এবং তাঁকে দেওয়া পদ্মশ্রী পুরস্কার প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছি।

স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসকে বিকৃত করা ও তার মিথ্যা উপস্থাপনার যে ষড়যন্ত্র বিজেপি-আরএসএস চালাচ্ছে, এই কনভেনশন তাকে ধিক্কার জানাচ্ছে এবং গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সৌভ্রাতৃত্ব, সামাজিক ন্যায় ও সমাজতন্ত্রের মতো মূল্যবোধগুলিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠা করা ও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করছে।

(লিবারেশন, ডিসেম্বর ২০২১ সংখ্যা থেকে)

খণ্ড-28
সংখ্যা-42