প্রতিবেদন
আগুনপাখি
Fireflies_0

“আমাকে কেউ বোঝাইতে পারলে না ক্যানে আলেদা একটো দ্যাশ হয়েছে গোঁজামিল দিয়ে যিখানে শুদু মোসলমানরা থাকবে কিন্তুক হিঁদু কেরেস্তানও আবার থাকতে পারবে। তাইলে আলাদা কিসের? আমাকে কেউ বোঝাইতে পারলে না যি সেই দ্যাশটো আমি মোসলমান বলেই আমার দ্যাশ আর এই দ্যাশটি আমার লয়। আমাকে আরো বোঝাইতে পারলে না যি ছেলেমেয়ে আর জায়গায় গেয়েছে বলে আমাকেও সিখানে যেতে হবে। আমার সোয়ামি গেলে আমি আর কি করব? আমি আর আমার সোয়ামি তো একটি মানুষ লয়, আলেদা মানুষ। খুবই আপন মানুষ, জানের মানুষ কিন্তুক আলেদা মানুষ।” – আগুনপাখি, হাসান আজিজুল হক।

হাসান আজিজুল হক বললেই মনে পড়ে আগুনপাখি।

তাঁর লেখা উপন্যাস। যদিও আদতে হাসান ছিলেন প্রধানত গল্পকার। তবু আগুনপাখি নিয়েই বলা যাক দু’চার কথা।

আগুনপাখি বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ রাঢ় অঞ্চলের পটভূমিতে লেখা। এই অঞ্চলে হাসান জন্মেছিলেন, লেখাপড়াও শিখেছিলেন, প্রধানত বিদ্যালয়-পর্ব। এই উপন্যাসটি মূলত একটি গ্রামীণ পরিবারের উত্থান-পতনের অপ-রূপকথা। কাহিনীর, সুত্রধার একজন গৃহিণী, তিনিই বলেছেন কাহিনী। গল্পটি শুরু হচ্ছে দেশভাগের, মানে ভারতবর্ষ ভাগের কয়েক বছর আগে।

উপন্যাসের শুরুর দিকে, লেখক পরিবার-জীবনের কথা বলেছেন, বলেছেন জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ নিয়ে হরেক অপ-রূপকথা। লেখকরা তাঁদের এলাকার সবচেয়ে বড় জমির মালিক হওয়ায় তাঁদের ভাগ্য পীড়িত ছিল না বটে কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা কলেরা, অভাব, ফসল না হওয়া এবং হিন্দু-মুসলিম বিভাজনের আতঙ্কে আক্রান্ত হন। এই ঘটনাগুলি যেন একটি অভ্যন্তরীণ গল্পকে তার ঘরোয়া চৌকাঠ পার করে রাস্তায় এনে উলঙ্গ করে দাঁড় করায় বা বলা ভাল উন্মুক্ত নগ্ন জগতের পরিসরে নিয়ে আসে।

উপন্যাসের শেষে, পরিবারের সন্তানরা পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন এবং সেখানে গিয়ে তাঁরা তাঁদের বাবা-মাকেও তাঁদের কাছে যেতে বলে। গৃহিণীর স্বামী সম্মত হন, কিন্তু গৃহিণী গৃহ ছেড়ে যেতে অস্বীকার করেন। তাঁর একা থাকার সিদ্ধান্ত স্বামীকে হতবাক করে। স্বামী প্রশ্ন করেন, “তুমি এত কিছু কবে শিখলে?” তিনি জবাব দেন, “এই সমস্ত বছর আমি কেবল আপনি আমাকে যা শিখিয়েছেন তা শিখেছি এবং আপনি আমাকে যা বলেছিলেন তা আমি বলেছি। এখন আমি নিজে থেকে একটি-দুটি জিনিস শিখেছি।”

উপন্যাসের এই গৃহিণী, এই নারী চরিত্রটি দেশভাগের পর কী দেখলেন? অনেকে রাঢ়বঙ্গ ত্যাগ করে পাকিস্তানে চলে গেল আবার অনেকে গেলনা। যেসব লোকজন দেশভাগ নিয়ে উদ্বেল ও উদ্বাহু ছিল তারা অনেকে থেকে গেল কিন্তু অন্যরা যারা চায়নি এই বিভাজন তারা চলে যেতে বাধ্য হল। ওই নারীচরিত্র বিভাজনের রাজনীতি বোঝেন না কিন্তু এটা জানেন যে একটা বড় বৃক্ষকে যদি তার ভূমি থেকে তুলে নিয়ে অন্যভূমিতে রোপন করা হয় তবে সে বৃক্ষ বাঁচবে না। তাঁকে পাকিস্তানে যেতে বাধ্য করলে তিনিও মারা যাবেন।

স্বাধীনতা দেশভাগ নিয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে আগুনপাখির স্রষ্টা বলেছিলেন, “হিন্দু মিথের একটা গল্প বলি। পার্বতীর সঙ্গে তাঁর শ্বশুরকুলের খুব গণ্ডগোল। শিবের পোশাক-আশাক, চলাফেরা এসবের কোনো ঠিকঠিকানা নেই। প্রায়ই তাঁদের মধ্যে ঝগড়া লেগে থাকে। একদিন শিব পার্বতীকে চক্র দিয়ে কেটে ৫০ টুকরো করে বিভিন্ন জায়গায় ফেলে দিলেন। এক পর্যায়ে দেখা গেল, প্রত্যেকটি টুকরো এক-একটা ঐতিহ্যের অংশ হয়ে গেল। এই সব মিলে আলাদা একটা ইতিহাসও তৈরি করে ফেলল। আমাদের অবস্থা হচ্ছে এমন। দেশভাগ, স্বাধীনতা অঞ্চলভেদে এক-একটা ঐতিহ্য যেমন আছে, সব মিলিয়ে সম্মিলিত সংস্কৃতির ভেতরে আছি আমরা।”

ওপার বাংলায় ফেলে দেওয়ার আগের কথা বলা যাক। হাসান আজিজুল হক ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ২ ফেব্রুয়ারি বর্ধমান জেলার যবগ্রামে এক অবস্থাপন্ন যৌথ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আব্বার নাম মোহাম্মদ দোয়া বখশ্ আর মা হলেন জোহরা খাতুন। ১৯৫৪ সালে যবগ্রাম মহারানী কাশীশ্বরী উচ্চ ইংরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। তিনি যখন কাশীশ্বরী উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র তখন ঐ স্কুলে রাজা সৌমেন্দ্র চন্দ্র নন্দীর আগমন উপলক্ষ্যে একটি সম্বর্ধনাপত্র রচনার মধ্য দিয়ে তার লেখালেখি জীবনের শুরু। এছাড়া প্রবেশিকা পাশের পরপরই তিনি লেখেন ‘মাটি ও মানুষ’ শীর্ষক একটি উপন্যাস; যে রচনাটি আজও প্রকাশিত হয়নি। ১৯৫৬ সালে খুলনা শহরের অদূরে দৌলতপুরের ব্রজলাল কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তারপর তিনি দেশত্যাগ করেন। তাঁর দেশত্যাগ নিয়ে সরাসরি কথা না বললেও ছোটগল্পে তার ছাপ রেখে গেছেন। এ প্রসঙ্গে হাসান আজিজুলের দেশভাগ নিয়ে ‘খাঁচা’ ও ‘মুক্তিযুদ্ধের গল্প’ স্মরণীয়, পরে যা সিনেমা হয়েছে। তাঁর আর একটি গল্প দেশ বিভাজনের যন্ত্রণা নিয়ে, যার নাম ‘উত্তর বসন্তে’। তাঁর ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’, ‘পরবাসী’, ‘আগুনপাখি’ এবং ‘ফিরে আসি ফিরে যাই’, ‘উঁকি দিয়ে দিগন্ত’ আত্মজীবনীমূলক লেখাগুলোয় দেশভাগের বেদনা মূর্ত হয়ে উঠেছে। হাসান নিজেই দেশভাগের শিকার, তাঁকে দেশভাগের জন্য বাবা-মা, পরিজন, ভিটে ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে।

Fireflies_1

আমরা সাধারণত দেশভাগ নিয়ে যে সব লেখা পড়েছি তা মূলত পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমবঙ্গে চলে যাওয়া হিন্দুদের দুর্দশা ও বেদনা নিয়ে। হাসান আজিজুল হক মুদ্রার অন্য পিঠ। তাঁর লেখায় মুসলমান পরিবারের ওপারে চলে যাওয়ার বেদনাক্লিষ্ট আখ্যান চিত্রিত হয়েছে।

১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে রাজশাহী সরকারি কলেজে থেকে দর্শন অনার্স নিয়ে তিনি বিএ পাশ করেন। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। অস্ট্রেলিয়া গিয়েছিলেন গবেষণার উদ্দেশে। কিন্তু বিদেশে মন টেকেনি তাঁর। ১৯৬০ থেকে ১৯৭৩ পর্যন্ত তিনি রাজশাহী সিটি কলেজ, সিরাজগঞ্জ কলেজ, খুলনা গার্লস কলেজ এবং দৌলতপুর ব্রজলাল কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৪ সাল পর্যন্ত একনাগাড়ে ৩১ বছর অধ্যাপনা করেন। রাজশাহী ছিল মুর্শিদাবাদের সন্নিহিত জেলা, আমের জন্য বিখ্যাত। রাজশাহী কলেজে পড়ার সময় কলেজের পত্রিকায় হাসানের প্রথম লেখা ছাপা হয়। লেখাটির বিষয় ছিল ‘রাজশাহীর আমের মাহাত্ম্য’। সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল পত্রিকায় ১৯৬০ সালে ‘শকুন’ শীর্ষক গল্প প্রকাশের মধ্য দিয়ে হাসান আজিজুল হক বৃহত্তর সাহিত্য অঙ্গনে পরিচিত হন। ১৯৬০ সালে ‘পূর্বমেঘ’ পত্রিকায় ‘একজন চরিত্রহীনের সপক্ষে’ গল্পটি প্রকাশিত হওয়ার পরই তিনি এক বিশিষ্ট কথাশিল্পী হিসেবে খ্যাত হন।

হাসান আজিজুল হকের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে: সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য (১৯৬৪), আত্মজা ও একটি করবী গাছ (১৯৬৭), জীবন ঘষে আগুন (১৯৭৩), নামহীন গোত্রহীন (১৯৭৫), পাতালে হাসপাতালে (১৯৮১), নির্বাচিত গল্প (১৯৮৭), আমরা অপেক্ষা করছি (১৯৮৮), রাঢ়বঙ্গের গল্প (১৯৯১), রোদে যাব (১৯৯৫), হাসান আজিজুল হকের শ্রেষ্ঠগল্প (১৯৯৫), মা মেয়ের সংসার (১৯৯৭), বিধবাদের কথা ও অন্যান্য গল্প (২০০৭)।

প্রবন্ধসাহিত্যেও তিনি উজ্জ্বল। তাঁর লেখা — কথাসাহিত্যের কথকতা (১৯৮১), চালচিত্রের খুঁটিনাটি (১৯৮৬), অপ্রকাশের ভার (১৯৮৮), সক্রেটিস (১৯৮৬), অতলের আধি (১৯৯৮), কথা লেখা কথা (২০০৩), লোকযাত্রা আধুনিক সাহিত্য (২০০৫), একাত্তরঃ করতলে ছিন্নমাথা (২০০৫), ছড়ানো ছিটানো (২০০৮), কে বাঁচে কে বাঁচায় (২০০৯), বাচনিক আত্মজৈবনিক (২০১১), চিন্তন-কণা (২০১৩), রবীন্দ্রনাথ ও ভাষাভাবনা (২০১৪)।

উপন্যাস কম লিখেছেন, মাত্র তিনটি — আগুনপাখি (২০০৬), সাবিত্রী উপাখ্যান (২০১৩), শামুক (২০১৫)।

তাঁর মৃত্যুতে একটি অধ্যায়ের সমাপন ঘটলো। কী সেই অধ্যায়? সেই অধ্যায় হল সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, স্বাধীনতার পক্ষে, বিভাজনের বিপক্ষে, সম্প্রীতির পক্ষে, ঘৃণা লালসার বিরুদ্ধে, শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের পক্ষে সৎ লেখকদের যে সহজাত লড়াই সে এক অধ্যায় বটে, যখন দেখি কাকতাড়ুয়া-লেখকে বাজার ছেয়ে গেছে, বাজারকে তারা মহিয়ান করে তুলছে, ঘৃণাকে ও বিভাজনকে তারা পরিণত করছে পণ্যসাহিত্যে তখন হাসান আজিজুলের মতো এক মহান স্রষ্টার চলে যাওয়া অপূরণীয় ক্ষতি।

- শামিম আহমেদ

খণ্ড-28
সংখ্যা-42