সর্বজনীন সমমানের শিক্ষার উপায়
equal education

শিক্ষক নিয়োগ, পাঠক্রম তৈরি, শিক্ষণ প্রণালী, বিদ্যালয়ের পরিকাঠামো, ছাত্রীছাত্রদের উপস্থিতি, শিক্ষক-ছাত্রীছাত্র যোগাযোগ, ছাত্রীছাত্রদের মূল্যায়ন এই সমস্ত মিলিয়ে বিদ্যালয় শিক্ষাকে সামগ্রিকে দেখার ভাবনা তৈরি করা দরকার। তেমনটা কী হয়? পাঠক্রম তো বহুলাংশেই রাজনীতিপ্রসূত। কোন রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এলো ও তাদের সমাজ সম্পর্কে ভাবনা কতটা উদার, বৈজ্ঞানিক অথবা রক্ষণশীল ও মৌলবাদী তার উপরে পাঠক্রম নির্ভর করেই থাকে। এছাড়াও সব ছাত্র সমগুণমানের শিক্ষা পাবে কিনা বা তারা সকলে তেমন শিক্ষা পাওয়ার যোগ্য কিনা সেটিও নির্ভর করে সমাজ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীর উপরে। এদেশের বা রাজ্যের শিক্ষা প্রশাসক তথা এতাবতকাল পর্যন্ত শাসক রাজনৈতিক দলগুলির দৃষ্টিভঙ্গীই ছিল যে দরিদ্র সাধারণ পরিবারের ছাত্রীছাত্রদের কেবল বিদ্যালয়ে হাজির করাতে হবে, সাক্ষর করে তুলতে হবে। ২০০১ সালে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে মিড ডে মিল ও পরবর্তীতে শিক্ষার অধিকার আইনের সুবাদে ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত সমস্ত শিশুকে বিদ্যালয়ে আনা বাধ্যতামূলক করা হয়, একই সঙ্গে শিক্ষার অধিকার আইন মেনে ছাত্রীছাত্রদের অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত ফেল না করানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ব্যাস, ওই বিদ্যালয়ে আনা, অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত ধরে রাখা, দুপুরে যেমন তেমন পেট ভরার মত খেতে দেওয়া – এভাবেই দায় সারা হয়ে আসছে সরকারের। লক্ষণীয় যে, প্রচার মাধ্যম থেকে শুরু করে সরকার সকলেই যে তেমনটাই মনে করে তা প্রকাশ পায় যখন কোনো অতি নিম্নবিত্ত পরিবারের ছাত্রী বা ছাত্র তেমন কোনো খুব ভালো ফল করে, প্রচার মাধ্যম বা সরকার তা নিয়ে খুব ফলাও করে বলতে থাকে। অর্থ করা হয় যে, ওই ছাত্রী বা ছাত্র সমস্ত প্রতিকূলতাকে জয় করে ভালো ফল করেছে। কিন্তু এটাও মেনে নেওয়া হয় যে, সকলের জন্য সমগুণমানের শিক্ষার বন্দোবস্ত করা হয়নি, যদিও তেমনটা করা প্রয়োজন মনে করেন না, কারণ সরকারপক্ষের মতে, যে ব্যবস্থাটি আছে তাতেই ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে ভালো ফল করতে পারে।

বিদ্যালয় স্তরে সরকারি বিদ্যালয়ে পূর্ণ সময়ের শিক্ষক নিয়োগের জন্য প্রাথমিকে টেট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা হিসেবে ডিএলইড পাশ করতে হবে। ডিএলইড পড়ার ন্যূনতম যোগ্যতা উচ্চ মাধ্যমিক বা সমতুল্য পরীক্ষায় ৫০ শতাংশ (বিশেষ ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ ছাড় আছে) পেয়ে উত্তীর্ণ হওয়া। মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষকতার জন্য ন্যূনতম বিএড পাশ করতে হবে ও বিএড পড়ার জন্য স্নাতকে ৫০ শতাংশ (এক্ষেত্রেও ছাড় আছে) পেতে হবে। এই যে বিএড, ডিএলইড, পূর্বে পিটিটিআই উত্তীর্ণ হওয়া আবশ্যিক করা হোল, যা আগে ছিল না, তার ফলে বিদ্যালয় স্তরে শিক্ষার কী উন্নতি হল তা যাচাই করা হয়েছে কখনো? যদি তেমন কোনো উন্নতি না হয়ে থাকে তাহলে ওই সব বিধিনিষেধ আরোপ করে রাখা হচ্ছে কেন? কেনই বা দেশের তথা রাজ্যের বিভিন্ন জেলা সদর ও মফস্বল শহরে গাদা গাদা বিএড, ডিএলইড পড়ানোর বেসরকারি (বানিজ্যিক?) প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়ে গেল? প্রকাশ্যে ওই কোর্সগুলি পড়ার খরচ দুবছরে ২ লক্ষ টাকা বা তার বেশি। পিছনের দরজায় কত দিতে হয় কে জানে! ফলে, যে সমস্ত সাধারণ ঘরের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ছাত্রীছাত্ররা শিক্ষকতার পরীক্ষা দিয়ে চাকরিতে নিযুক্ত হচ্ছিলেন তাঁদের পক্ষে সেটা অসুবিধেজনক হয়ে গেল। অন্যদিকে ওই সমস্ত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলির রমরমা শুরু হল। ওগুলির অনুমোদনের জন্য শাসক দলের মন্ত্রীসান্ত্রীরা ‘অনুদান’ও পেলেন। যে অর্থের একাংশ হয়তোবা সম্প্রতি খুঁজে পাওয়া ২০-২২কোটির মধ্যে ঢুকে পড়েছে।

বিদ্যালয়স্তরে শিক্ষক নিয়োগের শুরুতেই যে যোগ্যতার বিধিনিষেধ শুরু করা হয়েছে, কেবল এরাজ্যে নয়, সারা দেশে, উৎসুক ছাত্রীছাত্রদের এক বড় অংশই তার ফলে শিক্ষকতা করার জন্য পাথেয় যোগাড় করতে না পেরে অসহায় হয়ে পড়ছে। যারা থাকছে তাদের বৃহদাংশ অর্থের বিনিময়ে যোগ্যতা অর্জন থেকে শুরু করে টেটএসএলএসটি পাশ করা ও চাকরি পাওয়ার জন্য অর্থ দিতে রাজি হয়ে যাচ্ছে। কেবল নিয়োগই নয়, তার পরে নিজের সুবিধে মতো জায়গায় পোস্টিং পেতে বা বদলি হতেও টাকা হাত ফিরছে।

শিক্ষক নিয়োগের প্রাক শর্ত হওয়া উচিত যে বিদ্যালয়ে নিয়োগের জন্য নিজ পছন্দের সুযোগকে কর্মপ্রার্থী ব্যবহার করবেন সেখানেই তিনি শিক্ষকতা করবেন আন্তরিকতার সঙ্গে। সরকারকে ওই শিক্ষিকা বা শিক্ষকদের বিদ্যালয়ের অনতিদূরে থাকার যথাযোগ্য বন্দোবস্ত করতে হবে, অবশ্যই তার জন্য কোনো প্রাপ্য বেতন বা সুবিধের কাটছাঁট করা চলবে না। নিয়োজিত শিক্ষককেও দায়বদ্ধ হতে হবে যে বিদ্যালয়ের শ্রেণী কক্ষেই পাঠক্রমকে ছাত্রীছাত্রদের সম্পূর্ণ অনুধাবন করানোর। পাঠক্রম প্রস্তুতের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের ভূমিকা সর্বোচ্চ হতে হবে। রাজ্য তথা দেশের শিক্ষানীতি প্রনয়ণের বিষয়েও একদম সর্বনিম্ন শ্রেণী থেকে শুরু করে সর্বস্তরের সব শ্রেণীর শিক্ষকদের সর্বোচ্চ ও সার্বিক ক্ষমতা দিতে হবে। এমনভাবে পাঠক্রম তৈরি করা দরকার যাতে একটি শ্রেণীর জন্য বন্টিত পাঠক্রম সেই শ্রেণীতে পাঠরত সকল ছাত্রীছাত্রদের বিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষেই সম্পূর্ণশেখাতে শিক্ষকরা সমর্থ হন। ওই পাঠক্রমের সঙ্গে সাযূজ্যপূর্ণ বিদ্যালয়ের পঠন-পাঠনের সময় ও শ্রেণীকক্ষ পিছু ছাত্রীছাত্র সংখ্যা ও শিক্ষিকা-শিক্ষক সংখ্যা নির্ধারণ করতে হবে। মোদ্দা কথা পড়ুয়ারা পড়বে শিখবে লিখবে বিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষে, বাড়িতে কোনো পড়াশোনার দরকার পড়বে না। সর্বনিম্ন শ্রেণী থেকে প্রথমে এমনটাই শুরু করতে হবে ও সেই শ্রেণীর শিক্ষিকা ও শিক্ষকদের দায়বদ্ধ করতে হবে যাতে সব ছাত্রীছাত্র যথাযথ শেখে। পরবর্তী বছরে অনুরূপে পরবর্তী শ্রেণীর শিক্ষিকা-শিক্ষকদের অনুরূপ দায়িত্ব নিতে হবে। এইভাবে ১০-১২ বছর পরে সকল শ্রেণীর পড়ুয়ারাই যথাযথ শিখে বিদ্যালয়ের দরজা পার করবে। পড়ুয়াদের না শেখার দায় শিক্ষিকা শিক্ষক ও শিক্ষা প্রশাসনকেই নিতে হবে। অনেকেই, বিশেষত শিক্ষকরা বলবেন যে, এমন দায় তাঁরা নেবেন কেন, যেখানে উপযুক্ত শিক্ষা পরিকাঠামোর বন্দোবস্ত নেই। কিন্তু তাদের বুঝতে হবে, পাঠক্রম তৈরির অধিকার ও দায় মূলত শিক্ষকদের, উপযুক্ত পরিকাঠামো যোগানের দায় সরকারের, তা পাওয়ার অধিকার পড়ুয়া ও শিক্ষকদের। ওই পরিকাঠামোর জন্য সরকারকে দায়ী করানোর অধিকার ও দায়িত্ব জনগণের।

উপরের অনুচ্ছেদে যা লেখা হয়েছে তা আজকের পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে অবাস্তব ও অনেকের কাছে অনাকাঙ্খিত মনে হতে পারে। তারা ধরে নেন কেবল বিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষেই শিশু কিশোররা লেখাপড়া করে সব শিখবে এমনটা ভাবাই যায় না। গৃহশিক্ষক বা কোচিং ব্যতিরেকে পড়াশোনাও অবাস্তব শোনায়। এদেশে সব থেকে ‘বুদ্ধিমান’ ছাত্রীছাত্র বলে পরিগণিত আইআইটিতে ভর্তি হওয়ার যোগ্য পড়ুয়াদের কোচিং না নিলে চলে না। তার জন্য ফিটজি, আকাশ, সুপার থার্টি সমেত কোটার মত গোটা একটা শহর ‘করে খাচ্ছে’। ফলে আমাদের মত অর্বাচীনরা শ্রেণীকক্ষে পড়া শেষ করার কথা বললে শুনবে কে? তবুও বলতে হবে, কারণ সেটাই হতে পারে একমাত্র সর্বজনীন সমমানের শিক্ষার পথ।

- অমিত দাশগুপ্ত

খণ্ড-29
সংখ্যা-29