প্রতিবেদন
আমলাসোল : আজও অনাহার ও সরকারি উপেক্ষার কবলে
Amalasol Still suffering

আমলাসোল নিশ্চয় আমাদের স্মৃতি থেকে মুছে যায়নি। বামফ্রন্ট জমানায় ২০০৪ সালে সবর সম্প্রদায়ের পাঁচজনের অনাহারে মৃত্যুর পর সে খবর নাগরিক বিবেককে উদ্বেলিত করেছিল — সরকারি আমলা, বেশকিছু এনজিও ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা সেখানে গিয়েছিলেন পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে। বামফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তখন বলেছিলেন আমলাসোল কোনো ব্যতিক্রম নয়, এরকম আমলাসোল আরও রয়েছে। কিন্তু আঠের বছর পর আজ ২০২২ সালে আমলাসোল কোথায় দাঁড়িয়ে? যে সবর সম্প্রদায়ের মানুষরা অনাহারে মারা গিয়েছিলেন, তারা কি অনাহার থেকে মুক্তি পেয়েছেন? বড় মুখ করে মমতা ব্যানার্জির ঘোষণা করা বিভিন্ন সামাজিক প্রকল্প সেখানে কি সচল হয়? তারা কি আদৌ কাজ পায়? সম্প্রতি নিউজক্লিক ওয়েব পত্রিকার পক্ষে সাংবাদিক মধুসূদন চ্যাটার্জি আমলাসোল গিয়ে সেখানকার বর্তমান পরিস্থিতি সরজমিনে পর্যবেক্ষণ করেছেন। সেই অনুসন্ধানের ভিত্তিতে তিনি একটা রিপোর্ট তৈরি করেছেন যার শিরোনাম ‘আমলাসোল — এ সাগা অব এক্সট্রিম পভার্টি এলংসাইড সিনিক রিসর্টস ইন বেঙ্গলস ঝাড়গ্ৰাম’। সেই রিপোর্ট থেকে চয়ন করে আমলাসোলের বর্তমান পরিস্থিতির মূল বিষয়গুলোকে আমরা এখানে রাখছি।

আমলাসোল আজও চরম দারিদ্র লাঞ্ছিত এক অঞ্চল। আজও সেখানে অনাহারে মানুষ মারা যায়, সরকারি প্রকল্পে কাজ পাওয়াটা একরকম অনুপস্থিত, জীবিকা খুঁজে পাওয়াটা আক্ষরিক অর্থেই দুর্লভ। আজও সবর সম্প্রদায়ের জীবন নির্বাহের একমাত্র উপায় হলো পিঁপড়ের ডিম বিক্রি। জঙ্গলে গিয়ে তাঁরা পিঁপড়ের ডিম সংগ্ৰহ করেন আর সেটুকু দিয়ে যেটুকু অর্থ পান তাই দিয়ে দৈনন্দিন ব্যয় মেটানোর চেষ্টা হয়। এতেও বাজারের পাইকারি ব্যবসাদারদের হাতে তাঁদের বঞ্চনা অমোঘ বাস্তব। স্থানীয় সবর সম্প্রদায়ের মানুষ নিমাই সবরের স্ত্রী সোনামনি সবরের কথায়, “পাইকারি ব্যবসাদার আমাদের কাছ থেকে কেনে ৭০ টাকা কেজি দরে (বাজারে যেটা বিক্রি হয় ৩০০ টাকা কেজি দরে)। রেশনের মাধ্যমে যে চাল দেওয়া হয় তাতে সারা মাস চলে না। আমরা (স্বামী ও স্ত্রী) দুটো ছেলে নিয়ে থাকি। মাত্র ১২ কেজি চালে আমাদের পেট ভরে না। সব্জি আর মশলাপাতি কেনার কথা আমরা ভাবব কী করে?”

এখানে ১০০ দিনের প্রকল্পে কোনো কাজ হয় না, পঞ্চায়েতের উদ্যোগও অনুপস্থিত, আর তাই কাজের দেখা মেলে না। কাজের এই অলভ্যতার কারণে যুবকদের মধ্যে যথেষ্ট ক্ষোভও রয়েছে। এই অঞ্চলে এক সময় মাওবাদীদের প্রাধান্য ছিল। সরকারের পক্ষে বলা হয়েছিল যারা মাওবাদী নয় তাদের কাজ দেওয়া হবে। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি কাগজে-কলমে রয়ে গেছে, আমলাসোলের বাস্তবে তার কোনো নিদর্শন মেলে না। দেহে অপুষ্টির প্রকট চিহ্ন বহন করা বুদ্ধেশর সবর ক্ষোভ প্রকাশ করে জানিয়েছে, “আমি কেন কাজ পেলাম না? যারা মাওবাদী ও বন পুলিশ নামে পরিচিত তারা মমতা সরকারের অধীনে এই সুযোগটা পেয়েছে। আমি রোজগার করতে পারি না, আর সেই কারণেই আমার পেটে খাবার নেই।” বুদ্ধেশ্বরের দাবি অনুযায়ী সে মাওবাদী না হওয়া সত্ত্বেও পুলিশ মাওবাদী সন্দেহে ২০০৮ সালে তাকে ধরে নিয়ে যায়। তারপর পুলিশি হেফাজতে চরম নিপীড়ন ভোগ করা ও ছ’মাস জেলে কাটানো। এই বুদ্ধেশ্বরের বাবা সামাই ও দিদি মঙ্গলি অনাহারে মারা গেছে বলেই স্থানীয় মানুষরা জানিয়েছেন।

ঘোষিত সরকারি প্রকল্পের কোনো সুবিধার সঙ্গে আমলাসোলের মানুষরা সম্পূর্ণ অপরিচিত। জয় জহর প্রকল্প অনুসারে ৬০ বছর বয়স পেরোনোর পর জনসাতি সম্প্রদায়ের ভাতা পাওয়ার কথা। কিন্তু ১৪টা সবর পরিবারের মধ্যে ৭টা পরিবার ভাতা পাওয়ার যোগ্য হলেও কোনো ভাতা তাঁরা পান না। ২০০৪ সালে অনাহারে মারা যাওয়া নাথু সবরের বৃদ্ধা স্ত্রী ফুলমণি সবর ভাতা না পাওয়ার এবং ২০০৪ সালে অনাহারে মৃত্যুগুলির পর দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ না হওয়ার কথা জানিয়ে বলেছেন, “ওরা বলেছিল আমাদের জীবিকা পাওয়ায় ওরা সাহায্য করবে। এ সত্ত্বেও আমি কোনো ভাতা পাইনি। এ কথা কাকে বলব? আমাদের জন্য কারো কী কোনো মাথাব্যথা আছে।”

starvation and government neglect

সরকারের তরফে দরিদ্রদের জন্য বসত বাড়ি নির্মাণ করে দেওয়ার প্রকল্প আগে ছিল, এখনও রয়েছে। এখন প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় দরিদ্রদের বাড়ি দেওয়া হয়, আর নরেন্দ্র মোদী দাবি করেন যে এই বাড়ি তৈরি করে দেওয়ার ফলে গরিবরা ‘লাখোপতি’ হয়ে গেছে। কিন্তু আমলাশোলে দরিদ্রদের জন্য বাড়ি তৈরির কোনো চিহ্ন নেই। আজ থেকে ১০-১৫ বছর আগে ইন্দিরা আবাস যোজনায় সেখানে কিছু বাড়ি তৈরি হয়েছিল। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। বনমালি সবর জানিয়েছেন, “আমরা পঞ্চায়েতকে জানিয়েছিলাম, কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি”।

শিক্ষার ব্যবস্থাও অত্যন্ত করুণ। আমলাসোল থেকে ৫ কিমি দূরে কোকরাঝাড়ে একটা মাধ্যমিক স্কুল রয়েছে। যথেষ্ট শিক্ষক না থাকায় শিক্ষা সেখানে ধুঁকছে। আর আমলাসোল থেকে ২৬ কিমি দূরে বেলপাহাড়িতে রয়েছে একটা হাইস্কুল। এত পথ পেরিয়ে সবর সন্তানরা কি সেখানে পৌঁছতে পারবে?

আমলাসোলে কোনো বিদ্যুৎ নেই, সবর ঘরে রাতে তাই একটা বাতি টিমটিম করে জ্বলে। স্থানীয় মানুষরা জানিয়েছেন, ১৪ বছর আগে কয়েকটা ইলেক্ট্রিক পোল পোঁতা হয়েছিল এবং তখন দারিদ্রসীমার নীচে থাকা মানুষদের বিদ্যুতের জন্য কোনো ফী দিতে হত না। কিন্তু পশ্চিমবাংলায় ২০১১ সালে সরকার পরিবর্তনের পর বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। কিন্তু কেন তা করা হয়েছিল তার কারণ আজও তাঁদের কাছে অধরা রয়ে গেছে।

স্বাস্থ্য পরিস্থিতিও সেখানে তথৈবচ। হেলথ সেন্টার নামে স্বাস্থ্য পরিষেবার একটা কেন্দ্র রয়েছে বটে। আগে সেখানে ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রতি সপ্তাহে যেতেন। এখন কেউ সেখানে যান দু’তিন মাসে একবার। সরকারি হাসপাতাল রয়েছে আমলাসোল থেকে ৫ কিমি দূরে কোকরাঝাড়ে। আর প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র রয়েছে ৩০ কিমি দূরে বেলপাহাড়িতে। স্বাস্থ্য পরিষেবার কোনো উন্নতি এখানে হয়নি ১৮ বছরে। মমতা জমানায় স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বেসরকারি ক্ষেত্রের রমরমা ঘটেছে, মালটি স্পেশালিটি হাসপাতাল হয়েছে অনেক। কিন্তু দরিদ্রদের কাছে, দারিদ্র সীমার নীচে বাস করা মানুষদের কাছে স্বাস্থ্য পরিষেবা শুধু দুর্লভই নয়, সুদূরের বস্তুও।

তবে শুধু আমলাসোল নয়, আরও অনেক গ্ৰামের মানুষের দুর্দশায় কোনো ঘাটতি নেই। যেমন ঢেঙ্গাকুসুম ও কদলবোনি। পিঁপড়ের ডিম বিক্রি এখানের মানুষেরও প্রধান জীবিকা। পাহাড়ের টিলায় বাস করা এখানকার মানুষের জলকষ্টও মাত্রাতিরেক। জল যোগাড়ে তাঁদের যেতে হয় ৩ কিমি দূরে।

পাহাড় ঘেরা আমলাসোলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এখন পুঁজিকে আকৃষ্ট করেছে, আমলাসোল পরিণত হয়েছে পর্যটন কেন্দ্রে, সেখানে তৈরি হয়েছে ও হচ্ছে বহু রিসর্ট। তবে পুঁজির আগমন মানে শুধু কাজ নয়, তার সঙ্গে জড়িয়ে অর্থের দৌরাত্ম্য, কাজ টেকার অনিশ্চয়তা এবং কিছু বিধিবহির্ভূত কাজ। যে সমস্ত রিসর্ট গড়ে উঠেছে ও উঠছে সবক্ষেত্রে সেগুলোর জমি কি নিয়মের পথে প্রাপ্ত হয়েছে? এখন যেমন যে জমিতে একটা রিসর্ট তৈরি হতে যাচ্ছে সেটা বামফ্রন্ট আমলে দেওয়া হয়েছিল গুরুপদ সবরকে, তার পাট্টাও রয়েছে। গুরুপদর ছেলে লক্ষ্মীকান্তর ক্ষোভ, “কার কাছে আমরা অভিযোগ জানাতে যাব? আমরা কি জমিটা ফিরে পাব?” এছাড়াও প্রশ্ন, ঐ রিসর্টগুলোতে কি সবররা কাজ পায়? রিসর্টগুলোর ব্যাপক সংখ্যাধিক কর্মীকেই আনা হয়েছে বাইরে থেকে।

দেশের সব শাসকই গরিবের নামে শপথ করে, কিন্তু স্বার্থরক্ষা করে পুঁজির ও পুঁজিপতিদের। এর প্রশ্নহীন উদাহরণ আজকের মোদী সরকার। মমতা ব্যানার্জিও ‘শ্রী’ যুক্ত প্রকল্পগুলোর বড়াই করে দরিদ্রদের উদ্ধার করার আস্ফালন করেন ও ভোট চান। আর দরিদ্ররা রয়ে যায় অবহেলা ও উপেক্ষার অন্ধকারে। আমলাসোলও এর ব্যতিক্রম নয়।

খণ্ড-29
সংখ্যা-48