পরিসংখ্যানের ধুম্রজালের আড়ালে
Behind the smokescreen

পরিসংখ্যানের ধুম্রজাল তৈরি করে প্রকৃত চিত্রকে আড়ালে লুকিয়ে রাখার প্রশ্নে মোদী সরকারের মুন্সিয়ানা ও দক্ষতা রীতিমতো সুবিদিত। ভারতীয় অর্থনীতির প্রকৃত ছবি, তার রূঢ় বাস্তবতাকে নানা পরিসংখ্যানে মুড়ে পরিবেশন করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, বিশ্বের বৃহৎ অর্থব্যবস্থার তুলনায় ভারতের আর্থিক বনিয়াদ নাকি অনেকটা মজবুত। দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে ভারতে আর্থিক বৃদ্ধির হার ৬.৩ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। দুনিয়া জুড়ে শেয়ার বাজার যখন নাস্তানাবুদ হচ্ছে, তখন ভারতীয় বাজারে বিপুল পরিমাণে আন্তর্জাতিক প্রাতিষ্ঠানিক পুঁজি প্রবেশ করে তরতর করে দেশের শেয়ার সূচককে বাড়িয়ে দিচ্ছে। আর, তা নিয়ে প্রচার করা হচ্ছে দেশীয় অর্থনীতির উজ্জীবনের কাহিনী। কে না জানে, অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী অতিচঞ্চলমতি এই পুঁজি সামান্য ঝুঁকির গন্ধ পেলেই মুহূর্তেই সটান দেশের সীমানা পেরিয়ে অন্যত্র পাড়ি জমায়।

সিএমআইই’র তথ্য সামনে নিয়ে এল কর্মসংস্থানের বেহাল দশা। এই সংস্থা দেখাল, নভেম্বরে বেকারত্বের হার ফের ৮ শতাংশ টপকে গেছে। শহরে এই বেকারত্বের হার গ্রামের থেকে বেশি, ৯ শতাংশ। আর গ্রামে তা সামান্য কম হলেও (৭.৫৫ শতাংশ) আদৌ আশাপ্রদ নয়। গ্রামাঞ্চলে বেকারত্বের হার সেপ্টেম্বরে ৫.৮৪ শতাংশ থেকে অক্টোবরে এক লাফে বেড়ে ৮.০৪ শতাংশ হয়েছিল। সিএমআইই’র রিপোর্ট অনুযায়ী, গ্রামীণ অর্থনীতিতে মূলত কৃষি বাদে অন্যান্য ক্ষেত্রে কাজ কম থাকায় এই অবস্থা হয়েছে।

এদিকে, ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে আর্থিক বৃদ্ধির যে আশা করা হয়েছিল, প্রকৃত বৃদ্ধির পরিমাণ তার থেকে বেশি দাঁড়াবে বলে অনুমান। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বা রিজার্ভ ব্যাঙ্ক আর্থিক বৃদ্ধির পূর্বাভাস যতটা কাটছাঁট করেছিল, তার থেকেও প্রকৃত হ্রাসের পরিমাণ বেশ অনেকটা বেশি হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। এই অর্থবর্ষের দ্বিতীয়ার্ধে আর্থিক অবস্থা বেশ কিছু প্রতিকূলতার মধ্যে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে ঘনিয়ে উঠছে মন্দা। ২০২৩ থেকে ২০২৬’র মধ্যে বিশ্ব আউটপুটের ৪ লক্ষ কোটি মার্কিন ডলার সমান আর্থিক মূল্য বরবাদ হবে, যা ইউরোপের বৃহত্তম অর্থনীতি, জার্মানির অর্থব্যবস্থার সমান, আর যা ভারতীয় অর্থনীতিতেও বিরাট নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

যেকোনো অর্থনীতিতে ম্যানুফ্যাকচারিং বা উৎপাদন ক্ষেত্রের গুরুত্ব অপরিসীম। জিভিএ (গ্রস ভ্যালু অ্যাডেড বা মোট মূল্য সংযুক্তি) হিসাবে গত অর্থবর্ষের তুলনায় এই অর্থবর্ষের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে উৎপাদন ক্ষেত্র সংকুচিত হয়েছে ৪.৩ শতাংশ হারে। এই ক্ষেত্রটিতে বিরাট মাত্রায় কর্মসংস্থান হয়ে থাকে, বিশেষত কৃষির উদ্বৃত্ত শ্রম। দেখা যাচ্ছে, ২০২০ সালে, অর্থাৎ, কোভিড হানা দেওয়ার আগে উৎপাদন ক্ষেত্র যে অবস্থায় ছিল, ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে তার তুলনায় বৃদ্ধি হবে মাত্র ৬.৩ শতাংশ হারে। এ’থেকে এটা প্রমানিত যে কোভিড নয়, গত ছ’বছর ধরেই দেশের উৎপাদন ক্ষেত্রটির নাভিশ্বাস উঠেছে। ২০১৬-২০২০’র মধ্যে এই ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান অর্ধেক হ্রাস পেয়েছে।

পরিসংখ্যান যা আড়াল করে তা হল, সরকারি ব্যয়ের পরিমাণটি কমেছে লক্ষনীয় হারে। এই বছরের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে সরকারি ব্যয়ের পরিমাণ গতবছরের এই সময়কালের তুলনায় ৪.৪ শতাংশ কম। এবং, ২০১৯- ২০’র তুলনায় ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে সরকারি ভোগব্যয়ের হ্রাসের পরিমাণ প্রায় ২০ শতাংশ! সরকারি ব্যয় বাড়লে বিশেষত দরিদ্র মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়ে, ভোগব্যয়ও বাড়ে। আর, আর্থিক বৃদ্ধির ক্ষেত্রে তার গুরুত্ব অনেক। এই অর্থবর্ষে বাজেটে গ্রামের বিভিন্ন প্রকল্পে ১.৩৬ লক্ষ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিল কেন্দ্র আর বিগত অর্থ বর্ষের তুলনায় ১০০ দিনের কাজের বরাদ্দ ও কমানো হয় ২৫ শতাংশের বেশি। গ্রামাঞ্চলে ১০০ দিনের কাজ রোজগারের এক বড় ভরসা। এই প্রকল্পে কাজ করে অর্জিত অর্থ গ্রামীণ অর্থনীতিকে কিছুটা সচল রাখে। এই প্রকল্পের ব্যাপক চাহিদা থাকা সত্ত্বেও বাজেট বরাদ্দ কাটছাঁট করে মোদী সরকার। বছরের মাঝামাঝি বরাদ্দের অর্থশেষ হয়, কাজ করা সত্ত্বেও মজুরি পায়নি বহু জব কার্ডধারী। থমকে যাওয়া প্রকল্পের কাজ কৃষির বাইরে কর্মসংস্থান তৈরি করতে ব্যর্থ হয়। ক্রমহ্রাসমান আয়, পাশাপাশি মূল্যবৃদ্ধি গ্রামাঞ্চলের মানুষের ক্রয় ক্ষমতাকে সংকুচিত করেছে, যার প্রভাব সামগ্রিক অর্থনীতির উপরই পড়বে।

ভ্রান্ত অর্থনৈতিক পরিচালনা, ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিতে না চাওয়া, মুষ্ঠিমেয় ক্রোনি কর্পোরেটদের স্বার্থে সমস্ত আর্থিক নীতিকে পরিচালিত করতে গিয়ে দেশ আজ দাঁড়িয়েছে গভীর খাদের কিনারে। অনেক আশঙ্কা নিয়ে অপেক্ষা করছে সামনের দিনগুলো।

খণ্ড-29
সংখ্যা-48