প্রতিবেদন
পরিবেশ এবং জনস্বার্থ উপেক্ষা করেই আদানির কয়লা খনিতে খননের অনুমোদন
ignoring environment and public interest

গৌতম আদানি নরেন্দ্র মোদীর ঘনিষ্ঠতম পুঁজিপতি বলেই সুবিদিত। মোদী জমানায় জাঁকিয়ে বসা ক্রোনি ক্যাপিট্যালিজম বা স্যাঙাতি পুঁজিতন্ত্রের কেন্দ্রে থাকা পুঁজিপতিদেরও অন্যতম হলেন এই গৌতম আদানি। অর্থের প্রবল প্রতিপত্তি সম্পন্ন এই পুঁজিপতির কোনো প্রকল্পের অনুমোদন লাভের পথে সরকারি বিধিনিষেধ কি কোনো প্রতিবন্ধক হতে পারে? যদি তা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখাও দেয়, সেই অন্তরায়কে নস্যাৎ করে তার অপসারণ কি তাঁর কাছে অনায়াসসাধ্য হবে না? মধ্যপ্রদেশের সিংরউলি জেলার সুলিয়ারি কয়লা খনি প্রকল্পের অনুমোদন লাভের প্রক্রিয়া ছিল সরকারি বিধিনিষেধকে, পরিবেশকে বিপন্ন না করার বিধানকে খারিজ করার আদানির এরকমই এক আখ্যান যা আমরা এখানে বিধৃত করব।

এই খনির মালিকানা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা অন্ধ্রপ্রদেশ খনি উন্নয়ন কর্পোরেশনের হাতে থাকলেও এখন ঐ খনি থেকে কয়লা উত্তোলনের অধিকারী আদানির মালিকানাধীন সংস্থা। খনি এলাকার বিস্তার ১২৯৮ হেক্টর জুড়ে যার মধ্যে বন অঞ্চল হলো ২৫৯ হেক্টর, কৃষি জমি ২৫২ হেক্টর, গ্ৰাম এলাকা ৫২ হেক্টর, জলাশয় ৪৬ হেক্টর ও বাকিটা ঊষর ভূমি। সংলগ্ন অঞ্চলে একাধিক নদী ও জলাশয়ও রয়েছে। এই প্রকল্পকে চালু করার আবেদন অনেক আগে কংগ্ৰেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ জমানাতে হলেও সেই প্রক্রিয়া তখন গতিলাভ করতে পারেনি। আবার ইউপিএ জমানায় কয়লা ব্লক বণ্টনে দুর্নীতির অভিযোগকে কেন্দ্র করে সুপ্রিম কোর্ট ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসের এক রায়ে বন্টন হওয়া ২০৪টে কয়লা ব্লকের অনুমোদনকে বাতিল করে, যার মধ্যে সুলিয়ারি কয়লা খনিও ছিল। পরে অবশ্য সুপ্রিম কোর্ট সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়ে কয়লা খনিগুলোতে খননের অনুমোদন দেয় এবং সুলিয়ারি খনি কালক্রমে আদানির হস্তগত হয়।

মধ্যপ্রদেশের সিংরউলি জেলাতে বান্ধা ও বিরাউলি নামে দুটো কয়লা খনি থেকে শীঘ্রই কয়লা উত্তোলন শুরু হবে। এছাড়া, জেলায় চালু তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে ছাই নির্গমন এবং জমা হওয়া ছাই-এর আধার থেকে দূষিত পদার্থের বহির্গমনের জন্য এই জেলা “অত্যন্ত দূষিত” বলে চিহ্নিত। এই ধরনের বৈশিষ্ট্যের এক জেলায় কয়লা খননের অনুমোদন প্রদানে যে বিষয়গুলো বিবেচ্য হওয়া উচিৎ তা হল –খনির জন্য জমি অধিগ্রহণের ফলে উচ্ছেদ হওয়া পরিবারগুলোর পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ, পরিবেশের সুরক্ষা, খনি এলাকা সংলগ্ন নদী ও অন্যান্য জলাশয়গুলোকে দূষণমুক্ত রাখা। এই সমস্ত বিষয়কে খতিয়ে দেখতেই কেন্দ্রীয় পরিবেশ, বন ও সামাজিক প্রভাব মূল্যায়ন মন্ত্রকের বিশেষজ্ঞ কমিটি (ইএসি) ২০১৯ সালের ৫ ডিসেম্বর আদানি গোষ্ঠীকে খনি প্রকল্পের সামাজিক প্রভাব সংক্রান্ত মূল্যায়নের রিপোর্ট দিতে বলে। পরিবেশগত ছাড়পত্র প্রদানের বিবেচনায় ঐ রিপোর্টের ভূমিকা ছিল যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এরপর ২০২০ সালের ১৭ এপ্রিল বিশেষজ্ঞ কমিটি অর্থাৎ ইএসি-র বৈঠকে (কোভিড অতিমারির জন্য তখন লকডাউন চালু থাকায় বৈঠক হয়েছিল ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে) আদানিরা সামাজিক প্রভাবের সমীক্ষা রিপোর্টে শুধু জানায় – কত পরিবার উচ্ছেদ হবে তার সংখ্যা, সেই পরিবারগুলোর জাতভিত্তিক বিন্যাস, তাদের জীবিকা ও অর্থনৈতিক অবস্থার কথা। সেদিন কিন্তু আদানিদের কয়লা খনি, অর্থাৎ, সুলিয়ারি কয়লা খনি সম্পর্কে বিবেচনার কথা প্রাথমিকভাবে ইএসি-র এজেন্ডায় ছিল না। ইএসি-র সেদিনের বৈঠকের মিনিটসে উল্লেখ রয়েছে – “মন্ত্রক সেটি অতিরিক্ত বিচার্য বিষয় হিসাবে বিবেচনা করার অনুমোদন ইএসি-কে দেওয়ার পর ইএসি এই বিষয়টার বিবেচনা করছে। প্রস্তাবকে বিশদে খুঁটিয়ে দেখার সময় ইএসি সদস্যদের ছিল না।” অর্থাৎ, কেন্দ্রীয় মন্ত্রকই সেদিন আদানির প্রস্তাব নিয়ে বিবেচনার জন্য ইএসি-কে চাপ দেয়। বিষয়টি নিয়ে আলোচনার জন্য যথেষ্ট সময় না থাকলেও ইএসি সেদিন প্রস্তাব করে – খনি এলাকার একটা তাৎপর্যপূর্ণ অংশ ৪৬ হেক্টরে বিভিন্ন জলাশয় থাকায় নদীগুলোর সুরক্ষার জন্য এক সর্বাঙ্গীন পরিকল্পনা জরুরি হয়ে দেখা দিচ্ছে। ইএসি সেদিন আরো প্রস্তাব দেয়, হুরদুল নালার (যা এক নদীর শাখা) গতিপথকে ঘুরিয়ে দেওয়া এবং অন্যান্য জলাশয় ও জলাধারের ওপর খনন কার্যের প্রভাব কী হবে তা সমীক্ষার জন্য ইএসির এক সাব-কমিটি সংশ্লিষ্ট এলাকা পরিদর্শন করবে।

এরপর ইএসি তাদের ২০২০র ৩০ জুনের বৈঠকে আদানিদের সুলিয়ারি খনি প্রকল্পের অনুমোদন নিয়ে আলোচনা চালায়। আদানিরা ইএসি-কে জানায়, হুরদুল নালার গতিপথকে ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত করার শর্তসাপেক্ষ ছাড়পত্র তারা মধ্যপ্রদেশ সরকারের (এক বিজেপি শাসিত রাজ্য) জলসম্পদ বিভাগের কাছ থেকে পেয়েছে। ইএসি-র কাছে আদানিরা আরও প্রস্তাব দেয় – যেহেতু কোভিড অতিমারি চলছে, ইএসি যেন তাদের সাব-কমিটির সংশ্লিষ্ট এলাকা পরিদর্শনের কর্মসূচিকে স্থগিত রাখে। এইভাবে, ইএসি-র কী করা উচিৎ তার পরামর্শ ইএসি-কে দিতেও আদানিরা দ্বিধা করে না! আদানিরা আরও জানায়, গোপাদ নদীর (যার সঙ্গে হুরদুল নালা মিশেছে) শাখা নদীগুলোর ওপর সুলিয়ারি খনি প্রকল্পের নিকাশী ব্যবস্থার কোনো প্রাসঙ্গিকতা নেই। যেটা  সাব-কমিটির এলাকা সরজমিনে পরিদর্শন করে নির্ধারণ করার কথা, আদানিরাই তার ফলাফল আগেভাগে জানিয়ে তাদের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছে বলে দেখা যাচ্ছে। বিস্ময়ের ব্যাপার হল, আদানিদের পেশ করা এই বক্তব্যের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট এলাকা পরিদর্শন স্থগিত রেখে এবং সুলিয়ারি খনির নিকাশি ব্যবস্থা জলাশয়গুলোতে কোনো দূষণ সৃষ্টি করবে কী না তা পরখ না করেই ইএসি ‘এক বছরের জন্য’ সুলিয়ারি খনি প্রকল্পে পরিবেশগত ছাড়পত্র দেয়। তার হঙ্গে কিছু শর্তও অবশ্যও জোড়ে, যার অন্যতম ছিল খনির কাজের জন্য হুরদুল নালার কোনো জল ব্যবহার করা যাবে না।

আদানির প্রকল্পের ওপর শর্ত চাপানোটাকে তাদের পক্ষে কতদূর মানা সম্ভব? আসরে নেমে গেল নরেন্দ্র মোদীর পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রক। ইএসি-র কাছে তাদের প্রশ্ন এল–পরিবেশ ছাড়পত্র ‘মাত্র এক বছরের জন্য’ দেওয়া হল কেন? আর, কোভিড অতিমারীর মধ্যে সংশ্লিষ্ট এলাকা পরিদর্শন ও সমীক্ষার প্রয়োজনটাই বা কোথায়! ইএসি-র কাছে সংকেত সুস্পষ্ট হয়ে গেল। ২০২১-এর ২৬ ফেব্রুয়ারির তাদের বৈঠকে তারা সিদ্ধান্ত নিল – “আলাপ আলোচনার পর ইএসি মনে করছে যে, বাঁধ নির্মাণ ও বন্যা সুরক্ষা ব্যবস্থার যে প্রস্তাব খনি প্রকল্পের প্রস্তাবকরা করেছে তা সন্তোষজনক এবং এলাকা পরিদর্শনের শর্ত বাদ দিয়ে … সুলিয়ারি কয়লা খনি প্রকল্পে পরিবেশগত ছাড়পত্র প্রদানের প্রস্তাব করা হচ্ছে।”

খনির জন্য জমি অধিগ্রহণের ফলে উচ্ছেদ হওয়া পরিবারের সংখ্যা ১৩৮৬ বলে আদানিরা জানালেও প্রকৃত সংখ্যা তার চেয়ে কিছুটা অতিরিক্ত, ১৫০০র বেশি। জমি অধিগ্রহণ সম্পূর্ণ হয়ে গেছে এবং পরিবেশের ওপর খনি প্রকল্পের প্রভাব সম্পর্কিত রিপোর্টেও প্রান্তিক ও ক্ষতিগ্ৰস্ত জনগণ কি ধরনের সমস্যা ও সংকটের মুখে পড়ছেন তার কোনো বিস্তৃত আলোচনা নেই। খনিটা মধ্যপ্রদেশে আর উচ্ছেদ হওয়া জনগণের পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণের ভার মধ্যপ্রদেশ সরকারেরই। কিন্তু এই ব্যাপারে বিজেপি শাসিত রাজ্য সরকারের দায়বদ্ধতার নিদর্শন একেবারেই নিকৃষ্ট ও উপেক্ষার। খনির জন্য জমি অধিগৃহীত হয়েছে এমন একটা গ্ৰাম হল মাঝোলিপাথ। সেই গ্ৰামের এক যুবক সুমিত কুমার শাহ জানিয়েছেন, খনির জন্য তাঁদের জমি নিয়ে নেওয়া হয়েছে, তবে, “কোভিড অতিমারীর আগেই আমাদের বাড়ির সমীক্ষা হয়েছিল। কিন্তু আমাদের বাড়ি নিয়ে নেওয়ার জন্য ক্ষতিপূরণ কখন দেওয়া হবে কোভিডের পর সে সম্পর্কে কোনো কথা শোনা যায়নি।”

অতএব, আদানিরা যা চেয়েছিল তাই হল। পরিবেশগত ছাড়পত্র তারা পেল, ‘শুধু এক বছরের জন্য’ নয়, স্থায়ীভাবেই। উচ্ছেদ হওয়া জনগণের পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ অবহেলিত রইল। ‘অতি দূষণগ্ৰস্ত’ সিংরউলি জেলা সম্ভবত আরো দূষণের কবলে পড়ল। আর একটা প্রশ্নও বড় হয়ে মাথাচাড়া দিল। খনিতে কর্মসংস্থান হবে মাত্র ১১৫৭ জনের। তার জন্য পরিবেশকে দূষণের এত ঝুঁকির বধ্যে ঠেলে দেওয়া, এত পরিবারকে জমি-বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলা, যথেষ্ট পরিমাণ বন ধ্বংস করা (ভারতের জাতীয় গ্ৰিন ট্রাইব্যুনালের ২০২২-এর মে মাসের রিপোর্ট জানাচ্ছে, ৫০০০০ গাছ কাটার কর্মযজ্ঞ অতি উৎসাহে শুরু হয়ে গেছে), বহু জলাশয়কে বিপন্ন করে তোলা–সুলিয়ারি খনির কয়লা খনন থেকে প্রাপ্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক লাভ কি এই ক্ষয়ক্ষতির সঙ্গে আদৌ সঙ্গতিপূর্ণ হবে?

উড়িষ্যার সম্বলপুর জেলায় আদানি পরিচালিত তালাবিরা-১ কয়লা খনির কৃষিজমি ধ্বংস ও স্থানীয় স্তরে জলসরবরাহে দূষণ সৃষ্টির জন্য খনি পরিচালনার কোম্পানিকে ভালো পরিমাণ আর্থিক জরিমানা করা হয়েছিল এবং সুপ্রিম কোর্টও সেই জরিমানাকে বজায় রেখেছিল। ঝাড়খণ্ডের হাজারিবাগ জেলার গোন্ডালপুরায় আদানি পরিচালিত প্রস্তাবিত কয়লা খনির জমি ও জীবিকা ধ্বংস, স্বাস্থ্য ও জলদূষণের অনিবার্য সম্ভাবনার বিরুদ্ধে স্থানীয় গ্ৰামগুলোর জনগণ প্রতিবাদে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। আদানি পরিচালিত কোম্পানিগুলোর দূষণ সৃষ্টির এমন নজির থাকার কারণে সুলিয়ারি কয়লা খনির পরিবেশগত ছাড়পত্র প্রদানে আরো সতর্কতা অবলম্বনই ন্যায়সংগত হতো। কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর পরিচালনাধীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রকের কাছে নতিস্বীকার করে ইএসি-কে দূষণ নিরোধক ব্যবস্থা খতিয়ে দেখার নিজেদের প্রস্তাবিত পদক্ষেপকে হিমঘরে পাঠিয়ে পরিবেশগত ছাড়পত্র দিতে হল, অবহেলিত হল পরিবেশ-সমাজ-জনগণের স্বার্থ। তবে, সরকার-পুঁজিপতি গাঁটছড়ার প্রতাপে কোথাও কি স্যাঙাতি স্বার্থের ওপরে দেশ-সমাজের স্বার্থ অগ্ৰাধিকার পেয়েছে?

– জয়দীপ মিত্র

খণ্ড-29
সংখ্যা-49