হিমাচল, দিল্লি ও গুজরাট নির্বাচন যে সংকেত ও শিক্ষা দিল
Signals and Lessons from Himachal Delhi Elections

গুজরাট ও হিমাচল প্রদেশের বিধানসভা এবং দিল্লির পৌরসভা নির্বাচনের ফলাফল মোটামুটি যেমন অনুমান ছিল তেমনই হয়েছে, কেবল গুজরাটে বিজেপির এই মাত্রার জয়ের বিষয়টা ছাড়া যা অবশ্যই আরও নিবিড় অনুসন্ধানের দাবি জানায়। তিনটি নির্বাচনের ক্ষেত্রেই বিজেপি ছিল ক্ষমতায়। তার মধ্যে দুটিতে তারা ক্ষমতা হারাল। এই অর্থে দেখলে মোদ্দা হিসেবে বিজেপি হেরেছে। কিন্তু ভোটের ভাগ (৫২ শতাংশের উপরে) আর আসন ভাগ (৮৫ শতাংশের উপরে) উভয় নিরিখে গুজরাটে তাদের জয়ের মাত্রা স্পষ্টতই তাদের বাকি দুটি পরাজয়কে ছাপিয়ে গেছে। এটাও লক্ষ্য রাখতে হবে যে হিমাচল ও দিল্লিতে বিজেপি হেরেছে বটে কিন্তু সেখানেও তারা দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। গুজরাটে কংগ্রেস অভূতপূর্ব ধাক্কা খেয়েছে। আসন সংখ্যা ৭৭ থেকে নেমে ১৭ হয়েছে। কিন্তু স্বল্প ব্যবধানে হলেও বিজেপির কাছ থেকে তারা হিমাচল প্রদেশ কেড়ে নিতে সফল হয়েছে। আপ-এর আসল লাভ এমসিডি নির্বাচনে বিজয় এবং স্বীকৃত জাতীয় দল হিসাবে তার নবলব্ধ মর্যাদা।

বিজেপি এখন হিমাচল প্রদেশ এবং এমসিডি-তে তাদের পরাজয়ের তাৎপর্য কমিয়ে দেখাতে ব্যস্ত, কিন্তু সবাই জানে যে এই দুটি নির্বাচনেও জয় হাসিল করতে বিজেপি কোনও কসরত বাকি রাখেনি। দিল্লি কর্পোরেশনে কোনও কাজ না করেই দীর্ঘ পনের বছর মেয়াদে থাকার কারণে জনগণের ক্রমবর্ধমান ক্ষোভ সম্পর্কে বিজেপি সচেতন ছিল এবং তাই তারা এমসিডি-র দখল ধরে রাখতে বহুবিধ কারসাজি অবলম্বন করেছিল। ২০১৪ সালে মোদি শাসন ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ওরা দিল্লি রাজ্যটাকে কেবল এক মহিমান্বিত পৌরসভায় সংকুচিত করে ফেলার চেষ্টা চালিয়েছে একদিকে আক্রমণাত্মক কেন্দ্রীয় সরকার ও অন্যদিকে পৌরসভার ক্ষমতার মাঝে নিষ্পেষিত করে৷ দিল্লি রাজ্য সরকারের বিপ্রতীপে মিউনিসিপ্যাল ক্ষমতার মর্যাদা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে দিল্লির তিনটি কর্পোরেশনকে একটি একক সত্তায় কেন্দ্রীভূত করা হয় এবং বিজেপির নির্বাচনী সম্ভাবনা উন্নত করার জন্য অস্ত্রোপচারের নিপুনতায় ডিলিমিটেশনের মাধ্যমে সমস্ত ওয়ার্ডকে পুনর্গঠিত করা হয়। এবারে গুজরাট নির্বাচনের সাথে এমসিডি নির্বাচন মিলিয়ে দেওয়ার জন্য নির্বাচনের সময়সূচিতেও হেরফের করা হয়েছিল সংক্ষিপ্ত নোটিশে হঠাৎ করে তারিখগুলি ঘোষণা করার মাধ্যমে।

এই সবকয়টি নির্বাচনেই বিজেপি তার সবরকম আর্থিক সংস্থান, প্রশাসনিক ক্ষমতা, সাম্প্রদায়িক বিষোদ্গার, প্রোপাগান্ডা ব্লিটজক্রিগ এবং তথাকথিত মোদী ক্যারিশ্মাকে কাজে লাগিয়েছে। হিমাচল ও দিল্লিতে বিজেপির পরাজয়কে এই পটভূমি মাথায় রেখেই বুঝতে হবে। দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও হিমাচল প্রদেশে অনেক বিদ্রোহী প্রার্থী সম্পর্কে সচেতন মোদি প্রকাশ্যে নিজের নামে ভোট চেয়েছেন। তবুও হিমাচলের ক্ষুব্ধ ভোটাররা বিজেপিকে ভোটআউট করেছে। হিমাচল হল বিজেপি সাংসদ জেপি নাড্ডার আর ঘৃণা ছড়ানো হাই-প্রোফাইল মোদীমন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুরের নিজের রাজ্য। আমদানি বৃদ্ধি ও প্যাকেজিংয়ের উপর জিএসটি-র সম্মিলিত চাপে হিমাচলের আপেল চাষিদের দুর্দশা, পুরানো পেনশন স্কিম ফিরিয়ে আনার জন্য সর্বত্র সরকারি কর্মচারীদের ক্রমবর্ধমান দাবি এবং অগ্নিপথ প্রকল্পের কারণে সেনাবাহিনীতে নিরাপদ ভবিষ্যত খোঁজার সুযোগ থেকে বঞ্চিত যুবকদের উৎক্ষিপ্ত উত্তেজনা — এই আসল ইস্যুগুলি মোদীর অন্তঃসারশূন্য বাগাড়াম্বরের ঊর্ধ্বে প্রাধান্য পেয়েছে এবং বিজেপিকে ভোটআউট করেছে।

গুজরাটের ফলাফল স্পষ্টতই হিমাচল এবং দিল্লিতে প্রত্যক্ষ করা ভোটপ্রবণতার তীক্ষ্ণ বৈপরিত্যে দাঁড়িয়ে আছে। বিজেপি অলরেডি ২৭ বছর হয়ে গেল রাজ্যে ক্ষমতায় রয়েছে — এই বিষয়টা মাথায় রেখে বৈপরীত্যটিকে আমরা কীভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি? মোদি আমলে গুজরাট অবশ্যই বিজেপির সবচেয়ে শক্ত ঘাঁটি। এটি তো কেবল সংঘ বাহিনীর সবচেয়ে বড় সাম্প্রদায়িক পরীক্ষাগার নয়, এটি আদানি- আম্বানিরও হোমস্টেট এবং নির্বাচনের ঠিক আগে মোদি মহারাষ্ট্রের বরাত থেকে টেনে গুজরাটে কয়েকটি বড় বিনিয়োগ প্রকল্প ঘোষণা করতে সক্ষম হন। কংগ্রেস একের পর এক দলত্যাগের কারণে দুর্বল হয়ে পড়ে, বিশেষ করে ২০১৭ নির্বাচনের তারকা প্রচারক হার্দিক প্যাটেলের দলত্যাগের পর। ফলত তাদের প্রচারও ছিল অনেক স্তিমিত ধরনের। আপ এই পরিস্থিতির পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে এবং সুরাটের পৌর নির্বাচনে তাদের উৎসাহজনক প্রদর্শন ও পাঞ্জাবে এই বছরের শুরুতে তাদের চমকপ্রদ জয়ের প্লাবনে উদ্দীপ্ত হয়ে তারা বিজেপির অব্যাহত শাসনের আসন্ন প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে নিজেকে তুলে ধরার যথাসাধ্য চেষ্টা করে। আপের ভোট স্পষ্টতই কংগ্রেসের চিরাচরিত ভিত্তি ভেঙ্গেই এসেছে, বিশেষ করে গুজরাটের আদিবাসী অঞ্চলে, এবং অ-বিজেপি ভোটের এই বিভাজন থেকে বিজেপি ব্যাপকভাবে উপকৃত হয়েছে।

অ-বিজেপি ভোটের বিভাজন অবশ্য বিজেপির সপক্ষে ৫ শতাংশ ভোটবৃদ্ধির কৌতুহল উদ্রেককারী বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে পারে না। ভোটগ্রহণের শেষ ঘণ্টায় ভোটদানে ব্যাপক বৃদ্ধির বিষয়টি, বিশেষ করে দ্বিতীয় পর্বে যেরকম হল, গুরুতর সন্দেহের জন্ম দেয় এবং ভারতের নির্বাচন কমিশনকে অবশ্যই এই সমস্যাটি তদন্ত করতে হবে এবং বিশ্বাসযোগ্য উত্তর দিতে হবে। ৫ ডিসেম্বরের শেষ ঘণ্টায় ১৬ লাখেরও বেশি ভোট পড়েছে বলে জানা যায়, যা গড়ে ৬.৫ শতাংশ বৃদ্ধি এবং কিছু কিছু নির্বাচনক্ষেত্রে এমনকি ১০ শতাংশেরও বেশি বৃদ্ধি ঘটে। ভোটকেন্দ্রের বাইরে দীর্ঘ লাইনের কোনো চিহ্নই ছিল না, অথচ ইভিএম পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে হঠাৎ করে মাত্র ত্রিশ সেকেন্ড পরপর এত ভোট পড়েছে! হাতবাছাই আমলাদের দ্বারা নির্বাচন কমিশন ভরে যাওয়ায়, যা সুপ্রিম কোর্টের মতে এই প্রতিষ্ঠানের অখণ্ডতা ও স্বায়ত্ততা এবং নির্বাচন পরিচালনার ক্ষেত্রে অত্যন্ত বিরূপ প্রভাব ফেলছে, ভারতের ভোট প্রক্রিয়ার অখণ্ডতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পর্কে সন্দেহের জন্ম দিয়েছে, ভারতের নির্বাচন ব্যবস্থা ক্রমশ অন্ধকার মেঘাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে।

গুজরাট থেকে আসা প্রতিবেদনগুলি ইঙ্গিত দিচ্ছে যে বিজেপি ইতিমধ্যেই আপ বিধায়কদের মধ্যে দলত্যাগের মরিয়া কারিকুরি চালাচ্ছে। আপ বিধায়কদের মধ্যে বেশ কয়েকজন অতীতে বিজেপির সাথে যুক্ত ছিল। আপ এপর্যন্ত মূলত কংগ্রেসের গণভিত ভেঙেই বেড়ে থাকতে পারে, কিন্তু এখন তা একটি জাতীয় দল হিসাবে বড় হয়েছে, বিজেপির ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর ইচ্ছা এবং শক্তি থাকলে তবেই একমাত্র এই দল গুরুত্ব সহকারে বিবেচিত হতে পারে। কংগ্রেস গুজরাটে খারাপ ফল করেছে, কিন্তু কঠিন লড়াইয়ের মধ্যে জিগনেশ মেভানির জয় সংঘ ব্রিগেডের সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সকল মানুষের কাছেই এক উৎসাহজনক সংকেত হিসেবে থাকছে। পরের বছর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিধানসভা নির্বাচন নির্ধারিত আছে — উত্তর-পূর্বের ত্রিপুরা থেকে দক্ষিণে কর্ণাটক পর্যন্ত, ২০২৪-এ বিজেপিকে ভোটআউট করতে আগে মোদী শাসনকে চোট দেওয়ার লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি আঘাত হানতে হবে।

এমএল আপডেট সম্পাদকীয় ১৩-১৯ ডিসেম্বর ২০২২

খণ্ড-29
সংখ্যা-48