প্রতিবেদন
কৃষিতে স্মার্ট বিপ্লব
revolution in agriculture

গত মার্চ মাসে ফুড কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়া হরিয়ানায় কৃষকদের নির্দেশ দেয় সরকারি মাণ্ডিগুলির বদলে সরাসরি আদানি কোম্পানির সাইলোতে ফসল বেচতে। কৃষকের বিরোধিতার মুখে পড়ে এফসিআই নোটিশটিকে সংশোধন করে নিতে বাধ্য হয়। নোটিশটিতে বলা হয়েছিল যে, আগামী মরশুম থেকে মাণ্ডিগুলির খোলা খলিয়ানে আর গম নেওয়া হবে না এবং আদানি কোম্পানির সাইলোগুলোর কাছাকাছি থাকা সরকারি মাণ্ডিগুলির এজেন্টরা কৃষকদের বস্তা সরবরাহ করবে না। নোটিশটিতে এ’কথাও জানানো হয় যে উপরতলার নির্দেশে আদানিদের সাইলোগুলিতে সরাসরি গম পাঠাতেই এই ব্যবস্থা। কৃষকদের বিক্ষোভের পর এফসিআই নতুন একটি নোটিশ এনে বলেছে যে কৃষকেরা ‘চাইলে’ আদানির সাইলোতে সরাসরি ফসল দিতে পারে এবং এজেন্সিগুলি ‘চাইলে’ বস্তা সরবরাহ করতে পারে।

ফুড কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়া (এফসিআই)-কে ধাপে ধাপে ‘আদানি এগ্রি লজিস্টিকস’-এর হাতে তুলে দিচ্ছে মোদি সরকার। পাব্লিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের নামে। ফুড-চেইনের ব্যবস্থাগত সমস্ত দিকই দ্রুত কেন্দ্রীভূত হচ্ছে আদানির হাতে। দেশ জুড়ে ৯০০’র ওপর সাইলোর এক জাল বিছিয়েছে আদানি। পাঞ্জাব ও হরিয়ানায় সাইলোগুলিকে ঘিরে প্রাইভেট রেল, স্বয়ংক্রিয় শস্য প্রক্রিয়াকরণ কারখানা ইত্যাদি সবরকম পরিকাঠামো আদানিদের নিজস্ব। সরকারি কোষাগার থেকে এসবের জন্য ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। আদানিদের পরিকাঠামো সম্পত্তি পাহারা দেওয়ার জন্য নিজস্ব সশস্ত্র সুরক্ষা বাহিনী গড়ে তুলতেও সবরকম পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে সরকার।

সবুজ বিপ্লবের দশক থেকে ভারতীয় কৃষিতে কৃষকের পতন ও কর্পোরেট আধিপত্যের উত্থান শুরু হয়। নয়া উদার অর্থনীতি আসার পর এদের চরম বৃদ্ধি ঘটে। আহরণ, পরিবহন, সঞ্চয়ন, প্রক্রিয়াকরণ ও বিতরণ – সর্বক্ষেত্রে বড় বড় কর্পোরেটদের বিস্তার ঘটে। এদের স্বার্থেই তিনটি কৃষি আইন প্রণয়নের চেষ্টা করেছিল মোদি সরকার। ফসলের ব্যবসা বাণিজ্য, ফসলের মূল্য নির্ধারণ এবং ফসল মজুতদারি — এই তিনটি বিষয়ে তিনটি আইন। এর বিরুদ্ধে সবচেয়ে ব্যাপক ও একরোখা প্রতিরোধ গড়ে তোলে পূর্বতন সবুজ বিপ্লবের মূল মূল এলাকার কৃষকেরা। কৃষকদের মূল কথা ছিল, আইনগুলি সমগ্র কৃষি ব্যবস্থার ওপর কর্পোরেট কোম্পানিগুলির একচেটিয়া আধিপত্য কায়েম করে কৃষি থেকে কৃষকদেরই বিচ্ছিন্ন করে দেবে এবং দেশের খাদ্য নিরাপত্তা সম্পূর্ণ ধ্বংস করবে। দিল্লি সীমান্ত ঘিরে গড়ে ওঠা অভূতপূর্ব কৃষক আন্দোলন শেষ পর্যন্ত সরকারকে বাধ্য করে আইনপ্রস্তাবগুলি প্রত্যাহার করে নিতে। কিন্তু ভারতীয় কৃষির ওপর কৃষি-কর্পোরেটদের একাধিপত্যের গতি থেমে যায়নি। রিলায়েন্স ফ্রেস, আদানি এগ্রিফ্রেস, ভারতি’স ফিল্ডফ্রেস — কাঁচা ফসলের বাজারে কর্পোরেটরা জাঁকিয়ে বসছে। বীজ থেকে ফসল হয়ে পাকস্থলিতে খাদ্য পৌঁছনো পর্যন্ত খাদ্যপ্রবাহের সমগ্র প্রক্রিয়া আরও তীব্র গতিতে কর্পোরেট কোম্পানিগুলির হাতে একচেটিয়া হয়ে যাচ্ছে। এই আধিপত্য আরও আঁটোসাটো ও সর্বব্যাপি করে তোলার নতুন প্ল্যাটফর্ম হিসেবে আসছে ডিজিটাল-কৃষি, যাকে বিশ্ব ইতিহাসের ‘চতুর্থ কৃষি বিপ্লব’ বলছেন অনেকে।

সবুজ বিপ্লবের ধারাতেই ভারতের কৃষিতে এই নতুন বিপ্লব আসছে। কৃষিক্ষেত্রে স্মার্টবিপ্লব বা ডিজিটাল-কৃষি। আপাতত পাঁচ বছরের পরিকল্পনা হিসেবে ‘ডিজিটাল এগ্রিকালচার মিশন ২০২১–২০২৫’ আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নরেন্দ্র সিং তোমর ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে। বলা হয়েছে, ডিজিটাল-কৃষি ব্যাপারটা সে অর্থে কোনও প্রজেক্ট সম্পর্কিত ব্যাপার নয়, জনগণ সম্পর্কিত ব্যাপার, এবং ব্যাপারটা বাস্তুতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সম্পন্ন হবে। এ’বছর ‘পিএম কিসান সম্মান সম্মেলনে’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, “বর্তমানে গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে ড্রোন প্রযুক্তি নির্ভর আধুনিক কৃষি পদ্ধতিই সময়ের দাবি”। তিনি এ’কথাও বলেন যে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে আমাদের আরও খোলা মনে গ্রহণ করা দরকার।

জুলাই-সেপ্টেম্বর মাসে চীনের সরকারি মেগা কর্পোরেট সিনজেন্টা (Syngenta) ভারতে ১৭ হাজার কিলোমিটার ড্রোনযাত্রা সংগঠিত করেছে ১৩টি রাজ্যের ক্ষেত-খামারের ওপর দিয়ে ৫০টি ড্রোন উড়িয়ে। অনেকগুলি রাজ্যে বড় বড় ইভেন্ট ছিল এই ড্রোনযাত্রার অঙ্গ। কেন্দ্রীয় ও রাজ্যের মন্ত্রীরা সেগুলিতে উপস্থিত ছিলেন। সিনজেন্টা ইন্ডিয়ার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে, আধুনিকতম প্রযুক্তির প্রয়োগে কৃষিকে কৃষকের পক্ষে লাভজনক করে তোলাই সিনজেন্টার লক্ষ্য, অনেকগুলি রাজ্য সরকারের সাথে বেশ কিছুদিন যাবৎ সেই লক্ষ্যে কাজ চলছে। নভেম্বরে নয়টি ফসল সংক্রান্ত ‘ক্রপওয়াইজ গ্রোয়ার’ অ্যাপ চালু করেছে সিনজেন্টা যার মাধ্যমে নয়টি ভারতীয় ভাষায় ড্রোন ও বুম স্প্রেয়ার প্রযুক্তির নাগাল তথা আট রকম মূল মূল বিষয়ে তথ্যানুসন্ধান পাবে কৃষকেরা। প্রধানমন্ত্রী আমাজন কোম্পানির হাতে তুলে দিয়েছেন ভারতের ৫ কোটি কৃষকের সরকারি ডেটা। নীতি আয়োগের সাথে আইবিএম কোম্পানির চুক্তি হয়েছে চার বছর আগেই। নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে আণবিক জৈব কারিগরির ব্যবসায়িক প্রয়োগের পর থেকে বীজ ও কীটনাশক উৎপাদন ক্ষেত্র দুটি পরস্পর যুক্ত হতে থাকে। এখন বিগ-ডেটা স্ট্র্যাটেজি তাদের আরও বৃহত্তর মিলনক্ষেত্র যোগাচ্ছে। অ্যাপল, আমাজন, গুগল, আলিবাবা সহ সমস্ত বিগডেটা কর্পোরেটগুলি খাদ্যশিল্পের বিগ প্লেয়ার হয়ে উঠছে—“ডেটা এখন নতুন মাটি”।

বিশ্বের বীজ ও কৃষি রাসায়নিকের বাজার যে ৪টি কর্পোরেটের একচেটিয়া দখলে, সিনজেন্টা তাদের মধ্যে এক নম্বরে। সুইজারল্যাণ্ডের কৃষি-রাসায়নিক কোম্পানি সিনজেন্টাকে ২০১৭ সালে কিনে নিয়ে চীনা সরকার তাদের নিজস্ব দুটি সংস্থা ‘সাইনোকেম’ ও ‘কেমচাইনা’-কে সিনজেন্টায় মিলিয়ে দেওয়ার পর পৃথিবীর কৃষিশিল্পে বৃহত্তম অংশের নিয়ন্ত্রক সিনজেন্টা। শুধু বীজ ও রাসায়নিক উৎপাদনে নয়, কৃষি উপাদানের সমস্ত ক্ষেত্রসহ — বড় ডেটা, বড় প্রযুক্তি আর বড় লগ্নি — এই সমস্ত মূল মূল ক্ষেত্র জুড়েই ছড়ানো তাদের পুঁজির জাল। অন্তরজাল বিস্তারের জন্য আগামী কয়েক বছরের মধ্যে চীন মাহাকাশে নিম্নকক্ষপথে স্থাপন করবে ১০ হাজার ভূ-স্থির স্যাটেলাইটমালা। চীনের আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রের বাইরে সিনজেন্টার ব্যবসায়ের ঘোষিত ফোকাসবিন্দু হল ভারত, ব্রাজিল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ২০৫০ সালের দিকে তাকিয়ে তাদের দিশা ঘোষণা করেছে তারা : জনসংখ্যা ও ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির কারণে খাদ্যের চাহিদা বাড়বে, খামারগুলি আরও কেন্দ্রীভূত হবে, কৃষিকাজ একক চাষির কাজের বদলে যৌথ বিজনেস ফার্মের চেহারা নেবে, রোবট ও ড্রোন মানবশ্রমকে প্রতিস্থাপিত করবে, জিন সম্পাদিত শস্য ব্যাপক প্রচলিত হবে, স্যাটেলাইট নজর রাখবে প্রতিটি ফসলের শরীর স্বাস্থ্য, নির্দেশ দেবে ও ব্যবস্থাপনা করবে চাষের প্রতিটি পদক্ষেপে।

Smart revolution in agriculture_0

সিনজেন্টা ও আদানি কোম্পানি হাত মিলিয়েছে হিমাচলের আপেল চাষিদের উপকার করতে। সিনজেন্টা ‘আদর্শ আপেল বাগিচা’ গড়ে তুলছে, আর আদানি এগ্রিফ্রেশ সরাসরি বাগিচা থেকে আহরণ করে বাজারজাত করছে। হিমাচল প্রদেশের ৭ শত গ্রামের ১৭ হাজার আপেল উৎপাদককে নিজেদের আওতায় এনেছে আদানি। আপেল চাষের ‘সিনজেন্টা প্রোটকল’ ও আদানির সিমলায় স্থিত ‘আবহাওয়া নিয়ন্ত্রক গুদাম’-এর সমন্বয়ে ও তত্ত্বাবধানে চলবে আপেলের বাগিচা ও বাজার। বড় বড় শহরের দৈনন্দিন বাজার ও রেস্তোরাঁয় কাঁচা সব্জি সরবরাহের নেটওয়ার্ক ‘নিঞ্জাকার্ট’-এর লগ্নিকারীদের মধ্যে অন্যতম হল সিনজেন্টা ও ওয়ালমার্ট। ভারতে টম্যাটো, ক্যাপসিকাম, মরিচ, তরমুজ, ভুট্টা সহ বহু ফসলের বীজের বাজার সিনজেন্টার। সিনজেন্টার ৪০ ধরনের কীটনাশক ভারতে অনুমোদিত। ধান, তুলো ও সয়াবিন — আপাতত এই তিনটি চাষে ড্রোনের মাধ্যমে কীটনাশক ছড়ানোর ছাড়পত্র পেয়েছে তারা। ‘জয় কিসান’ ফিনটেক (লগ্নি-প্রযুক্তি) সংস্থার সাথে গাঁটছড়া বেঁধে কৃষিঋণের বাজারেও বিস্তার করছে তাদের পসার। দেশের ৭৫টি সেরা কৃষি-বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণাকেন্দ্রের ভেতরে কাজ করছে সিনজেন্টা।

অবশ্য নিছক ব্যবসা নয়, সামাজিক দায় সম্পর্কেও বলেছে সিনজেন্টা। ‘কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি’-র দায় মেটাতে ২০২৫ সাল পর্যন্ত সিনজেন্টার ঘোষিত সামাজিক কর্মসূচি হল : ৭৫টি বুনিয়াদি পরিকাঠামোযুক্ত সব্জি-বাজার, ৫০০ গ্রামে সৌর বিদ্যুৎ, ৩০টি গ্রামের সামাজিক পরিবর্তন, ১০ হাজার যুবাকে গ্রামীণ শিল্পদ্যোগী হিসেবে ট্রেনিং; ১০ হাজার কৃষককে সেচ ও চাষ প্রকল্পে সুবিধা প্রদান, ১০০ গ্রামে নিরাপদ পানীয় জল, ১০ হাজার কৃষককে মাটির উর্বরতায় সহযোগ; ৫ লক্ষ কৃষককে স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা প্রদান, ডাক্তারদের জন্য ২৫০০ সচেতনতা বৃদ্ধি শিবির, অভাবী কৃষককে সহযোগিতা; সিনজেন্টা কমিউনিটি এনগেজমেন্ট উদ্যোগের মাধ্যমে শিক্ষা, শুচি ও পরিচ্ছন্নতা, গ্রামীণ পরিকাঠামো ইত্যাদি শিক্ষা প্রদান।

কোন জমিতে কোন বছর কোন বীজ কোথা থেকে কিনে কোন মেসিন দিয়ে কীভাবে বপন করবেন, আবহাওয়া কেমন, মাটিটা কেমন, কতটা আর্দ্র, কতটা শুষ্ক, চারার শরীর-স্বাস্থ্য কেমন আছে, কোন বিষ কোন সার কোন পুষ্টি কতটা দিতে হবে — এইসব চিন্তা আর কৃষককে করতে হবে না। কৃষকের হাতের স্মার্টফোনে অ্যাপে আসা নির্দেশ মেনে চললেই হবে। লেবার খুঁজতেও হবে না, রোবোট ও ড্রোন করে দেবে কাজগুলি। রোবোট হোক বা ড্রোন, কৃষির সব যন্ত্রপাতিই হবে স্মার্ট। আকাশে হাজার হাজার স্যাটেলাইটের সাথে ইন্টারনেটে যুক্ত থাকবে স্মার্টমেসিনগুলি। তারা চাষের প্রতি মুহূর্তের সমস্ত ডেটা সংগ্রহ করে পাঠাবে আর আকাশ থেকে আসা নির্দেশ অনুযায়ি সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ করবে। ফসল ফলানোর পর কোন বাজারে কোন চেইনের মধ্যে দিয়ে কত দরে বিক্রি করবেন তাও স্মার্টভাবে ঠিক হবে। প্রতিটি পণ্যের প্রতিটি ক্রয়-বিক্রয়ের হদিস ধরা থাকবে ব্লকচেইন কারিগরিতে, উপভোক্তা চাইলে জেনে যাবেন বস্তুটি কোন খামারে কোন কৃষকের জমিতে ফলানো। উৎপাদন শুরু হওয়ার অনেক আগে বীজের জীন সম্পাদনা থেকে শুরু করে উৎপাদনের পরে শেষ উপভোক্তার কাছে পৌঁছনো পর্যন্ত সমগ্র প্রক্রিয়াটি হবে ডিজিটাল ও স্মার্ট। সুতরাং ভারতীয় কৃষিতে অবশেষে আচ্ছে দিন আসছে।

- মলয় তেওয়ারী

খণ্ড-29
সংখ্যা-48