আইনি সংস্কারের মাধ্যমে আদালতের ক্ষমতা খর্ব করার প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ইজরায়েলে পথে নামলেন লক্ষ লক্ষ মানুষ
millions-of-people

ইজরায়েলে নতুন সরকার গঠিত হয় গতবছরের ডিসেম্বর মাসে। ভাষ্যকারদের মতে ইজরায়েলের ইতিহাসে এটা ‘সবচেয়ে দক্ষিণপন্থী’ সরকার। কিন্তু নেতানিয়াহু সরকার ক্ষমতায় বসার কিছুদিন পর থেকেই সরকার প্রস্তাবিত এক আইনি সংস্কারকে কেন্দ্র করে সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জোরালো হতে থাকে, এবং গত দশ সপ্তাহ ধরে প্রতিবাদ অব্যাহত রয়েছে। তবে, এই প্রতিবাদ সবচেয়ে প্রবল আকার নেয় গত শনিবার ১২ মার্চ। সেদিন ইজরায়েলের বিভিন্ন শহরে লাখ লাখ মানুষ পথে নেমে প্রস্তাবিত আইন বাতিলের দাবিতে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন এবং অন্তত পাঁচ লাখ মানুষ প্রতিবাদে অংশ নেন। শুধু রাজধানী টেল আভিভেই সমাবেশিত হন এক লক্ষের বেশি মানুষ এবং উত্তরের হাইফা শহরেও ৫০,০০০’র বেশি মানুষ প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশ নেন। তাঁরা রাস্তা অবরোধ করে প্রস্তাবিত সংস্কারের এবং সরকারের বিরুদ্ধে শ্লোগান দিতে থাকেন। শ্লোগানগুলোর অন্যতম ছিল “একনায়কতন্ত্র চলবে না”। প্রতিরোধ আন্দোলন চলার সময় রোম সফরে যাবার জন্য নেতানিয়াহুর বিমানবন্দরে যাওয়ার প্রয়োজন ছিল, কিন্তু তাঁর যাত্রাকে আটকাতে বিক্ষোভকারীরা বিমানবন্দর যাওয়ার মূল রাস্তা অবরোধ করেন। সে সময় আবার ইজরায়েল সফরে এসেছিলেন মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব লয়েড অস্টিন। টেল আভিভের কেন্দ্রস্থলে প্রতিরক্ষা দপ্তরে নেতানিয়াহু ও ইজরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইয়োভা গ্যালান্টের সঙ্গে অস্টিনের আলোচনার কথা ছিল। কিন্তু প্রতিবাদ তীব্র হতে থাকায় নিরাপত্তার কারণে অস্টিনের পক্ষে বিমানবন্দর অঞ্চল ছেড়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। নেতানিয়াহু হেলিকপ্টারে গিয়ে বিমানবন্দর সংলগ্ন স্থানে অস্টিনের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নেন। ইজরায়েলে এই প্রতিবাদ আন্দোলন ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। প্রতিবাদের ইস্যুর প্রতি পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর এক অংশের সমর্থন রয়েছে বলে দেখা গেছে। টেল আভিভের পুলিশ প্রধান আমিচাই এশেদকেও উর্দি পরিহিত অবস্থায় মিছিলকারীদের সঙ্গে হাঁটতে দেখা গেছে। গেরেপ্তার, জলকামান, স্টান গেরেনেড, কোনো কিছুই প্রতিবাদ আন্দোলনের তীব্রতাকে প্রশমিত করতে পারেনি। ইজরায়েলি সংবাদপত্র হারটেজ’এর মতে, এই বিক্ষোভ কর্মসূচি “দেশের ইতিহাসে বৃহত্তম প্রতিবাদ সমাবেশ”।

নেতানিয়াহু সরকারের আইনি সংস্কারের উদ্দেশ্য হল সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি নিয়োগে সরকারের ভূমিকাকে নির্ধারক করা। সরকারের প্রস্তাবিত সংশোধনী সংসদে পেশ হয়েছে এবং তা নিয়ে সংসদে প্রচুর প্রতিবাদ ও বিতর্ক চলছে, এবং সরকারের বিপক্ষে ও পক্ষে মতামত পেশ হচ্ছে। ইজরায়েলের সুপ্রিম কোর্টে এখন বিচারপতি নিয়োগ হয় পেশাদার ব্যক্তি, বিচারক ও সংসদ সদস্যদের নিয়ে গঠিত এক কমিটির মাধ্যমে। কিন্তু সরকার চাইছে সর্বোচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগে শেষ কথা বলবে আইনসভা। প্রস্তাবিত নতুন কমিটিতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকবে আইনসভার সদস্যদের, এবং ইজরায়েলে এখন দক্ষিণপন্থী জোট সরকার থাকায় এই সদস্যদের অধিকাংশই আসবে দক্ষিণপন্থী ও ধর্মীয় রক্ষণশীল সংগঠনগুলো থেকে। আর এটা সম্ভব করতে পারলে দক্ষিণপন্থী মনোভাবাপন্ন ও সরকার অনুগত বিচারপতি দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট ভরিয়ে ফেলতে অসুবিধা হবে না। এছাড়া, পেশ করা সংস্কারে আরও প্রস্তাব করা হয়েছে, সংসদ সুপ্রিম কোর্টের কোনো সিদ্ধান্ত ও রায়ে আপত্তি জানালে সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত খারিজ হয়ে গিয়ে সংসদের অবস্থানই গ্ৰহণীয় হবে। সুপ্রিম কোর্ট যে কিছু প্রশাসন বিরোধী রায় দেয়, সরকারের কোনো কোনো সিদ্ধান্তকে নাকচ করে, সেটা নেতানিয়াহু ও তাঁর দক্ষিণপন্থী অনুগামীদের কাছে অনর্থক ও অনাবশ্যক প্রতিবন্ধক। সরকারের ধারণায়, সুপ্রিম কোর্ট এখন অনেক ক্ষমতা ভোগ করে এবং সেই ক্ষমতায় লাগাম পরাতে হবে।

ইজরায়েলের সংসদে সদস্য সংখ্যা ১২০, আর নেতানিয়াহুর জোট সরকারের সাংসদ সংখ্যা ৬৪। অর্থাৎ, জোট সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা একেবারেই কানঘেঁষা। প্রস্তাবিত আইন পাশ হলে সংসদের ৬১ জন সাংসদই সুপ্রিম কোর্টের কোনো সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপত্তি জানালে তা খারিজ হয়ে যাবে। এইভাবে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতাতেই শুধু বিপর্যয় ঘটানো হবে না, ন্যূনতম সংখ্যাগরিষ্ঠতার বলেই সরকার দেশের জনগণকে তাদের স্বৈরাচারী সিদ্ধান্তের অধীন করতে পারবে। এই আইনি সংস্কারের পরিকল্পনার পিছনে আরো যে উদ্দেশ্য কাজ করছে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন তার একটি হল, “প্যালেস্তিনীয় জমিতে ইজরায়েলের পুলিশ ফাঁড়িকে অবৈধ” বলে সুপ্রিম কোর্টের বিধান। এই নির্দেশ নেতানিয়াহুদের কাছে এক কাঁটা হয়ে দেখা দেয়। এছাড়া, প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে চলছে দুর্নীতির মামলা। এই আইন পাশ হলে সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে নেতানিয়াহু দোষী সাব্যস্ত হওয়া থেকে রেহাই পেতে পারেন এবং তাঁর বিরুদ্ধে চলা মামলা খারিজ পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে। বিজ্ঞানি এবং প্রতিবাদের অন্যতম সংগঠক শিকমা ব্রেসলার জানিয়েছেন, “নতুন সরকার এমন আইন আনতে চাইছে যার ফলে বিচার ব্যবস্থা সহ সবকিছুতেই সরকারই হবে সর্বোচ্চ, আর তাই আমরা এখানে সমবেত হয়েছি এই আইন যাতে পাশ হতে না পারে তা সুনিশ্চিত করতে।” দ্য টাইমস অব ইজরায়েল পত্রিকাও ব্যক্ত করেছে এই অভিমত, “এই আইন পাশ হলে রাষ্ট্রের জীবনে গণতান্ত্রিক অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটবে।”

নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন জোট সরকার আজ ইজরায়েলে যা করছে, আমাদের কাছে তা একেবারেই অপরিচিত ঠেকছে না। আমাদের দেশেও নরেন্দ্র মোদী সরকার সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি নিয়োগে সুপ্রিম কোর্ট চালিত কলেজিয়াম ব্যবস্থাকে গুরুত্বহীন করে তুলে সরকারের ভূমিকাকে কর্তৃত্বময় করে তুলতে চাইছে। নরেন্দ্র মোদী সরকারের অভিপ্রায় প্রকাশ করে আইন মন্ত্রী কিরেন রিজিজু বলেছেন, আইন মন্ত্রকের মাধ্যমেই সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের মনোনয়ন হওয়াটা বাঞ্ছনীয়। আর ইজরায়েলের চরম দক্ষিণপন্থী ধর্মীয় জায়নবাদ দলের সাংসদ সিমচে রথমান বলেছেন, “১ নভেম্বর জনগণ বাড়ি থেকে গিয়ে ভোট দেন। আর তাঁরা এই ইস্যুতে ভোট দিয়েছেন।” দেশ ভিন্ন হলেও স্বৈরাচারী সরকার ও দক্ষিণপন্থার প্রতিনিধিদের মধ্যে কি ভয়ঙ্কর সাদৃশ্যকে আমরা দেখতে পাচ্ছি। স্বাধীনতাকে খর্ব করে স্বৈর অভিপ্রায়কে জনগণের ওপর চাপিয়ে দিতে সংসদীয় গরিষ্ঠতা সর্বত্রই দক্ষিণপন্থী সরকারের কাছে এক সুবিধাজনক কৌশল হয়ে উঠেছে ও উঠছে।

- জয়দীপ মিত্র

খণ্ড-30
সংখ্যা-6