শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেই সরকারী কর্মচারী ও শিক্ষক সমাজের আন্দোলন ক্রমশ শক্তিশালী হচ্ছে
teachers-societies-is-getting-stronger

একটি আন্দোলনের শক্তি বোঝা যায় তাতে সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মধ্যে দিয়ে। সরকারী কর্মচারী ও শিক্ষকদের যে অনশন অবস্থান চলছে কেন্দ্রীয় হারে ডিএ, দুর্নীতিমুক্ত নিয়োগ সহ কয়েকটি দাবি নিয়ে, সেখানে এই শক্তির জায়গাটি লক্ষ করা যাচ্ছে। গত ১০ মার্চ ২০২৩ যে ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়েছিল, তাতে সংগঠন নিরপেক্ষভাবে যে স্বতঃস্ফূর্ততা নিয়ে সমস্ত স্তরের সরকারী কর্মচারী ও শিক্ষক শিক্ষিকারা সামিল হয়েছিলেন, তা এ’কারণেই গভীর তাৎপর্যবাহী।

ধর্মঘটের অনেক আগে থেকেই এর সমর্থনে বিভিন্ন সরকারী অফিসে, স্কুলে, এলাকায় এলাকায় হয়েছে মিছিল মিটিং, লিফলেট বিতরণ। দেওয়ালে দেওয়ালে আটকানো হয়েছে ধর্মঘটের সমর্থনে পোস্টার। প্রতিবারের মতো এবারও তৃণমূল শাসিত রাজ্য সরকার ধর্মঘট ভাঙার জন্য স্বৈরতান্ত্রিক নির্দেশিকা জারি করে। কিন্তু সেই নির্দেশিকার রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করেই হাজারে হাজারে সরকারী কর্মচারী ও শিক্ষক শিক্ষিকা ধর্মঘটে সামিল হন।

শহীদ মিনার চত্বর, যেখানে চলছে কেন্দ্রীয় হারে ডিএ ও স্বচ্ছ নিয়োগের দাবিতে লাগাতার অনশন অবস্থান — ১০ মার্চ কার্যত দেখল এক জনপ্লাবন। কলকাতা ও সংলগ্ন জেলাগুলি থেকেই শুধু নয়, দূরবর্তী নানা জেলা সহ গোটা রাজ্যের আন্দোলনকারীরাই সেদিন শহীদ মিনার চত্বরে হাজির হন। একদিকে যখন মূল মঞ্চে বিপুল ভিড়ের সামনে চলছে লাগাতার ভাষণ, তখন অন্যদিকে আবার এলাকা ভিত্তিক শিক্ষক শিক্ষিকারা নিজেদের মধ্যে ছোট ছোট জমায়েতে সেরে নিয়েছেন আন্দোলনের ভবিষ্যৎ রূপরেখা নিয়ে মত বিনিময়।

গোটা রাজ্যের সরকারী অফিস, স্কুল ও আদালত চত্বর সহ নানা জায়গায় সেদিন ধর্মঘটে যে অভূতপূর্ব সাড়া পড়ে, তা সরকারের কর্তাব্যক্তিদের যেমন বিব্রত করেছে তেমনি জনসমাজেও তুলেছে খানিক ঢেউ। সংবাদ মাধ্যমের পাতা তারপর থেকে নিয়মিতভাবে এই সংক্রান্ত সংবাদ পরিবেশনে বাধ্য হচ্ছে।

তবে সমস্ত আন্দোলনকারীরা এও বুঝতে পারছেন যে এই সরকার সহজে সরকারী কর্মচারী ও শিক্ষকদের দাবি মেনে নেবে না। নানাভাবে আন্দোলনকে দমন করার চেষ্টা করবে। বস্তুত সেই চেষ্টা ধর্মঘট ভাঙার নোটিশ জারি থেকে শুরু করে ধর্মঘটের পর শো কজ করা — নানাভাবে সরকার শুরুও করে দিয়েছে। বিষয়টা শুধু সরকারী নির্দেশিকা জারির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই৷ ধর্মঘটের দিন থেকেই দলীয় নির্দেশে তৃণমূলের গুণ্ডাবাহিনী মাঠে নেমে পড়েছে। বাইক বাহিনী স্কুলে স্কুলে ঢুকছে। শিক্ষক শিক্ষিকা শিক্ষাকর্মীদের ধর্মঘটে সামিল হবার জন্য হেনস্থা করছে, বাদ থাকেনি শারীরিক নিগ্রহও। কয়েকটি স্কুলে তৃণমূলী গুণ্ডাবাহিনী তালাও ঝুলিয়ে দিয়েছে। আন্দোলনের পক্ষ থেকে চাপ বাড়ানোর পর প্রশাসনের হস্তক্ষেপে কয়েকটি জায়গায় সমাধান হলেও সার্বিকভাবে পুলিশ প্রশাসনের দলদাস চরিত্রটি এই পর্বে আরেকবার সামনে এসেছে৷ সব দেখেও তারা অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র সেজে বসে আছে। সরকারী কর্মচারী ও শিক্ষক শিক্ষিকাদের গরিষ্ঠ অংশটি সাহসের সঙ্গেই এই দুর্বৃত্ত হামলার মোকাবিলা করছেন।

এই আন্দোলনের বিশেষ একটি দিক হল শিক্ষিকাদের সক্রিয় সাহসী ভূমিকা। তাঁরা নিয়মিত দলবেঁধে আন্দোলন মঞ্চে সামিল হয়েছেন। ধর্মঘটের প্রচারে ছিল তাঁদের সক্রিয় অংশগ্রহণ। বিপুল সংখ্যায় তাঁরা ১০ মার্চ ভরিয়ে দিয়েছিলেন শহীদ মিনার চত্বর। তাঁদের উৎসাহ উদ্দীপনা সাহস সমাজে সার্বিকভাবে যে মহিলা জাগরণ ঘটছে তারই এক বলিষ্ঠ প্রকাশ৷

একদিকে যখন তৃণমূলের গুণ্ডাবাহিনী ধর্মঘটীদের ওপর আক্রমণ চালাচ্ছে, রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধানের নির্দেশে ধর্মঘটীদের শো কজ করা হচ্ছে, তখন ১২ মার্চ সকাল সাড়ে এগারোটায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন রাজ্যের সাংবিধানিক রাজ্যপাল শ্রীযুক্ত বোস।

রাজ্যপাল স্বীকার করে নেন সরকারী কর্মচারী ও শিক্ষকদের দাবি ন্যায্য। তিনি নিজেও যে একসময় সরকারী কর্মচারী ছিলেন এবং এই বিষয় সম্পর্কে ওয়াকিবহাল তা জানিয়েছেন আলোচনায়। রাজ্যপাল জানান সরকারকে তিনি তাঁর পক্ষ থেকে যা বলার বলবেন। লেভেল বেস্ট শব্দবন্ধটি উল্লেখ করে তিনি বলেন সর্বতোভাবে তিনি চেষ্টা করবেন যাতে সরকারী কর্মচারী ও শিক্ষকেরা তাঁদের অধিকার পান। এরপর সংগ্রামী যৌথ মঞ্চ জানায় সরকারের বিবেচনার জন্য তারা অপেক্ষা করবে।

তবে সরকারের ইতিবাচক ঘোষণা না আসা পর্যন্ত অবস্থান যেমন চলছিল, চলবে। অনশন যেমন চলছিল, চলবে।

এই আন্দোলনে এখনো অবধি কেন্দ্রীয় হারে ডিএ’র ন্যায্য দাবিটি যতটা সামনে এসেছে দুর্নীতিমুক্ত স্বচ্ছ নিয়োগের দাবিটি ততটা সামনে আসেনি। আন্দোলনের সামাজিক ভিত্তিকে বাড়ানো ও শিক্ষা ও প্রশাসনের কাজকে সমৃদ্ধ ও মসৃণ করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই দাবিটিকে আরো বেশি বেশি করে সামনে আনতে হবে৷ অস্থায়ী কর্মীদের স্থায়ীকরণের দাবিটিও যেন অবহেলিত না থাকে সেটাও দেখা দরকার।

এই আন্দোলন রাজ্য সরকারকে যথেষ্ট ধাক্কা দিয়েছে। দুর্নীতি মামলায় যখন রাজ্য সরকারের ভাবমূর্তি ও সমর্থন প্রতিদিন দুর্বল হচ্ছে, তখন সরকারী কর্মচারী ও শিক্ষকদের সামনে সুযোগ ক্রমশ বাড়ছে তাঁদের দাবিগুলিকে জোরালো করে তোলার। সুযোগ রয়েছে নিজেদের দাবির লড়াই লড়তে লড়তেই সরকারী প্রতিষ্ঠান ও বিদ্যালয়গুলির হাল ফেরানোর বড় লড়াইয়ের প্রশ্নগুলোকে সামনে আনার। সমগ্র জনসমাজকে এই আন্দোলনের মধ্যে টেনে আনার। এই কাজ শুরু হয়েছে। দৃঢ়, ঐক্যবদ্ধ ও কৌশলী লড়াইয়ের লম্বা রাস্তা সামনে রয়েছে।

- সৌভিক ঘোষাল

খণ্ড-30
সংখ্যা-6