আজকের দেশব্রতী : ৪ এপ্রিল ২০২৪ (অনলাইন সংখ্যা)
deshabrati-april-2024disaster-report-jalpaigurireport-from-mainaguri

ময়নাগুড়িতে ৩১ মার্চ ২০২৪ বিধ্বংসী ট্যুইস্টার ঘূর্ণিঝড়ের অভূতপূর্ব তান্ডবে দক্ষিণ বার্নিশ অঞ্চলে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলিতে ১ এপ্রিল শিলিগুড়ি ওয়েলফেয়ার অর্গানাইজেশনের উদ্যোগে পরিচালিত হয়েছে এক ত্রাণশিবির। এই ত্রাণকার্যে প্রথম থেকে শেষ অবধি তৎপর থেকেছেন পার্টির জলপাইগুড়ি জেলা সদস্য শ্যামল ভৌমিক, মুকুল চক্রবর্তী, দেবনাথ রায়, অন্নদেব রায় সহ তপেশ দাশগুপ্ত ও একঝাঁক তরুণ গ্রামীণ পার্টি সদস্য। সঙ্গে ছিলেন রাজ্য সম্পাদক। ৫০টি পরিবারকে চিড়ে, মুড়ি, বিস্কুট, পানীয় জল, মোমবাতি, দেশলাই ইত্যাদি সামগ্রী বণ্টন করা হয়।

ত্রাণের কাজ শুরুর আগে কয়েকটি গ্রাম প্রদক্ষিণ করে যে ভয়াবহ ও আতঙ্কজনক পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করা গেছে তা অবর্ণনীয়। মাত্র মিনিটখানেকের বিধ্বংসী তান্ডবের গতিপথের ব্যাসার্ধ বড় জোড় ১ কিলোমিটার। কিন্তু এই গতিপথে ট্যুইস্টার যা কিছু পেয়েছে আকাশসমান ধুলোধূসর এই ঘূর্ণিদৈত্য তা দুমড়েমুচড়ে ছারখার করে দিয়েছে। গতিপথের সামান্য বাইরে থাকা বিস্তীর্ণ বসতি ও ফসলসমৃদ্ধ মাঠপ্রান্তর অক্ষত ও অবিকৃত রয়ে গেছে। অথচ গায়ে লেগে থাকা মাঠে লক্ষ লক্ষ টাকা মূল্যের বেগুন, টমেটো ও অন্যান্য অর্থকরী ফসল সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। প্রাণহানি ও গুরুতর আঘাতপ্রাপ্তি ঘটেছে। হতাহতের সংখ্যা ক্রমশ বেড়ে চলেছে। ঝড়ের প্রবল শক্তির অভিঘাত দেখে স্তম্ভিত হতে হয়।

আশেপাশের অঞ্চলগুলি থেকে হাজারে হাজারে রাজবংশী গ্রামীণ মানুষ তাঁদের আত্মীয়, পরিজন, অপরিচিত মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, বিভ্রান্ত সহনাগরিকদের প্রতি সহমর্মিতায় দীর্ঘ ও এখন অনেকটাই রুদ্ধ পথ হেঁটে পৌঁছতে চেষ্টা করছেন।

প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো কার্যকরী উদ্যোগ চোখে পড়েনি। বিদ্যুত বিভাগের কর্মঠ শ্রমিকেরা অসম্ভব পরিশ্রম করে চলেছেন। NDRF’এর একটি ইউনিট মোতায়েন আছে একটি মাত্র জায়গায়। কিন্তু সরকারীভাবে বড়ো লঙ্গর চালানো বা ভেঙে পড়া বাড়িঘর পুনর্নির্মাণের কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি।

রাতে টেলিফোন মারফত খবর পাওয়া গেল যে আমাদের পরামর্শ অনুযায়ী অকুস্থলে হাজির জেলা সম্পাদক ভাস্কর দত্ত, শ্যামল ভৌমিক, দেবনাথ রায়ের উদ্যোগে পয়েরবাড়ি গ্রামের ২২টি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের যথাযথ ক্ষতিপূরণের দাবি জোরালো করতে প্রত্যেকটি পরিবারের একটি তালিকা তৈরি হয়েছে বিদ্যুতবিহীন অন্ধকারে বাড়িতে বাড়িতে ঘুরে। আগামীকাল এই পরিবারের সদস্যরা পার্টি কমরেডদের নেতৃত্বে ময়নাগুড়ি বিডিও দপ্তরে তাঁদের দাবিসনদ পেশ করবেন। ক্ষতিপূরণ অনাদায়ে ধর্ণা-বিক্ষোভ সংগঠিত হবে। অন্যান্য সংলগ্ন গ্রামগুলিতে এই পার্টি উদ্যোগ অব্যাহত থাকবে।

১ এপ্রিল রাতে তৃণমূল ও বিজেপির নির্বাচিত স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্যদের উদ্যোগহীনতার বিপরীতে ময়নাগুড়ি শহর ও ময়নাগুড়ি রোডের কিছু যুবক নিজেদের উদ্যোগে গ্রামগুলির প্রত্যন্ত অংশে চাল-ডাল ফুটিয়ে গ্রামের মানুষকে রাতের অন্ন যোগাতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নেমে পড়েছেন। আমরা তরুণ নাগরিকদের এই মানবিক উদ্যোগকে সেলাম জানাই।

কয়েকদিন বাদে নির্বাচনী ডামাডোলে এই বিপন্ন মানুষগুলির বিস্মৃতির শিকার হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।

সহৃদয় কমরেড ও সহনাগরিকদের প্রতি একান্ত আবেদন বিপর্যস্ত পরিবারগুলির পাশে দাঁড়ান। সাধ্যমতো রাশি রাজ্য ত্রাণ তহবিলে যুক্ত করুন। দুর্গত পরিবারগুলিকে মাথা তুলে দাঁড়াতে সাহায্য করুন।

- অভিজিৎ মজুমদার

people-of-burdwan-east-loksabha-constituencyburdwan-east-loksabha-constituency

প্রিয় নির্বাচকমন্ডলী,

আগামী ১৩ মে (৩০ বৈশাখ) বর্ধমান পূর্ব লোকসভা কেন্দ্রে আপনার গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগের দিন। বেছে নিতে হবে দেশের ও জনগণের জন্য যোগ্য প্রতিনিধিকে, যিনি এই জেলার কৃষক জনগণ, তাঁতি সহ বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ ও সাধারণ জনগণের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কাজের দাবিকে সংসদে তুলে ধরবেন।

এবারের লোকসভা নির্বাচন ভারতীয় জনগণের কাছে বড় কঠিন চ্যালেঞ্জ। কেন্দ্রের মোদী সরকার দেশকে এক বড় বিপর্যয়ের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। দেশের সংবিধান, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ব্যবস্থা, গণতন্ত্র আজ বিপদের মুখে। দেশের জনগণ‌ও চাইছে বিজেপির এই নাগপাশ থেকে মুক্ত হতে। সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপে বিজেপির নির্বাচনী বন্ডের কোটি কোটি টাকার কেলেঙ্কারী দেশের সবচেয়ে বড় দুর্নীতি হিসাবে সদ্য সামনে এসেছে। বিরোধীদের দুর্নীতি নিয়ে সরব প্রধানমন্ত্রী এই প্রশ্নে মুখে কুলুপ এঁটেছেন। বিজেপির এই দুর্নীতি নিয়ে দেশের মানুষ দাবি তুলেছে অবিলম্বে এই টাকা বাজেয়াপ্ত করতে হবে। বিজেপি দেশের সম্পদ (কৃষি, রেল, কোলিয়ারী, বিদ্যুৎ, ব্যাঙ্ক, এল‌আইসি প্রভৃতি) কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর হাতে তুলে দিচ্ছে। বিভেদ, বিভাজন, ঘৃণার রাজনীতির মাধ্যমে সম্প্রীতির পরিবেশকে ধ্বংস করছে। বিরোধী দলগুলিকে ইডি, সিবিআই, ভুয়ো মামলা দিয়ে গ্রেফতার করা, নির্বাচিত রাজ্য সরকারগুলিকে ভেঙে দিতে কোটি কোটি টাকা খরচ করে ঘোড়া কেনাবেচা চলছে। চক্রান্ত চালাচ্ছে মানুষকে বেনাগরিক করার। জনগণের প্রধান শত্রু এই ধরনের ফ্যাসিস্ট সরকারকে পরাস্ত করা আজ সময়ের দাবি।

এদিকে বাংলার শাসক তৃণমূল সরকার বাংলার যুবকদের চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রতারণা করেছে। রোদ, বৃষ্টি, ঠান্ডা’কে উপেক্ষা করে কলকাতায় মাসের পর মাস অবস্থান করে চলেছে চাকরিপ্রার্থী ভাবি-শিক্ষকরা। মেধায় যারা যোগ্য তারা চাকরি থেকে আজও বঞ্চিত হয়ে আছে। কিন্তু সরকার বধির। প্রতিদিন নতুন নতুন দুনীর্তির তথ্য সামনে আসছে। তৃণমূলের এই অধঃপতনের সুযোগ নিয়ে বিজেপির এজেন্ট বিচারপতি হাততালি কুড়িয়ে নিয়ে এবারে লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির প্রার্থী হয়েছেন। শুধু চাকরি নয় বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতি এবং গণতন্ত্র হরণের প্রশ্নে তৃণমূল আজ কাঠগড়ায়। বামফ্রন্ট আমল থেকে বাংলার কৃষিমজুর ও গ্রামীণ যুবরা রাজ্যে কাজ না পেয়ে পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে অন্য দেশ ও অন্য রাজ্যে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। বর্তমান শাসনকালে তার সংখ্যা ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে কোভিড সময়ে মোদী সরকারের চরম পৈশাচিক আচরণ এবং রাজ্য সরকারের বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করা মানুষ আজ‌ও ভোলেনি। পূর্ব বর্ধমান জেলায় পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে আমাদের পার্টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। এর পাশাপাশি আমরা গড়ে তুলি ঋণমুক্তি আন্দোলন। কালনা, জামালপুর, পূর্বস্থলী, রায়না সহ সমস্ত ব্লকে এই আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা ঋণগ্রস্ত মানুষের পাশে, বিশেষ করে মহিলাদের পাশে দৃঢ়তার সাথে দাঁড়াই।

মোদী সরকার কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর হাতে জমি, কৃষি ও কৃষি-বাজার তুলে দিচ্ছে। চাষের খরচের দেড়গুণ ফসলের সহায়ক মূল্য আজ‌ও কৃষকের অধরা। দেশব্যাপী কৃষক আন্দোলনে আমাদের পার্টি, তার কৃষক সংগঠন, কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সংগঠন নেতৃত্বকারী ভূমিকা নিয়েছে। পূর্ব বর্ধমান জেলায় এই ধরনের আন্দোলনে স্বাধীনভাবে ও সংযুক্ত কৃষক মোর্চার নেতৃত্বে সংহতিমূলক আন্দোলনে আমাদের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। খুব স্বাভাবিকভাবেই এই জেলার সমস্ত নাগরিকদের কাছে অনুরোধ বিজেপিকে পরাজিত করতে আপনারা আজকের সময়ের যোগ্য পার্টি ও প্রার্থিকে বিপুল ভোটে জয়যুক্ত করুন। আমাদের পার্টি ‘ইন্ডিয়া’ জোটের শরিক। সংগ্রামী বামপন্থী পার্টি হিসাবে জাতীয় রাজনৈতিক মঞ্চে নতুনত্ব নিয়ে আপনাদের পাশে এসেছি। দায়িত্বশীল, বিশ্বস্ত, স্বচ্ছ পার্টি হিসেবে কাজ করে চলেছি। আমরা জনগণের উপর নির্ভর ও ভরসা করে চলি। বিজেপি আপনাকে হিন্দুত্ব দেখিয়ে দেশের ঐতিহ্য ও সংবিধান নস্যাৎ করে চলেছে। সচেতন ভোটার ও বিবেকবান নাগরিক হিসেবে আপনাকে আপনার ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে হবে।

বর্ধমান পূর্ব কেন্দ্রে আমাদের পার্টি সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের প্রার্থী যুবনেতা ও শিক্ষকপদে চাকরি প্রার্থীদের চলমান আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক সজল দে। তার নির্বাচনী প্রতীক পতাকায় তিন তারা। চরম দুর্নীতিবাজ ও কর্পোরেট দালাল বিজেপিকে পরাজিত করতে এবং তৃণমুল সরকারের অপশাসনের বিরুদ্ধে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন প্রার্থীকে আপনারা জয়যুক্ত করুন।

অভিনন্দন সহ,
সলিল দত্ত,
সিপিআই(এমএল) লিবারেশন,
বর্ধমান জেলা কমিটি

ugly-inequality-stark-povertyugly-inequality

ট্রেনের ইঞ্জিনটা দুরন্ত গতিতে ছুটে যাচ্ছে, কিন্তু পেছন দিকের কামরাগুলি অতি দ্রুত বেগে এগোতে পারছে না। লন্ডন স্কুল অফ ইকনমিক্সের অধ্যাপক মৈত্রীশ ঘটক এই উপমা সামনে এনে হায়দ্রাবাদের এক আলোচনাসভায় বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন, বহু ঢাকঢোল পেটানো ভারতীয় অর্থব্যবস্থার যে ফানুস ওড়ানো হচ্ছে, তা ঠিক নয়। দেশের এক বৃহৎ অংশের মানুষ, ওই ট্রেনের কামরার মতো দ্রুত বেগে সামনের দিকে এগোতে পারছেন না। কারণ প্রকট আর্থিক অসাম্য দেশের অর্থব্যবস্থার এক অন্যতম অসুখ।

সম্প্রতি মোদীর আমলে দেশের আর্থিক বৃদ্ধি নিয়ে প্রথম সারির বেশ কিছু অর্থশাস্ত্রী প্রশ্ন তুলেছেন। আইএমএফ’এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জি-২০’র কুড়িটি দেশের মধ্যে মাথাপিছু আয়ের নিরিখে ভারত সবচেয়ে নীচে! মানবোন্নয়ন সূচকের নিরিখে ভারত ২০টি দেশের মধ্যে ২০তম স্থানে। শিশুমৃত্যুর হারে ভারতের অবস্থা সামান্য ভালো — ১৯তম স্থানে।

স্বঘোষিত ‘বিশ্বগুরু’র দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ মুখ থুবড়ে পড়েছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কই পরিসংখ্যান দিয়ে জানিয়েছে, ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষের প্রথম ছ’মাসে ভারতে যত কম প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে, ২০০৭-০৮’র পর তা কখনও এত কম হয়নি। জিডিপি’র অনুপাতে এই বিনিয়োগের পরিমাণও ২০০৫-০৬ সালের পর সর্বনিম্ন। এমনকি মোদীর আমলে বেসরকারি বিনিয়োগও ক্রমশই নীচের দিকে গড়িয়ে পড়েছে। মোদী ক্ষমতায় আসার আগে দেশে বেসরকারি বিনিয়োগের গড় হার ছিল ৩৩.৪ শতাংশ। কিন্তু মোদী আসার পর তা দাঁড়ায় ২৮.৯ শতাংশ, আর তারপর থেকে এমন একটা বছরও দেখানো যাবে না যেখানে এই বিনিযোগের হার ৩০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। দেশে বেসরকারি বিনিয়োগের এই অত্যন্ত মন্থর গতি প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের উপরও প্রভাব ফেলেছে, তারাও এদেশে বিনিয়োগের আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। একটা ছোট্ট উদাহরণ দেওয়া যাক। দেশের গ্রামীণ বাজারে হিন্দুস্থান ইউনিলিভারের মতো বৃহদায়তন সংস্থার ষাট শতাংশ পণ্য বিক্রি হোত। গত দশ বছর যাবত এই বৃহৎ বাজারে থমকে রয়েছে। সাবান, শ্যাম্পু, টুথপেস্টের মতো পণ্যগুলোর নিশ্চিত আভ্যন্তরীণ বাজার সংকটে। ২০১৭-১৮ থেকে ২০২২-২৩ পর্যায়ে সমস্ত ধরনের মজুরি থমকে রয়েছে, বা হ্রাসপ্রাপ্ত হয়েছে। ক্ষয়িষ্ণু ক্রয় ক্ষমতা ভোগব্যয়ে বিরাট নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে, যা মোদী সরকারের পা-চাটা অর্থনীতিবিদেরা স্বীকার করেন না।

গোটা দুনিয়ায় ভারতের মতো আর কোনো উন্নয়নশীল দেশে এতো বিপুল সংখ্যক মানুষ স্বরোজগারের সাথে যুক্ত নয়। ২০১৭-১৮ থেকে ২০২২-২৩ পর্যায়ে পারিশ্রমিকবিহীন কাজে (আনপেইড লেবার) নিয়োজিত হওয়ার সংখ্যা ৪ কোটি থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৯.৫ কোটিতে পৌঁছেছে। আর, এই অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাওয়া পারিশ্রমিকবিহীন পেশার সাথে যুক্ত সিংহভাগই হলেন নারী শ্রমিক। সরকারি নথিতে এই বিপুল সংখ্যক নারী শ্রমিকদের ‘কর্মরত’ হিসাবেই দেখানো হয় যা বিরাট মাপের এক ভাওতা। আইএলও’র পরিভাষায় সেই পেশাগুলোই ‘কাজ’ (এমপ্লয়মেন্ট) হিসাবে স্বীকৃত যেখানে বেতন/মজুরি প্রদানের বন্দোবস্ত রয়েছে।

কিছুদিন আগে জাতীয় নমুনা সমীক্ষা দপ্তর ২০২২-২৩’র জন্য যে পরিবারভিত্তিক ভোগব্যয় সমীক্ষা প্রকাশ করল, তাতেই দেখা যাচ্ছে দেশের গরিবরা দৈনিক খরচ করেন মাত্র ৪৬ টাকা!

বিভিন্ন সমীক্ষায় আরও প্রকাশ, দেশে আর্থিক অসাম্য ঔপনিবেশিক আমলকেও ছাপিয়ে গেছে, তরুণ প্রজন্মের বেকারত্বের মাপকাঠিতে ভারত সিরিয়া, আর্মেনিয়া, লেবানন, ইয়েমেন বা ইরানের মতো গৃহযুদ্ধ-দীর্ণ বিধ্বস্ত দেশগুলির সঙ্গে এক সারিতে রয়েছে।

সমস্ত ক্ষেত্র মোদী আমলে ধ্বংসপ্রাপ্ত। আইন-সংবিধান, বহু বছর ধরে সযত্নে লালিত ভারতীয়ত্ব, তার বহুত্ববাদ আজ বিপর্যয়ের কিনারায়।

মোদীর এই অপশাসন, প্রগতি-বিরোধী, গণতন্ত্র রোধকারী জমানাকে আসন্ন নির্বাচনে পরাস্ত করাটাই আজ ভারতবাসীর কেন্দ্রীয় কর্তব্য।

challenge-of-2024-general-elections2024-general-elections

‘মোদী ভক্তি’ ঘিরে বিরাট প্রচার ঝড় আর অভূতপূর্ব টাকার খেলা। গত ২০১৩তে ‘মোদী ফর পিএম’ প্রচার শুরু হওয়া থেকে এটাই হয়ে উঠেছে ভোট প্রচারে মোদীর একেবারে নিজস্ব ঢং, যাকে বলে, স্বাতন্ত্র্যচিহ্ন। গত দশ বছরে এই দুটো বৈশিষ্ট্যই লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে গেছে। কিন্তু এবার মোদী ৪০০+ সংখ্যাগরিষ্ঠতার আগ্রাসী দাবি নিয়ে তৃতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় ফেরার নিলাম হেঁকে রেখেছেন; এক্ষেত্রে অঘোষিত উদ্দশ্য হল — ভারতের সংবিধানকে গভীরতর সর্বনাশের দিকে ঠেলে নিয়ে যাওয়া। দাবি তো করেছেন, কিন্তু একটা ব্যাপারে তিনি আগের যে কোনো সময়ের থেকে বেশি ভীত হয়ে পড়েছেন। তিনি ভয় পাচ্ছেন, তার সরকারকে গদিচ্যুত করার উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধ বিরোধীশক্তিকে ঘিরে বিপুল জনসমাবেশ দেখে। তাই কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলোকে হাতিয়ার করা আর বিরোধী নেতৃত্বকে নির্যাতন-নিগ্রহ করাই হয়ে উঠেছে মোদীর ২০২৪-এ তৃতীয়বার ক্ষমতায় ফেরার মরিয়া চেষ্টার বর্শামুখ!

গত ১৬ মার্চ নির্বাচন কমিশন লোকসভার ১৮তম সাধারণ নির্বাচনের নির্ঘন্ট ঘোষণা করার সময় মুখ্য নির্বাচন কমিশনার বার বার ‘লেভেল প্লেয়িং ফীল্ড’ অর্থাৎ নির্বাচনে নিরপেক্ষতা বজায় রাখার কথা বলেছেন। কিন্তু আদর্শ আচরণবিধির বিজ্ঞপ্তি ঘোষণার মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যেই আমরা দেখতে পেলাম, ভারতের আরেক অ-বিজেপি রাজ্যসরকারের মুখ্যমন্ত্রীকে ইডি দিয়ে গ্রেফতার করানো হল! ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্তের পর, দিল্লীর মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়ালকেও হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু ঘোর আশ্চর্যের ব্যাপার হল, ইডি আজ পর্যন্ত, মনোজ সিসোদিয়া থেকে কেজরিওয়াল — আপ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া আবগারী দুর্নীতি মামলায় একটা সাক্ষ্য প্রমাণও পেশ করতে পারেনি, অথচ এখন এসবিআই’এর ঝুলি থেকে বেরিয়ে আসা নির্বাচনী বন্ডের তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে বিজেপি ঐ বন্ডের এক প্রত্যক্ষ ও প্রধান দানগ্রহীতা। বন্ডটি কিনেছিল হায়দ্রাবাদ-ভিত্তিক এক সংস্থা অরবিন্দ ফার্মা লিমিটেড, যার ডিরেক্টর অভিযুক্ত পি শরৎ চন্দ্র রেড্ডী দিল্লী লিকার পলিসি মামলায় এখন রাজসাক্ষী।

মনীশ সিসোদিয়াকে জামিন না পেয়ে এক বছরের ওপর জেলে পচতে হচ্ছে, অথচ পি শরৎ রেড্ডী এই মামলায় ২০২২ সালের নভেম্বরে গ্রেপ্তার হয়ে ২০২৩’র মে’তে জামিন পেয়ে যায়। সে গ্রেপ্তার হওয়ার মাত্র ৫ দিন পরে তার কোম্পানি বিজেপি’কে ৫ কোটি টাকা দেয়। মে মাসে জামিন পাওয়ার পর শরৎ রেড্ডী জুন মাসে রাজসাক্ষী হয়ে যায় এবং দু’’মাসের মধ্যে বিজেপি’কে আরও ২৫ কোটি টাকা চাঁদা দেয়। শরৎ রেড্ডীর বাবা পিভি রামপ্রসাদ রেড্ডী — প্রতিষ্ঠিত অরবিন্দ ফার্মা সর্বমোট ৫২ কোটি টাকার নির্বাচনী বন্ড কেনে যার মধ্যে বিজেপি পায় ৩৪.৫ কোটি টাকা, বিআরএস ১৫ কোটি এবং টিডিপি পেয়েছে ২.৫ কোটি টাকা। কোম্পানিগুলোকে শুধু বলপ্রয়োগ করে মোটা টাকার ঘুষ দিতেই বাধ্য করা হচ্ছে না, বিরোধীপক্ষকে নিশানা করার যন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতেও বাধ্য করা হচ্ছে।

এ’পর্যন্ত যেভাবে নির্বাচনী বন্ড কেলেঙ্কারি উদ্ঘাটিত হয়েছে, তাতে মোদী সরকার স্পষ্টতই যথেষ্ট উৎকণ্ঠা ও অস্বস্তিতে আছে, তাই এই ঘোটালা থেকে মানুষের নজর ঘোরাতে আপ্রাণ চেষ্টা করছে। শেষ পর্যন্ত এসবিআই’এর পেশ করা তথ্য থেকে প্রকাশ পেয়েছে যে ইলেক্টোরাল বন্ড টাকার বেআইনি পাচারের এক লাগামহীন বেপরোয়া ব্যবস্থা যা কোনো আইনের তোয়াক্কা করে না এবং যা দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক করে তুলেছে। সাংবাদিকরা দাতা কোম্পানিগুলোকে ট্র্যাক করে নির্মাণ, ওষুধ উৎপাদন, খনি ইত্যাদি ক্ষেত্রে একই রকম সুপরিচিত বেশ কিছু কর্পোরেট সংস্থা, কিছু ছায়াবৃত সংস্থা, কিছু আবার সদ্য তৈরি হওয়া সংস্থাকে চিহ্নিত করতে পেরেছেন যেগুলি বিপুল পরিমাণে বন্ড কিনেছে। বন্ডের মূল্য অনেক ক্ষেত্রে তাদের অর্জিত মুনাফার বহুগুণ বেশি, আবার লোকসানে ডুবে থাকা কোম্পানিও আছে।

নিঃসন্দেহে এই প্রকল্পটি বন্ডগুলির ‘অসদুপায়ে অর্জিত টাকার বেআইনি পাচারের রাস্তা’ হয়ে ওঠার আরবিআই’এর সবচেয়ে খারাপ আশঙ্কাটিকে সত্য বলে প্রমাণ করেছে; সত্য প্রমাণ করেছে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার অপলাপ নিয়ে নির্বাচন কমিশনের প্রাথমিক সতর্কীকরণকে; সত্য প্রমাণ করেছে, বন্ডগুলোর দাতা কোম্পানিগুলোর ‘এটার বদলে ওটা’ পদ্ধতিতে শাস্তি থেকে অব্যাহতি ‘কেনার’, চুক্তি এমনকি অনুকূল পলিসি-পরিবর্তনকে নিশ্চিত করার ব্যবস্থা হয়ে ওঠা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণকেও! সমস্ত ইঙ্গিত থেকে এটা স্পষ্ট, নির্বাচনী বন্ড স্কিম স্বাধীন ভারতে রাষ্ট্র-পোষিত ও বৈধতাপ্রাপ্ত আর্থিক ও রাজনৈতিক ভ্রষ্টাচারের সবচেয়ে বেপরোয়া বেশরম এক ব্যবস্থা হয়ে উঠেছে। এসবিআই বন্ড সম্পর্কে বিশদ তথ্য প্রকাশকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্যে বা কালহরণের উদ্দেশ্যে সুপ্রিম কোর্টের সামনে বার বার মিথ্যে বলেছে এবং সমস্ত রকম বাজে ওজর দেখিয়ে গেছে। এই ঘটনা নির্বাচনী বন্ড স্কিমের কলূষ উদ্দেশ্যকেই আরও নিশ্চিত করেছে।

প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যমগুলো এই পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি ও ভ্রষ্টাচার নিয়ে সমস্ত তথ্য ও আলোচনা বেমালুম চেপে গেছে — যেন এমন কিছুই ঘটেনি! একমাত্র বিকল্প সংবাদমাধ্যমগুলোর মাধ্যমেই মানুষ এই কেলেঙ্কারির সম্পর্কে জানতে পেরেছে, যা উদ্ঘাটন করেছেন অনুসন্ধানকারী সাংবাদিক, সত্যান্বেষী গবেষক এবং স্বচ্ছতার প্রচারকদের একটি একনিষ্ঠ নিবেদিতপ্রাণ টিম। সরকার তাই বিকল্প মিডিয়ার শ্বাসরোধ করতে উদ্যত — দম্ভভরে নিজেকে ‘তথ্য যাচাই’ কর্তৃত্ব হিসেবে জাহির করে এবং যে কোন সমালোচনামূলক তথ্যকে ‘মিথ্যা’, ‘জাল’ তকমা দিয়ে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সেইসব তথ্য প্রচার বন্ধ করে। এই দানবীয় চেষ্টায় স্থগিতাদেশ দেওয়ার জন্য সুপ্রিম কোর্টকে ধন্যবাদ, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম এবং সমাজমাধ্যম সাময়িকভাবে অন্তত কাজ করে যেতে পারছে। কিন্তু বাক স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং অল্টারনেটিভ মিডিয়ার বিরুদ্ধে হুমকি উদ্বেগজনকভাবে বেড়েই চলেছে।

তৃতীয়বারের মোদী শাসনের অর্থ — আরও বেপরোয়া বেশরম দুর্নীতি, আরও অবাধ কর্পোরেট লুঠ, সংবিধানের ঘোরতর বিপর্যয় এবং গণতন্ত্রের আরও ক্ষয়কে ত্বরান্বিত করা। শুধু তাই নয়, গণতন্ত্রের অন্য সব বৈশিষ্ট্য — ধর্মনিরপেক্ষতার বুনোট, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং নাগরিক স্বাধীনতার ক্ষয়কেও ত্বরান্বিত করা, বাড়তি উৎসাহ যোগানো। কুড়ি বছর আগে, ভারত অটল-আদবানি যুগের এনডিএ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল। সময়টা ছিল গুজরাটের সাম্প্রদায়িক গণহত্যার পর, যখন কৃষিতে ঘনিয়ে উঠছিল গভীর সংকট আর প্রতিদিন অসংখ্য কৃষক আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছিলেন। ২০২৪-এ ভারতকে আবার উঠে দাঁড়াতে হবে, মোদী-শাহ রাজকে উপড়ে ফেলতে — যে জমানা লাফিয়ে বেড়ে চলা অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিপর্যয় আর স্বৈরাচারী শাসনে জর্জরিত! 

- এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ১ এপ্রিল ২০২৪

farmer-interestsfocal-point-of-the-campaign

আস্তে আস্তে ভোটের দিন যত এগিয়ে আসছে, হুগলী-বর্ধমানের গঞ্জে-বাজারে চায়ের দোকানের আড্ডায় রাজনীতি নিয়ে গরম গরম কড়চাও তত জমে উঠছে। মেমারীর এক চায়ের দোকানের আড্ডার একটা খণ্ডচিত্র তুলে ধরা যাক। এক বিজেপি ঘেঁষা টোটো চালক বললেন, “তা দিদির কেবল ভোটের মুখেই অ্যাক্সিডেন্ট বাধে? সেবার নন্দীগ্রামে পা ভাঙ্গল আর এবার কিনা কালীঘাটে নিজের বাড়িতেই কপাল ফাটল!” মোটরভ্যান চালক আর একজন সাথে সাথেই চেঁচিয়ে উঠল, “হতেই পারে। অ্যাক্সিডেন্ট ইজ অ্যাক্সিডেন্ট।” প্রথমজন মানতে নারাজ। একই বিষয় নিয়ে দু’জনের চ্যাঁচামেচি চলতেই থাকল। এরই মধ্যে এক মাঝবয়সী লোক এক মোক্ষম প্রশ্ন তুলে আলোচনার মুখ ঘুরিয়ে দিলেন। তাঁর জিজ্ঞাসা, “মোদী বলেছেন, ইডি পশ্চিমবঙ্গে নগদ টাকা ও সম্পত্তি সমেত যে ৩০০০ কোটি টাকা বাজেয়াপ্ত করেছে তা ভোটের পরে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া হবে। তা হ্যাঁ হে ছোকরারা, ভোটের পরে যা দেবে সেটা এখন বলার কী দরকার?” বিজেপি ঘেঁষা টোটো চালক সামান্য থতমত খেতেই পাশ থেকে একটা হালকা বয়সী ছেলে বলে উঠল, “কাকু, মোদীজির কোনো ভুল হয়নি। রাম জন্মানোর হাজার বছর আগে যদি রামায়ণ লেখা হয়ে থাকে তাহলে ভোটের পরে টাকা বিলোবার কথা আগেভাগে বলে মোদীজি তো নির্ঘাত রামভক্তের কাজই করেছেন।” সবাই হৈ হৈ করে হেসে ওঠে। এরপর ওই দোকানে রাজনীতির কথা বন্ধ হয়ে যায়। চলে আসে আলুচাষ, সবজি চাষে লাভ লোকসানের কথা। কিন্তু সে আর কতক্ষণ? ঘুরিয়ে ফিরিয়ে চাষের কথার মধ্যেও রাজনীতি এসে পড়ে। ঠাট্টা করে হয়ত বলা হয়, “ভাতের হাঁড়ির মধ্যেও রাজনীতি!” কিন্তু ভাতের সমস্যা, হাতের কাছে কাজের সমস্যাই তো আসল রাজনীতি।

পূর্ব বর্ধমান কেন্দ্রে আমাদের প্রার্থীর সমর্থনে প্রচারে, সেজন্য কৃষি প্রশ্নকেই যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হচ্ছে। এই কেন্দ্রের মেমারী, কালনা, জামালপুর ও রায়নার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে মূলত আলু চাষই হল উপার্জনের একটা বড় উপায়। আর সেই আলু চাষেই সেখানে নেমে এসেছে বিরাট বিপর্যয়।

গতবছর (২০২৩) ৫-৬ ডিসেম্বরের তুমুল বৃষ্টি এবার আলু চাষে বড় মাত্রায় সংকট ডেকে এনেছে। বৃষ্টির বেশ খানিকটা আগে কিছু জমিতে যে আলু চাষ হয়, সেখানে আলু বেঁচে যায়। প্রত্যাশামত সেখানে ফলনও ভালো হয়। কিন্তু অধিকাংশ জমিতে বৃষ্টির পরে, স্বাভাবিক সময়ের অনেক দেরীতে, যে আলু বসানো হয়, তার ফলন হয়েছে খুবই কম পরিমাণে। অনিবার্যভাবেই কৃষকদের চাষের খরচ তো উঠবেই না, উল্টে মোটা টাকা লোকসান হবে। এ’বছর বিঘেপিছু (আলুচাষে) ৩০ হাজার টাকার বেশি খরচ হয়েছে। ডবল করে চাষের জন্য ওই খরচ পৌঁছেছে ৩২ হাজার টাকায়। সবচেয়ে শেষ দিকে যারা চাষ করেছেন তাঁদের খরচ এমনকি ৩৫ হাজার টাকাতেও গিয়ে ঠেকেছে। নিশ্চিতভাবেই সব চাষির লোকসান একই মাত্রার নয়। আলুর গড় ফলন খুব কম হওয়ায় অনেক চাষিই আলুর ভালো দাম পেয়েছেন। কেবলমাত্র বৃষ্টির আগে যারা আলু চাষ করেছিলেন, ভাল ফলন হওয়ায় তাঁদের কিছু লাভ তো হয়েইছে, এমনকি বৃষ্টির পর চাষ করা আলু থেকেও কিছু চাষি লাভবান হয়েছেন। কিন্তু এদের সংখ্যা আঙ্গুলে গোনা। অধিকাংশ চাষিই বড় রকমের ধাক্কা খেয়েছেন।

একটা তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা যেতে পারে। বৃষ্টির আগে চাষ করে কোনো চাষি ৪ বিঘে জমিতে আলু ফলিয়েছেন ৩০০ বস্তা (গড়ে ৭৫ বস্তা/প্রতি বিঘা)। প্রথমদিকে বাজার খুব চড়া ছিল না। তিনি ৬১০ টাকা বস্তা দরে ২০০ বস্তা আলু বিক্রি করে চাষের খরচ তুলে ফেলেছেন। বাকি ১০০ বস্তা তিনি হিমঘরে রেখেছেন। যেহেতু পর্যাপ্ত আলুর অভাবে হিমঘরগুলি পুরো ভরাট হবে না, সে কারণে আশা করা যায়, ওই চাষি ভবিষ্যতে আলু বেচে ভালো লাভের মুখ দেখবেন।

ঠিক বিপরীত ছবিটা কেমন? এক গরিব চাষি ১.৫ বিঘে জমি ঠিকে নিয়েছিলেন। এজন্য ১৫ বস্তা আলু মালিককে দেওয়ার চুক্তি হয়েছিল। বৃষ্টির পরে চাষ করে, তাঁর ফলন হয়েছে মাত্র ১২ বস্তা! মালিকের কাছে নতজানু হয়েও তাঁর চোখ থেকে অঝোরে জল ঝরতেই থাকবে। ব্যাপারটা অতিরঞ্জিত মনে হতে পারে। তবে যাঁরা সার, কীটনাশক ইত্যাদি সময় ও পরিমাণমত দিতে পারেননি — এমন বহু গরিব চাষির ক্ষেত্রে এ ব্যাপারটাই ঘটেছে।

মধ্য ও স্বচ্ছল চাষিদের ক্ষেত্রে, উৎপাদন এমন খারাপ না হলেও প্রায়শই তা বিঘে পিছু ৪৫-৪৬ বস্তার আশপাশে থেকেছে। এই সময় অবশ্য আলুর বাজার দর ৭০০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। ফলে কিছু চাষি অতি সামান্য লাভের মুখ দেখলেও অনেকের ক্ষেত্রেই বড়জোর দু’মুখ প্রায় সমান থেকেছে। খুবই ব্যতিক্রম হিসেবে, সামান্য কিছু ক্ষেত্রে বিঘেয় ১০০ বস্তাও ফলেছে। কিন্তু ব্যাপক ব্যবহৃত ‘জ্যোতি’ আলুর ক্ষেত্রে এটি ঘটেনি। হিমালিনী বা নতুন উচ্চ ফলনশীল ‘১২১ প্রজাতির’ আলুর ক্ষেত্রেই ভালো ফলন চোখে পড়েছে। কিন্তু এই দুই শ্রেণীর আলু বীজের দাম জ্যোতি আলুর বীজের থেকে (২৫০০/বস্তা) অনেক বেশি (৩৫০০/বস্তা) হওয়ায়, কম সংখ্যক চাষিই এই আলু চাষ করেছিলেন।

তবে বড় গণ্ডগোলটা বেধেছে ‘পেপসিকো’র আলু চাষে। আলুর বাজার দর কোনো কোনো বছর খুব নিচে নেমে আসায় ইদানীং অনেক চাষি (বিশেষত অকৃষক জমির মালিকরা) পেপসি আলু চাষের দিকে ঝুঁকেছেন। পেপসি কর্তৃপক্ষ (আসলে কোম্পানির এজেন্ট বা সাব এজেন্ট ) চাষিদের সাথে দাম নিয়ে আগাম চুক্তি করে। এবারে পেপসি বস্তা পিছু ৪৯০ টাকাতে চুক্তি করে। অথচ এখন আলুর বাজার দর ৭০০ টাকার কম নয়। চাষিরা হাত কামড়াচ্ছেন। পেপসি আলুর ফলনও হয়েছে খুব কম। কেউ ২.৫ বিঘে চাষ করে পেয়েছেন ৭০ বস্তা। কেউ ১.৫ বিঘে চাষ করে ৬০ বস্তা। কোনো কোনো মৌজায় এবার ৭-৮শ বিঘে জমিতে পেপসি চাষ হয়েছিল। চাষিদের এখন মাথায় হাত। ‘পেপসিকো’ অবশ্য নাকের বদলে নরুন ধরাচ্ছে। তারা বলছে, যাদের দু’বার করে চাষ করতে হয়েছে তাদের একবারের বীজের দাম কোম্পানি নেবে না। সরকার নীরব দর্শক আর ‘পেপসিকো’র মতো কোম্পানি কৃষিজাত শিল্পের নামে বেমালুম লুট চালিয়ে যাচ্ছে। এনিয়ে পৃথকভাবে চর্চা হতে পারে। কিন্তু সরকারের যেখানে সত্যিই হস্তক্ষেপ দরকার সেখানে কী চলছে?

সকলেই জানে, মধ্য ও স্বচ্ছল চাষিরা ব্যাঙ্ক বা সমবায় থেকে চাষের জন্য লোন পেয়ে থাকেন। আইন থাকুক বা নাই থাকুক, সমবায়গুলি লোনের একটা অংশ (বীমার) প্রিমিয়াম বাবদ কেটে নেয়। ফসলের ক্ষতির জন্য রাজ্য সরকার আদৌ কোন ব্যবস্থা নেবে কিনা তার ঠিক নেই, সমবায় সমিতিগুলি কিন্তু লোনের টাকা উশুল করতে এক পায়ে খাড়া। তারা উঠতে বসতে চাষিকে লোনের টাকা মেটানোর জন্য ফোন করছে। যেমন মেমারীর আমাদপুর সমবায় সমিতি থেকে এক ক্ষুদ্র কৃষকের কাছে বারবার ফোন আসে। তিনি এক বিঘে জমিতে আলু চাষের জন্য নিয়মমাফিক পঁচিশ হাজার টাকা লোন পেয়েছেন। বোরো ধান চাষ অবধি তাঁর এই লোন পরিশোধের মেয়াদ। তবু এখনই তাঁকে ঋণ শোধ করার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে। আলু চাষের জলকর মেটাননি বলে তাঁর বোরো ধানে জল দেওয়া অবধি বন্ধ করে দিয়েছে। দায়ে পড়ে, তিনি বকেয়া জলকর মিটিয়ে দিয়েছেন। অথচ ওই ক্ষুদ্র কৃষক জানাচ্ছেন, ওই সমবায় সমিতি নাকি একজন হিমঘর মালিককে বহু আগে ৬০ লক্ষ টাকা লোন দিয়েছে — যা এখনও অনাদায়ী পড়ে রয়েছে। কারণ হিসেবে সমিতি নাকি বলেছে, ওই হিমঘরটি সমবায় কিনে নেবে। হয়ত আমাদপুর সমবায় কোনো দিন কোনো কোল্ডস্টোরের মালিক হবে। কিন্তু তাতে কৃষকদের কোন স্বার্থ রক্ষিত হবে? মেমারীর পার্শ্ববর্তী পান্ডুয়ার বৈঁচিতে সমবায় চালিত একাধিক কোল্ডস্টোরে চাষির আলু সংরক্ষণ করা হয় যৎসামান্য। সমবায় স্টোর ভরাট হয় প্রাইভেট স্টোর মালিকের আলু মজুত করে।

গভীর সংকটে ডুবে যাচ্ছে কৃষিক্ষেত্র। মরণাপন্ন কৃষক, অথচ সরকার নির্বিকার। এ জিনিস চলতে পারে না। সে কারণে, বাস্তবের রুক্ষ জমির ওপর পা রেখে উঠে দাঁড়াচ্ছে সিপিআই(এমএল)। পূর্ব বর্ধমান লোকসভা কেন্দ্রে রাজনৈতিক প্রচারে তুলে ধরা হচ্ছে বিপন্ন আলুচাষিদের ন্যায্য দাবিগুলি। রাজ্য সরকারকে আলু চাষের জন্য দেওয়া ঋণ মকুব করতে হবে। আলু চাষের লোকসানের জন্য উপযুক্ত পরিমাণে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। বাংলা শস্যবীমার আওতায় কৃষকের কাছ থেকে নেওয়া প্রিমিয়ামের টাকা সরকারকে অবিলম্বে ফেরত দিতে হবে। শুধু প্রচার নয়, ইতিমধ্যেই একাধিক স্থানে সংগঠিত হয়েছে বিক্ষোভ আন্দোলন। এ আন্দোলনে আরও বড় মাত্রায় কৃষক সমাজকে সামিল করতে হবে।

- মুকুল কুমার

general-meeting-of-west-bengal-tea-garden-employeestea-garden-employees-association

গত ৩১ মার্চ ২০২৪ রবিবার ডুয়ার্সের চালসাতে ওয়েস্ট বেঙ্গল টি গার্ডেন এমপ্লয়িজ এসোসিয়েশনের ৭৪তম বার্ষিক সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৪৮ সালে গঠিত কর্মচারীদের এই ইউনিয়ন স্বাধীন ভাবে স্বতন্ত্রতা নিয়ে চলছে। সম্প্রতি স্টাফ ও সাব-স্টাফ নিয়ে গঠিত জয়েন্ট কমিটির আন্দোলন এই ইউনিয়নকে আরও শক্তিশালী করেছে। এবারের ৭৪তম বার্ষিক সাধারণ সভায় এআইসিসিটিইউ ও তার অন্তর্ভুক্ত তরাই সংগ্রামী চা শ্রমিক ইউনিয়ন আমন্ত্রিত ছিল। এই সভায় এআইসিসিটিইউ’র পক্ষ থেকে অভিজিৎ মজুমদার ও বাসুদেব বসু সহ অন্যান্য ট্রেড ইউনিয়নের নেতৃত্ব বক্তব্য রাখেন। ইউনিয়নের সভাপতি আশীষ বোস সভায় সভাপতিত্ব করেন। এই বার্ষিক সভায় চা শ্রমিকদের জমির পাট্টা ও পুরো শিল্পে ন্যূনতম মজুরির দাবিতে শ্রমিক কর্মচারীদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানানো হয়। পাশাপাশি শ্রমিক কর্মচারীদের ৫৮ বছর কাজের মেয়াদের পরিবর্তে ৬০ বছর করার দাবি জোরালোভাবে তুলে ধরা হয়।

celebrating-martyrs-day

“২৩ মার্চ বিপ্লবী ভগৎ সিং’এর শহীদ দিবসে শপথ নিন, ফ্যাসিস্ট বুলডোজার রাজনীতি রুখে দিন” বার্তা সামনে রেখে হাওড়া জেলার বালিতে বিপ্লবী ভগৎ সিং, রাজগুরু এবং শুকদেব সহ স্বাধীনতা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ফ্যাসিবাদ বিরোধী কর্মসূচি পালন করা হয় পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের অন্তর্ভুক্ত সংযোগ এবং ইঙ্গিত সাংস্কৃতিক সংস্থার যৌথ উদ্যোগে। শুরুতেই শহীদ ভগৎ সিং’এর প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের মাধ্যমে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন ইঙ্গিত সাংস্কৃতিক এবং সংযোগ সাংস্কৃতিক সংস্থার শিল্পী বন্ধুরা। দু’টি সংস্থার সঙ্গীত পরিবেশন মানুষের নজর কাড়ে। কবিতা পাঠ করেন এবং বক্তব্য রাখেন আমাদের সকলের প্রিয় ফুলদি, ফ্যাসিস্ট আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে বক্তব্য রাখেন পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের পক্ষে মাধব মুখার্জী, ইঙ্গিত সাংস্কৃতিক সংস্থার পক্ষে দীপক চক্রবর্তী, সংযোগ সাংস্কৃতিক সংস্থার পক্ষে পার্থ সারথি মিত্র, বালি এলাকার প্রবীণ সাংস্কৃতিক কর্মী বাবলু গুহ। ফ্যাসিস্ট বিরোধী মানুষকে ঐক্যবদ্ধভাবে সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সামিল হওয়ার আহ্বান জানিয়ে শ্রমিক, কৃষক ছাত্র-যুব-মহিলা সমাজের সর্বস্তরের মানুষের পাশে থাকার অঙ্গীকার করে সভার সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।

former-chief-election-commissioner-demanded-to-ensure-equalitythe-former-chief-election-commissioner-demanded-

তিনজন ভূতপূর্ব মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’কে জানিয়েছেন যে সম্প্রতি আয়কর বিভাগ, ইডি বিরোধী দল ও তাদের নেতাদের বিরুদ্ধে যে সমস্ত পদক্ষেপ নিয়েছে, তা সুষ্ঠুভাবে, সমস্ত প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনী ময়দানে সমতা নিশ্চিত করার যে নির্বাচনী বিধি রয়েছে, তার পরিপন্থী।

ইতিমধ্যে আয়কর দপ্তর কংগ্রেসকে ২০১৪-১৫ এবং ২০১৬-১৭’র জন্য নতুন করে ১,৭৪৫ কোটি টাকার নোটিশ ধরিয়েছে। এর আগে, ১৯৯৪-১৯৯৫ এবং ২০১৭-১৮’র আয়কর নোটিশ আগেই ধরানো হয়, ফলে সব মিলিয়ে ৩,৫৬৭ কোটি টাকা দেবার জন্য আয়কর দপ্তর হুমকি দিয়েছে। এর আগে, আয়কর দপ্তর কংগ্রেসের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে ১৩৫ কোটি টাকা তুলে নিয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দু’জন ভূতপূর্ব কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, এই ধরনের পদক্ষেপ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন প্রক্রিয়ার পথে বাধাস্বরূপ। তাঁরা বলেছেন, ভারতীয় নির্বাচন কমিশনের মুখ্য আধিকারিক সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে নির্দেশ দিতে পারেন যে আপাতত ওই সমস্ত পদক্ষেপ মুলতুবি থাকুক। নির্বাচন পর্ব সাঙ্গ হওয়ার পর আবার তারা অগ্রসর হতে পারেন।

“আমি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি নির্বাচন কমিশন ওই পদক্ষেপকে নিজের ক্ষমতাবলে স্থগিত রাখতে পারে, কারণ তা নির্বাচনী ময়দানে সমতা নিশ্চিত করার নীতিকে (লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড) ক্ষতিগ্রস্ত করছে।” নির্বাচন কমিশনে আমরা যে নীতি অনুসরণ করতাম তা হল, “এতদিন ধরে যা অপেক্ষা করেছিল, নির্বাচনের সময় তা অপেক্ষা করুক”। যে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটা উঠে আসে তা হল, ওই পদক্ষেপ আপাতত মুলতুবি রাখলে কি অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে? তিন মাসের জন্য এমন কোন অপূরণীয় ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই, বলেছেন ভূতপূর্ব মুখ্য নির্বাচন কমিশনার এস ওয়াই কুরেশি।

আরেকজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভূতপূর্ব মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেছেন, আমাদের আমলে এই ধরনের ঘটনাগুলো কখনই ঘটেনি। যেহেতু এই ধরনের নজির নেই, তাই বলাটাও মুশকিল যে নির্বাচন কমিশন কিভাবে হস্তক্ষেপ ঘটাবে। তবে এটা নিশ্চিত করেই বলা যায় যে, আদর্শ আচরণ বিধি অনুযায়ী নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সকলকেই ভোটের ময়দানে সমতা দিতে হবে। কর সংস্থাগুলো যদি লাগাতারভাবে প্রধান বিরোধী দলকে একের পর এক নোটিশ ধরাতে থাকে, ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করে, এমনকি সেই অ্যাকাউন্ট থেকে টাকাও কেটে নেয় নির্বাচনী প্রচার চলাকালীন, তবে নির্বাচন কমিশন সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ডাইরেক্ট ট্যাক্সকে বলতেই পারে, এমন কী বাধ্যবাধকতা রয়েছে যে তোমরা নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারবে না? কেন কমিশন সিবিডিটি’র সাথে বৈঠক করে তা মেটাতে পারছে না?

সকল প্রাক্তন নির্বাচনী আধিকারিক বলেছেন, নির্বাচন কমিশন নীরব হয়ে বসে থাকতে পারেনা। তারা সরাসরি কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলোকে জানাক, এখন নয়, নির্বাচন মিটে যাওয়ার পর যা করার করবে।

in-a-democratic-system-arrests-of-opposition-leaders-and-tax-terrorismtax-terrorism-are-unprecedented

লোকসভা নির্বাচনের প্রথম ভোট পড়তে আর বেশি দিন নেই। প্রায় সমস্ত জনমত সমীক্ষা, প্রধানমন্ত্রী এবং বিজেপির সুরে সুর মিলিয়ে বলছে, এবার ৫৪৩ জনের লোকসভায়, তাঁরা একাই ৪০০ আসন পাবেন। তা দেখে শুনে, অনেকেই হতোদ্যম হয়ে পড়ছেন, তবে কি বিজেপিকে কোনোভাবেই আর পরাজিত করা সম্ভব নয়? কিন্তু কিছু প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, বিজেপি এবং প্রধানমন্ত্রী মোদী যদি এতোটাই নিশ্চিত হন, তাঁদের দলের তৃতীয়বারের ক্ষমতায় আসা নিয়ে, তাহলে তিনি গণতান্ত্রিক পদ্ধতি মেনে, নির্বাচনে বিরোধীদের পরাজিত করার কথা না বলে, সমস্ত বিরোধী দলগুলোকে এইভাবে হেনস্থা করছেন কেন? তাহলে কি উনি হেরে যাওয়ার ভয় পাচ্ছেন? তাহলে কি মনের কোনও একটি জায়গায় পরাজয়ের ভীতি প্রবেশ করেছে?

যেদিকেই তাকানো যাচ্ছে, সেদিকেই দেখা যাচ্ছে, কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাদের তৎপড়তা বেড়ে গেছে। স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পরে, লোকসভা নির্বাচন হচ্ছে, কোনোদিনও কি কেউ বলতে পারবেন, ইডি এবং সিবিআই এতটা তৎপড়তা দেখিয়েছেন এর আগে? সাধারণত নির্বাচন ঘোষণা হয়ে গেলে, যাবতীয় এই ধরনের বিষয়গুলো স্থগিত রাখা হয়, কিন্তু এবার দেখা যাচ্ছে উল্টো। নির্বাচন ঘোষণা হওয়ার পরে, বিরোধী ইন্ডিয়া জোটের অন্যতম দু’জন শরিক আম আদমি পার্টি এবং ঝাড়খন্ড মুক্তি মোর্চার প্রথম সারির নেতৃত্ব এবং সেই রাজ্যগুলোর মুখ্যমন্ত্রীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দিল্লীর মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল এবং ঝাড়খন্ডের মুখ্যমন্ত্রী, হেমন্ত সোরেনকে গ্রেপ্তারের পরে, সারা বিশ্বের নানান দেশ থেকে সমালোচনা হলেও, নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁর মন্ত্রীসভার সদস্যদের থামানো যাচ্ছে না। এমনকি উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখড়, যিনি একটি সাংবিধানিক পদে বহাল, যাঁর দলীয় রাজনীতিতে মন্তব্য করা সমীচীন নয়, তিনি অবধি বলেছেন, বিদেশী কোনও দেশের উপদেশ নেওয়ার প্রয়োজন তাঁদের নেই। একদিকে গ্রেপ্তারি চলছে, পাশাপাশি বিভিন্ন জনসভায় প্রধানমন্ত্রী বলে বেড়াচ্ছেন, তিনি দুর্নীতির সঙ্গে আপোষ করবেন না, যে কোনও দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে এবং আগামীতেও হবে। এই কথা শুনে অনেকেই হয়তো ভাবছেন, এইরকম কঠোরতাই দরকার, দুর্নীতি রুখতে এইরকম শক্ত লোকই দরকার।

২০১৪ সালের আগে, দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের দুর্নীতি নিয়ে যখন রোজ খবর হচ্ছিল, তখন যুগপুরুষ হিসেবে নরেন্দ্র মোদীকে খুব সচেতনভাবে তুলে ধরা হয়েছিল। শ্লোগান উঠেছিল, ‘বহুত হুয়া ভ্রষ্টাচার, আবকি বার মোদী সরকার’। ক্ষমতায় আসার পরে গঙ্গা, যমুনা, নর্মদা দিয়ে বহু জল যাওয়ার পরে দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা, যাঁদের বিরুদ্ধে এতদিন তদন্ত চলছিল, তাঁদের বিজেপিতে অন্তর্ভুক্তি হচ্ছে। শুধু তাই নয়, তাঁদের বিরুদ্ধে যে তদন্ত চলছিল, সেই তদন্ত অবধি বন্ধ করা হচ্ছে। যাঁদের বিরুদ্ধে, সকাল থেকে রাত অবধি নরেন্দ্র মোদী আঙুল তুলতেন, সেই হিমন্ত বিশ্বশর্মা, শুভেন্দু অধিকারী, প্রফুল্ল প্যাটেল, ছগন ভুজাওয়াল কিংবা অজিত পাওয়ারদের আজকাল প্রধানমন্ত্রীর পাশেই দেখা যাচ্ছে। এমনকি, নরেন্দ্র মোদীর মন্ত্রীসভার অর্থমন্ত্রী, নির্মলা সীতারামন একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তাঁদের দলের দরজা, সকলের জন্য খোলা। যে কোনও মানুষ, যিনি দুর্নীতিগ্রস্ত হোন, কিংবা তাঁর বিরুদ্ধে যদি তদন্তও চলে, তাতেও সেই নেতাকে দলে নিতে তাঁদের আপত্তি নেই।

বিরোধী দলের নেতামন্ত্রীদের হেনস্থা এবং গ্রেপ্তারিতেই কিন্তু বিষয়টা থেমে নেই। প্রধান বিরোধী দল, কংগ্রেসের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, তাঁদের সমস্ত ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করে দেওয়া হয়েছে আয়কর দপ্তরের পক্ষ থেকে। বলা হয়েছে, যেহেতু কংগ্রেসের তরফ থেকে ২০১৭-১৮ সাল থেকে পরপর পাঁচ বছর, আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়া হয়নি, তাই এই পথ নিতে বাধ্য হয়েছে আয়কর দপ্তরের পক্ষ থেকে। রাহুল গান্ধী, সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ করেছেন, ৩০ বছর আগের অভিযোগ সহ আয়কর ফাঁকির অভিযোগ তুলে আয়কর দপ্তর শুধু শতাব্দী প্রাচীন দলটির ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করেই ইতিমধ্যে বাজেয়াপ্ত করেছে ১৩৫ কোটি, যা আইনত করা যায় না। শুধু তাই নয়, কংগ্রেসের কাছে, আয়কর দপ্তরের তরফ থেকে প্রাথমিকভাবে ১৮২৩ কোটি টাকা ফাইন ধার্য করে চিঠি অবধি পৌঁছে গেছে। স্থাবর অস্থাবর মিলিয়ে কংগ্রেসের মোট সম্পত্তি ১৪৩০ কোটি টাকা। টাকা। শোনা যাচ্ছে, গত কয়েকদিনে আয়কর দপ্তর কংগ্রেসকে মোট ৩৫৩৬ কোটি টাকার নোটিস ধরিয়েছে। অর্থাৎ দলটি দেউলিয়া হয়ে গেলেও অত টাকা দেবার সাধ্য থাকবে না। আর ভোটের মুখে দলটির টাকা খরচ করার সাধ্যকে শূন্যে নামিয়ে আনাই লক্ষ্য। এই বিষয়টিকে কি সন্ত্রাস বলা উচিৎ নয়?

ইলেক্টোরাল বন্ডের থেকে যে টাকা বিজেপির ঘরে আসার ছিল তা সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বানচাল হয়ে যেতেই বিপক্ষকে আর্থিকভাবে পঙ্গু করার এই বিজেপীয় চাল দেশের ইতিহাসের কদর্যতার অধ্যায়ে লেখা থাকবে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশের নির্বাচনের আগে এই কর-সন্ত্রাস নিয়ে ইতিমধ্যেই শোরগোল পড়ে গেছে। অনেকে বলছেন, কংগ্রেস নিজের দোষেই এই বিপদে পড়েছে। শুধু কংগ্রেস নয়, বাম দলগুলোর মধ্যে, সিপিআই(এম) এবং সিপিআই দলের নামেও আয়কর দপ্তরের চিঠি এবং শাস্তি ধার্য হয়েছে। বলা হয়েছে, তাঁরা যেহেতু পুরোনো প্যান কার্ড ব্যবহার করে কর জমা করেছেন, সেই কারণে তাঁদেরও জরিমানা দিতে হবে। সিপিআইকে বলা হয়েছে ১১ কোটি টাকা জরিমানা দিতে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, নির্বাচনী বন্ডে একমাত্র বাম দলগুলোই টাকা নেয়নি। এই অভূতপূর্ব কর সন্ত্রাসের মুখে দাঁড়িয়ে বিজেপি বিরোধী সমস্ত রাজনৈতিক দল প্রশ্ন তুলেছে, যে দল নির্বাচনী বন্ডে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে তাঁদের তো কোনও কেন্দ্রীয় সংস্থা হেনস্থা করছে না, তাঁদের তো আয়কর দপ্তরের চিঠি পেতে হচ্ছে না, তাহলে শুধু বিরোধী দলেদের ক্ষেত্রেই এই নিয়ম, নাকি তাঁরা বিজেপির চাপের কাছে মাথা নোয়ায়নি বলে এইরকম করা হচ্ছে তাঁদের? এই যে বিরোধী দলগুলোর থেকে ওয়াশিং মেশিনের উদাহরণ দেওয়া হচ্ছে এবং বলা হচ্ছে, যে ঐ মেশিনে ঢুকলেই সবার গায়ের নোংরা পরিষ্কার হয়ে যায়, তাহলে কি সেই অভিযোগটাই ঠিক?

শেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী, আয়কর দপ্তর, দেশের সর্বোচ্চ আদালতকে জানিয়েছে, যে আপাতত নির্বাচন চলে আসার কারণে, তাঁরা কংগ্রেসের কাছ থেকে, জরিমানার টাকা আদায় করবে না, কিন্তু ভবিষ্যতে যে হবে না, তা কিন্তু বলা হয়নি। অর্থাৎ পরিষ্কার বোঝানো হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী এবং বিজেপির বিরুদ্ধে বেশি কথা বললে, আবার তাঁদের কোনও না কোনও হেনস্থার সম্মুখীন হতে হবে না, তার নিশ্চয়তা নেই।

- সুমন সেনগুপ্ত

facts-to-know-about-citizenship-lawabout-citizenship-law

ভারতের সংবিধানে নাগরিকত্ব সংক্রান্ত আদি আইন ১৯৫৫ সালে গৃহীত হয়। যে কেউ ভারতে জন্মালেই সে ভারতের নাগরিক হিসেবে গণ্য হবে — এই ছিল মূল কথা। তাছাড়া মূল ভারতীয় ভূখণ্ড (অর্থাৎ ব্রিটিশ ভারত)-এর যে কোনো ব্যক্তির ভারতীয় নাগরিক হওয়ার সহজ ব্যবস্থা ছিল।

পরবর্তীতে নাগরিকত্ব আইনে কিছু কিছু পরিবর্তন হয়। সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হয় ২০০৩ সালে।

২০০৩ সালে ১৯৫৫’র আইনে তিনটি নতুন ধারা যুক্ত হয়। প্রথমত, জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব পাওয়ার অধিকার কেড়ে নিয়ে উত্তরাধিকার সূত্রের কথা বলা হয়। শুধু ভারতে জন্মালেই হবে না, তার বাবা ও মা উভয়কেই ভারতীয় নাগরিক হতে হবে।

দ্বিতীয়ত, সকলকেই বিভিন্ন নথিপত্র দিয়ে নিজের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে হবে এবং তার ভিত্তিতে সরকার একটা নাগরিকপঞ্জি বা তালিকা বানাবে এবং নাগরিকের পরিচয়পত্র দেবে। এই তালিকার নাম ‘ন্যাশনাল রেজিস্টার অব ইণ্ডিয়ান সিটিজেন্স’ বা এক কথায় এনআরসি।

তৃতীয়ত, অন্য দেশ থেকে এসে যারা ভারতে বসবাস করছেন তারা সকলেই বেআইনি অনুপ্রবেশকারী হিসেবে গণ্য হবেন।

২০০৩ সালে নাগরিকত্ব আইনে এই তিনটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ ‘সংশোধন’ আনে সেই সময়কার বিজেপি সরকার। দেশভাগের শিকার হয়ে ওপার বাংলা থেকে আসা সকল ব্যক্তি ও তার বংশধরদের বেআইনি অনুপ্রবেশকারী বানিয়ে দেয় এবং সমস্ত দেশবাসীর মাথায় এনআরসি’র খাঁড়া ঝুলিয়ে দেয়।

২০১৯ সালে আসামে এনআরসি’র ভহাবহ অভিজ্ঞতা সামনে আসে। নাগরিকত্বের প্রমাণ হাজির করতে কোটি কোটি মানুষের চরম হয়রানি, আতঙ্ক, জমিজায়গা বেচতে বাধ্যা হওয়া, বহু মানুষের আত্মহত্যা, ডি-ভোটার, ডিটেনশন ক্যাম্পের বিভীষিকা, জাতি-ধর্ম-ভাষা নির্বিশেষে ১৯ লক্ষ মানুষের বেনাগরিক হয়ে যাওয়া — বিজেপি নেতা অমিত শাহের ‘উইপোকা’ উক্তি।

দেশজুড়ে এনআরসি’র বিরুদ্ধে তীব্র গণক্ষোভ ছড়াতে থাকায় বিজেপি সামনে আনে নাগরিকত্ব আইনে নতুন সংশোধন — সিএএ-২০১৯। বিজেপি বলার চেষ্টা করে, সিএএ’র ফলে হিন্দুদের আর এনআরসি’র ভয় পাওয়ার কিছু নেই। অমিত শাহ বলেন, “ক্রনলজি সমঝিয়ে। পহলে সিএএ, উসকে বাদ এনআরসি”।

সিএএ-২০১৯এ বলা হয় যে পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে নির্দিষ্ট কয়েকটি ধর্মের মানুষ ধর্মীয় কারণে উৎপীড়িত হয়ে ভারতে এলে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন জানাতে পারবে। মুসলমান, ইহুদি, নাস্তিক ইত্যাদিদের এই সুযোগের বাইরে রাখা হয়। এর বিরুদ্ধে দুই শতাধিক মামলা সুপ্রিম কোর্টে চলছে।

সংবিধানের ১৪নং ধারায় ভারতে বসবাসকারী যে কোনও ব্যক্তিকে আইনের চোখে সমান হিসেবে দেখার যে নির্দেশ দেওয়া আছে সিএএ তা লঙ্ঘন করছে, অন্যান্য সমস্ত ধরণের নিপীড়নকে গণ‍্য না করে (যথা, রাজনৈতিক, জাতিগত, গোষ্ঠিগত বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়গত কারণ) কেবলমাত্র ধর্মীয় নিপীড়নকেই নাগরিকত্ব প্রদানের জন্য গণ্য করা, ধর্মীয় পরিচিতিগুলির মধ্যেও বিশেষ কয়েকটিকে মান্যতা দিয়ে বাকিগুলিকে বাদ দেওয়া ইত্যাদি কারণে সিএএ-২০১৯-কে বহু আইনবিদ সংবিধান-বিরোধী আখ্যা দেন। স্পষ্টতই এই ‘ক‍্যা-২০১৯’ ধর্মীয় মেরুকরণের প্রচেষ্টা মাত্র।

সিএএ-২০১৯ লাগু করার নিয়ম কী হবে, কীভাবে ওপার বাংলা থেকে আসা লক্ষ লক্ষ মানুষ ও তাঁদের পরিবার নিজেদের ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার বলে প্রমাণ দেবেন তা নিয়ে ব্যাপক উদ্বেগ ছড়ায়।

পাঁচ বছর ঝুলিয়ে রেখে গত ১১ মার্চ সিটিজেনশিপ এমেন্ডমেন্ট রুলস বা সিএআর’২০২৪ জারি হয়। এতে আবেদন জানানোর যে নিয়ম ও যা যা প্রমাণপত্র দাখিল করার কথা বলা আছে তাতে স্পষ্ট যে, নাগরিকত্বের আবেদন জানানোর অর্থ নিজেকে এবং নিজের পরিবারকে বেআইনি অনুপ্রবেশকারী হিসেবে ঘোষণা করে, এযাবৎ পাওয়া সমস্ত আইনি অধিকার খুইয়ে, পুলিশ ও প্রশাসনের কাছে আত্মসমর্পন করে, আবেদন মঞ্জুরির জন্য অনির্দিষ্টকাল অপেক্ষা করা। এক উচ্চ পর্যায়ের সংস্থা খতিয়ে দেখবে আবেদনকারীকে নাগরিকত্ব দেওয়া যাবে কী না। ততদিন সব নাগরিক অধিকার খুইয়ে আবেদনকারী ও তাঁর পরিবারের স্থান কোথায় হবে তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। তাঁরা যে ডি-ভোটার হয়ে যাবেন, তাঁদের নামে থাকা সবকিছুই বেআইনি হয়ে যাবে এবং পুলিশ প্রশাসন ইচ্ছে করলে সব ধরনের হয়রানি চালাতে পারবে — এটুকু বোঝাই যায়, কিন্তু তাঁদের এখুনি ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দী করা হবে কিনা সে বিষয়টা স্পষ্ট নয়, যাদের আবেদন নাকচ হয়ে যাবে তাঁদের কী দশা হবে সেটাও বোঝা যাচ্ছে না।

এইসবই সাধারণ তথ্য মাত্র। সিএএ ও এনআরসি পরস্পর অবিচ্ছেদ্য প্রক্রিয়া। ভোটের আগে সিএএ রুলস আনা হয়েছে, ভোটে জিতলেই ওরা হয়তো নামিয়ে আনবে এনআরসি’র খাঁড়া।

(২৩ মার্চ ২০২৪, সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পক্ষে জীবন কবিরাজ কর্তৃক, তাহেরপুর, নদীয়া থেকে প্রকাশিত প্রচারপত্র)

one-hundred-days-of-work-and-wageshundred-days-of-work-and-wages

দেশে সাধারণ নির্বাচনের ভরা মরসুমেই মোদী সরকার ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প খাতে মজুরি বাড়াল, নির্বাচন কমিশনের অনুমতি নিয়ে। কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের জন্য নতুন মজুরি ঘোষণা করেছে। এ’রাজ্যের কপালে জুটল নামমাত্র ৫.৪৯ শতাংশ বৃদ্ধি, অর্থাৎ আগে ছিল ২৩৭ টাকা, এবার হল ২৫০ টাকা। গোটা দেশে গড়ে দৈনিক মজুরি বেড়েছে দৈনিক ২৮ টাকা, অর্থাৎ ৭ শতাংশের মতো। ১ এপ্রিল থেকে দৈনিক গড় মজুরি বেড়ে হবে ২৮৫ টাকা ৪৭ পয়সা। সেই সাপেক্ষে এ’রাজ্যে ২৫০ টাকা দৈনিক মজুরি ও ৫.৪৯ শতাংশ বৃদ্ধি, দু’টিই কম।

বিভিন্ন রাজ্যে গড়ে এই মজুরি বৃদ্ধি হয়েছে ৩ থেকে ১০.৫ শতাংশ হারে। হরিয়ানায় ১০০ দিনের কাজের মজুরি সব থেকে বেশি বেড়েছে — দৈনিক ৩৭৪ টাকা। আর, সব থেকে কম বৃদ্ধি হয়েছে অরুণাচল প্রদেশ ও নাগাল্যান্ডে, দৈনিক ২৩৪ টাকা। শতাংশের সাপেক্ষে সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি হয়েছে গোয়ায় (১০.৫৬ শতাংশ), তারপর কর্নাটক (১০.৪ শতাংশ)। উত্তরপ্রদেশ ও উত্তরাখন্ডে বৃদ্ধির শতাংশের হার সর্বনিম্ন — মাত্র ৩ শতাংশ।

গোটা দেশে, কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সক্রিয় ১০০ দিন প্রকল্পের সাথে যুক্ত মজুরের সংখ্যা a-farce-of-one-hundred-days-of-work-and-wages১৪.৩৪ কোটি, পরিবারপিছু গড়ে যারা ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষে কাজ পেয়েছেন মাত্র ৫১ দিন। গত অর্থবর্ষে এই একশ দিনের কাজে মজুরি ছিল মাত্র ২৬৭ টাকা। দেশের কী বিপুল সংখ্যক কর্মক্ষম মানুষ কত কম মজুরি নিয়ে অসংগঠিত ক্ষেত্রের সবচেয়ে নিম্নমানের কাজের সাথে যুক্ত এই মোদী জমানায়! তাও এই রোজগার নিয়মিত নয়, বরং সারা বছরে গত অর্থবর্ষে তাঁদের কপালে ওই কাজ জুটলো মাত্র ৫১ দিন। আর কোনো উন্নতমানের কাজ খুঁজে না পেয়ে তাঁরা বাধ্য হচ্ছেন এই রোজগার নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে। এটা আমাদের দেশে দারিদ্রের, কর্মক্ষেত্রের গুণমান ও রোজগারের ধরণের নিদারুণ বাস্তবতাকে দেখিয়ে দেয়।

এ’বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে গ্রামোন্নয়ন ও পঞ্চায়েত রাজের সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটি যে সুপারিশ পেশ করে তাতে স্পষ্টই বলা হয়, ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির সাথে ভোগ্যপণ্য সূচক — কৃষি শ্রমিকের মূল্যযুক্ত (সিপিআই-এগ্রিকালচারাল লেবার) ভিত্তিক মজুরি নির্ধারণের এই রেওয়াজ যথাযথ নয়। এই কমিটি মজুরি বৃদ্ধির দাবি করে। সংসদীয় কমিটি সমালোচনা করে বলে, ২০২৩-২৪-এ মনরেগা খাতে বরাদ্দের প্রস্তাব ছিল ৯৮,০০০ কোটি টাকা, যা আবার সংশোধিত হয়ে দাঁড়ায় ৮৯,৪০০ কোটি টাকা। কিন্তু বাস্তবে বরাদ্দ করা হয় ৬০,০০০ কোটি টাকা। এই হ্রাসপ্রাপ্ত বাজেট বরাদ্দ যে এই গুরুত্বপূর্ণ গ্রামীণ রোজগার যোজনায় বিরাট নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে, তা উল্লেখ করেছে এই কমিটি।

২০১০-১১-কে ভিত্তিবর্ষ ধরে, মজুরি নির্ধারণ করা হচ্ছে ভোগ্যপণ্য সূচক — কৃষি শ্রমিকের উপর দাঁড়িয়ে (সিপিআই-এগ্রিকালচারাল লেবার)। যা বর্তমানে মূল্যস্ফীতির সাথে সাযুজ্য বজায় রাখছে না। মনরেগার জন্য বিজ্ঞান ভিত্তিক মজুরি নির্ধারনের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার নিযুক্ত এক কমিটি, মহেন্দ্র দেব কমিটির সুপারিশ ছিল সিপিআই’এ এল’এর বদলে তা নির্ধারিত হোক সিপিআই-রুরাল লেবারার বা আরএল’এর ভিত্তিতে। অথবা অনুপ সথপতি’র প্রস্তাবিত দৈনিক মজুরি ৩৭৫ টাকা করা হোক। কিন্তু কোন সুপারিশই কেন্দ্র আমল দিল না। কোন পদ্ধতিতে প্রতিবছর মনরেগার মজুরি নির্ধারিত হচ্ছে, তা কেন্দ্রীয় সরকার জনসমক্ষে প্রকাশ করে না, ফলে তা নিয়ে আলাপ আলোচনা বা বিতর্কের অবকাশ থাকে না। মজুরি নির্ধারণ প্রশ্নে এই অস্বচ্ছতা এই আইনের মূল স্পিরিটের বিরুদ্ধেই যায়। ঝাড়খন্ডের মতো হাতে গোনা দু’একটি রাজ্য নিজেদের রাজ্য বাজেট থেকে মজুরি খাতে টাকা বাড়িয়েছে (১৯৮ টাকা থেকে ২২৫ টাকা)। বেশিরভাগ রাজ্য সরকার কিন্তু নিজ নিজ রাজ্যে হরেক জনপ্রিয়বাদী প্রকল্প খাতে অনেক টাকা ব্যয় করলেও শ্রম বাজারে গরিবদের মজুরি বৃদ্ধির জন্য কানাকড়িও বাড়ায় না।

সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, কেন্দ্রীয় সরকার কেন মনরেগা’র মজুরদের ন্যূনতম মজুরি দেবে না? সুপ্রিম কোর্ট একাধিকবার বিভিন্ন রায় দিতে গিয়ে বলেছে, ন্যূনতম মজুরি হল এক মৌলিক অধিকার, আর নির্ধারিত ন্যূনতম মজুরির থেকে কম মজুরি দেওয়ার অর্থ ‘দাস প্রথার প্রবর্তন’। মজুরি প্রদানের রয়েছে এক আইনি বাধ্যতা। বাজেট বরাদ্দের সাথে তা যুক্ত করা বেআইনি। কেন্দ্রীয় সরকারের সদ্য ঘোষিত ন্যূনতম মজুরি একজন কৃষি শ্রমিক যা আয় করেন, তার তুলনায় অনেক কম। দেখা যাচ্ছে, ২০২৩’র অর্থবর্ষে একজন কৃষি মজুরের দৈনিক মজুরির তুলনায় মনরেগা’র মজুরি গড়ে ১০৫ টাকা কম। কেরল রাজ্যে এই ফারাক সর্বোচ্চ, যা অত্যন্ত প্রকটভাবে দেখা যায়। সেখানে ২০২৩-২৪-এ মনরেগার দৈনিক মজুরি যখন ৩৩৩ টাকা, তখন পুরুষদের কৃষিকাজে ২০২২-২৩এ দৈনিক মজুরি ৭৬৪.৩ টাকা — অর্থাৎ পার্থক্য ৪৩১ টাকা।

দিনকয়েক আগে দিল্লীতে অনুষ্ঠিত হল মিন্ট ইন্ডিয়া ইনভেস্টমেন্ট সামিট। সেখানে দেশের অর্থনীতির সামনে যে সমস্ত বড় বড় চ্যালেঞ্জগুলো উঠে আসছে তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রায় সমস্ত আলোচকেরা বলেছেন, ভোগব্যয় বাড়ানো, বিশেষ করে বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলে ভোগব্যয় বাড়াতে নজর ফেরানো, ক্রমে চওড়া হওয়া আর্থিক অসাম্যকে কমিয়ে আনা দেশের অর্থনীতির সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

ধুঁকতে থাকা মন্থর গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে গ্রামীণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়াতে হবে। আর তা করতে সর্বাগ্রে দরকার ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি। বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ এ’কথাই বারংবার বলে আসছেন।

- অতনু চক্রবর্তী

economists-questioned-the-financial-growthfinancial-growth-of-the-country

( সম্প্রতি দেশের বহু ঢাক পেটানো আর্থিক বৃদ্ধি নিয়ে কয়েকজন প্রথম সারির অর্থনীতিবিদ প্রশ্ন তুলেছেন। একজন হলেন, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ভূতপূর্ব গভর্নর রঘুরাম রাজন, আর আরেকজন হলেন কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাক্তন মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রহ্মণ্যন। আমরা তাঁদের বক্তব্য এখানে তুলে ধরছি। - সম্পাদকমন্ডলী, আজকের দেশব্রতী )

“দেশের আর্থিক বৃদ্ধিকে বাড়িয়ে চাড়িয়ে দেখানো হচ্ছে যা ভারত বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। এটা তার সবচেয়ে বড় ভুল”, বললেন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজন। তিনি বলেছেন, “অর্থব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু কাঠামোগত সমস্যা থেকে যাচ্ছে, যা সমাধান করার উপরই দেশের অগ্রগতি নির্ভর করছে।”

তাঁর মতে, নির্বাচনের পর ক্ষমতায় যে সরকার আসীন হবে তার সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে শ্রমশক্তির শিক্ষার গুণমান ও দক্ষতা বাড়ানো। এই সমস্যা মোকাবিলা করতে না পারলে ভারত তার তরুণ জনসংখ্যার থেকে ফসল তুলতে পারবে না — ১৪০ কোটির দেশের মধ্যে যাদের সংখ্যা প্রায় অর্ধেক আর বয়স ৩০’র মধ্যে।

“ভারত সবচেয়ে বড় ভুল করবে যদি বাড়িয়ে চাড়িয়ে তুলে ধরা ওই আর্থিক বৃদ্ধির প্রতি আস্থা রাখে। ওই গালগল্পকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে আরও বহু বছর আমাদের পরিশ্রম করতে হবে। রাজনীতিবিদেরা আপনাদের ওই অবাস্তব কথাকে বিশ্বাস করাতে চাইবে। কিন্তু তা বিশ্বাস করলে মারাত্মক ভুল হবে।”

২০৪৭’র মধ্যে ভারত এক উন্নত অর্থব্যবস্থায় উন্নীত হবে, মোদীর এই দাবিকে রাজন ‘স্রেফ বাজে কথা’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এখনও বহু পড়ুয়া উচ্চ মাধ্যমিকের গন্ডি পেরোতে পারে না। স্কুল-ছুটের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। আমাদের শ্রমশক্তি ক্রমবর্ধমান। সেখান থেকে ফসল তুলতে গেলে তাঁদের জন্য শোভন কাজ জোটাতে হবে। আমাদের সামনে এই সমস্যাটাই রয়েছে।

রাজন বিভিন্ন সমীক্ষার ফলাফল তুলে ধরে দেখান, কোভিডের পর দেশে স্কুল পড়ুয়াদের শিক্ষার মান ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে ২০১২’র আগের অবস্থায় ফিরে গেছে। মাত্র ২০.৫ শতাংশ তিন ক্লাসের পড়ুয়া ক্লাস দুই’এর বই পড়তে পারছে। স্বাক্ষরতার মানের ক্ষেত্রে অন্যান্য এশিয় দেশ, যেমন ভিয়েতনামের নিচে এখন ভারতের স্থান।

উচ্চশিক্ষা খাতে বাজেটের ব্যয় বরাদ্দ না বাড়িয়ে বিপুল সরকারি ভর্তুকি দিয়ে চিপ উৎপাদনের ‘বিপথগামী’ নীতিকে রাজন সমালোচনা করেছেন। দেশে সেমি-কন্ডাক্টার ব্যবসা স্থাপনের জন্য মোদী সরকার খরচ করছে ৭৬০ বিলিয়ন (এক বিলিয়ন = ১০০ কোটি) টাকা। আর, উচ্চশিক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দ মাত্র ৪৭৬ বিলিয়ন টাকা।

চিপ উৎপাদনের মতো হাই প্রোফাইল প্রকল্পের দিকে মোদী সরকারের বেশি নজর, কিন্তু প্রশিক্ষিত প্রযুক্তিবিদ তৈরি করার লক্ষ্যে শিক্ষা ব্যবস্থাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কোনো চিন্তা ভাবনাই বর্তমান সরকারের নেই, বলেছেন রাজন।

শিক্ষা ব্যবস্থার পাশাপাশি রাজন আগামী দিনে নির্বাচিত সরকারের জন্য কিছু নীতিগত অগ্রাধিকার রেখেছেন। তাঁর মতে, আর্থিক অসাম্যকে কমানো, শ্রমনিবিড় উৎপাদনের দিকে জোর দেওয়া দরকার। ভারতের প্রশাসনিক ব্যবস্থা ক্রমেই কেন্দ্রীভূত হয়ে উঠছে। তার বিপরীতে, দ্রুত বিকাশের স্বার্থে রাজ্যগুলির হাতে আরও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের কথা তিনি বলেছেন। (ইকনমিক টাইমস, ২৬ মার্চ ২০২৪)

এদিকে, চলতি অর্থবর্ষের তৃতীয় ত্রৈমাসিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৮.৪ শতাংশ। যা প্রায় সমস্ত মূল্যায়ন সংস্থার পূর্বাভাসকে ছাপিয়ে গিয়েছে। অবাক করেছে অর্থনীতিবিদদের একাংশকে। কেন্দ্রের প্রাক্তন মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রহ্মণ্যনের বক্তব্য, এই হার ‘রহস্যজনক’, যা ‘হৃদয়ঙ্গম’ করাও কঠিন।

বিভিন্ন মূল্যায়ন সংস্থার সমীক্ষায় ব্যাখ্যা করা হয়েছিল, গত ত্রৈমাসিকে আর্থিক বৃদ্ধির হার হতে পারে ৬.৫ শতাংশ থেকে ৭ শতাংশের মধ্যে। কিন্তু, সরকারি পরিসংখ্যান প্রকাশের পর দেখা যায়, আলোচ্য সময়ে জিডিপি বেড়েছে ৮.৪ শতাংশ হারে। যা গত দেড় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। শুধু তাই নয়, আগের দুই ত্রৈমাসিকের বৃদ্ধির হারেও বড় সংশোধন আনে সরকার। এপ্রিল-জুনে তা ৭.৮ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে করা হয় ৮.২ শতাংশ। জুলাই-সেপ্টেম্বরে ৭.৬ শতাংশ থেকে বেড়ে হয় ৮.১ শতাংশ। গোটা অর্থবর্ষে বৃদ্ধির পূর্বাভাসও বাড়িয়ে ৭.৬ শতাংশ করা হয়। সুব্রহ্মণ্যন বলেন, “আমি সৎ ভাবেই আপনাদের বলতে চাই, সর্বশেষ জিডিপি’র হিসাব আমি বুঝতে পারিনি। ওই পরিসংখ্যান রহস্যজনক। হিসাবেই আনা যাচ্ছে না। এর অর্থ আমার বোধগম্য হচ্ছে না।”

গত ত্রৈমাসিকে জিডিপি’র পরিসংখ্যান নিয়ে অবশ্য অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। দেশের প্রাক্তন মুখ্য পরিসংখ্যানবিদ প্রণব সেন এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, দেশের বাজারের চাহিদার পরিস্থিতির সঙ্গে জিডিপি’র একটা সামঞ্জস্য থাকে। এক্ষেত্রে দুই পরিসংখ্যানের অনেক ফারাক রয়েছে। অর্থনীতিবিদদের একাংশের ব্যাখ্যা, এবার অনিয়মিত বর্ষার ফলে কৃষিক্ষেত্রের অগ্রগতি মসৃণ ছিল না। খাদ্যপণ্যের ছেঁকায় হাত পুড়েছে সাধারণ মানুষের। ফলে অত্যাবশ্যক পণ্য বাদে অন্যান্য পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধির হারও মন্থর, ৩ শতাংশের আশপাশে। সন্তোষজনক নয় শিল্পোৎপাদনের হারও।

প্রাক্তন মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা বলেছেন, “সরকার বারবার বলছে বিনিয়োগের জন্য ভারত এখন আদর্শ জায়গা। কিন্তু বাস্তব হল, গত কয়েক বছরে প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নি, বেসরকারি লগ্নি এবং কর্পোরেট লগ্নি কমেছে।” তিনি আরও বলেছেন, এদেশের মানুষের মধ্যে একটা ধারণা রয়েছে যে, ভারত খুব বড় বাজার। এই ধারণা থেকে তাদের বার হয়ে আসতে হবে। ভারতের অর্থনীতির বহর ৩ লক্ষ কোটি ডলারের বেশি। কিন্তু, এর মধ্যে মধ্যবিত্তের বাজার মাত্র ৭৫,০০০ কোটি ডলার। গোটা বিশ্বের তা ২০-৩০ লক্ষ কোটি ডলার।

প্রধানমন্ত্রীর আর্থিক পরামর্শদাতা পরিষদের সদস্য শমীকা রবি স্বীকার করেন যে, বেসরকারি লগ্নি বিপুল ধাক্কা খেয়েছে। তবে তা নাকি দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের নীতির দীর্ঘমেয়াদি ফল।

(আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৬ মার্চ ২০২৪)

hasde-also-stood-by-the-forest-tribals-struggleremove-the-bjp-from-power

বাস্তুতন্ত্র ও স্বাধিকার রক্ষায় সোনাম ওয়াংচুকের নেতৃত্ব লাদাখের আদিবাসীরা যখন অনশন সত‍্যাগ্রহ চালাচ্ছেন ঠিক তখন, গত ২৪ মার্চ ২০২৪ রাতে অজ্ঞাত পরিচয় দুস্কৃতিরা ছত্তিশগড়ের হাসদেও অরণ্যে আদিবাসীদের প্রতিবাদমঞ্চ আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়।

হাসদেও অরণ্য বাঁচাও সংঘর্ষ সমিতির অন্যতম নেতা রামলাল করিয়ম মূকনায়ক ওয়েবসাইটের সাংবাদিককে জানান, “কারা আগুন লাগিয়েছে তা জানি না। কিন্তু বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে যাদের রুখতে আমাদের আন্দোলন তারাই এই কাজ করিয়েছে।” হাসদেও অরণ্যের জীবন ও বাস্তুতন্ত্র আদানি কোম্পানির আগ্রাসন থেকে বাঁচাতে গত এক দশক ধরে আদিবাসীরা তীব্র সংগ্রাম চালাচ্ছেন।

দেড় বছর আগে, ২০২২’র গান্ধী জয়ন্তীতে হাসদেও অরণ্যের আদিবাসীরা যখন ফতেপুর গ্রামে একত্রিত হয়ে ছত্তিশগড়ের রাজধানী রাইপুর শহরের উদ্দেশে পদযাত্রা শুরু করে, তখনও তাঁদের পথ আটকাতে কোম্পানির গুণ্ডাবাহিনী নানারকম হামলা চালিয়েছিল। তবু তাঁরা সমস্ত বাধাবিঘ্ন মোকাবিলা করে ৩০০ কিলোমিটার পথ হেঁটে ১৪ অক্টোবর ২০২২ রাইপুর পৌঁছেছিলেন। রাজ্যপাল তাঁদের সাথে দেখা করেছিলেন। কংগ্রেস সরকারের মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের সাথে দেখা করে কথা দিয়েছিলেন হাসদেও অরণ্যে কয়লাখনির প্রথম পর্যায়ের অনুমোদন আদানি কোম্পানি কীভাবে পেল তা খতিয়ে দেখা হবে। কিন্তু তারপর কেন্দ্রের মোদী সরকার আদানিদের দ্বিতীয় পর্যায়ের অনুমোদনও দিয়ে দেয়।

গত ডিসেম্বরে ছত্তিশগড়ে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর ডাবল ইঞ্জিন সরকার আদানিদের খনির জন্য জঙ্গল সাফ করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। শুরু হয় পুলিশ বাহিনীর সশস্ত্র পাহারায় হাজার হাজার গাছ কেটে ফেলা ও আদিবাসী গ্রামগুলিকে সন্ত্রস্ত করার অভিযান। অরণ্য রক্ষায়, জীবন-জীবিকা ও স্বাধিকার রক্ষায়, আদিবাসী গ্রামগুলি একত্রিত হয়ে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদস্থল গড়ে তোলেন। গত ২৪ মার্চ রাতে এই প্রতিবাদমঞ্চ পুড়িয়ে দিল কোম্পানির দুষ্কৃতিরা।

হাসদেও অরণ্যকে বলা হয় ছত্তিশগড়ের ফুসফুস। ভারতে টিকে থাকা সর্ববৃহৎ অখন্ড অরণ্যভূমির অন্যতম হাসদেও। ভারতের ঠিক বুকের মাঝে এর অবস্থান। এই গভীর অরণ্য হাতি চিতা ভাল্লুক সহ বহু বন্যপ্রাণীর আবাস। এখানে আছে বিপুল জল সম্পদ। ভারতের এই এলাকায় বসবাসকারী মানুষেরা দেশের অন্যতম আদি বাসিন্দা। হাসদেও অরণ্যের মধ্যে আছে তিনশ’র উপর গোন্দ গ্রাম। গভীর অরণ্যের নীরব উদ্ভিদকুল ও জীববৈচিত্র্যের সাথে সাথে ধ্বংস হয়ে যাবে এই গ্রামগুলিও, আদানি কোম্পানির খোলামুখ কয়লাখনির গ্রাসে।

গত এক দশকে আদানিরা ক্রমাগত খনি এলাকা বাড়িয়ে চলেছে। ২০১৯’র মার্চ মাসে মোদী সরকার আরো এক লক্ষ সত্তর হাজার হেক্টর বা ১৭০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা তুলে দেয় আদানিদের হাতে। ২০০৬ সালের বনাধিকার আইনকে হাতিয়ার করে আদিবাসীরা যে প্রতিরোধ গড়ে তুলছিলেন সেই আইনকে বানচাল করে দিতে মোদী সরকার ২০২২ সালে নতুন বনসংরক্ষণ আইনের প্রস্তাব আনে যা ২০২৩এ পাস হয়ে গেছে। মোদী সরকারের এই নতুন আইন বনাঞ্চলের সংরক্ষণ ও সুরক্ষার বদলে বনের সংজ্ঞাই বদলে দেয় এবং আদিবাসীদের গ্রামসভাগুলির অধিকার খর্ব করে দিয়ে বনাঞ্চলকে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়ার আইনি বন্দোবস্ত পাকা করে।

মোদী সরকারের স্যাঙাত হিসেবে আদানি কোম্পানি একদিকে প্রকৃতি ও মানুষের জৈবনিক চক্র ধ্বংস করছে আবার অন্যদিকে বিশ্ব জলবায়ু সংকটের সুযোগ নিয়ে ‘সবুজ শক্তি’র একচেটিয়া উদ্যোক্তা হিসেবেও বিপুল মুনাফা লুটছে। লাদাখ থেকে শুরু করে হাসদেও, মোদী-আদানি স্যাঙাত দেশবাসীর অধিকার পদদলিত করে কেড়ে নিচ্ছে ভবিষ‍্যৎ প্রজন্মের প্রাণবায়ু। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিপর্যয়ের সাথে সাথে মোদী-বিজেপি সরকার হয়ে উঠেছে পরিবেশ বিপর্যয়েরও সমার্থক।

- মলয় তেওয়ারি

war-of-palashir-siraj-raja-krishnachandra-in-relation-to-the-historydebate-in-the-electoral-climate

আড়াইশো তিনশো বছরের পুরনো ইতিহাস নিয়ে কেন দেশব্রতীর পাতায় লোকসভা নির্বাচনের মুখে দাঁড়িয়ে এই লেখা লিখতে হচ্ছে সেটা প্রথমে বলি। লোকসভা নির্বাচনে কৃষ্ণনগর কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থী করেছে অমৃতা রায়কে। তাঁর যে পরিচয়টি কেন্দ্রের শাসকদল তুলে ধরছে সেটি হল কৃষ্ণনগরের যে রাজ পরিবার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের উত্তরাধিকারী, তিনি সেই পরিবারের সদস্যা। লোকসভার প্রার্থী হিসেবে তাঁর নাম ঘোষণার পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁকে শুভেচ্ছা জানিয়ে ফোন করেন। তাঁদের মধ্যেকার ফোনের বার্তালাপ প্রকাশ্যে আসার পর থেকেই পলাশীর যুদ্ধে সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের অন্যতম রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়।

পলাশীর যুদ্ধ ও তাতে কার কতটা ভূমিকা ছিল তা নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে যেমন বিতর্ক আছে, তেমনি বিতর্ক আছে সিরাজদ্দৌল্লা’কে নিয়েও। সিরাজকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের পর্বটিতে নানা সময়েই ইংরেজ বিরোধী লড়াইয়ের প্রথম নায়ক হিসেবে দেখা হয়েছে। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু শেষবার ব্রিটিশের হাতে বন্দী হবার অব্যবহিত আগে যে রাজনৈতিক কর্মসূচিটি নেবার চেষ্টা করেছিলেন, তা ছিল সিরাজের ইংরেজ বিরোধী ভূমিকার গৌরবকে স্মরণ করে সিরাজ দিবস পালন করা। স্বাধীনতা আন্দোলনের দিনগুলিতে সিরাজকে নায়ক করে নাটক লিখেছিলেন শচীন সেনগুপ্ত মহাশয়, যে নাটকের অংশ এখন মাধ্যমিকের বাংলা ভাষা সাহিত্যের সিলেবাসে ছাত্রছাত্রীদের পড়ানো হয়। এছাড়া সিরাজকে ইতিবাচক দিক থেকে বিশ্লেষণ করে বই লিখেছিলেন অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়। জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার ঠিক দশ বছর আগে, ১৮৭৫ সালে পলাশীর যুদ্ধ নিয়ে যে বিরাট আখ্যানকাব্য লিখেছিলেন সেকালের বিশিষ্ট কবি নবীনচন্দ্র সেন, সেখানেও সিরাজকে দেশপ্রেমিক বীর হিসেবে তিনি দেখিয়েছেন। তবে কাব্যকবিতা, নাটক ইত্যাদি সাহিত্যের বাইরে সিরাজকে নিয়ে অষ্টাদশ শতকে বা পরে যে সব ইতিহাস বা বিবরণী লেখা হয়েছে, সেখানে তাঁকে অনেকসময়েই একজন নিষ্ঠুর, অত্যাচারী, খামখেয়ালী উদ্ধত মানুষ ও শাসক হিসেবে দেখা হয়েছে। ইতিহাসবিদ সুশীল চৌধুরী লিখেছেন, “প্রায় সমসাময়িক সব ফারসি ইতিহাসে এবং ইউরোপীয় পর্যবেক্ষকদের লেখায় এটা পরিষ্কার যে তরুণ যুবক হিসেবে সিরাজদ্দৌল্লা এমনই নিষ্ঠুর, দুর্বিনীত, নির্দয় এবং দুশ্চরিত্র ছিলেন যে সবাই তাঁর নবাব হওয়ার সম্ভাবনায় শঙ্কিত হয়ে পড়েছিল।” (পলাশির অজানা কাহিনী, সুশীল রায়, পৃ-১৯)

গত শতাব্দীর আশির দশক থেকে শুরু করে পরের অর্ধশতকে সিরাজ ও পলাশীর ষড়যন্ত্র নিয়ে বেশ কিছু গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এই গবেষণাগুলিতে পলাশীর ষড়যন্ত্র সম্পর্কে মূলত দু’ধরনের মত রয়েছে। একটি মত অনুসারে সিরাজের প্রতি বিরূপ হয়ে রাজদরবারের অভিজাতরা প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে সামিল হন। ইংরেজদের তাতে তাঁরা যুক্ত করে নেন। ইতিহাসবিদ রজতকান্ত রায়ের ‘পলাশীর ষড়যন্ত্র ও সেকালের সমাজ’ নামক বিখ্যাত গবেষণাগ্রন্থে আমরা এই মতটি পাই। অন্য মতটি মনে করে ইংরেজরাই ছিলেন পলাশীর ষড়যন্ত্রের মূল ক্রীড়নক। নানা পদ্ধতিতে সভাসদদের ক্ষোভকে নবাব সিরাজের বিরুদ্ধে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তাব্যক্তিরা ব্যবহার করে নিয়েছিলেন। ইতিহাসবিদ সুশীল চৌধুরী মহাশয়ের ‘পলাশির অজানা কাহিনী’ নামক বিখ্যাত বইতে এই মতটি আমরা দেখতে পাই। কাদের ভূমিকা এই ষড়যন্ত্রে প্রধান ছিল আর কাদের ছিল খানিকটা সাহায্যকারী অবস্থান — বর্তমান প্রেক্ষিতে ইতিহাসবিদদের মধ্যেকার সেই বিতর্কের বিচার আমাদের লক্ষ্য নয়। আমরা এই ষড়যন্ত্রের কুশীলবদের অন্যতম কৃষ্ণনগরের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় কী ভূমিকা কেন পালন করেছিলেন, সেটাই মূলত বুঝতে চাইবো।

কৃষ্ণনগরের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় অষ্টাদশ শতকের একেবারে শুরুর দিকে জন্মগ্রহণ করেন। সেটা ১৭১০ সাল। তাঁর জন্মের তিন বছর আগে দিল্লীর শেষ মহাপ্রতাপশালী মুঘল শাসক ঔরঙ্গজেবের মৃত্যু হয়েছে৷ বাংলার নবার তখন মুর্শিদকুলি খাঁ। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের বেড়ে ওঠার দিনগুলিতে মুর্শিদকুলি খাঁই বাংলার একচ্ছত্র শাসক। ঔরঙ্গজেবের পরবর্তী মুঘল বাদশাহদের তিনি নামমাত্র স্বীকৃতি দিয়ে কার্যত স্বাধীন বাদশাহের মতোই শাসন চালাতেন। ১৭২৭এ মারা যান মুর্শিদকুলি খাঁ। তাঁর জায়গায় সিংহাসনে কে বসবেন তাই নিয়ে দ্বন্দ্ব বিবাদ তৈরি হয়। এই সময়েই ১৭২৮ খ্রিস্টাব্দে নবদ্বীপ রাজবংশের রাজা রঘুরাম রায়ের মৃত্যু হয়। পিতা রঘুরামের মৃত্যুর পর কৃষ্ণনগরের মহারাজার আসনে বসলেন সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ কৃষ্ণচন্দ্র রায়।

নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ সুজাউদ্দিনের পুত্র সফররাজ খানকে তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করেছিলেন। কিন্তু পুত্রের দাবিকে অস্বীকার করে মুর্শিদাবাদের দিকে সেনা অভিযান পরিচালনা করেন সুজাউদ্দিন এবং অবশেষে বাংলার নবাব হয়ে বসেন। তৎকালীন মুঘল সম্রাট মুহম্মদ শাহকে বিপুল পরিমাণ নজরানা পাঠিয়ে তাঁর সমর্থন আদায় করে নেন। বারো বছর পর সুজাউদ্দিনের মৃত্যু হলে অবশেষে তাঁর পুত্র সফররাজ খাঁ বাংলার নবাব হন। ১৭৩৯ সালে সফররাজ খাঁ সিংহাসনে বসলেও এক বছরের বেশি সময় রাজত্ব চালাতে পারেননি। আলিবর্দি খাঁর বিরাট বাহিনী তাঁকে আক্রমণ করেন। গিরকার যুদ্ধে সফররাজ খাঁ গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। বাংলার নবাব হন আলিবর্দি খাঁ।

আলিবর্দি খাঁর শাসনামলে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র একবার বন্দী হন। সেটা ছিল ১৭৫৪ সাল। মারাঠা হানাদের সন্তুষ্ট করতে আলিবর্দি তাঁদের শুধু উড়িষ্যার অধিকারই ছেড়ে দেননি, বেশ কয়েক লক্ষ টাকা নজরানা দিতেও বাধ্য হয়েছিলেন। ফলে কোষাগারের ওপর বাড়তি চাপ পড়ে এবং সেই চাপের মোকাবিলা করতে জমিদার, মনসবদার, ভূস্বামীদের প্রদেয় করের পরিমাণ অনেকটা বাড়ানো হয়। বাড়তি কর প্রদানে অক্ষম হওয়াতে আলিবর্দি কৃষ্ণচন্দ্রকে বন্দী করেছিলেন বলে শোনা যায়। কিছুদিন পর কৃষ্ণচন্দ্র আলিবর্দির কারাগার থেকে মুক্তি পান। কিন্তু আলিবর্দির সঙ্গে তাঁর দ্বন্দ্বসংঘাত সমাপ্ত হয়নি। আলিবর্দির পর তাঁর নাতি সিরাজদ্দৌল্লা ১৭৫৬ সালে সিংহাসনে বসেন। কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে তাঁরও দ্বন্দ্বসংঘাত অব্যাহত ছিল।

ইতিহাসবিদরা অনেকেই সিরাজকে উদ্ধত ও অত্যাচারী বলেছেন। সিরাজ তাঁর রাজ্য ও রাজসভার শক্তিশালী নানা ব্যক্তি — যেমন ব্যাঙ্কার জগৎ শেঠ পরিবার, রাজবল্লভ, সেনাপতি মীরজাফর প্রমুখদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে তাঁদের বিরাগভাজন হন। ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গেও তাঁর বিবাদ চরমে ওঠে। সিরাজের বিরোধীরা তাঁকে গদিচ্যুত করার জন্য নিজ নিজ স্বার্থকে সামনে রেখে একজোট হয়ে যান। অল্পবয়সী উদ্ধত নবাব সিরাজ এই জোটের মোকাবিলা করতে না পেরে পলাশীর যুদ্ধে পরাস্ত ও নিহত হন।

এবার আসা যাক মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের ইতিহাস প্রসঙ্গে। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে নিয়ে প্রথম উল্লেখযোগ্য বইটি লেখেন রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায়। বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৮০৫ সালে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ থেকে। বইটির নাম ‘মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়স্য চরিত্রং’। এই বই লেখার মাত্র বাইশ বছর আগে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র প্রয়াত হয়েছেন। ফলে সেকালের খ্যাতনামা ব্যক্তি কৃষ্ণচন্দ্রের জীবনের তথ্যাবলী পেতে রাজীবলোচনের বিশেষ সমস্যা হয়নি।

রাজীবলোচনের উপরোক্ত বই থেকে আমরা জানতে পারি সিরাজের রাজদরবারের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন রাজা মহেন্দ্র। তাঁর কাছে বিভিন্ন দেশীয় রাজারা এসে নতুন নবাব সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের সলতে পাকানো শুরু করেন। যাঁরা এই পরিকল্পনা শুরু করেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন বর্ধমানের রাজা, নবদ্বীপের রাজা, দিনাজপুরের রাজা, বিষ্ণুপুরের রাজা, মেদিনীপুরের রাজা প্রমুখ। (রাজীবলোচনের উক্ত বইয়ের পৃ-২৯ দ্রষ্টব্য।) মহারাজা মহেন্দ্র এই সমস্ত রাজাদের পক্ষ থেকে এরপর শলা পরামর্শ করেন সিরাজের রাজসভা তথা মুর্শিদাবাদের কিছু ক্ষমতাসীন ব্যক্তির সঙ্গে, যাঁদের মধ্যে ছিলেন রাজা রামনারায়ণ, রাজা রাজবল্লভ, রাজা কৃষ্ণদাস, সিরাজের প্রধান সেনাপতি বর্ষীয়ান জাফর আলি খাঁ বা মীরজাফর, ধনকুবের জগৎ শেঠ প্রমুখ। রাজীবলোচন তাঁর বইতে লিখেছেন এই শলাপরামর্শ চলাকালীন জগৎ শেঠ বাকিদের প্রস্তাব দেন সিরাজ বিরোধী জোটকে এগিয়ে নিয়ে যেতে নবদ্বীপের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পরামর্শ গ্রহণের (উক্ত গ্রন্থের পৃ-৩১ দ্রষ্টব্য)। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের কাছে দূত আসে এবং সভাসদদের সঙ্গে পরামর্শ করে সিরাজ বিরোধী মন্ত্রণাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে তিনি কালীপ্রসাদ সিংহকে তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে প্রেরণ করেন। কিছু আলাপ আলোচনার পর গুরুত্বপূর্ণ এই আলোচনাকে আরো এগিয়ে নিয়ে যেতে তাঁরা স্বয়ং কৃষ্ণচন্দ্রের সশরীরে মুর্শিদাবাদে উপস্থিত হওয়া জরুরি বলে মনে করেন। কৃষ্ণচন্দ্র ও তাঁর প্রতিনিধি কালীপ্রসাদ মনে করেন নবাব সিরাজদ্দৌল্লা’কে না জানিয়ে কৃষ্ণচন্দ্রের মুর্শিদাবাদে চলে আসাটা সন্দেহের জন্ম দিতে পারে। কৌশল অবলম্বন করে রাজা মহেন্দ্রকে সঙ্গে নিয়ে কৃষ্ণচন্দ্রের প্রতিনিধি হিসেবে কালীপ্রসাদ নবাব সিরাজের কাছে যান এবং কৃষ্ণচন্দ্রের মুর্শিদাবাদে এসে নবাবের সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি প্রার্থণা করেন। এই অনুমতি প্রাপ্তিকে সামনে রেখেই কৌশলী ও সাবধানী কৃষ্ণচন্দ্র সিরাজ বিরোধী ষড়যন্ত্রে শান দিতে মুর্শিদাবাদে আসেন। (উক্ত গ্রন্থের পৃ-৩৪-৩৬ দ্রষ্টব্য।) সিরাজকে কীভাবে অপসারিত করা যায় সেই প্রসঙ্গে মন্ত্রণাসভায় কৃষ্ণচন্দ্র রায় কী প্রস্তাব দিয়েছিলেন, সেই সম্পর্কে রাজীবলোচন লিখছেন, “রাজা (কৃষ্ণচন্দ্র রায়) কহিলেন বিলাত নিবাসী জাতিতে ইঙ্গরাজ কলিকাতায় কোঠী করিয়া আছেন। যদি তাঁহারা এদেশের রাজা হন তবে সকল মঙ্গল হইবে।” (উক্ত গ্রন্থের পৃ-৩৯ দ্রষ্টব্য।) এরপর এই ষড়যন্ত্রের অগ্রগতি কীভাবে হল, তার বিস্তারিত বর্ণনা রাজীবলোচনের বইতে আছে।

in-relation-to-the-history-debate

এই প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার, না ইংরেজ পক্ষ না দেশীয় অভিজাতবর্গ — কেউই সে সময় মনে করেননি পলাশীর যুদ্ধ তথা সিরাজকে অপসারণের মধ্যে দিয়ে বাংলা বিদেশী শাসনের নিগড়ে বাঁধা পড়তে চলেছে। সেকালে মুঘল দরবারের রাজধানী দিল্লীতে ও বিভিন্ন সুবাতে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র ছিল প্রচলিত ঘটনা। সিরাজের দাদু আলিবর্দি নিজেই নবাব সফররাজ খাঁর বিরুদ্ধে এক ষড়যন্ত্রমূলক অভিযান চালিয়ে তাঁকে গদিচ্যুত ও হত্যা করে নিজে নবাব হয়ে বসেছিলেন। সিরাজের সিংহাসন আরোহণ পর্বেও পরিবারের মধ্যে থেকেই আসা ঘসেটি বেগমের চ্যালেঞ্জ তাঁকে সামলাতে হয়েছিল।

সাধারণ প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের চেয়ে পলাশীর ঘটনাটি একেবারে অন্যরকম হয়ে গেছে ইতিহাসের পরবর্তী গতিস্রোতের জন্য। সেই স্রোত প্রথমে বাংলাকে এবং পরে গোটা ভারতকে প্রথমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির, পরে সরাসরি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনস্থ করেছিল। এই পরিপ্রেক্ষিতেই উদ্ধত, দুর্বিনীত, খামখেয়ালী অত্যাচারী চরিত্র সত্ত্বেও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছেন সিরাজ, কেননা তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আধিপত্য মানতে প্রস্তুত ছিলেন না। একাধিকবার ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে তিনি বিবাদ ও যুদ্ধে জড়িয়েছেন, আর এটাই পরবর্তীকালে তাঁকে উপনিবেশ বিরোধী মানুষের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। অন্যদিকে পলাশীর মুখ্য ষড়যন্ত্রকারীদের অন্যতম হিসেবে মীরজাফরের নামটি বিশ্বাসঘাতক শব্দের প্রায় প্রতিশব্দ হয়ে উঠেছে বাংলায়। তবে জগৎ শেঠ, রাজবল্লভ বা মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্ররা একই ষড়যন্ত্রে সামিল থাকলেও খলনায়ক হিসেবে মীরজাফরের মতো আলোচিত ও ধীকৃত হননি। কৃষ্ণনগর লোকসভা কেন্দ্রে কৃষ্ণনগরের রাজ পরিবারের একজন সদস্যা কেন্দ্রের শাসক দলের তরফে প্রার্থী হয়েছেন বলে নির্বাচনের তপ্ত আবহাওয়ায় বিষয়টি এখন নতুন করে চর্চার মধ্যে এসেছে। বিজেপি প্রার্থী অমৃতা রায় এবং তাঁর দল এই অভিযোগটিকে হালকা করে দিতে চাইছেন। তাঁরা একদিকে বলছেন কৃষ্ণচন্দ্রের নানা সামাজিক সাংস্কৃতিক অবদানগুলি বিবেচনা করতে। শাক্ত পদাবলীকার রামপ্রসাদ সেন এবং অন্নদামঙ্গল কাব্যের রচয়িতা ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর যে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিলেন তা তাঁরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন। এও মনে করিয়ে দিতে চাইছেন চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী পুজো প্রচলন এবং বাংলার বিভিন্ন জায়গায় দুর্গাপুজো প্রসারের ক্ষেত্রে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। অন্যদিকে পলাশীর ষড়যন্ত্র প্রসঙ্গে বলছেন মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র সহ অন্যান্য হিন্দু রাজারা মুসলমান শাসনের হাত থেকে হিন্দু বাঙালিকে বাঁচাতে এই ষড়যন্ত্র করেছিলেন। কৃষ্ণচন্দ্রের অবস্থানের সাফাই গাইতে গিয়ে যেভাবে সাম্প্রদায়িক তাস খেলেছেন বিজেপি প্রার্থী অমৃতা রায় ও তাঁর দল, মুসলমান নবাবের হাত থেকে হিন্দুকুলকে বাঁচানোর জন্য কৃষ্ণচন্দ্রদের ষড়যন্ত্র সংগঠিত হয়েছিল বলে যে কথা তাঁরা প্রচার করছেন, তা সর্বৈব মিথ্যা। ইতিহাসবিদরা প্রায় সকলেই বলেছেন যে পলাশীর ষড়যন্ত্রের পেছনে যে যে কারণই থাকুক না কেন, বিভিন্ন স্বার্থের দ্বন্দ্ব যে পরিমাণেই ক্রিয়াশীল থাকুক না কেন, হিন্দু মুসলিম প্রশ্ন একেবারেই কোনও বিবেচনাধীন বিষয় ছিল না। পলাশীর ষড়যন্ত্রকে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণে হিন্দু মুসলিম বিরোধ হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া একদিকে যেমন ইতিহাসবিকৃতি, তেমনি অন্যদিকে বিজেপির ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ও সমাজকে বিভাজনের ধারাবাহিক অপচেষ্টার আর এক চরম নিন্দনীয় প্রয়াস।

- সৌভিক ঘোষাল

israel-is-using-starvation-as-a-weapon-by-not-allowing-foodnot-allowing-food-to-enter-gaza

( গাজা ভূখণ্ডের ব্যাপক অংশকেই গুঁড়িয়ে ধূলিসাৎ করা হয়েছে। সেখানকার অর্থনীতিকে ধ্বংস করা হয়েছে। জনসংখ্যার এক বড় অংশকে বাস্তুচ্যুত হয়ে চলে যেতে হয়েছে দক্ষিণের রাফায়। খাদ্যদ্রব্য নিয়ে যাওয়া ট্রাককে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। দুর্ভিক্ষ আর খুব দূরে নেই। গাজা পরিস্থিতির বিশ্লেষণে কলম ধরেছেন স্ট্যানলি জনি। নিবন্ধটির গুরুত্ব বিবেচনা করে সেটির বঙ্গানুবাদ আমরা এখানে রাখছি। – সম্পাদক, আজকের দেশব্রতী )

এখনও পর্যন্ত যা ঘটেছে

গাজার বিরুদ্ধে ইজরায়েলের যুদ্ধ প্রবেশ করেছে ছ’মাসে, আর ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের বিদেশ নীতির প্রধান যোশেফ বোরেলের কথায় স্থলবেষ্টিত প্যালেস্তাইন হয়ে উঠেছে ‘বৃহত্তম উন্মুক্ত সমাধিস্থল’। রাষ্ট্রপুঞ্জ সতর্ক করে বলেছে যে, ২৩ লক্ষ মানুষের বসবাসের স্থল ক্ষুদ্র ভূখণ্ডে দুর্ভিক্ষ ‘আগতপ্রায়’। আন্তর্জাতিক স্তরে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জোরালো হয়ে ওঠা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সরকার জেদ ধরে রয়েছে যে ‘হামাসকে নিঃশেষ’ না করা পর্যন্ত সামরিক অভিযান চালিয়ে যাওয়া হবে।

গাজার পরিস্থিতি ঠিক কী রকম

বর্তমান যুদ্ধ শুরু হয় ২০২৩’র ৭ অক্টোবর ইজরায়েলের বিরুদ্ধে হামাসের সামরিক অভিযানের মধ্যে দিয়ে, যে অভিযানে অন্তত ১২০০ মানুষ নিহত হয়েছিল। এই যুদ্ধ গাজার ব্যাপক অঞ্চলকেই ধ্বংস করেছে এবং ভূখণ্ডের অধিকাংশ জনগণকেই অপসারিত করে নিয়ে গেছে দক্ষিণের শহর রাফায়। গাজার স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের বয়ান অনুযায়ী পাঁচ মাসেরও অধিক সময়ের ইজরায়েলি আক্রমণে নিহত হয়েছে অন্তত ৩২,০০০ মানুষ, যার এক বড় অংশই নারী ও শিশু। আহতের সংখ্যা ৭৪০০০’রও বেশি। আহতদের চিকিৎসার জন্য যথেষ্ট সংখ্যক হাসপাতাল, ডাক্তার, ওষুধ, যথেষ্ট পরিমাণ পরিশ্রুত জল ও স্বাস্থ্য পরিষেবার অন্যান্য সুযোগসুবিধা গাজার নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, “আমরা দেখতে পাচ্ছি, যে সমস্ত রোগী মৃত্যু থেকে বাঁচার শল্য চিকিৎসা ও অঙ্গহানি থেকে, অথবা ক্যান্সার ও ডায়াবেটিস থেকে সুস্থ হওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছেন, যে মায়েরা সদ্য সদ্য সন্তানের জন্ম দিয়েছেন, অথবা নবজাতক শিশুরা — সবাই বুভুক্ষায় এবং তার থেকে জন্ম নেওয়া ব্যাধিতে আক্রান্ত।”

অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে বাস্তুচ্যুত হওয়া প্রায় ২০ লক্ষ মানুষের অধিকাংশই দক্ষিণে কাজ চালানোর মতো অস্থায়ী শিবিরগুলোতে থাকছেন। রাষ্ট্রপুঞ্জ জানিয়েছে, যে সমস্ত স্কুলে শরণার্থীরা থাকছেন সেখানে এক একটা বাথরুম আর শাওয়ার ব্যবহার করছেন শতাধিক মানুষ। নিকৃষ্ট নির্মলীকরণ ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত হেপাটাইটিস এ, আন্ত্রিক ও অন্যান্য সংক্রামক রোগের প্রাবল্য দেখা যাচ্ছে। ইনটিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ বর্গবিন্যাসের সাম্প্রতিকতম রিপোর্ট অনুসারে গাজার পরিস্থিতি ‘সর্বনাশা’। যুদ্ধের আগে গাজার জনগণের খাদ্যের প্রয়োজন মেটানোর জন্য যথেষ্ট খাবার সেখানে ছিল। অপুষ্টির অস্তিত্ব বলতে গেলে ছিল না। আর এখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ডিরেক্টর জেনারেল টেড্রস আধানম ঘেব্রিয়েসাস বলছেন, “গাজায় যথেষ্ট পরিমাণ খাদ্য ঢুকতে না দিলে দশ লক্ষরও বেশি মানুষ বিপর্যয়কর বুভুক্ষার মুখে পড়বেন।”

গাজায় অনাহারের তীব্র সংকট কেন

ইনটিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ’এর রিপোর্টে বলা হয়েছে যে বিশ্বের যে কোনো স্থানের চেয়ে গাজায় অনাহারের সংকট এখন সবচেয়ে তীব্র। ৭ অক্টোবর ২০২৩’র আগে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে তীব্র অপুষ্টির হার ছিল ০.৮ শতাংশ, সেটাই বেড়ে ফেব্রুয়ারি ২০২৪-তে দাঁড়িয়েছে ১২.৪ থেকে ১৬.৫ শতাংশ। ঐ রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, গাজায় খাদ্য, জল এবং অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যের সরবরাহকে অবিলম্বে বাড়িয়ে তুলতে হবে। অপুষ্টি এবং ব্যাধি, উভয়ের মিলিত প্রভাব শিশুদের মৃত্যুমুখে ঠেলে দিচ্ছে। গত পাঁচ মাসে পরিস্থিতি ক্রমাগতই খারাপ হতে থেকেছে। গাজায় ফেব্রুয়ারিতে অনাহারগ্ৰস্ত মানুষের হার যেখানে ছিল ৩০ শতাংশ, মার্চ মাসের মাঝামাঝি সেটা বেড়ে দাঁড়ায় ৫০ শতাংশে। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, উত্তর গাজায় ২৭ জন, যাদের অধিকাংশই শিশু, অপুষ্টি এবং দেহে জলের ঘাটতির জন্য মারা গেছে। উত্তর গাজায় যেখানে এখনও ৩,০০,০০০ মানুষ থাকছেন, ইজরায়েল সীমানা বন্ধ করে দেওয়ায় (একটা মাত্র চেকপয়েন্ট খোলা রেখেছে) সেখানে সরবরাহ ছিন্ন হয়ে গেছে। গাজায় এখন যে সাহায্য পৌঁছচ্ছে তা ঢুকছে দক্ষিণের দুটো চেকপয়েন্ট দিয়ে।

দুর্ভিক্ষ নির্ধারণে বিশেষজ্ঞরা সাধারণত তিনটে মানদণ্ডকে বিবেচনায় রাখেন — খাদ্যের লভ্যতার প্রচণ্ড অভাব, তীব্র অপুষ্টির উচ্চ মাত্রা ও শিশু মৃত্যু। উত্তর গাজায় খাদ্যের অভাব চরম মাত্রায় পৌঁছেছে, অপুষ্টির মাত্রা এবং শিশু মৃত্যুও বেড়ে চলেছে। আর এ’জন্যই রাষ্ট্রপুঞ্জ এবং বিশ্বের কয়েকটি শক্তিশালী রাষ্ট্র অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি এবং গাজার জনগণের কাছে আরও বেশি পরিমাণে খাদ্যদ্রব্য সরবরাহের আহ্বান জানিয়েছেন।

গাজার বিপর্যয়ের কিনারায় পৌঁছানোর পিছনে কারণ কী?

৭ অক্টোবরের আগে গাজায় প্রতিদিন ৬০০ ট্রাক ঢুকত যার মধ্যে ১৫০টা ট্রাক হতো খাদ্যদ্রব্যের। এর পর থেকে যুদ্ধের পরিণামে গাজার অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে গেছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের খাদ্য ও কৃষি সংগঠন জানিয়েছে, গাজা ভূখণ্ডের খাদ্য উৎপাদন ভূমি উত্তর গাজার অর্ধেক কৃষিজমি যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইজরায়েলের নিরবচ্ছিন্ন বোমাবর্ষণ গাজার বন্দরটাকেও ধ্বংস করেছে, যার ফলে মাছ ধরে জীবিকা অর্জনের ক্ষেত্রটিও ধ্বংস হয়ে গেছে, যেটি ছিল গাজাবাসীর আয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে এবং নির্মাণ ও অন্যান্য কাজকর্ম সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে রয়েছে। এর ফলে প্রায় সমগ্র জনগণই সাহায্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন এবং সরবরাহের প্রয়োজনও বেড়ে গেছে বহুগুণ। রাষ্ট্রপুঞ্জর দেওয়া হিসাব অনুযায়ী অক্টোবরে গাজায় প্রতিদিন যেখানে ৬০০ ট্রাক ঢুকত, সেই সংখ্যাটা আজ নেমে এসেছে ২০০-তে। এই কারণেই সংকট তীব্রতর পর্যায়ে পৌঁছেছে, গাজার অর্থনীতি ধ্বংস হওয়ায় যে সংকটের উন্মোচন আগেই শুরু হয়েছিল। ফেব্রুয়ারির শেষে ইজরায়েলি সেনারা সাহায্য দ্রব্য নিয়ে পৌঁছানো এক কনভয়ের কাছে জড়ো হওয়া জনগণের ওপর গুলি চালায়, সঙ্গে সঙ্গেই জড়ো হওয়া লোকজন পড়ি কি মরি করে দৌড়তে থাকেন এবং ঐ সামরিক হানাদারিতে মারা যায় ১০০ প্যালেস্তিনীয়। সংকট প্রশমনের সহায়তায় আমেরিকা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আরব দুনিয়ার কিছু দেশ গাজায় বিমান/হেলিকপ্টার থেকে খাদ্যদ্রব্য ফেলাকে বাড়িয়ে দেয়। এমন একটা ঘটনা ঘটে যে খাদ্যদ্রব্য বহন করা আধারের প্যারাশুট না খোলায় সেটি খাবারের জন্য অপেক্ষারত জনগণের ওপর এসে পড়ে এবং তাতে অন্তত পাঁচজন মানুষ মারা যান। ইজরায়েল গাজায় আরও সাহায্য ঢুকতে না দেওয়ায় সংকটের তীব্রতা বেড়ে চলে, আর তাই সেবা সংস্থা ওয়ার্ল্ড সেন্ট্রাল কিচেন সমুদ্র পথে সহায়তা পাঠায়। আমেরিকা সাহায্য পাঠানোর জন্য গাজার উপকূলে একটা পাটাতন বা জেটি নির্মাণের পরিকল্পনা করছে, কিন্তু ঐ পরিকল্পনার রূপায়ণে কয়েক মাস লেগে যাবে। রাষ্ট্রপুঞ্জ গত সপ্তাহে বলেছে যে, গাজায় আরো সাহায্য ঢুকতে না দেওয়াটা অনাহারকে ‘যুদ্ধের অস্ত্র হিসাবে’ ব্যবহার করারই শামিল। রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার প্রধান ভল্কার টার্ক বলেছেন, “বুভুক্ষা, অনাহার ও দুর্ভিক্ষের এই পরিস্থিতি মানবতাবাদী সাহায্য ও বাণিজ্যিক দ্রব্য ঢুকতে দেওয়াকে ইজরায়েলের ব্যাপকভাবে আটকানোরই পরিণাম।”

আশু সমাধানের কোনো সম্ভাবনা কী রয়েছে?

রাষ্ট্রপুঞ্জের বিভিন্ন সংস্থাই সুস্পষ্টভাবে জানিয়েছে যে, পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতির জন্য যুদ্ধের অবসান একান্তই জরুরি। গাজা তার মানবতাবাদী সংকটের সবচেয়ে যন্ত্রণাদগ্ধ পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে চলেছে। গাজার অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে গেছে; জনগণকে বিধ্বস্ত করা হয়েছে; সাহায্যের সরবরাহ যথেষ্ট পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে; এমনকি যেটুকু সাহায্য সেখানে পৌঁছচ্ছে, চলমান যুদ্ধের কারণে সৃষ্টি হওয়া ব্যাঘাতের জন্য সেটুকুও ঠিকমতো বিতরণ করা যাচ্ছে না। রাষ্ট্রপুঞ্জেরও ১০০ জনের বেশি কর্মী নিহত হয়েছেন, ফলে তার কর্মীসংখ্যা অপ্রতুল এবং রাষ্ট্রপুঞ্জের কর্মীদেরও অনাহারে থাকতে হচ্ছে।

পশ্চিমে ইজরায়েলের যে মিত্ররা রয়েছে তারাও পরিস্থিতির বিপন্নতাকে স্বীকার করেছে। আমেরিকার বিদেশ সচিব অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন গত সপ্তাহে বলেছেন, “গাজার সমগ্র জনগণই চরম মাত্রার খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ভোগ করছেন।” কিন্তু তাদের সংকটের সমাধানের জন্য অবরোধ তুলতে ইজরায়েলকে বাধ্য না করে সরবরাহ বাড়িয়ে তোলার বিকল্প পথ বার করতে হবে; তবে এই বিকল্প সংকট প্রশমিত করতে পারবে বলে মনে হয় না। গাজার প্রয়োজন অবিলম্বে যুদ্ধ বিরতির। কিন্তু পাঁচ মাস যুদ্ধ চালানোর পরও ইজরায়েল তাদের ঘোষিত লক্ষ্য অর্জনে সফল হয়েছে বলে মনে হয় না, যথা, যুদ্ধ বন্দিদের মুক্ত করা বা হামাসকে ধ্বংস করা। কাতার, মিশর ও আমেরিকার মধ্যস্থতায় আপস আলোচনা চলছে, কিন্তু হামাস ও ইজরায়েল কোনো সমঝোতায় পৌঁছতে পারেনি। ইজরায়েল যুদ্ধবন্দিদের মুক্তির বিনিময়ে যুদ্ধে সাময়িক বিরতিতে আগ্ৰহী বলে মনে হচ্ছে, কিন্তু হামাস চাইছে স্থায়ী যুদ্ধবিরতি এবং তারা ইজরায়েলের জেলে বন্দি কয়েকজন বড় মাপের প্যালেস্তিনীয়র মুক্তির দাবিও জানিয়েছে, যার মধ্যে দু’দশকেরও বেশি ইজরায়েলের জেলে বন্দি ফাতাহ নেতা মারওয়ান বারঘৌটিও রয়েছেন। দুই পক্ষ স্বীকৃত কোনো ভিত্তিতে পৌঁছতে না পারায় যে ইজরায়েল আমেরিকার কাছ থেকে অস্ত্র সাহায্য পেতে থাকছে, তারা আপাতত যুদ্ধটাকেও চালিয়ে যাচ্ছে।

- জয়দীপ মিত্র

cpiml candidates 2024

===0===

খণ্ড-31
সংখ্যা-12