সর্বোচ্চ আদালতে কোভিড সংক্রান্ত রাষ্ট্রদ্রোহের একটি মামলা খারিজ হয়ে গেল। অভিযুক্ত করা হয়েছিল কয়েক দশকের বহুল পরিচিত প্রবীণ সাংবাদিক বিনোদ দুয়াকে। তার এফ আই আর দায়ের করেছিলেন হিমাচল প্রদেশের এক বিজেপি নেতা। তাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সুপ্রীম কোর্টে গিয়েছিলেন দুয়া। অভিযোগ নস্যাৎ করা প্রসঙ্গে ডিভিশন বেঞ্চের দুই বিচারপতি একসুরে বলেছেন, সরকারের সমালোচনা বা বিরোধিতা মানেই রাষ্ট্রদ্রোহ নয়। ভারতের সংবিধানে ১৯(১)(ক) ও ২১ ধারায় নাগরিকের স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার এবং মানবাধিকার রক্ষার সংস্থান আছে। সুতরাং সংবাদ মাধ্যম সংস্থা থেকে সংবাদ কর্মী – প্রত্যেকের আইনানুগ অধিকার রয়েছে যে কোনো মতামত প্রকাশের। ঠিক-বেঠিক ভালো-মন্দ যার যা মনে হোক, সরকার-পুলিশ-প্রশাসন-সেনাবাহিনী বা বিচারব্যবস্থার বিরুদ্ধে মতপ্রকাশ হলেও, তাকে কোনোভাবেই রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে অভিযুক্ত করা যায় না। শ্রীযুক্ত দুয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি কোভিড মোকাবিলার প্রশ্নে মোদী সরকারের শোচনীয় ব্যর্থতা-অপদার্থতা-স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন।
কোভিড প্রশ্নে আজ দেড়বছরে দেশ কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে? সংক্রমণের প্রথম ঢেউয়ে উন্মোচিত হয়েছে মোদী সরকার ও বিজেপির নানা চতুরামি। লক ডাউন, পরিযায়ী শ্রমিকদের অবর্ণনীয় দুর্দশা, নগদ অর্থ না মেলা, অনাহার-অর্ধাহার-মৃত্যুর ক্ষয়ক্ষতির পরেও ভাব দেখানো হয়েছিল করোনাকে নিয়ন্ত্রণ করা গেছে, শেষ বিদায় জানানো বাকি। তারপর পাঁচ রাজ্যের আসন্ন নির্বাচনে ঝাঁপানোর উদ্দেশ্যে স্বাস্থ্যবিধিকে শিথিল করা হল। আর তারপরের মর্মান্তিক পরিণতি হল সংক্রমণের প্রবল দ্বিতীয় ঢেউয়ে আক্রান্ত হল লক্ষ লক্ষ মানুষ, শহর-শিল্পাঞ্চল থেকে গ্রাম-গ্রামান্তর, পার্বত্য অঞ্চল-নদীতট, কোথাও সংক্রমণের থেকে নিস্তার পাওয়ার নিশ্চয়তা রইল না! ভেঙ্গে পড়ল সরকারী-বেসরকারী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা! সরকারী হাসপাতালকে সর্বস্তরে সম্প্রসারিত না করে তিন দশক যাবত মোহ ছড়ানো হয়েছিল বেসরকারী হাসপাতাল ব্যবস্থার। কোভিডের ধাক্কায় আজ তার কল্পনাতীত নিষ্ঠুরতা ভোগ করছে মানুষ। “হেলথ্ ওয়ার্কার”- “ফ্রন্টলাইনার”রা উজাড় করে দিচ্ছেন নিজেদের। কিন্তু চারিদিকে শুধু হাহাকার। টেস্ট, ওষুধ, সেফ হোম, এ্যাম্বুলেন্স, বেড, ডাক্তার, নার্স, অন্যান্য স্বাস্থ্য সহায়িকা, এ্যাডমিশন, অক্সিজেন, ভেন্টিলেশন, ভ্যাকসিন – সবকিছুরই ব্যাপক অভাব, তীব্র সংকট। সরকারী হাসপাতালে ভর্তি হলে ফতুর হতে হচ্ছে না। কিন্তু স্থান সংকুলানের সমস্যা থাকছে প্রবল। বেসরকারী হাসপাতাল, নামীদামী ‘স্পেশ্যালিটিগুলো’ নাজেহাল ও সর্বস্বান্ত করে ছাড়ছে। কোভিড চিকিৎসার ওষুধ মিলছে না খোলা দোকানে, তার চোরাকারবার চলছে আট-দশ গুণ বেশি দামে অন লাইনে, নানা ডেরায়। এবার মোদী সরকার শুরু করল ইতরামি। সবকিছু ঘটছে কেন্দ্রের নাকের ডগায়। অথচ আটকাতে কোনো ভিজিল্যান্স নেই, কোনো সিবিআই-ইডির নাম নেই। বাংলার দখল পেতে মরীয়া হয়ে গোটা নির্বাচনী প্রচারে বিজেপি ‘আয়ুষ্মান ভারত’ থেকে শুরু করে ‘আত্মনির্ভর ভারত’ নির্মাণের নামে চালায় সস্তা প্রচার, মিথ্যাচার। ভ্যাকসিনের প্রশ্নে মানুষকে রাখা হচ্ছে অনিশ্চয়তায় অন্ধকারে। দেশের মধ্যে টিকার উৎপাদন বৃদ্ধি, বিদেশ থেকে আমদানি, সংরক্ষণের ব্যবস্থা, বিনা মূল্যে দেওয়া, সব বয়সীদের সর্বজনীনভাবে দেওয়া, ডোজের মূল্য নির্ধারণ – সমস্ত বিষয়ে চলেছে চূড়ান্ত অমানবিকতা, শঠতা, নির্মমতা, বৈষম্য, প্রতারণা। ব্যবহার করা হচ্ছে এমন এক ‘অতিমারী আইন’ যা পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণের নামে সাধারণ মানুষের ওপর দমন চালানোর অস্ত্র হিসেবেই প্রমাণিত সত্য। এই সবকিছু যখন উন্মোচন, প্রতিবাদ, বিরোধিতার সম্মুখীন হতে শুরু করল, তখন বিজেপি-মোদী সরকার যোগসাজশ করে ভয় দেখাতে চুপ করাতে রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে ফাঁসাতে লাগল। তার শিকার সবচেয়ে বেশি হয়েছেন সংবাদ কর্মীরা, যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়েও মানুষের চোখ-কান খুলে দেন। এই কারণেই ফাঁসানো হয়েছিল সাংবাদিক বিনোদ দুয়াকে। কেবলমাত্র তাঁকে যে অন্যায়ভাবে অভিযুক্ত করা হয়েছিল তা নয়। এহেন অপচেষ্টা চালিয়ে আসা হচ্ছে আরও বহু ক্ষেত্রে। রাষ্ট্রদ্রোহ আইন প্রয়োগ করা হয়েছে ছাত্র আন্দোলন, মানবাধিকার আন্দোলন, পরিবেশ আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন, এনআরসি- সিএএ বিরোধী আন্দোলন-সংগঠন-কর্মীদের বিরুদ্ধে। বিভিন্ন তকমা লাগিয়ে দিয়ে, অজুহাত দেখিয়ে। কোভিড প্রশ্নেও প্রয়োগ হচ্ছে ঐ জনবিরোধী আইন।
গত ফেব্রুয়ারীতে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় তুলে ভাইরাল হওয়ার কারণে কর্ণাটক থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল সমাজকর্মী দিশা রবিকে, তবে তার সুপ্রীম কোর্ট থেকে জামিন পাওয়া আটকাতে পারেনি সরকার। মার্চ মাসে রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে অভিযোগের হাত থেকে রেহাই পান ফারুখ আবদুল্লা। মে মাসের শেষে সুপ্রীম কোর্ট ভর্ৎসনা করে অন্ধ্র পুলিশকে দুটি টিভি চ্যানেলকে রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে অভিযুক্ত করার দায়ে। এরকম মামলা গড়িয়েছে প্রচুর। এটা ঘটনা ও প্রবণতা যে, ভারতের শাসকশ্রেণীর দলগুলোর এই আইনে ঐকমত্য থাকছে। তারা অবস্থা বুঝে ভিন্ন ভিন্ন কৌশল নেয়, গরজ থাকলে কিছুটা সরব সক্রিয় হয়, নয়তো নীরব নিষ্ক্রিয় থাকে। তবে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস্ ব্যুরোর তথ্য বলছে, কেন্দ্রে মহামহিম মোদীরাজের আমল শুরু হওয়া থেকেই রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে দমন অনেক বেড়েছে। এই আইনে ২০১৪ সালে কেস ছিল ৪৭টি, চার্জশীট পেশ হতে পেরেছিল ১৬টি, আর সাজা ঘোষণা হয়েছিল মাত্র ১টি ক্ষেত্রে। তারপর থেকে প্রত্যেক বছরে লাফ দিয়ে দিয়ে বাড়ানো হয়েছে অভিযুক্তের, গ্রেপ্তার করার ও মামলার সংখ্যা, কিন্তু সাজা দেওয়া সম্ভব হয়েছে মাত্র দু’চারজন করে। ২০১৬-১৯ পাঁচ বছরে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলার বৃদ্ধি ঘটানো হয়েছিল ১৬০ শতাংশ, আর দোষী সাব্যস্ত করা গেছিল মাত্র ৩ শতাংশ। এই পরিসংখ্যান বুঝিয়ে দেয়, রাষ্ট্রদ্রোহ আইন প্রয়োগের পলিসি-প্রবণতার ভিত্তিটাই ভূয়ো। এই আইন গণতন্ত্র বিরোধী। যে জনবিরোধী আইন ব্রিটিশ আমলে ১৮৭০ সালে তৈরি করা হয়েছিল ঔপনিবেশিক শাসনের স্বার্থে, সেই আইন দূর্ভাগ্যবশত আজও স্বাধীন ভারতের সংবিধানে রেখে দেওয়া হয়েছে, যা আদৌ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সঙ্গতপূর্ণ নয়, কিছুতেই থাকতে পারে না। ইতিমধ্যে যেখানে অনেক আগেই ব্রিটেনে এহেন আইনের অবলুপ্তি ঘটানো হয়েছে, আরও বহু দেশেই বিলোপ করা হয়েছে, সেখানে সিডিশন আইন উপনিবেশমুক্ত স্বাধীন গণতান্ত্রিক ভারতে থাকবে কেন? প্রশ্ন উঠছে অবিরত আদালতের ভেতরে-বাইরে। আইনটি প্রত্যাহারের দাবির চাপের মুখে ২০১৮ সালে একবার আইন কমিশন বসেছিল পর্যালোচনায়। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। এই অবস্থা দাবি জানায়, দেশবাসীকে গণতান্ত্রিক অধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতার স্বার্থে সচেতন ও সংগঠিত হতে হবে; নামতে হবে আন্দোলনের রাস্তায়। দাবি তুলতে হবে একজোড়া – রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে দায়ের করা সমস্ত মামলা প্রত্যাহার কর! রাষ্ট্রদ্রোহ আইন বাতিল কর!
ভারতে টিকার ঘাটতি যে চরম মাত্রায় পৌঁছেছে তা গোপন কোনো ব্যাপার নয়, সকলেই সে সম্পর্কে অবহিত। মোদী সরকার ১৮ থেকে ৪৪ বছর বয়সীদের টিকাকরণের আওতায় নিয়ে আসায় অনেক বিশেষজ্ঞই এব্যাপারে সহমত পোষণ করছেন যে, ভারতের টিকা তৈরির সামর্থ্য এবং আনুষঙ্গিক প্রতিকূলতা যেমন রয়েছে, তাতে খুব বেশি হলেও ভারত ২০২২’র মাঝামাঝি সময়ের আগে তার সব প্রাপ্ত বয়স্কদের টিকাকরণ সম্পূর্ণ করে উঠতে পারবে না। টিকাকরণে এই বিলম্ব ভারতের কাছে সর্বনাশা হয়েই দেখা দিতে পারে, কেননা, দুনিয়ায় এবং তারসাথে ভারতেও যে কোভিড১৯-এর পরবর্তী পর্যায়ের তরঙ্গগুলো দেখা দেবে তা একরকম অবধারিত। অন্ততপক্ষে সমস্ত প্রাপ্ত বয়স্কদের টিকাকরণে এই বিলম্বের দায় সরাসরি বর্তাচ্ছে মোদী সরকারের ওপর। বিমুদ্রাকরণের মতো মোদী-সৃষ্ট অধিকাংশ বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে যা দেখা গেছে, টিকাকরণ কর্মসূচীর ক্ষেত্রেও সেটাই দেখা যাচ্ছে। টিকা নিয়ে বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে একাকার হয়ে আছে হামবড়া ভাব, ধৃষ্টতা ও প্রশাসনিক অপাদর্থতা।
বিহার বিধানসভা নির্বাচনকে নজরে রেখে মোদী ২০২০ সালের আগস্ট মাসে ঘোষণা করেছিলেন যে, ভাইরাসের বিরুদ্ধে ভারতীয় টিকা ২০২০’র ১৫ আগস্টের মধ্যে তৈরি হয়ে যাবে। এটা একটা মিথ্যা বলেই প্রতিপন্ন হল এবং এটার মধ্যে দিয়ে এই সংকেতই সর্বপ্রথম মিলল যে, টিকাকরণের মতো গুরুত্বপূর্ণ সর্বজনীন স্বাস্থ্য উদ্যমের চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করাতেই মোদী সরকারের যাবতীয় সুখ। ভাইরাস প্রতিরোধী টিকা ২০২১’র জানুয়ারীতেই মিলবে, এই কথাটা সর্বজনবিদিত ব্যাপার হলেও মোদী সরকার টিকার জন্য প্রথম দফার বরাতটা দিল ২০২১’র ১৭ জানুয়ারী ভারতের টিকাকরণ কর্মসূচী শুরু হওয়ার মাত্র এক সপ্তাহ আগে। ততদিনে বাংলাদেশের মতো দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশিরা সহ বিশ্বের অনেক দেশই টিকার জন্য বরাত দিয়ে রেখেছে। অপর দিকে, মোদী সরকার কিন্তু দেশের রাষ্ট্রায়ত্তক্ষেত্রের টিকা প্রস্তুকারক সংস্থাগুলোকে পুনরিজ্জীবিত করে টিকা তৈরিতে সক্ষম করে তুলল না। ফলে, আমরা এক পূর্ণাঙ্গ সংকটে নিমজ্জিত হয়েছি, যেখানে কোভিড১৯-এর দ্বিতীয় ঢেউ ভারতকে বিধ্বস্ত করেছে এবং টিকার তীব্র আকালের মধ্যে আমরা পড়ে গেছি।
অর্থমন্ত্রী বাজেটে শুধুমাত্র টিকাকরণের জন্যই ৩৫,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিলেন। সমস্ত প্রাপ্ত বয়স্কদের দু’ডোজ করে টিকা দিয়ে টিকাকারণ সম্পূর্ণ করার পক্ষে এই পরিমাণ টাকা প্রয়োজন মিটিয়েও বাড়তি হবে, কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হল, ১৮ থেকে ৪৪ বছর বয়সীদের টিকাকরণের আর্থিক দায় মোদী সরকার চাপিয়ে দিয়েছে রাজ্য সরকারগুলোর ঘাড়ে। ভারতই হল একমাত্র দেশ যেখানে কোভিড-১৯ টিকাকরণ কর্মসূচীর আর্থিক ভারকেন্দ্র সম্পূর্ণত বহন করছে না। নতুন টিকানীতি বেসরকারী হাসপাতাল, ইত্যাদিদের টিকা প্রস্তুতকারকদের কাছ থেকে সরাসরি টিকা কেনার অনুমতিও দিয়েছে। এরফলে, দেশে টিকদানের ক্ষেত্রে আমরা এক বড় আকারের বিভাজন উদ্ভূত হতে দেখছি, যেখানে বেসরকারী হাসপাতাল এবং আবাসিক কল্যাণ সমিতিগুলো সরাসরি টিকা কিনে ডোজ প্রতি একেবারে ১,৫০০ টাকা পর্যন্ত নিয়ে টিকা প্রদান করছে, আর সরকার চালিত টিকাদান কেন্দ্রগুলোতে টিকা অমিল হচ্ছে।
মোদী সরকার কিন্তু উদ্ভূত এই বিভাজনের দিকে চোখ বুজে থাকছে এবং এই তালগোল পাকানো অবস্থার দায়কে পাশ কাটানোর যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। সে টিকার ঘাটতির মোকাবিলায় উদ্ভট এবং বিপজ্জনক উপায় হাজির করছে। হরিয়ানার বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী মনোহর লাল খট্টর বলেন, দিল্লীতে অল্প সময়ে টিকা নিঃশেষ হয়েছে, কারণ, সেখানে “অতি দ্রুত হারে টিকা দেওয়া হয়েছে!” সরকার এমনকি কোভিশিল্ড টিকার দ্বিতীয় ডোজ তুলে দেওয়ার কথাও বিবেচনা করছে, যাতে টিকাকরণের লক্ষ্যমাত্রা দ্রুত সম্পন্ন করা যায়। এই পদক্ষেপের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই এবং তা মানুষের জীবনকে বিপন্ন করে তুলবে – সরকারের কিন্তু কোনো হেলদোল নেই। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকর দাবি করেছেন যে, ২০২১’র ডিসেম্বরের মধ্যেই সরকার ভারতের সমস্ত জনগণের টিকাকরণের কাজ সম্পূর্ণ করবে, কিন্তু এরজন্য যে ২০০ কোটি ডোজ টিকার প্রয়োজন সেটা কোথা থেকে পাওয়া যাবে সে কথা তিনি প্রকাশ করছেন না। বিদেশমন্ত্রী সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়েছিলেন টিকা জোগাড়ের উদ্দেশ্যে, কিন্তু তাঁকে খালি হাতে ফিরতে হয়েছে, কেননা, বিশ্বের টিকা প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলো অন্যান্য দেশকে টিকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছে।
সরকারের কাছে কোনো প্রশ্ন করলেই বিরোধীপক্ষকে দোষী সাব্যস্ত করে সেই প্রশ্নকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং এমন সমস্ত বিবৃতি দেওয়া হচ্ছে, যাতে বাস্তব ঘটনার তেমন পরোয়া করা হচ্ছে না। তার টিকা-নীতির সমর্থনে মোদী সরকার যা কিছু বলেছে তাতে বুনিয়াদি এই প্রশ্নটার কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি, আমাদের প্রতিবেশিরা সহ অন্যান্য দেশের মতো মোদী সরকার গত বছরেই টিকার বরাত দেয়নি কেন এবং টিকা প্রস্তুতকারক দেশীয় সংস্থাগুলোকে টিকা তৈরির উপযোগী করে তোলেনি কেন? সরকার যখন টিকা সম্পর্কে অবিশ্বাস তৈরির জন্য বিরোধীপক্ষকে দোষারোপ করছে, তখন তারা কিন্তু হাতুড়ে রামদেবের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না, যিনি টিকা না নেওয়ার জন্য প্রকাশ্যেই জনগণের কাছে আবেদন জানিয়েছেন!
মোদী সরকার যে টিকা-নীতি নিয়ে চলছে তাকে অবিলম্বে শোধরাতে হবে। বর্তমান নীতিকে যেমন পাল্টাতে হবে, সেরকমই টিকাও সংগ্ৰহ করতে হবে কেন্দ্রীয়ভাবেই। অনেক বেসরকারী কোম্পানিই সরাসরি রাজ্যগুলোকে টিকা বিক্রি করতে অসম্মত হয়েছে, কাজেই, সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করে কেন্দ্রকেই টিকা কিনতে হবে। বাস্তবসম্মত নীতির ভিত্তিতেই রাজ্যগুলোকে টিকা বরাদ্দ করতে হবে এবং রাজ্যগুলো যাতে সমাজের অসহায় ও শ্রমজীবী দরিদ্র অংশগুলোকে চিহ্নিত করে অগ্ৰাধিকারের ভিত্তিতে তাদের টিকাকরণ করতে পারে সেই নমনীয়তা গ্ৰহণের অধিকার তাদের দিতে হবে। ভারত বিনাখরচে সকলের টিকাকরণের সফল যে নীতি বরাবর অনুসরণ করে এসেছে, সরকারকে সেই নীতিতে ফিরে যেতে হবে এবং ডিজিটাল প্রযুক্তির সুবিধা নিতে না পারা এবং আধার না থাকা যেন টিকা নেওয়ার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। এবং রামদেব ও অন্যান্য হাতুড়েরা যে সমস্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন বিবৃতি দিয়েছেন, সেগুলোকে ধিক্কার জানিয়ে সরকারকে প্রকাশ্য বিবৃতি দিতে হবে।
মোদী সরকারের নিকৃষ্ট পরিকল্পনা এবং ঔদ্ধত্যের জন্য দেশের নাগরিকদের অকল্পনীয় দুর্দশা ভোগ করতে হয়েছে। তৃতীয় তরঙ্গের জন্য তারা প্রস্তুত হয়ে আছে, সরকারের পক্ষে দর্প-তাড়িত এমন বিবৃতি বন্ধ করার এটাই প্রকৃষ্ট সময়; মোদীর ভাবমূর্তির সুরক্ষায় ব্যস্ত না থেকে টিকাকরণ ক্ষেত্রে কাজকে তাদের অবিলম্বে গুছিয়ে নিতে হবে।
(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ১ জুন ২০২১)
৫ জুন সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা ও এআইকেএসসিসির আহ্বানে সারা দেশে পালিত হলো ‘সম্পূর্ণ ক্রান্তি দিবস’। ১৯৭৪ সালের এদিনেই ইন্দিরা গান্ধীর জমানার ভ্রষ্টাচারের বিরুদ্ধে, গণতন্ত্রের দাবিতে বিহারের বুকে সংগঠিত হয়েছিল এক গণবিস্ফোরণ, ছাত্র-যুবদের তুমুল বিদ্রোহ। যা গোটা দেশকে আলোড়িত করে তুলেছিলো। পরবর্তীকালে আসে জরুরি অবস্থার কালো দিনগুলি। মানুষের প্রতিবাদ প্রতিরোধে ইন্দিরা জমানার পতন হয়। সেই ঐতিহ্যকে পাথেয় করে আজ দেশব্যাপী অভূতপূর্ব কৃষক জাগরণকে এগিয়ে নিয়ে যেতে, মোদী হঠাও আন্দোলনকে তীব্রতর করে তোলার লক্ষ্যে এই আহ্বান জানানো হয়।
৬ জুন, এই দিনটি হলো কৃষক আন্দোলনের এক সন্ধিক্ষণ। পড়ে পড়ে মার খাওয়া অন্নদাতারা সেদিন ঘুরে দাঁড়িয়েছিলো। আজ থেকে চার বছর আগে মধ্যপ্রদেশের মন্দসৌর, যেখানে মুখোমুখী এসে দাঁড়িয়েছিলো দুটো দল। একদিকে উৎপাদিত শস্যের দাম না পাওয়া ঋণগ্রস্ত কৃষক, অপরদিকে কর্পোরেটের পা চাটা দালাল ফ্যাসিবাদী বিজেপি সরকার। কৃষকরা ছুঁড়ে দিয়েছিলো চ্যালেঞ্জ। লক্ষ লক্ষ কৃষকের আত্মহত্যার কালো মেঘ সরিয়ে ঝলকে উঠেছিল সোনালী আলোর রেখা। ছড়িয়ে দিয়েছিল কৃষক প্রতিরোধের বার্তা। শাসকেরা ভয় পেয়েছিল। নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ওরা হত্যা করলো ছয় জন কৃষককে, গুরুতর আহত কয়েক হাজার। যার মধ্যে ছিলো একেবারে সামনের সারিতে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একসারি নওজোয়ান কৃষক। কিন্তু শহীদের রক্ত ব্যর্থ হয়নি। হত্যাকাণ্ডের একমাসের মধ্যে রাজধানী দিল্লীতে সমাবেশিত হয়ে আড়াইশোর বেশি কৃষক সংগঠন গড়ে তুলেছে সর্বভারতীয় কৃষক সমন্বয় সমিতি। তারপর থেকেই শুরু হয়েছে কৃষক জাগরণের নতুন এক অধ্যায়। পার্লামেন্ট ঘেরাও, প্রকাশ্যে দিল্লীর বুকে কিষাণ পার্লামেন্ট, প্রভৃতি চলমান সংগ্রামের নানান কার্যক্রম। ফসলের দেড়গুণ দাম, ঋণমুক্তির দাবি সহ কৃষকের নানাবিধ বাঁচার দাবিগুলি আজ দেশের সর্বস্তরে মান্যতা লাভ করেছে, রাজনীতির একেবারে কেন্দ্রে এসে হাজির হয়েছে। বিজেপি সরকার কৃষককে গোলাম বানাবার চক্রান্ত করছে। সংসদীয় ব্যবস্থা, সংবিধানকে নাকচ করে মাত্র ছয় ঘণ্টায় তিনটি কৃষি আইন পাস করে দিয়েছে। কিন্তু না, ১৮২ দিন হয়ে গেলো, লক্ষ লক্ষ কৃষক আজ দিল্লীর উপকণ্ঠে। নয়া কৃষি আইন, বিদ্যুৎ বিল বাতিল, ন্যূনতম সহায়ক মূল্য গ্যারান্টি আইন প্রণয়নের দাবিতে, আন্দোলনের ময়দানে। সম্প্রতি বাংলা-বিহারের গণরায় মোদীর ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জবাব দিয়ে দিয়েছে, এ রায় নিশ্চিতভাবে কালা কৃষি আইনের বিরুদ্ধে। তাই অন্নদাতাদের পাশে দাঁড়িয়ে মন্দসৌর ও দিল্লীর কিষাণ আন্দোলনের রণভূমিতে প্রয়াত পাঁচ শতাধিক শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ৬ জুন রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে উদযাপিত হলো শহীদ স্মরণ ও সংকল্প দিবস। ৫ জুন সম্পূর্ণ ক্রান্তি দিবসে আয়োজিত হলো নানাবিধ কর্মসূচী।
উত্তর ২৪ পরগণা
৬ জুন ২০২১ বেলঘরিয়া। ঝড় বৃষ্টি হয়েছে, রাস্তার আলো নিভে গেছে। আমাদের মনটা খারাপ হয়ে গেল শেষ পর্যন্ত ঘরে বসে দীপ জ্বালাতে হবে। বৃষ্টি কমার পর ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে ‘স্বজনের স্মৃতি’তে শ্রদ্ধা লেখা ব্যানার নিয়ে রাস্তার ধারে টেবিল নিয়ে বসা হল। নিজেরাই মোমবাতি জ্বালিয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছিলাম। এরমধ্যেই গুটিগুটি পায়ে এসে প্রায় সব বয়সের, সব শ্রেণি, সব স্তর, সব ধর্মের, সব ভাষার এবং সব দলের রাজনৈতিক কর্মীরা মোমবাতি জ্বালিয়ে নিজেদের আপনজনকে শ্রদ্ধা নিবেদন করে গেলেন। অনেকেই জল কাদার মধ্যেই জুতো, চটি খুলে স্মরণ করলেন প্রিয় জনদের। মানুষ গণমৃত্যু ও গণচিতা দেখছেন, তাদের শোক ও ক্রোধ প্রকাশ করার একটা পরিসর তাঁরা এই দিন হাতের কাছে পেয়েছিলেন।
৫ জুন ২০২১ তারিখ, শনিবার সকাল সাতটায় হালিসহর সরকার বাজার অঞ্চলে বীজপুর আঞ্চলিক কমিটির ডাকে বিভিন্ন দাবি ধরে শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত করে ‘সম্পূর্ণ ক্রান্তি দিবস’ পালন করা হয়। উল্লেখ্য ১৯৭৪ সালে ৫ জুন পাটনায় এক বৃহৎ জনসমাবেশে প্রয়াত লোকনায়ক জয়প্রকাশ নারায়ণ সমস্ত ভারতবাসীর কাছে ‘সম্পূর্ণ ক্রান্তি আন্দোলন’এর ডাক দিয়েছিলেন। সেই দিনটিকে স্মরণ করে উত্তম দাস ও রবী সেন সংযুক্ত কৃষাণ মোর্চ্চার দীর্ঘদিনব্যাপী কৃষক আন্দোলনের বিষয় ও অন্যান্য দাবির যৌক্তিকতার বিষয়ে বক্তব্য পেশ করেন। এই দুঃসময়ে বাজার অঞ্চলের সাধারণ মানুষ আজকের এই সম্পূর্ণ ক্রান্তি দিবস পালনে আলোড়িত হয় এবং যথাযোগ্য মর্যাদায় আজকের কর্মসূচী শেষ হয়।
৫ জুন সকাল ৮ টায় ‘সম্পূর্ণ ক্রান্তি দিবস’ পালিত হলো বন্ধ নৈহাটি জুট মিল গেটে এআইসিসিটিইউ ও সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের যৌথ উদ্যোগে। শ্রমিক মহল্লাতেও শ্লোগান দিয়ে স্কোয়াড মিছিল করা হয়। জনবিরোধী কৃষিআইন ও শ্রমকোড বাতিলের দাবি তুলে ধরার পাশাপাশি নৈহাটি জুট মিল খোলা ও শ্রমিক পরিবারের জন্য বিনামূল্যে ভ্যাক্সিনের দাবিও তুলে ধরা হয়।
মধ্যমগ্রামে সম্পূর্ণ ক্রান্তি দিবসের কর্মসূচী ব্যানার-পোস্টার-শ্লোগান সহ পালিত হয়। এআইকেএসসিসি’র ডাকে বারাসাত কোর্ট চত্তরে ‘সম্পূর্ণ ক্রান্তি দিবস’ পালন করা হয়। কালা কৃষি বিল প্রত্যাহার, এমএসপি লাগু করা এবং শ্রমকোড বাতিলের দাবিতে পথসভা এবং কৃষিবিলের প্রতীকী প্রতিলিপি পোড়ানো হয়। সভার শুরুতে মিছিল সহ এলাকা পরিক্রমা করা হয়। এআইপিএফ, এপিডিআর এবং গণ-প্রতিবাদী মঞ্চ যুক্তভাবে এই কর্মসূচী পালন করে।
উ: ২৪পরগণা জেলার শ্রীকৃষ্ণপুর অঞ্চলে এআইএআরএলএ ও সিপিআই(এমএল) লিবারেশন যৌথভাবে এই দিনটি পালন করে। নৈহাটি শিবদাসপুর গ্রামীণ অঞ্চলে চিনের মোড়েও পালিত হয় ৫ জুনের কর্মসূচী।
হুগলী
হুগলী জেলার পান্ডুয়া ব্লকে ‘সম্পূর্ণ ক্রান্তি দিবস’। ‘ইন্দিরাই ভারত, ভারতই ইন্দিরা’-স্তাবককুলের মুখে যখন এমন স্তুতিবাক্য তখন উৎসাহিত হয়ে আরো বেশি বেশি করে সমস্ত গণআন্দোলন ও বিরোধী কণ্ঠস্বরকে দমন করছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। কিন্তু প্রতিবাদকে স্তব্ধ করা যায়নি। বরং ৫ জুন ১৯৭৪ লোকনায়ক জয়প্রকাশ নারায়ণের ‘সম্পূর্ণ ক্রান্তি’র আহ্বান যুব সমাজকে উত্তাল করে তোলে। ৪৯ বছর পরে, গণতন্ত্রের শ্বাসরোধকারী ফ্যাসিস্ট মোদী সরকারের বিরুদ্ধে ৫ জুন আর একবার ‘সম্পূর্ণ ক্রান্তি দিবস’ পালনের আহ্বান রাখে সারা ভারত কিষাণ সংঘর্ষ সমন্বয় সমিতি (এআইকেএসসিসি)।
সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে পান্ডুয়া ব্লকের বৈঁচিগ্রাম রেল স্টেশন বাজারে সকাল দশটায় তিন কৃষিআইন প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়। বর্ণময় বিভিন্ন পোস্টার ও ব্যানারে সজ্জিত বিক্ষোভ কর্মসূচী মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। শ্লোগান ও বক্তব্যে করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ সামলাতে নতুন করে জারি হওয়া লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত মেহনতি ও গরিব কৃষক পরিবারগুলিকে মাসিক ৭,৫০০ টাকা নগদ অর্থ প্রদান, গ্রামে গ্রামে ক্যাম্প করে প্রকৃত কৃষকদের নিকট থেকে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে ধান কেনা, বিদ্যুৎ বিল ২০২০ বাতিল, সার-বীজ-ডিজেল ইত্যাদি কৃষি উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি রোধ ইত্যাদি দাবিগুলি তুলে ধরা হয়। এছাড়া বিনা পয়সায় সর্বজনীন টিকাকরণের দাবিও জানানো হয়। পার্টির বৈঁচি লোকাল কমিটি সদস্য সেখ হানিফ, পাভেল কুমার ও এআইকেএম নেতা মহঃ ইউসুফ মন্ডল কর্মসূচীটি পরিচালনা করেন। উল্লেখ্য, ৫ জুন ছিল “বিশ্ব পরিবেশ দিবস”। সে কারণে বিক্ষোভ কর্মসূচীর শেষে বৈঁচিগ্রাম রেলওয়ে বুকিং কাউন্টারের অনতিদূরে কৃষক কর্মীরা বট, কদম ইত্যাদি বৃক্ষ রোপণ করেন।
এআইকেএসসিসি’র আহ্বানে সম্পূর্ণ ক্রান্তি দিবস পালন করা হয় হুগলীর বলাগড়ের গুপ্তিপাড়ায়। স্লোগান প্ল্যাকার্ড সহ কর্মীরা প্রতিবাদ কর্মসূচী পালন করে।
বাঁকুড়া জেলা
বাঁকুড়া জেলার পুয়াবাগান মোড়ে ৬ জুন কৃষক সংগঠনগুলি এক যৌথ কর্মসূচী অনুষ্ঠিত হয়। এইদিন মধ্যপ্রদেশের মন্দসৌরে গুলি চালিয়ে কৃষক হত্যার দিনটিতে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র ধিক্কার জানিয়ে যৌথ মিছিল ও কালা কৃষি আইনের প্রতিলিপি জ্বালানো হয়। নেতৃবৃন্দ খালি গলায় বক্তব্য রাখেন। একই দিনে সকালে ওন্দা থানার নিকুঞ্জপুর হাটতলায় কিষাণ মহাসভা ও আয়ারলার পক্ষ থেকে এক মিছিল সংগঠিত হয়। নয়া কৃষি আইন বাতিলের দাবি তুলে প্রতিলিপি জ্বালানো হয়। নেতৃত্বে ছিলেন বাবলু ব্যানার্জী, বৈদ্যনাথ চীনা, আদিত্য ধবল, অজিত দাস প্রমূখ। বিষ্ণুপুর শহরে অনুরূপ কর্মসূচীতে নেতৃত্ব দেন ফারহান খান।
হাওড়া জেলা
হাওড়া জেলা ঘোড়াঘাটায় ৫ জুন সকালে এআইকেএম, আয়ারলা ও পার্টির পক্ষ থেকে এক বিক্ষোভ কর্মসূচী অনুষ্ঠিত হয়। মোদী সরকারের কৃষক বিরোধী নীতির বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখা হয়, তিন কৃষি আইন বাতিল, ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য গ্যারান্টি আইন চালু করা, সার ডিজেল সহ মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে স্লোগান দেওয়া হয়, যা ব্যপক মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। নেতৃত্ব দেন সনাতন বনিক সহ অন্যান্যরা৷ একই দিনে বাগনানে এক প্রতিবাদ সভা করা হয়, নেতৃত্বে ছিলেন নবীন সামন্ত, দিলীপ দে।
জলপাইগুড়ি
৫ জুন জলপাইগুড়ি শহরে কদমতলায় এআইকেএসসিসি’র পক্ষ থেকে কালা কৃষি বিল বাতিলের দাবিতে সম্পূর্ণ ক্রান্তি দিবস পালিত হয় ও কৃষি আইনের কপি পোড়ানো হয়। নেতৃত্বে ছিলেন আয়ারলার শ্যামল ভৌমিক। এছাড়াও ছিলেন অন্যান্য সংগঠনের নেতা রবি রায়, পরিতোষ ভৌমিক প্রমূখ।
নদীয়া
গত ৫ জুন সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার আহ্বানে দেশব্যাপী ‘সম্পূর্ণ ক্রান্তি দিবস’ পালনের কর্মসূচী নদীয়া জেলায় সংগঠিত হয়। ১৯৭৪ সালে ইন্দিরা স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিহারে উত্তাল গণ-আন্দোলনের এই দিনটিকে স্মরণ করা হয় আজকের সময়ে মোদী সরকারের ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে চলমান কৃষক সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রেরণা হিসাবে। এইদিন কৃষকদের কর্পোরেটদের গোলামে পরিণত করার বিরুদ্ধে আওয়াজকে তুলে ধরে নাকাশীপাড়ার খিদিরপুর পার্টি অফিসে সমবেত কর্মীরা প্রচার করে। সকলের হাতে ছিলো স্লোগান সম্বলিত প্ল্যাকার্ড। তুলে ধরা হয় কৃষকের আজাদীর স্লোগান, নয়া কৃষি আইন ও বিদ্যুৎ বিল বাতিলের দাবি। বিগত ছ’মাসব্যাপী দিল্লীর কৃষক আন্দোলনের শহীদ পাঁচ শতাধিক কৃষকদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়।
একই দিনে চাকদা শহরের জনবহুল স্থানে পার্টি কর্মীরা সমাবেশিত হয়ে স্লোগান দিয়ে দিবসটিকে উদযাপন করেন। দিল্লীর কৃষক আন্দোলনের সংহতিতে সাধারণ মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার আহ্বান জানান। এই কর্মসূচী ব্যাপক মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
গ্রামীণ হাসপাতাল ও উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে সমস্ত মানুষকে করোনা টিকা দিতে হবে। গ্রামীণ স্বাস্থ্যকর্মীদের একাজে নিয়োগ করতে হবে। দুয়ারে দুয়ারে সরকারী দরে (১,৮৬৫ টাকা কুইঃ) ধান কিনতে হবে, অবিলম্বে ১০০ দিনের কাজ চালু করতে হবে প্রভৃতি ৮ দফা দাবিতে ৯ জুন সিপিআই(এমএল) লিবারেশন ও কিষাণ মহাসভার পক্ষ থেকে বেথুয়াডহরী এলাকায় কোভিড দুরত্ববিধি মেনে পথ পরিক্রমা করা হয়। স্থানীয় বুধবার হাটতলা ও স্ট্যাচুর মোড়ে অনুষ্ঠিত এই প্রচার কর্মসূচী ব্যপক মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। অংশগ্রহণকারী কর্মীদের হাতের প্ল্যাকার্ডে দাবিগুলি তুলে ধরা হয়। উপস্থিত ছিলেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের নদীয়া জেলা কমিটির সম্পাদক জয়তু দেশমুখ, কিষাণ মহাসভার জেলা সদস্য কৃষ্ণ প্রামানিক, পার্টির ব্লক কমিটি নেতা হবিবুর রহমান, ইয়াদ আলি প্রমূখ। এরপর নাকাশীপাড়া বিডিও’র কাছে ডেপুটেশন দেওয়া হয়।
পরিসংখ্যানবিদরা উন্নত মানের সমীক্ষা ও সংখ্যাতাত্বিক পদ্ধতি প্রয়োগ করে, অর্থনীতির বিবিধ পরিসংখ্যানকে ব্যবহার করে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ‘বস্তুনিষ্ঠ’ তথ্য পেশ করেন। সেই পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে গত বিত্ত বর্ষের শেষ ত্রৈমাসিক অর্থাৎ জানুয়ারী ২০২১ – এপ্রিল ২০২১ সময়কালে দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি বা জিডিপি বৃদ্ধির হারকে ১.৬% হিসেবে অনুমান করা হয়েছে। ফলে সামগ্রিকে ২০১৯-২০ বিত্তবর্ষে বৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক, -৭.৩%। অর্থাৎ ২০১৯-২০ সালের জিডিপির তুলনায় ২০২০-২১ সালে জিডিপি ৭.৩% হ্রাস পেয়েছে। সামগ্রিক জিডিপির হ্রাসের জন্য সব থেকে বেশি দায়ী মোট স্থির মূলধন গঠন, যা কমেছে ১০.৮%; এর পরে দায়ী ব্যক্তিগত ভোগব্যয়ের হ্রাস, যা গত ২০১৯-২০ বর্ষের তুলনায় ৯.১% কমেছে। উভয় ক্ষেত্রেই তা ২০১৮-১৯ সালের তুলনায়ও কম যথাক্রমে ৫.৯% ও ৪.১%। ফলে বোঝাই যাচ্ছে যে, শিল্পপতিরা বিনিয়োগে উৎসাহী নয়, এবং গৃহস্থ ভোগ ব্যয়ে নিরুৎসাহ। কেবল জিডিপির বৃদ্ধি বা হ্রাস এই দিক গুলিকে আলোকিত করে না। তদর্থে ওই দুটি অঙ্গ যা অর্থনীতিতে ব্যক্তিসমূহের অংশগ্রহণের পরিমাণকে ইঙ্গিত করে তা প্রায় ১০% কমেছে। যেহেতু বাণিজ্য ঘাটতি প্রায় ৪০% কমেছে (বাণিজ্য ঘাটতি কমার অর্থ জিডিপি বৃদ্ধি) ও সরকারী ভোগ ব্যয় ৩% বেড়েছে, তাই জিডিপির হ্রাস তুলনায় কম হযেছে।
সরকারী পরিসংখ্যানের বাইরেও ব্যক্তির অভিজ্ঞতা যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ঘটছে তার ভিত্তিতেও দেশের অর্থনীতি ও সমাজের অবস্থা সম্পর্কে আন্দাজ করা যায়। তাছাড়াও অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান বিষয়ে বিশেষজ্ঞ সংস্থাগুলি রয়েছে। সিএমআইই-র তথ্য অনুযায়ী গত মার্চের শেষ সপ্তাহের তুলনায় মে মাসের শেষ সপ্তাহে উপভোক্তার আবেগ ১৫% কমেছে। তাদের তথ্য অনুসারে ৯৭% ভারতীয়ের প্রকৃত আয় কমেছে। ফলে আয়ের অপেক্ষক হিসেবে ভোগ চাহিদাও কমছে। দেশ জোড়া কোভিড আক্রমণ ও আতঙ্কের পরিবেশে এই অবস্থা ঘটা আশ্চর্যের কিছু নয়। প্রশ্নমের একটি সমীক্ষা অনুসারে সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারী ১৭% মানুষের আত্মীয়-স্বজনের কেউ না কেউ মারা গেছে কোভিডের দ্বিতীয় অভিঘাতে। ফলে একদিকে মানুষ বাইরে বেরচ্ছে না, বাজার দোকানে যাচ্ছে না। ফলে অবশ্যম্ভাবীভাবে বিক্রেতার পণ্য বিক্রি কমছে, অটো, রিকশ, বাসের যাত্রী কমছে। অন্যদিকে ভবিষ্যতে অসুখের কথা ভেবেও লোকে ভোগ কমিয়ে দিয়ে সঞ্চয় করছে।
এই যে ভোগব্যয় ও মূলধন গঠনে ঘাটতির তার ফল কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হচ্ছে। এপ্রিল মাসে বেকারির হার ছিল ৮%, মে মাসে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১.৩%। কেবল মে মাসেই ১ কোটি ৫৩ লক্ষ মানুষ কাজ হারিয়েছেন। ফলে জানুয়ারী থেকে এপ্রিল পর্যন্ত কাজ হারানো ১ কোটি মানুষের সঙ্গে এই সংখ্যা জুড়ে তা আড়াই কোটি ছাড়িয়ে গেছে। এছাড়াও প্রতি বছর নুতন করে শ্রমের বাজারে কর্মপ্রার্থী হয়ে উপস্থিত হচ্ছে ১ কোটির বেশি লোক। সিএমআইই-র তথ্য অনুসারে গত ২৫ এপ্রিলের পর থেকে টানা ৪ সপ্তাহ বেকারত্বের হার বেড়েছে, মাঝে ৩০ মে শেষ হওয়া সপ্তাহে তা একটু কমে ১২.১৫% হলেও পরের ৬ জুনের সপ্তাহেই তা বেড়ে ১৩.৬২% হয়েছে। সব মিলিয়ে গত ১৪-১৫ মাসের অতিমারী আক্রান্ত বিপর্যস্ত জনজীবন অধিকতর সমস্যায় জড়িয়ে পড়ছে। শ্লথ বা ঋণাত্মক বৃদ্ধি, ঊর্ধগামী বেকারি, সঙ্কুচিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি, অদিকতর দারিদ্র এই সবই অতিমারী সময়কার বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠছে। আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সমীক্ষা অনুসারে ২৩ কোটি মানুষ দারিদ্র সীমার নীচে নুতন করে নেমে গেছেন।
সরকারী পরিসংখ্যানের ক্ষেত্রে বহুবিধ আপত্তির কথা বিচক্ষণ ও বিশেষজ্ঞ অর্থনীতিবিদ ও পরিসংখ্যানবিদরা বারম্বার তুলেছেন। তদর্থে দেশ যখন এক ফ্যাসিস্ট শাসনের অধীন থাকে তখন পরিসংখ্যানকে মনোমত তৈরি অত্যন্ত স্বাভাবিক। দেশের সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে যখন বশম্বদ করে তোলা হয়েছে তখন জাতীয় পরিসংখ্যান কমিশন সেই তাঁবেদারির বািরে থাকবে এমনটা ভাবাও পাপ। অতিমারীর সময়ে দেশের সব থেকে সংগঠিত ক্ষেত্র কর্পোরেট ক্ষেত্র বহুল পরিমাণে মুনাফা করেছে। বেশ কয়েকজন শিল্পপতির সম্পদ কয়েকগুণ বেড়েছে। অনলাইন ব্যবসায়, সফ্টওয়্যার সংস্থা, ওষুধের কোম্পানি, প্রভৃতি সংস্থাগুলি দ্রুত লাভ বাড়িয়েছে। ভারতে অসংগঠিত ক্ষেত্রে অন্তত ৮৫% শ্রমিক কর্মচারি কাজ করে (নীতি আয়োগের হিসাব)। সেই অসংগঠিত ক্ষেত্রের উৎপাদনের পরিমাপ করা হয় সংগঠিত বা কর্পোরেট ক্ষেত্রের উৎপাদনের উপর নির্ভর করে করা অনুমানের ভিত্তিতে। ২০১৮-১৯ সালের তুলনায় ২০১৯-২০ সালে অসংগঠিত ক্ষেত্র বহুল পরিমাণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিপরীতে, আগেই বলা হয়েছে, কর্পোরেট ক্ষেত্রের উৎপাদন ও মুনাফা বেড়েছে। এমতাবস্থায়, কর্পোরেটের উৎপাদনের পরিমাণের উপর নির্ভর করে অসংগঠিত ক্ষেত্রের উৎপাদন মাপলে তা বাস্তবের তুলনায় অনেকটাই বেশি হবে। ফলে, অনুমানের তুলনায় জিডিপির হ্রাস বেশিই। যেমন কোভিড থেকে মৃত্যুর সংখ্যা সরকারী পরিসংখ্যানের তুলনায় অনেক বেশি বলেই অনুমান করা হচ্ছে ও সংখ্যাটি প্রায় ৪ লাখের তুলনায় ৪০-৪৫ লাখও হতে পারে বলে অনুমান করছে নিউইয়র্ক টাইমস। পূর্বোক্ত প্রশ্নমের সমীক্ষার ‘১৭%’ ও সেদিকেই ইঙ্গিত করছে। যদি কোভিডে মৃত্যু সংখ্যা গত দুমাসে এই বীভৎসায় পৌঁছায় যার ছবি ভারতের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে, তাহলে তা দেশের অসংগঠিত অর্থনীতিতে যে প্রভাব ফেলবে তা অনুমানের বাইরে।
দৈনন্দিন জীবনচর্যায় যেভাবে অতিমারীর ফলে বিপর্যস্ত নাগরিকদের দেখা যাচ্ছে তা সত্যিই চিন্তার বিষয় ও হৃদয় বিদারক। যে রিকশ চালক অটো চালকের সঙ্গে যাতায়াতের সূত্রে আলাপ, যে মাছ বিক্রেতা, সব্জি বিক্রেতা, কিংবা হকারের সঙ্গে কেনা বেচার লেনদেন করেছি, তাদের সঙ্গে দেখা হলেই আক্ষেপ ও দুঃখ ভিঢ় করে আসে। যে যুবক বা প্রৌঢ় শ্রমিক কর্মচারি কাজ হারিয়েছেন বা মাসে ১৫ দিন কাজ পাচ্ছেন দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে তার অভিজ্ঞতার উপরে ভর করে বা আমাদের ব্যক্তিজীবনের সেইসব অভিজ্ঞতার উপরে ভর করে যদি বাস্তব অর্থনীতির পরিস্থিতিকে বুঝতে চেষ্টা করি তাহলে সামনে ভেসে উঠছে এক অসহনীয় দারিদ্র বেকারি শিক্ষা স্বাস্থ্যের অবনতি (অপরদিকে কুৎসিত দালাল পুঁজির নারকীয় বৈভব), যেটাই আসলে বাস্তব। যে দারিদ্র বেকারিকে মন কি বাত মাসান্তে পরিহাস করে; আর যেগুলোকে মনে করিয়ে দিতে হবে প্রতিনিয়ত, ভবিষ্যতে ওই পরিহাসকারীকে উচিৎ শিক্ষা দেওয়ার জন্য।
-- অমিত দাশগুপ্ত
“পেটেন্ট বলে কোনো বস্তু হয় না, আপনি কি সূর্যের পেটেন্ট নিতে পারেন”। কেন তিনি তাঁর উদ্ভাবিত টিকার পেটেন্ট নেননি, এই প্রশ্নের উত্তরে পোলিও টিকার আবিষ্কারক জোনাস সক এই মন্তব্য করেন।
ভারতে যে শম্বুকগতিতে টিকাকরণ চলছে তা সারা বিশ্বে উদ্বেগের সৃষ্টি করছে। তার কারণ শুধু এই নয় যে, এড়ানো যেত এমন হাজার-হাজার, হয়ত বা লক্ষ-লক্ষ মৃত্যু ঘটবে মাঝে-মাঝেই হানা দেওয়া কোভিড তরঙ্গের কারণে এবং তার কারণেই বিপর্যস্ত হবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। ঐ উদ্বেগের আরও কারণ হল, সংক্রমণের ছড়িয়ে যাওয়ার ফলে হয়ত ভাইরাসের রূপান্তরণ ঘটবে যা টিকাকে সম্পূর্ণরূপে অকার্যকরী করে তুলবে। বিশ্বের বিজ্ঞানীরা এবং চিকিৎসক সম্প্রদায় সুবিপুল আত্মত্যাগের মধ্যে দিয়ে যে সাফল্য অর্জন করেছেন, এর মধ্যে দিয়ে তার পুরোপুরি বিলুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, ফলে যে তিমিরে আমরা ছিলাম সেই তিমিরেই আমাদের ফিরে যেতে হতে পারে। দ্রুত টিকাকরণের পথে একটা বাধা হল মেধাসত্ব নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা যা প্রযুক্তিজ্ঞানের অবাধ চলাচলে বাধা দেয় এবং যা এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার লক্ষ-কোটি দরিদ্রদের স্বার্থের বিনিময়ে ধনী কর্পোরেট সংস্থাগুলোর সুবিধা করে দেয়।
বাণিজ্য সম্পর্কিত মেধাসত্ব (ট্রিপস) এবং বিশ্ব মেধাসত্ব ব্যবস্থা গতবছর অক্টোবর মাসে ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা এবং তারসাথে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাভুক্ত ৫৭টি সদস্য দেশ ট্রিপস চুক্তির কয়েকটি বিধান ছাড় দেওয়ার প্রস্তাব করে, যাতে কোভিড-১৯’কে প্রতিহত করা, প্রশমিত করা ও তার চিকিৎসা করা সম্ভব হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, গ্ৰেট ব্রিটেন, জাপান এবং অন্য কয়েকটি দেশের বিরোধিতায় গত সাতমাসে এই বিষয়ে কোনো অগ্ৰগতি হতে পারেনি। মোদীর বহু বিজ্ঞাপিত বিদেশনীতি, যা ২০১৯ সালে তাঁর দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, এই বিরোধিতার মুখে তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে পড়ে। মোদী কানাডার মতো বিশ্বের ধনী দেশগুলোকে টিকা বিলিয়ে, টিকা কূটনীতিতে চীনকে টেক্কা দিতে চাইলেও মৈত্রীর ধারা দুদিক থেকেই বইল না, দেখা গেল, আমাদের প্রয়োজনের সময় কোনো প্রতিদানমূলক প্রতিক্রিয়া অপর দিক থেকে এলো না।
অতিমারী শুরুর প্রথম দিকের মাসগুলোতে বিশ্বের নেতৃবৃন্দ এবং কর্পোরেট কর্তারা সামাজিক সহযোগিতার ভাষায় কথা বলতে লাগলেন, কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই দেখা গেল, পুঁজিবাদের অধীনে জনগণের স্বার্থের চেয়ে পুঁজির স্বার্থই সর্বদা বেশি গুরুত্ব পায়। বিশ্বের সমাজতন্ত্রীরা টিকা বিক্রি থেকে মুনাফা করার কর্পোরেট সংস্থাগুলোর প্রচেষ্টার সমালোচনা করলেন, কিন্তু প্রচলিত ব্যবস্থার সমর্থকরা দাবি করলেন, ‘মুনাফা’ আছে বলেই ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলো দ্রুতই টিকা বার করতে সক্ষম হয়েছে। এই দাবি একটা নির্ভেজাল মিথ্যা, কেননা, যথেষ্ট পরিমাণে সরকারী অনুদান এবং সরকারী অর্থপুষ্ট গবেষণার মধ্যে দিয়েই টিকার উদ্ভব সম্ভব হয়েছে। টিকা তৈরিতে ভারতীয় নৈপুণ্যের পোস্টার বয় হিসাবে আবির্ভূত হওয়া আদার পুনাওয়ালা এইজন্যই উৎপাদনে গতি আনতে পেরেছিলেন যে, দ্রুতগতিতে উৎপাদন করার উদ্দেশ্যেই তিনি ২০০৬ সাল থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আর্থিক সহায়তা পেয়ে এসেছেন।
তথ্যের যে অবাধ আদান-প্রদানের ভিত্তিতে টিকার উদ্ভব সম্ভব হয়েছিল, দ্রুতই তাকে পরিত্যাগ করে এমন একটা মডেল নিয়ে আসা হল যাতে টিকা তৈরির উদ্যোগে পুঁজিবাদী মুনাফাকেই অগ্ৰাধিকার দেওয়া হল। সকলে নিখরচায় টিকা পেতে পারে এমন ফলপ্রসূ রাস্তা ধনী দেশগুলো আটকে দিয়েছে। আমরা সবাই জানি, এবছরের এপ্রিল মাসে কোভিড-১৯’র দ্বিতীয় তরঙ্গ ভারতে যখন আছড়ে পড়ল, সেই সময় জীবনদায়ী ওষুধ তৈরির কাঁচামাল আমদানিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিভাবে আটকে দিয়েছিল। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে আমেরিকা অবশ্য টিকা তৈরির ক্ষেত্রে মেধাস্বত্বের অধিকারে কিছুটা ছাড় দিতে সম্মত হয়েছে। তবে, ভারত এবং দক্ষিণ আফ্রিকা প্রথমে যে প্রস্তাব দিয়েছিল, যাতে চিকিৎসা, রোগ নির্ণয়ের কিট, ভেন্টিলেটর ইত্যাদি সহ কোভিড-১৯’র মোকাবিলায় অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যে ছাড়ের যে প্রস্তাব ছিল, তার তুলনায় মেধাসত্বের ছাড়ে মার্কিনের এই আংশিক সম্মতি প্রদান নেহাতই কম।
সকলের জন্য টিকা
ধনী দেশগুলোর সম্মিলিত জনসংখ্যা যেখানে বিশ্বের জনসংখ্যার ১৪ শতাংশ, সেখানে তাদের হাতে রয়েছে মোট টিকার ৫৩ শতাংশ, যার অনেকটাই মজুত করা হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকায় অনুমোদন না দিলেও তারা ঐ টিকার লক্ষ-লক্ষ ডোজ নিজেদের কব্জায় রেখেছে, আর অন্যান্য দেশ মরিয়া হয়ে এর প্রয়োগে সম্মতি দিলেও ঐ টিকা আমদানি করতে পারেনি। দক্ষিণ আফ্রিকাকে টিকার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের আড়াই গুণ দাম দিতে হয়েছে। এগুলো সবই পুঁজিবাদ চালিত টিকা কর্মসূচীর বুনিয়াদি সমস্যাকে দেখিয়ে দেয়।
মেধাসত্বে ছাড় টিকা তৈরির প্রক্রিয়ায় গতি আনতে সহায়তা করলেও তা কিন্তু অভিপ্রেত সমাধানের থেকে অনেক দূরে থাকছে। এই অভিমত পোষণ করা হয়েছে যে, “তাদের লব্ধ জ্ঞানকে ভাগ করে নেওয়া এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোতে উৎকৃষ্ট গুণমানের, শ্রেণীগত সংস্করণের টিকা তৈরির লক্ষ্যে উৎপাদনক্ষমতা নির্মাণের জন্য ওষুধ কোম্পানিগুলোকে আর্থিক প্রণোদনা জোগানোর দরকার হতে পারে।” এই ব্যাপারটা মেধাসত্ব নিয়ন্ত্রণের একটা বুনিয়াদি সমস্যাকে দেখিয়ে দেয় যার কেন্দ্রে রয়েছে উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করার চেয়ে মুনাফাকে সুরক্ষিত করার তাড়না। মুনাফাই উদ্ভাবনকে চালিত করে, এই ধারণা বারবারই মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়েছে।
পরিস্থিতির প্রতিকারে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংস্থাগুলোকে নিয়ে গঠিত পিপলস ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স এই আবেদনগুলো জানিয়েছে।
স্বাস্থ্য পরিষেবার বেসরকারীকরণের দরুণ গুরুতর সংকটের মোকাবিলা দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে এবং দীর্ঘমেয়াদে এই ক্ষতিকে পূরণ করতে হবে। জনগণের স্বাস্থ্য এবং মুনাফা কখনই একসাথে চলতে পারে না এবং এই দুটিকে পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন করার এটাই প্রকৃষ্ট সময়।
(লিবারেশন, জুন ২০২১ সংখ্যা থেকে)
-- ঐশিক সাহা
সুপ্রিম কোর্ট যখন প্রস্তাব করছে যে, আদালতগুলোতে দলিত, পশ্চাদপদ, সংখ্যালঘু, নারীদের মধ্যে থেকে বেশি সংখ্যায় বিচারপতি নিয়োগ করতে হবে, ঠিক সে সময় প্রান্তিক ও বঞ্চিত এই গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে থেকে একজনকে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান করার প্রস্তাবকে খারিজ করা হল। এই প্রস্তাবের পিছনে যুক্তি ছিল – এই সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীগুলোর মানুষজনই সবচেয়ে বেশি রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার হন, আর তাই এদের মধ্যে থেকে কাউকে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান করা হলে তিনি তাদের প্রতি ন্যায়বিচার প্রদানে আন্তরিক হবেন। কিন্তু যারা ঐ পদে নিয়োগের সুপারিশ করে থাকে সেই উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি সুপারিশ করল সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিতর্কিত বিচারপতি অরুণ মিশ্রর নাম এবং রাষ্ট্রপতি প্রত্যাশিতভাবেই জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান পদে তাঁকেই নিয়োগ করলেন। উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ছাড়াও রয়েছেন অমিত শাহ, রাজ্যসভার ডেপুটি চেয়ারম্যান হরিবংশ, লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লা ও রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা মল্লিকার্জুন খাড়্গে। বঞ্চিত ও নিপীড়িত গোষ্ঠীগুলোর কাউকে মানবাধিকার কমিশনের প্রধান করার মল্লিকার্জুন খাড়্গের প্রস্তাব নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর ঘনিষ্ঠরা সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে প্রত্যাখ্যান করেন, যদিও সেই প্রত্যাখ্যানের পিছনে কোনো যুক্তি তাঁরা দেননি।
১৯৯৩ সালে তৈরি হওয়া মানবাধিকার আইনে বলা ছিল, সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত কোনো প্রধান বিচারপতিই জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান হবেন। কিন্তু ২০১৯ সালের জুলাই মাসে ঐ আইন সংশোধন করে সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত কোনো প্রধান বিচারপতি ছাড়াও অবসর নেওয়া অন্য যে কোনো বিচারপতিরও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান হতে পারার সংস্থান করা হয়। আজ পিছন ফিরে তাকালে এই সন্দেহের উদ্রেক হয় যে, অরুণ মিশ্রকে পুরস্কৃত করার জন্যই হয়তবা আইনের ঐ সংশোধন করা হয়েছিল।
অরুণ মিশ্র জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান হওয়ায় তাঁর নিয়োগের বিরোধিতা করে বিভিন্ন মহল থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে। এর মূল কারণ, তিনি শাসক দল ঘনিষ্ঠ বলে সুবিদিত এবং সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি থাকাকালে যে সমস্ত রায় তিনি দিয়েছেন, ব্যাপক সংখ্যাধিক ক্ষেত্রেই সেগুলো সরকারের পক্ষে গেছে এবং মানবাধিকারের প্রতি কোনো সহমর্মিতা ও দায়বদ্ধতা তাঁর রায় থেকে বেরিয়ে আসেনি। প্রথমেই উল্লেখ্য, ২০২০ সালের ২০ জানুয়ারী ২৪টা দেশের বিচারপতিদের উপস্থিতিতে তিনি মন্তব্য করেন, নরেন্দ্র মোদী হলেন “বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন” এবং তিনি “এমন ব্যক্তি যিনি বিশ্বের কথা মাথায় রেখে দেশের জন্য কাজ করেন।” নরেন্দ্র মোদীর প্রশংসায় যিনি এমন গদগদ হতে পারেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে সেই মোদী পরিচালিত সরকারের বিরুদ্ধে কোনো অবস্থান নেওয়া তাঁর পক্ষে কতটা সম্ভব হবে? তাঁর এই মন্তব্যর পরিপ্রেক্ষিতে পিইউসিএল-এর সভাপতি কবিতা শ্রীবাস্তবের নেতৃত্বে ৬৭ জন মানবাধিকার কর্মীর দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতেই তাঁর প্রশংসা করে যিনি অনুচিত ও অসংগত মন্তব্য করতে পারেন, এমন ব্যক্তি নির্ভয়ে বা পক্ষপাতিত্ব না দেখিয়ে সরকারের লঙ্ঘন করা জনগণের মানবাধিকারকে রক্ষা করবেন, এই কথা জনগণ বিশ্বাস করবেন কি করে?”
অরুণ মিশ্রর দেওয়া কয়েকটা রায়ের দিকে তাকানো যাক। সাহারা-বিড়লা দুর্নীতি মামলায় আয়কর দপ্তর ও সিবিআই আদিত্য বিড়লা গোষ্ঠীর ব্যবসা সংক্রান্ত কিছু নথি বাজেয়াপ্ত করে এবং সেগুলোতে দেখা যায়, ঐ গোষ্ঠী গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে ৯ দফায় ৪০ কোটি টাকা দিয়েছে। কিন্তু অরুণ মিশ্রর বেঞ্চ রায় দেয় যে, বাজেয়াপ্ত করা বিচ্ছিন্ন কিছু কাগজকে প্রামাণ্য নথি বলে গণ্য করা যাবে না। এইভাবে দুর্নীতির অভিযোগ থেকে নরেন্দ্র মোদী রেহাই পেয়ে যান। গুজরাটের আইপিএস অফিসার সঞ্জীব ভাট ২০০২’র গুজরাট গণহত্যা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে একটা হলফনামা জমা দেন যাতে তিনি বলেন, গোধরা কাণ্ডের পর মোদীর ডাকা একটা বৈঠকে তিনি উপস্থিত ছিলেন এবং মোদী ঐ বৈঠকে গোধরা পরবর্তী পরিস্থিতিতে হিন্দুদের ক্রোধ প্রকাশ করার পথে কোনো বাধা না দেওয়ার নির্দেশ দেন। সেই মামলায় অরুণ মিশ্র সঞ্জীব ভাটের হলফনামায় বিধৃত বক্তব্যকে খারিজ করে দেন যারফলে দাঙ্গায় ইন্ধন জোগানোর অভিযোগ থেকে নরেন্দ্র মোদী অব্যাহতি পান। গুজরাটের প্রাক্তন মন্ত্রী হরেন পাণ্ড্য হত্যা মামলাতেও যে রায় তিনি দেন তাতে নরেন্দ্র মোদীর সুবিধা হয়। ঐ হত্যা একটা রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ছিল না এবং মোদী-অমিত শাহ ঘনিষ্ঠ পুলিশ অফিসার বানজারা ঐ হত্যার নির্দেশ দেননি – তাঁর দেওয়া রায় এই ব্যাপারটা প্রতিষ্ঠিত করতে সহায়তা করে। ভিমা কোরেগাঁও মামলায় নাগরিক আন্দোলনের কর্মী আনন্দ তেলতুম্বডে ও গৌতম নভলখার বিরুদ্ধে ইউএপিএ আইনে অভিযোগ দায়ের হয়। তাঁদের আগাম জামিনের আবেদন খারিজ করে অরুণ মিশ্র তাঁদের আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার মঞ্চ ক্যাম্পেন এগেনস্ট স্টেট রিপ্রেসন তখন বলে, “জামিনের আবেদন নাকচ করা এবং অতিমারীর মধ্যে আত্মসমর্পণের নির্দেশ ভারতীয় বিচার ব্যবস্থার এই চরিত্রকেই দেখিয়ে দিল যে, তারা ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্ব ফ্যাসিস্ত রাষ্ট্রের একান্ত অনুগত।” মানবাধিকারের প্রতি তিনি অঙ্গীকারবদ্ধ বলে প্রতিপন্ন হওয়ার চেয়ে তার বিপরীতটাই এই রায়ে প্রতিষ্ঠিত হয়। জঙ্গলের জমিতে দীর্ঘদিন ধরে বসবাসকারী উপজাতিদের সেখান থেকে উচ্ছেদের মামলায় অরুণ মিশ্রর বেঞ্চ উপজাতিদের ‘বেআইনি বসবাসকারী’ ও ‘জবরদখলকারী’ বলে অভিহিত করে বনজমির প্রতি উপজাতিদের অধিকারকে খারিজ করেন এবং সরকারের বনজমি দখলের সমর্থনে রায় দেন। তাঁর ঐ রায়ে বনজমিতে বসবাস করা ২০ লক্ষ উপজাতি পরিবারের মাথার ওপর উচ্ছেদের খাঁড়া ঝোলে। এই রায় নিয়ে বিপুল সমালোচনা ও আলোড়ন হলে পরে ঐ রায়ে স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়।
সুপ্রিম কোর্টের চার বরিষ্ঠ বিচারপতি ২০১৮ সালের ১২ জানুয়ারী দেশের সর্বোচ্চ আদালতের কাজকর্মের ধারার বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে যে সাংবাদিক সম্মেলন করেন এবং প্রধান বিচারপতিকে লেখা তাঁদের চিঠির প্রতিলপি সাংবাদিকদের হাতে তুলে দেন, তারও কেন্দ্রে ছিলেন অরুণ মিশ্র। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্র নিজের ক্ষমতা অপপ্রয়োগ করে রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর মামলাগুলো অরুণ মিশ্রর বেঞ্চে পাঠাতেন যাতে নিরপেক্ষ বিচারের চেয়ে অভিপ্রেত রায় প্রদানই লক্ষ্য হত। এবং মামলা অরুণ মিশ্রর বেঞ্চে নির্দিষ্ট হলে রায় তাদের অনুকূলে আসবে বলে সরকারও আশা করত। সোহরাবুদ্দিন সেখ হত্যা মামলায় অমিত শাহর জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছিল এবং সেই মামলা শোনার সময় রহস্যজনকভাবে মৃত্যু হয়েছিল বিচারপতি ব্রিজগোপাল লোয়ার। এই লোয়া মৃত্যু মামলায় তদন্তের নির্দেশ দেওয়ার আবেদন জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলা হয় এবং রাজনৈতিক দিক থেকে স্পর্শকাতর এই মামলাও প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্র নির্ধারিত করেন অরুণ মিশ্রর বেঞ্চে। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েই চার বিচারপতির সাংবাদিক সম্মেলন।
কুখ্যাত প্রশান্ত ভূষণ টুইট মামলা শোনেন ও রায় দেন অরুণ মিশ্র। জনস্বার্থ নিয়ে লড়াই করার জন্য সুপরিচিত আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ সুপ্রিম কোর্টের সমালোচনা করে দুটো টুইট করেন। একটা টুইটে তিনি বলেন, “ভবিষ্যতে ঐতিহাসিকরা যখন পিছন ফিরে গত ছ’বছরের দিকে তাকিয়ে দেখবেন যে, আনুষ্ঠানিক জরুরি অবস্থা ঘোষণা ছাড়াই কিভাবে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করা হয়েছে, তাঁরা ঐ ধ্বংসকাণ্ডে সুপ্রিম কোর্টের এবং বিশেশভাবে শেষ চার প্রধান বিচারপতির ভূমিকার উল্লেখ করবেন”। উল্লেখ্য, ঐ চার প্রধান বিচারপতি হলেন জগদীশ সিং কেহর, দীপক মিশ্র, রঞ্জন গগৈ এবং শারদ অরবিন্দ বোবদে। আর দ্বিতীয় টুইটে তিনি বিজেপি নেতার ছেলের হার্লে ডেভিডসন মোটর বাইকে বসা শারদ অরবিন্দ বোবদের ছবি পোস্ট করে বলেন, তিনি এমন সময় বাইকে বসে আছেন যখন সুপ্রিম কোর্ট “ন্যায়বিচার পাওয়ার বুনিয়াদি অধিকার থেকে নাগরিকদের বঞ্চিত করছে”, কারণ, আদালত তখন লকডাউনের ধারায় রয়েছে। প্রশান্ত ভূষণের টুইটে আদালতের মর্যাদা হানি হয়েছে গণ্য করে সুপ্রিম কোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে প্রশান্ত ভূষণের বিরুদ্ধে মামলা শুরু করে। অরুণ মিশ্র শুনানির মধ্যে দিয়ে প্রশান্ত ভূষণকে নত করার, টুইটের জন্য অনুশোচনা প্রকাশ করে মার্জনা ভিক্ষার যথাসাধ্য চেষ্টা চালান। প্রশান্ত ভূষণ কিন্তু তাঁর টুইটের যথার্থতার প্রতি ও ক্ষমা না চাওয়ার প্রতি অবিচল থাকেন এবং অরুণ মিশ্রদের হতাশ করেন। অরুণ মিশ্রর নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ অবশেষে তাঁকে আদালত অবমাননায় দোষী সাব্যস্ত করে ১০০ পাতারও বেশি রায়ে ভূষণকে এক টাকা জরিমানা করেন! এই রায় দিয়ে অরুণ মিশ্র ভারতীয় বিচারধারার ইতিহাসে সবচেয়ে স্বেচ্ছাচারী ও উদ্ভট রায়গুলির অন্যতম স্রষ্টা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবেন।
অরুণ মিশ্র সুপ্রিম কোর্ট থেকে অবসর গ্ৰহণ করেন ২০২০ সালের ২ সেপ্টেম্বর। সুপ্রিম কোর্টে ২০২০ সালের ৩১ আগস্ট শেষ যে রায় তিনি দেন, সেই মামলায় জড়িত ছিল আদানিদের বিদ্যুৎক্ষেত্রের একটা সংস্থা। সেই রায়ে আদানি গোষ্ঠীর ঐ সংস্থা ৮,০০০ কোটি টাকা লাভবান হয়। সংবাদে প্রকাশ, আদানি গোষ্ঠীর জড়িত থাকা ৭টা মামলার সবগুলোই ২০১৯’র জানুয়ারী থেকে শোনা হয় অরুণ মিশ্রর নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে এবং সবগুলোর রায়ই আদানিদের অনুকূলে যায়। সমাজমাধ্যমে কৌতুক করে জনৈক ব্যক্তি মন্তব্য করেছেন – মানবাধিকারকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার অসাধারণ রেকর্ড অরুণ মিশ্রর রয়েছে – অবশ্য সে অধিকার যদি আদানি ও আম্বানিদের হয়!
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন যখন গঠন হয়, তার উদ্দেশ্য ছিল এটিকে একটি স্বশাসিত সংস্থা করে তোলা। সংস্থাটা হবে সরকারের প্রভাব থেকে মুক্ত এবং সে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে। যে সমস্ত গোষ্ঠী বেশি সামাজিক বৈষম্য ও অসাম্যের শিকার, রাষ্ট্রীয় ও জাতপাতগত নিপীড়ন যাদের বেশি ভোগ করতে হয়, সেই সমস্ত অংশের প্রতিনিধিত্ব যেন এই সংস্থায় থাকে তা সুনিশ্চিত করাটাও মানবাধিকার প্রদানের অন্যতম শর্ত রূপে ভাবা হয়েছিল। রাষ্ট্রের স্বেচ্ছাচারিতার নাটের গুরুরা যদি মনে করেন যে, তাঁরা যাই করুন তারজন্য কোনো দণ্ড তাঁদের ভোগ করতে হবেনা – এই ধারণায় লাগাম পরানোর সংস্থা হিসাবেও মানবাধিকার কমিশনকে ভাবা হয়েছিল। কমিশনের দায়বদ্ধতাকে নির্দিষ্ট করা হয়েছিল জনগণের প্রতি, সরাকারের কাছে নয়। কিন্তু কালক্রমে রাষ্ট্রের স্বৈরাচারী প্রবণতা বেড়ে চলায় মানবাধিকার কমিশনকে এক অবহেলিত, নখদন্তহীন ঠুঁটো জগন্নাথ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে। সিবিআই, আরবিআই, ইডি, এনআইএ’র মতো মানবাধিকার কমিশনকেও সরকারের তাঁবেদার প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার উদগ্ৰ অভিপ্রায় থেকেই সরকার ঘনিষ্ঠ অরুণ মিশ্রকে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান পদে বসানো হয়েছে। দ্য ক্যাম্পেন ফর জুডিসিয়াল অ্যাকাউন্টাবিলিটি এণ্ড জুডিসিয়াল রিফর্মস (সিজেএআর), যাতে যুক্ত আছেন প্রশান্ত ভূষণ, অরুন্ধতি রায়, মনোজ মিত্তা’র মতো সমাজ আন্দোলনের কর্মীরা, এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন – মদন লোকুর, দীপক গুপ্ত, কুরিয়েন যোশেফ এবং আরও কিছু বিচারপতি সুপ্রিম কোর্ট থেকে অবসর গ্ৰহণ করেছেন, মানবাধিকারকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরায় যাঁদের অসামান্য অবদান রয়েছে। সদিচ্ছা থাকলে এঁদের মধ্যে থেকে যে কোনো একজনকে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান হিসাবে বেছে নেওয়া যেত। কিন্তু তাদের ধামা ধরতে পারবে এমন একজনকেই নরেন্দ্র মোদীরা বেছে নিয়েছেন। সিজেএআর-এর বিবৃতিতে যথার্থভাবেই বলা হয়েছে, “তাঁর (অরুণ মিশ্রর) নিয়োগ মানবাধিকারের সুরক্ষা ও তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটায় মৃত্যুঘণ্টা বাজারই সংকেত দিচ্ছে, যে লক্ষ্যে ভারতে মানবাধিকার কমিশন গঠন করা হয়েছিল।”
মূলত কাঁচাপাটের অভাবে নির্বাচনের পরপরই ১৭টা চটকল বন্ধ হয়েছে। কাঁচাপাটের অভাবের কারণ, পাট চাষ কম হওয়া এবং এক শ্রেণির অসাধু মালিক ও আড়তদারদের বে-আইনি মজুত। রাজ্য সরকারের নির্দেশে বাকি মিলগুলো অর্ধেক খোলা। কারণ করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে রাজ্য সরকার ‘বিধিনিষেধ’ (অঘোষিত লকডাউন) আরোপ করেছে। রাজ্যে চটকলের উপর নির্ভরশীল ২.৫ লক্ষ শ্রমিক ও তাদের পরিবারের সদস্যরা করোনা আতঙ্ক, অভাব, অর্ধাহারে দিশাহারা। এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি মিল কোয়ার্টার্স ও সংলগ্ন পাড়াগুলোতে।
গোদের উপর বিষফোঁড়া কেন্দ্রীয় শ্রমদপ্তর ‘মিনিস্ট্রি অব লেবার এন্ড এমপ্লয়মেন্ট ব্যুরো’র হিসাব অনুযায়ী চটকল শ্রমিকদের মহার্ঘভাতা এই নিদারুণ মূল্যবৃদ্ধির মধ্যেও কমে গেছে। মালিকপক্ষের সংগঠন ‘ইন্ডিয়ান জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশন’ ইতিমধ্যে প্রত্যেক মিলে মহার্ঘভাতা কমার বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে। শ্রমিকরা জুন, জুলাই, আগস্ট এই তিনমাস দৈনিক ১৯.৫১ টাকা করে কম মজুরি পাবেন।
চটকলে প্রতি ত্রৈমাসিক অন্তর (নভেম্বর-জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি-এপ্রিল, মে-জুলাই এবং আগস্ট-অক্টোবর) কেন্দ্রীয় শ্রম ব্যুরো মহার্ঘভাতা ঘোষণা করে। ভোগ্যপণ্যের মূল্যসূচকের উপর মহার্ঘভাতা বাড়ে বা কমে।
কনজিউমার প্রাইস ইন্ডেক্স (সিপিআই)। এই ‘উপভোক্তা মূল্যসূচক’ শহর, গ্রাম, কৃষি ও শিল্প শ্রমিকের পারিবারিক নিত্যপ্রয়োজনীয় কয়েকটি বস্তুর ব্যবহারের উপর নির্ধারিত হয়। এখানে চটকল শ্রমিকদের সমস্যাটাই তুলে ধরছি।
সাধারণভাবে সাতটা শিল্পক্ষেত্রের শ্রমিক-কর্মচারি এবং তাদের পরিবারকে সিপিআই-এর আওতায় রাখা হয়েছে। এই সাতটা শিল্প ক্ষেত্র হল – কারখানা, খনি, বাগিচা, মোটর পরিবহণ, বন্দর, রেল, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবারহ।
যে যে বস্তুর মূল্য ওঠানামার উপর ভিত্তি করে হিসাব কষা হয় তা হল,
(১) খাদ্য ও পানীয়। (২) পান তামাক এবং নেশার দ্রব্য। (৩) পোশাক ও জুতো। (৪) বাসস্থান। (৫) জ্বালানি ও বিদ্যুৎ। (৬) বিবিধ – এরমধ্যে আছে শিক্ষা, আমোদ প্রমোদ, পরিবহণ ও চিকিৎসা ইত্যাদি।
উপভোক্তা এই সব জিনিসগুলো কত পরিমাণে ব্যবহার করেছেন এবং কি মূল্যে কিনেছেন তার উপর ভিত্তি করে উপভোক্তা মূল্যসূচক নির্ধারিত হয় এবং শ্রমিক কর্মচারিদের মহার্ঘভাতা ঠিক হয়। প্রাইভেট সেক্টারে মহার্ঘভাতা পরিবর্তনশীল (Variable)। ডিএ’র সাথে যুক্ত আছে মজুরি, বেতন এবং পেনশন।
উপরে বর্ণিত বস্তুগুলোর বাজারদর ঊর্ধ্বমুখী। পেট্রল, ডিজেল, রান্নার গ্যাসের দাম কোথায় গিয়ে থামবে সরকারও জানেনা। চিকিৎসা, শিক্ষা, পরিবহন প্রভৃতির খরচ বহুগুণ বেড়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার কি মুদ্রাস্ফীতিকে আড়াল করতে চাইছে? এটা কি আর এক জুমলা? এতে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন শ্রমিক ও কর্মচারিরা।
কেন্দ্রীয় সরকারের হিসাব অনুযায়ী চটকল শ্রমিকদের মহার্ঘভাতা কমলো ২৬৭ পয়েন্টস। চটকল শ্রমিকদের প্রতি পয়েন্টে ১.৯০ টাকা করে মহার্ঘভাতা মজুরির সাথে যুক্ত হয় বা বাদ যায়। মে-জুলাই এই তিন মাস, প্রতি মাসে (২৬দিন) ৫০৭.৩০ টাকা করে মজুরি কম পাবেন।
শ্রম কেন্দ্র ও রাজ্যের যুগ্ম তালিকাভুক্ত। রাজ্য সরকার নিজেদের আইনগত অধিকারের উপর দাঁড়িয়েই শ্রমিক স্বার্থে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে পারে। গত ১ জুন চটকলে কর্মরত ২১টি ইউনিয়নের প্রতিনিধিদের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শ্রমমন্ত্রী বেচারাম মান্নার সাথে ভার্চ্যুয়াল মিটিং হয়ে গেল। ইউনিয়নের পক্ষ থেকে আবেদন করা হয়,
(১) অবিলম্বে বন্ধ মিলগুলো খুলতে হবে। (২) কাঁচাপাটের মজুত উদ্ধার কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের বিভিন্ন এজেন্সির মাধ্যমে করতে হবে। (৩) করোনা কালে ডিএ থেকে যেন ৫০৭.৩০ টাকা কেটে না নেওয়া হয়। (৪) চটকল অত্যাবশকীয় পণ্য আইনের আওতায় পড়ে, প্রত্যেকটা মিলে ফ্রন্টলাইন কোভিড যোদ্ধা হিসাবে শ্রমিক ও তাদের পরিবারকে দ্রুত টিকাকরণ করা হোক। (৫) শ্রমবিরোধ আইনে রাজ্য সরকারের হাতে প্রভূত ক্ষমতা আছে শ্রমিক সমস্যা সমাধানের।
রাজ্য সরকারের নির্দেশে মিলগুলো ৪০ শতাংশ শ্রমিক নিয়ে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। এরফলে লক্ষাধিক শ্রমিক কাজ থেকে বসে গেছেন। রাজ্য শ্রমদপ্তর শ্রমবিরোধ আইন অনুযায়ী শ্রমিকদের লে-অফ দেওয়ার জন্যে ‘ইন্ডিয়ান জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশন’এর কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ জারি করতে পারে।
‘ইন্ডিয়ান জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশন’ যে স্ট্যান্ডিং অর্ডার আছে তাতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে লে-অফ কি কি কারণে দেওয়া যেতে পারে।
কাজ বন্ধ হলে
১২(ক) নিয়োগকর্তা যে কোনো সময়েই পারে অগ্নিকান্ড, বিপর্যয়, যন্ত্রপাতির গোলযোগ বা বিদ্যুৎ সরবরাহে বিঘ্ন, মহামারি, নাগরিক জীবনে অশান্তি নেমে আসা, কয়লা বা কাঁচা মাল বা অত্যাবশকীয় জিনিষপত্রের ঘাটতি, উৎপাদনের ধরনে পরিবর্তন এবং নিয়ন্ত্রণের বাইরে অন্য কোনো কারণবশত যদি কোনো একটা বিভাগ বা অনেকগুলো বিভাগ পুরোপুরি বা আংশিক সময়ের জন্য বা দীর্ঘ সময়ের জন্য আগাম বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই বন্ধ রাখে।
১২(খ) এই সমস্ত ক্ষেত্রে কাজ বন্ধ থাকলে শ্রমিকেরা শিল্প বিরোধ আইন, ১৯৪৭ এর ধারা অনুযায়ী মজুরি পাবেন।
লে-অফ’এর ক্ষতিপূরণ পাওয়া শ্রমিকদের অধিকার মধ্যেই পড়ে। শ্রমবিরোধ আইনের ২৫(সি) ধারা অনুযায়ী, লে-অফ ঘোষিত হলে শ্রমিকরা লে-অফ পর্যায়ে মোট মজুরি ও মহার্ঘ ভাতার ৫০ শতাংশ পাবেন।
শ্রমিকরা লকডাউনের জন্য কাজ পাচ্ছেন না, সরকারী কোনো সাহায্য নেই, আবার নিজেদের অধিকার থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। নতুন ৪টি শ্রমকোড এবং বিধি এখনো লাগু হয়নি, তাই আগের শ্রম-বিরোধ আইনের কার্যকারিতা এখনো থাকছে। আইনগতভাবে প্রাপ্য লে-অফ থেকে কপর্দক শূন্য শ্রমিকরা যদি মজুরির ৫০ শতাংশ হাতে পান, অন্তত কিছুটা কষ্ট তাদের লাঘব হয়। রাজ্য সরকার বিপন্ন শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ান।
- নবেন্দু দাশগুপ্ত
(বেঙ্গালুরুর কিছু এআইসিসিটিইউ কর্মী বিভিন্ন শ্মশান, কবরস্থানে গিয়ে শ্মশান কর্মীদের জীবন-যন্ত্রণার কাহিনী লিপিবদ্ধ করেন। এই সমস্ত নামহীন, অন্তরালে থাকা কর্মীদের রিপোর্ট বেশ আলোড়ন তোলে। দ্য হিন্দু সংবাদপত্র গুরুত্ব দিয়ে তা প্রকাশ করে। এআইসিসিটিইউ কর্তৃক প্রকাশিত ওয়েভ পত্রিকা ‘ওয়ার্কার্স রেজিস্টান্স’র জুন, ২০২১ সংখ্যায় এর বিস্তারিত রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। এখানে তার অনুবাদ প্রকাশিত হল।)
কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ এবার দেশজুড়ে কেড়ে নিয়েছে অনেক নাগরিকের প্রাণ। আর, এই সমস্ত মৃত্যুর অন্তিম সৎকার করতে গিয়ে কবরস্থান ও শ্মশানের উপর চাপ অনেক বেড়েছে। আমরা জেনেছি কিভাবে স্থানীয় প্রশাসন এই সমস্ত সমস্যাকে সমাধান করতে হিমশিম খাচ্ছে, কিভাবেই বা সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে গণচিতা বা গণকবরগুলোকে, অস্বাভাবিক চাপের মুখে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ছে বিদ্যুৎ চুল্লিগুলো। মৃতদেহগুলো দাহ করার জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। কর্ণাটকে, বেঙ্গালুরুর আর্চ বিশপ বৃহৎ বেঙ্গালুরু মহানগর পালিকা (বিবিএমপি)’র কাছে কাতর আবেদন জানিয়েছেন যাতে, ক্রিশ্চান সম্প্রদায়ের মৃত ব্যক্তিদের সম্ভ্রমের সাথে কবর দেওয়া যায়। আর, সবার অলক্ষ্যে চাপা পড়ে গেছে, শ্মশান ও কবরস্থানের কর্মীদের উপর নেমে আসা অকল্পনীয় কাজের বোঝা! তাঁদের অব্যক্ত যন্ত্রণা, দুঃখ দুর্দশার করুণ কাহিনী।
জাতপাতগতভাবে দলিত সম্প্রদায়ের মানুষের উপর আরোপিত এই অন্তিম সৎকারের কাজটি তাঁরা করে চলেছেন বংশ পরম্পরাগত ভাবে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। মৃতদেহ সৎকারের ‘প্রথাগত’ এই পেশাটি নীচু চোখে দেখা হয়, আর এজন্য এই কাজ বা পেশাটি ইনফর্মাল, তা যতই সরকার বা ব্যক্তি মালিকানাধীন সংস্থা মারফত পরিচালিত হোক না কেন। এই সমস্ত কর্মীরা সামান্যতম মর্যাদা পান না, নাগরিকদের সমস্ত অধিকার থেকে তাঁরা বঞ্চিত। বেঙ্গালুরুর প্রায় কুড়িটি শ্মশান ও কবরস্থান ঘুরে আমরা দেখলাম, এদের নেই কোনো ন্যূনতম মজুরি, সমস্ত ধরনের আইনগত, বিধিবদ্ধ সুযোগ সুবিধা থেকে তাঁরা বঞ্চিত। তাঁদের কাজটিকে নিয়মিত করা হয়নি, ইএসআই–পিএফ-পেনশন তাঁদের কাছে আজও অধরা। এদের সমস্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত ও বর্জিত কর্মীবৃন্দ হিসাবেই গণ্য করা হয়। সাবেক শ্মশান বা কবরস্থানের পরিষেবা কর্মী হিসাবে এদের পরিচিতি।
এই কর্মীরা বছরে ৩৬৫ দিনই কাজ করেন। এদের নেই কোনো ধরনের ছুটি। নেই সাপ্তাহিক, জাতীয়, উৎসবকালীন বা ক্যাজুয়াল অথবা আপৎকালীন ছুটি। হঠাৎ, অগুন্তি শবদেহ শ্মশান বা কবরস্থানে আসতে থাকায়, বিরামহীনভাবেই এরা কাজ করে চলেছেন দিনে ১২ ঘণ্টা। প্রতিটি সরকারী বা বেসরকারী শ্মশান বা কবরস্থানে সারাক্ষণ কাজ করা কিছু কর্মী রয়েছেন, যারা কোনোদিন সময়মতো মাসিক মজুরি পান না। সময়মতো মজুরি না পাওয়াটাই যেন তাঁদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এক আইনসিদ্ধ নিয়ম। যতজন কর্মীর সাথে আমাদের কথা হয় তাতে জানা গেল যে, অতিমারির আগেও তাঁরা পেতেন না নিয়মিত মজুরি। সরকারী শ্মশান বা কবরস্থানে যারা কাজ করেন, তাঁরা কয়েকমাস পর পর পান কিছু থোক টাকা, কিন্তু সেক্ষেত্রেও কত ঘণ্টা তাঁরা কাজ করেছেন, তার হিসাব থাকে না। তাঁদের মজুরি ঠিক কত, কিভাবেই বা তার হিসাব হয়, তা তাঁদের অজানা। মৃতদেহ সৎকারের অত্যাধিক চাপ থাকায় এই কয়মাস উদ্বৃত্ত কর্মীদের কাজে লাগানো হচ্ছে। কিন্তু তাঁরা কেউ জানেননা ঠিক কত মজুরি তাঁরা পাবেন। কয়েকটি ক্ষেত্রে দেখা গেল, অত্যাধিক কাজের চাপ সামলাতে তাঁরা কেউ কেউ নিজেদের পরিচিত লোকজনকে কাজে লাগাচ্ছে, আর নিজেদের মজুরির একটা অংশ তাঁদের দিতে হচ্ছে। এই এপ্রিল মাসে অম্বেদকার দলিত সংঘর্ষ সমিতি, রুদ্রভূমি সংঘর পতাকাতলে এই সমস্ত কর্মীরা তাঁদের বকেয়া মজুরির দাবিতে ব্যাঙ্গালোরে মুখ্যমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ সংগঠিত করেন। তাঁদের বকেয়া মজুরি প্রদানে নিশ্চয়তা দিলেও মুখ্যমন্ত্রী ওই সমস্ত কর্মীদের জ্বালা-যন্ত্রণা, অপমান, বঞ্চনাগুলো দূর করার ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপই নেননি। কোনো নির্দিষ্ট মজুরি না থাকায় তাঁদের কোনো মাসে ১,০০০ বা কখনো ১,৫০০ টাকাতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। তাঁরা মূলত নির্ভর করেন সেই সমস্ত পরিবারগুলোর দান বা বকশিশের উপর যারা তাঁদের প্রিয় পরিজনদের শেষকৃত্য সম্পন্ন করার জন্য আসেন।
এই সমস্ত কর্মীরা পিপিই কিট পান, যেহেতু তাঁদের কোভিড মৃতদেহ নিয়ে নাড়া চাড়া করতে হয়। কিন্তু যে সমস্ত কর্মীরা শেষ কৃত্যের জন্য কাঠ ব্যবহার করেন, তাঁরা পিপিই পরেন না, কারণ, ওই কিটগুলো দাহ্য পদার্থ, দ্রুতই তাতে আগুন ধরে যায়। এরকম এক কর্মী পিপিই পরে কাজ করার সময়ে গুরুতরভাবে আহত হন। আজ পর্যন্ত কারুরই কোভিড পরীক্ষা হয়নি, নিয়োগকর্তারা তাঁদের টিকার ও ব্যবস্থা করেনি। হাতে গোনা কয়েকজন নিজেদের উদ্যোগে টিকা নিয়েছেন। কোভিডে মৃত ব্যক্তিদের দাহকাজের সাথে যুক্ত হওয়া সত্ত্বেও সরকার এদের ফ্রন্টলাইন কর্মী বলে স্বীকৃতি দিচ্ছে না।
এই সমস্ত কর্মীরা নিজ নিজ পরিবার নিয়ে বসবাস করেন শ্মশান বা কবরস্থানেই। কিছুদিন যাবৎ, বিদ্যুৎচুল্লির সাথে যুক্ত কর্মীরাও সেখানেই থাকছেন পরিবার নিয়ে, কিন্তু সেখানে নিকাশী বা পানীয় জলের বুনিয়াদি সুযোগ সুবিধা নেই। অনেকেই আবার আশপাশ এলাকায় বৈষম্যের শিকার। যেমন, মহিলারা এলাকার আশপাশে পরিচারিকার কাজ করেন। কিন্তু, তাঁদের থাকার জায়গা জানাজানি হলে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেওয়া হয়।
এই সমস্ত কর্মীদের ফ্রন্টলাইন কর্মী হিসাবে স্বীকৃতি দিতে হবে। তাঁদের ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের জীবনের সুরক্ষা দিতে হবে। শুধুমাত্র ন্যূনতম মজুরিই নয়, এই কাজটাকেও আইনী স্বীকৃতি দিয়ে নিয়মিত করতে হবে। সময়মতো মজুরি প্রদান, বিধিবদ্ধ সুযোগ সুবিধা, বাড়তি শ্রমের জন্য বাড়তি মজুরি প্রভৃতি বিষয়গুলো সরকারকে সুনিশ্চিত করতে হবে।
খুবই আলোচিত তথ্যানুসন্ধানী এই সমীক্ষা কিছুদিন আগে প্রকাশ করেছে আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়। পূর্ণাঙ্গ ও বিস্তৃত এই সমীক্ষা অনেক বিষয়কেই সামনে এনেছে। গতবছর কোভিড হানায় দেশের অর্থনীতি, কাজের বাজার, আয়, ক্রমবর্ধমান আর্থিক বৈষম্য ও দারিদ্র কি কি প্রভাব ফেলেছে, তা এই সমীক্ষা তুলে ধরেছে। এখানে দেখানো হয়েছে, মাথা চাড়া দিয়ে ওঠা আর্থিক বৈষম্য, মজুরির অবক্ষয় রীতিমতো এক উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমীক্ষা বলেছে, “আমরা বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছি, অতিমারি ইনফর্মাল ক্ষেত্রকে আরও অনেক বেশি সম্প্রসারিত করেছে, যার দরুণ সিংহভাগ শ্রমিকদের উপার্জন মারাত্বকভাবে নীচে নেমে গেছে আর, এক ধাক্কায় দারিদ্র বেড়ে গেছে অনেকটাই। মহিলা ও অল্প বয়সী শ্রমিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন সবচেয়ে বেশি। এই পরিস্থিতিকে যুজতে পরিবারগুলো কম খাবার খেয়েছে, ধার করেছে, বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে নিজেদের কিছু গচ্ছিত জিনিষপত্র। সরকারী সাহায্য নিদারুণ বিপর্যয়ের হাত থেকে সাময়িকভাবে ঠেকালেও সাহায্যের প্রকল্পগুলো ছিল অসম্পূর্ণ, অনেক বিপন্ন শ্রমিক পরিবার থেকে গেছে এই সমস্থ কিছুর বাইরে। আমরা দেখেছি, দুটো কারণে বাড়তি সরকারী সাহায্য আবশ্যক – এক, প্রথম বছরের ক্ষয়ক্ষতিকে মেরামত করা আর পরের বিষয়টা হল, দ্বিতীয় ঢেউএর অভিঘাতকে আগে থেকেই অনুমান করে নেওয়া।”
আলোচ্য সমীক্ষা কর্মসংস্থানের উপর কোভিডের অভিঘাত নিয়ে আলোকপাত করেছে। লকডাউনের প্রথম দুই মাস, অর্থাৎ এপ্রিল-মে ২০২০-তে দশ কোটি কাজ খোয়া যায়। প্রায় দেড় কোটি শ্রমিক প্রথম ঢেউয়ের সময় কাজ হারায়, তারপর তা আর কোনোদিনও ফিরে পায়নি। যদিও বাকি কাজ হারানো বেশিরভাগ শ্রমিকরা জুন ২০২০-তে কাজে ফিরে আসে। এটা খুবই লক্ষণীয় যে ২০২০’র জুনের কোভিডের প্রথম ঢেউ-এর পর একটা গড় পরিবারের মাথাপিছু মাসিক আয় ছিল মাত্র ৪,৯৭৯ টাকা, সেই বছরের জানুয়ারী মাসে যা ছিল ৫,৯৮৯ টাকা। এটা দেখা গেছে যে, গড়পড়তা আয়ের এই অবক্ষয়ের পেছনে ৯০ শতাংশই হল উপার্জন কমে যাওয়ার ফলে, আর ১০ শতাংশ ছিল কাজ হারানোর জন্য। বিজেপি শাসিত রাজ্যে অবস্থার আরও অবনতি হয় এই কারণে যে, সেখানে কর্মদিবস বাড়িয়ে ১২ ঘণ্টা করে দেওয়া হয়, আর আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, ওভারটাইম কাজের জন্য তাঁদের দেওয়া হয়নি বাড়তি এক কানাকড়িও।
খোয়া যাওয়া কাজ
সমীক্ষা দেখিয়েছে, শ্রমিকরা কোভিডের আগে যে কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন, সেখানে আবার বাধ্যতামূলকভাবে ফিরে গেছেন অনেকটা কম মজুরিতে। যাঁদের কাজ চলে যায়, তাঁরা স্বনিযুক্ত বিশাল ইনফর্মাল বাহিনীতে নাম লেখাতে বাধ্য হন। কাজ হারানো মহিলারা ফের ফিরে যান ঘরকন্নার কাজে।
সবচেয়ে মারাত্মক আঘাত নেমে আসে মহিলাদের উপর। ৪৭ শতাংশ মহিলা বরাবরের জন্য কাজ হারান, মাত্র ১৯ শতাংশ মহিলা কোনক্রমে তাঁদের আগের কাজে টিকে থাকতে পেরেছেন। এদিকে, ৬১ শতাংশ পুরুষ তাঁদের কাজ টিকিয়ে রাখতে পারেন আর ৭ শতাংশ কাজ হারান। পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের উপর কোভিডের অভিঘাত অত্যন্ত নির্দয়। আরেকটা বিষয় সমীক্ষা দেখিয়েছে যে কর্মরত মহিলাদের তুলনায় ঘরের কাজে আবদ্ধ মহিলারা অনেক বেশি সময় ব্যয় করতে বাধ্য হয়েছেন।
সমীক্ষা অনুযায়ী, ১৫ থেকে ২৪ বছরের শ্রমিকদের মধ্যে ৩৩ শতাংশ পর্যন্ত এবং ২৫ থেকে ৪৪ বছরের শ্রমিকদের মধ্যে ৬ শতাংশ ডিসেম্বর ২০২০ অবধি কোনো কাজ জোগাড় করতে পারেননি। কোভিডের প্রথম ধাক্কায় মহিলাদের পরেই অল্প বয়সী শ্রমিকরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন।
ফর্মাল থেকে ইনফর্মাল
প্রথম লকডাউনের পর অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও ইনফর্মাল কাজে যোগ দেওয়া ছাড়া শ্রমিকদের সামনে আর অন্য কোনো রাস্তা খোলা ছিল না। দেখা যাচ্ছে যে প্রায় অর্দ্ধেকের ও বেশি বেতনভুক ফর্মাল কাজের সাথে যুক্ত শ্রমিকরা বাধ্য হয়ে যুক্ত হন ঝুঁকিপূর্ণ ইনফর্মাল কাজের সাথে। এদের মধ্যে ৩০ শতাংশ স্বনিযুক্ত কাজে, ক্যাজুয়াল ও ইনফর্মাল কাজে যথাক্রমে ১০ এবং ৯ শতাংশ। আবার, এই কাজগুলোও জাতপাত ও ধর্মের ভিত্তিতে ভীষণভাবে বিভাজিত। দেখা গেল, হিন্দু ও সাধারণ বর্গের শ্রমিকরা স্বনিযুক্ত কাজের দিকে ঝুঁকেছেন, আর জাতপাতভিত্তিক প্রান্তিক শ্রমিক এবং মুসলমানেরা দৈনিক দিন মজুরের কাজে যোগ দিয়েছেন। এই সমীক্ষা একটা দৃষ্টি আকর্ষণকারী পর্যবেক্ষণ সামনে তুলে এনেছে। “কৃষি, নির্মাণ ও খুদে ব্যবসা হল এমনই ক্ষেত্র যেখানে কাজ হারানো মানুষগুলো ঠাঁই পেতে গেছে। শিক্ষা-স্বাস্থ্য-পেশাগত ক্ষেত্র থেকে সবচেয়ে বেশি মানুষ অন্যক্ষেত্রে সরে যেতে বাধ্য হয়েছেন। দেখা গেছে, শিক্ষাক্ষেত্র থেকে ১৮ শতাংশ মানুষ কৃষিক্ষেত্রে আর একই শতাংশ মানুষ স্বাস্থ্যক্ষেত্র থেকে কাজ হারিয়ে যোগ দিয়েছেন খুদে ব্যবসায়। হিন্দুদের বেলায় কৃষি হল এমন এক ক্ষেত্র যেখানে অন্যান্য ক্ষেত্র থেকে ১০-২০ শতাংশ শ্রমিক কাজে যোগ দেন। আর মুসলমানদের ক্ষেত্রে ব্যবসা হল সেই ক্ষেত্র যেখানে অন্যান্য পেশা থেকে ২০-৩৫ শতাংশ শ্রমিক যুক্ত হন।” ইনফর্মাল ক্ষেত্র ও নিম্নগামী আর্থিক অবস্থার দরুণ অতিমারির সময়ে শ্রমিকদের গড় আয় সংকুচিত হয় ১৭ শতাংশ। স্বনিযুক্ত ও ইনফর্মাল শ্রমিকদের উপার্জন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ক্রমবর্ধমান বৈষম্য ও অসাম্য
দেশের গরিব মানুষদের সবচেয়ে বেশি মূল্য চোকাতে হয়েছে। দরিদ্রতম ২০ শতাংশ মানুষ খুইয়েছেন তাঁদের সমস্ত সঞ্চয়। আর, আদানি-আম্বানিরা এই কোভিডকালে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে। প্রতি ঘণ্টায় আম্বানি কামায় ৯০ কোটি টাকা, আর আদানি এশিয়ায় দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ১৪নং স্থান দখল করে নেয়।
রিপোর্ট জানাচ্ছে, “এই অতিমারির সময়ে জাতীয় ন্যূনতম মজুরির (অনুপ সথপতি কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী যা দৈনিক ৩৭৫ টাকা) নীচে নেমে গেছে ২৩ কোটি মানুষ। এর অর্থ, নতুন করে দারিদ্রের কবলে এসেছেন গ্রামাঞ্চলের ১৫ শতাংশ আর শহরাঞ্চলে ২০ শতাংশ। অতিমারী গ্রাস না করলে, গ্রামাঞ্চলে ৫ শতাংশ ও শহরাঞ্চলে ১.৫ শতাংশ দারিদ্র হ্রাসপ্রাপ্ত হত ২০১৯-২০’র মধ্যে আর ৫ কোটি মানুষকে দারিদ্র সীমার নীচ থেকে উপরে টেনে তোলা যেত।”
সাধারণ মানুষ দিনে কম খেয়ে, নিত্যকার, জরুরি প্রয়োজন সামগ্রী কমিয়ে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছে এই অতিমারিকে। নিজেদের গচ্ছিত জিনিষপত্র বিক্রি করে, বন্ধু-আত্মীয় পরিজনের বা মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছেন।
সরকারী সাহায্যের মরীচিকা
প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ যোজনা বহুকিছুর প্রতিশ্রুতি দেয় – বিনামূল্যে রেশন, নগদ টাকা অ্যাকাউন্টে পাঠানো, মনরেগা, পিএম-কিষাণ পেমেন্ট, পেনশন প্রদান ইত্যাদি। আত্মনির্ভর ভারত প্রকল্পও ঘোষণা করেছিল, বিপন্ন পরিবারগুলোকে অতিমারীর আঘাত থেকে পরিত্রাণ দেওয়া হবে। কিন্তু, রাজস্থান ও কর্ণাটকের এক সমীক্ষা দেখিয়েছে যে যাদের কাছে রেশন কার্ড রয়েছে, তাঁদের মধ্যে মাত্র ৬৫ শতাংশ মানুষ স্বাভাবিকের তুলনায় কিছু মাত্রায় বেশি শস্য পেয়েছেন, কিন্তু ৩৫ শতাংশ পেয়েছেন আগের বরাদ্দই। জনধন অ্যাকাউন্ট রয়েছে এমন ৬০ শতাংশ মহিলা আর্থিক সাহায্য পেয়েছেন, কিন্তু ৩০ শতাংশ মহিলা সেখান থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত। আরও পরিতাপের বিষয় হল, ১০ শতাংশ মহিলা এই নগদ সাহায্যের ব্যাপারে বিন্দু-বিসর্গও জানেন না।
অতিমারির সময়ে গ্রামীম পরিবারগুলোর জন্য মনরেগার কাজটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সমীক্ষা দেখিয়েছে, নভেম্বর ২০২০ পর্যন্ত ২৫২ কোটি শ্রমদিবস সৃষ্টি হয়েছে, গত বছরের তুলনায় এই বৃদ্ধির হার ৪৩ শতাংশ। গত বছরের তুলনায় এক কোটি বেশি মানুষ এই প্রকল্পে কাজ করেছেন। তাও দেখা যাচ্ছে যে আরও বেশি মানুষের তরফ থেকে কাজের চাহিদা ছিল। মোট কর্মপ্রার্থীর মধ্যে ৫৫ শতাংশ গ্রামীণ জনসংখ্যা এই কাজ পেয়েছে। আর্থিক অনটনকে কিছুটা সামলাতে আরও বেশি কাজের চাহিদা থাকলেও তা পূরণ হয়নি।
কাজ খোয়ানোর পাশাপাশি পরিযায়ী শ্রমিকরা বিরাটভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। দেখা যাচ্ছে, লকডাউনের ফলে ৮১ শতাংশ পরিযায়ী শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন, পরিযায়ী নন এমন শ্রমিকরা কাজ হারিয়েছেন ৬৪ শতাংশ, ৩১ শতাংশ রেশন পাননি, আর ১৫ শতাংশ অপরিযায়ী পাননি রেশন।
সুপারিশ
এই সমীক্ষার ভিত্তিতে তারা যে সুপারিশ করেছেন, তার মূল মূল কয়েকটি এখানে দেওয়া হল।
১) এখনো পর্যন্ত সরকার মোট জিডিপির মাত্র ১.৫-১.৭ শতাংশ বরাদ্দ করেছে, যা খুবই নগন্য। কোভিডের পরবর্তী ঢেউ’র প্রকোপ আরও বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর তা কর্মক্ষেত্র, আয়, খাদ্য নিশ্চয়তা, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার উপর আরও প্রভাব ফেলবে। রাজ্য সরকারগুলো কোভিড পরিস্থিতিকে সামাল দিতে ইতিমধ্যেই আর্থিক সংকটের সম্মুখীন হয়েছে। তাই, এখন কেন্দ্রীয় সরকারকেই এগিয়ে এসে বাড়তি ব্যয় বরাদ্দ করতে হবে।
২) আমরা নিম্নোক্ত কয়েকটি জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ করছি।
এই সমস্ত পদক্ষেপগুলো একযোগে নিলে বাড়তি ১৫.৫ লক্ষ কোটি টাকা খরচ করতে হবে, যা কোভিড ত্রাণ প্রকল্পে আগামী দু’বছরের জন্য মোট জিডিপির ৪.৫ শতাংশ হবে। সংকটের যা ব্যাপকতা ও গভীরতা, তাতে এই অর্থ বরাদ্দ যুক্তিযুক্ত।
৩) এই আশু পদক্ষেপগুলো না নিলে নেমে আসা দুরাবস্থা বজায় থেকে যাবে, যা এতদিন পর্যন্ত আর্থিক ক্ষেত্রে যা যা অর্জিত হয়েছে, তার সবটাই লোপাট করে নেবে। বেড়ে চলা দারিদ্র, সঞ্চয়ে ধারাবাহিক ক্ষয়, এবং উৎপাদনশীলতার উৎসগুলো শুকিয়ে আসলে দারিদ্রের পাপচক্রে আবর্তিত হবে। পরিবারগুলোর আর্থিক টানাটানি পুষ্টিকর খাদ্য ও শিক্ষার ক্ষেত্রে বিস্তার লাভ করলে তার ফল হবে সুদুরপ্রসারি। শ্রমবাজার থেকে মহিলাদের ক্রমে ক্রমে সরে আসা আগামীদিনে বিরাট জেন্ডার ঘাটতির জন্ম দেবে। এই কর্মহীন বছরগুলো যুবকদের উপার্জন ও উৎপাদনশীলতার উপরও বিস্তর প্রভাব ফেলবে।
৪) জাতীয় স্তরে এক কর্মসংস্থান নীতির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। যে সমস্ত কর্মীরা এই সংকটের সময়ে ফ্রন্টলাইনে থেকে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন, এতোদিন পর্যন্ত তাঁদের ভূমিকার যে অবমূল্যায়ন করে আসা হয়েছে, তা এবার সংশোধন করার সময় এসেছে। নাছোড় ইনফর্মাল কর্মক্ষেত্রকে টিকিয়ে রাখা, অত্যন্ত অপর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ – এই সবকিছু বদলানো, অর্থনীতির পুনরুজ্জীবনে কাঠামোগত পরিবর্তন আনা খুব জরুরি। রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগকে বাড়ানো, সামাজিক পরিকাঠামোতে সরকারের পক্ষ থেকে অনেক বেশি বিনিয়োগ, শ্রমিকদের কল্যাণমূলক বোর্ডগুলোকে আরো মজবুত ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ অবলুপ্ত করা, মানুষের হাতে অর্থের জোগান বাড়ানো প্রভৃতি একগুচ্ছ সুপারিশ এই সমীক্ষা করেছে।
“আমরা আশা করব, দেশের সামনে আর্থিক পুনরুজ্জীবনের যে কঠিন চ্যালেঞ্জ সামনে রয়েছে, এই সুপারিশগুলো সেই কঠিন যাত্রাপথ অতিক্রম করতে সাহায্য করবে।
(সৌজন্য স্বীকার : ওয়ার্কার্স রেজিস্ট্যান্স, জুন সংখ্যা)
কিছুদিন আগে ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির এক গবেষণা সংস্থা জানিয়েছিল, বিশ্বে কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে প্রায় ৬৯ লক্ষ মানুষের, যে সংখ্যাটা সরকারী পরিসংখ্যানের দ্বিগুণেরও বেশি। ইন্সটিটিউট অব হেল্থ ম্যাট্রিক্স অ্যান্ড ভ্যালুয়েশন এমনটাই জানিয়েছিল। ভারতবর্ষেও মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যাটা যে অনেক বেশি সেই অনুমানকেই সত্যতা দিল যোগীরাজ্যের পরশ হাসপাতালের গত ২৬ এপ্রিলের ভয়ঙ্কর ঘটনা। মক ড্রিলের নাম করে অক্সিজেন বন্ধ করে অন্তত ২২ জন রোগীকে কার্যত হত্যা করার ঘটনাকেও প্রশাসন প্রথমে সাফাই দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। পরে চাপের মুখে তদন্ত শুরু হয়েছে। এমন বহু মৃত্যুর কোনো হিসেবই নেই।
শিশু অধিকার রক্ষা বিষয়ক জাতীয় কমিশনের রিপোর্ট বলছে-গত বছর এপ্রিল থেকে এ বছর ৫ জুন পর্যন্ত সারা দেশে ৩৬২১টি শিশু কোভিড-অনাথ হয়েছে। বাবা-মায়ের কোন একজনকে হারিয়েছে এমন শিশুর সংখ্যা ২৬০০০-এরও বেশি। এটা সরকারী পরিসংখ্যান। কার্যত সংখ্যাটা আরও অনেক বেশি হতে পারে। এই অনাথ শিশুদের দায়িত্ব হয়তো সরকার বা বেসরকারী স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা নেবে। কিন্তু বাবা-মায়ের আদর থেকে ওরা চিরবঞ্চিত থেকে যাবে।
লকডাউনে পেটের তাগিদে মুর্শিদাবাদ থেকে বিহারে কাজে গিয়েছিল একাদশ শ্রেণীর ছাত্র ইকবাল হোসেন। ঠিকাদারের দালাল বলেছিল, পাইপ বসানোর কাজ। কিন্তু নামানো হল নর্দমা পরিষ্কারের কাজে। অনভিজ্ঞ কিশোর বিষাক্ত গ্যাসে দমবন্ধ হয়ে আর উঠতে পারেনি। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। একই সঙ্গে মৃত্যু হয়েছে তার সঙ্গী আরেক তরুণের। অসুস্থ আরও অনেকে । মাত্র কিছু দিন আগে একই ভাবে মারা গেছেন আরও চারজন কলকাতায় নর্দমা পরিষ্কার করতে গিয়ে। এইসব মৃত্যু কি অনিবার্য ছিল?
মধ্য ত্রিশের শিক্ষক, সুস্থ দেহে ইলেকশন ডিউটি করতে গিয়েছিলেন। ফিরলেন সংক্রমণ নিয়ে। স্ত্রীও সংক্রমিত হলেন। দু-বছরের ছোট্ট সন্তানটিকে রেখে দুজনেই চলে গেলেন অক্সিজেনের অভাবে। এই শিশুর বাবা মায়ের স্নেহ-আদর থেকে চিরবঞ্চিত হয়ে হতভাগ্য জীবন কাটানোটা তো অনিবার্য ছিল না! রাস্তার ধারে রুটি সব্জির দোকান চালিয়ে মেয়েকে মনের মতো গড়ার স্বপ্ন দেখেছিল অনূর্ধ্ব চল্লিশের এক মা। সংক্রমিত হয়ে হাসপাতালে একটি বেডের অভাবে স্বপ্ন অপূর্ণ রেখে চলে যেতে হল তাকে। তার কবন্ধ সংসারটার কী হবে!
দ্বিতীয় ঢেউয়ের শুরুতেই অক্সিজেনের, ওষুধের, বেডের অভাবে গণচিতা জ্বলেছে। নদীর চরে গণকবর দিতে হয়েছে। গ্রাম কে গ্রাম উজাড় হয়ে গেছে সংক্রমণে। কারণ গ্রামীণ স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর অত্যন্ত করুণ অবস্থায় এই সংক্রমণ রোখা তথা মানুষকে সুস্থ করে তোলা সম্ভব নয়। মৃতদেহ নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই প্রতিটি মানুষের একটা নাম ছিল, ঘর ছিল, সংসার ছিল। পরিবারে পাড়ায় সমাজে কর্মস্থলে নানা সম্পর্কের বাঁধনে ছিলেন তারা। আর্থিক অবস্থা যেমনই হোক। কিন্তু সরকার নিজের অপদার্থতা ঢাকতে সংখ্যা গোপন করতে গিয়ে, শুধু যে তাদের মৃত্যুকে অস্বীকার করছে তই-ই নয়, অসম্মানও করেছে। তারা সকলেই ভারতবর্ষের মানুষ। এমন ভয়ঙ্কর কষ্টের অকালমৃত্যু, মৃতদেহের এমন নিষ্ঠুর পরিণতি তো প্রাপ্য ছিল না কারও! কেন হল? তাদের অপরাধ একটাই। এমন একটা সরকারের তদারকিতে থাকা যার হৈমালিক ঔদাসীন্যের কাছে, তীব্র অহমিকার কাছে, মূঢ় আত্মম্ভরিতা আর আত্মসন্তুষ্টির কাছে সাধারণ নাগরিকের ধন, প্রাণ, মর্যাদা-সব তুচ্ছ! অমর্ত্য সেন একেই ‘স্কিৎজোফ্রেনিয়া’ বলেছেন।
পঞ্চাশের (১৯৪৩-৪৪ সাল) মন্বন্তরে এই বাংলায় প্রাণ হারিয়েছিলেন ৩০ লক্ষ মানুষ স্রেফ না খেতে পেয়ে। তার কারণ কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয় নয়, ব্রিটিশ শাসকের নিষ্ঠুর বর্ণবিদ্বেষী ঔপনিবেশিক নীতি। সম্প্রতি এক ভারতীয় তথা বাঙালি গবেষক সরাসরি এই গণসংহারের জন্য তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল এবং তার সাঙ্গোপাঙ্গদের দায়ী করেছেন।
আজকের ভারতের এই অতিমারীজনিত গণসংহারের জন্য দায়ী অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনকভাবে, পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের একটি নির্বাচিত সরকারের চরম ঔদাসীন্য, ভ্রান্ত স্বাস্থ্য নীতি এবং অতিমারী পরিস্থিতি মোকাবিলায় সীমাহীন অপদার্থতা। গোটা বিশ্বেই মোদী সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় উঠেছে।
অতিমারী পরিস্থিতিতে কোভিড ছাড়াও অন্যান্য রোগে মানুষ অনেক ক্ষেত্রেই বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন। দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বেহাল অবস্থাটা সম্পূর্ণ বেআব্রু হয়ে পড়েছে।
লকডাউনে পরিযায়ী শ্রমিকরা কতজন পথেই ক্ষুধা ক্লান্তির চরম সীমায় পৌঁছে অসুস্থ হয়ে বা দুর্ঘটনায় মারা গেছেন সরকারের নির্মমতায়। কাজ হারিয়ে কঠোর দারিদ্র্যের নির্মম পেষণে অনাহারে মারা গেছেন অনেক মানুষ। নিরুপায় হয়ে আত্মঘাতী হয়েছেন কতজন। সে সব হিসেব কি সরকারের ঘরে আছে! তিনটি জনবিরোধী কৃষি আইনের বিরোধিতায় দীর্ঘদিন ধরে চলা কৃষক আন্দোলনে কতজন শহীদ হয়েছেন সে খবর রাখেন দাম্ভিক মোদী!
কেন্দ্রীয় সরকারের সাত বছরের অপশাসন সমাজ পরিসরেও এক অমানবিক বিদ্বেষপূর্ণ হিংস্র আবহ তৈরি করেছে যার বলি হয়েছে বহু প্রাণ-ভীড় হিংসায়, পিতৃতান্ত্রিক বর্বরতায়, জাতি ও বর্ণ বিদ্বেষে। সমাজ যেন ক্রমশ গরিব শ্রমজীবী মানুষের মৃত্যুতে নিস্পৃহ উদাসীন হয়ে যাচ্ছে। তাই পরের পর দুর্ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। অগ্নিকাণ্ডে, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে চলে গেল কত প্রাণ। বজ্রাঘাতে দু'দিনে তেত্রিশটি প্রাণ বলি হল।
এইসব মৃত্যুকে অসম্মান ও অস্বীকৃতি জানানোর ঔদ্ধত্যের বিরুদ্ধে প্রতিটি মৃত্যুকে স্মরণে রাখা, শ্রদ্ধা জানানোর উদ্দেশ্যে সমাজে বিভিন্ন পেশায় প্রতিষ্ঠিত মানুষেরা এক গণস্বাক্ষরিত আবেদনে জানিয়েছেন, মানবতা যখন সরকারের কাছে সংখ্যাগত পরিসংখ্যান মাত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন আমাদের নিজেদের মধ্যেকার মনুষ্যত্বকে জ্বালিয়ে তুলতে হবে। সরকার আমাদের হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনদের অস্তিত্ব ভুলিয়ে দিতে চাইছে। কিন্তু আমরা তাদের ভুলবো না! আমরা তাদের প্রত্যেককে শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় স্মরণ করব। প্রতিটি অঞ্চলে পাড়ায় মহল্লায় প্রতিটি মৃত্যুর হিসেব রাখতে, তাদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের সঙ্গে তাদের ব্যথা, কষ্ট ভাগ করে নিতে প্রতি রবিবার সন্ধ্যায় দীপ জ্বালিয়ে সমবেত বা ব্যক্তিগতভাবে স্মরণ অনুষ্ঠানের আহ্বান রেখেছেন।
প্রতিটি মোমবাতির আলোয় উৎসারিত হোক প্রয়াত প্রিয়জনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা আর দাম্ভিক সরকারের অমানবিক তার বিরুদ্ধে শাণিত প্রতিবাদ!
-- জয়ন্তী দাশগুপ্ত
দেশে দ্রুত সার্বজনীন গণ-টিকাকরণ সুনিশ্চিত করা এবং একে জাতীয় টিকা-নীতির মূল অভিমুখ করার জন্য প্রচারাভিযান সংগঠিত করবে সিপিআই(এমএল)। প্রধানমন্ত্রী গরিব অন্ন কল্যাণ যোজনায় মাথাপিছু পাঁচ কেজি চাল ও এক কেজি চানা-বুটের সাথে প্রয়োজন মতো ডাল, ভোজ্য তেল ও মশলা দিতে হবে।
কোভিড-১৯ দ্বিতীয় ঢেউ এবং অর্থনৈতিক মন্দার তান্ডবে দেশজুড়ে জনজীবনে এক বিপর্যয় নেমে এসেছে। মোদী সরকারের চরম অবহেলা ও অপদার্থতা, অস্বচ্ছ, স্বৈরাচারী ও অযৌক্তিক টিকানীতির ফলে এই অতিমারীতে ভারতই বিশ্বে সবচেয়ে বেশি বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে এবং হচ্ছে। পবিত্র গঙ্গা শববাহিনী গঙ্গায় পরিণত হয়েছে। এর বিরুদ্ধে সারা দেশে জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ছেন। এমতাবস্থায় দেশের শীর্ষ আদালত এই অযৌক্তিক, স্বৈরাচারী টিকা-নীতির জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে তীব্র ভৎসনা করে কঠোর অভিযোগে অভিযুক্ত করেছে। জবাবদিহি করতে সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে। আর তাই চাপে পড়ে সাত দিনের মধ্যে জাতীয় টিকানীতি বদলাতে বাধ্য হয়েছে মোদী সরকার। এরজন্য দেশের সর্বোচ্চ আদালতকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছেন দেশবাসী।
গত সাত জুন প্রধানমন্ত্রী মূলত তিনটি ঘোষণা করেছেন এবং ত্রিশ মিনিট ভাষণ দিয়েছেন। (ক) একুশে জুন থেকে কেন্দ্র পচাত্তর শতাংশ টিকা কিনে রাজ্য সরকারগুলিকে সরবরাহ করবে এবং ১৮-৪৪ বছর পর্যন্ত সবার জন্য মুক্ত টিকাকরন সুনিশ্চিত করবে। (খ) পঁচিশ শতাংশ টিকা উৎপাদক সংস্থার কাছ থেকে বেসরকারী হাসপাতাল সংগ্রহ করতে পারবে এবং প্রতি ডোজ টিকার দামের বাইরে সর্বোচ্চ ১৫০ টাকার বেশি সার্ভিস চার্জ নিতে পারবেনা। (গ) আগামী নভেম্বর মাস অর্থাৎ দিপাবলী উৎসব পর্যন্ত গরিবদের বিনামূল্যে খাদ্যশষ্য সরবরাহ অব্যাহত রাখা হবে।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী এরমধ্যে কিছু নির্দিষ্ট ইস্যু এখনো গোপন ও বিমুর্ত হিসাবে রেখে দিয়েছেন। যেমন কোভিডে মৃত্যুর তথ্যের সংখ্যা এড়িয়ে শতাংশের হিসাব তুলে ধরেছেন। এখানে তিনি এই সত্যিটাই গোপন করেছেন যে, গত পাঁচ মাসে ৪% ভারতবাসীকে টিকাকরণ করা যায়নি। এক্ষেত্রে বেসরকারী দরজা বেশি করে রাজ্যে রাজ্যে উন্মুক্ত করা হয়েছে। যারফলে কোভিড চিকিৎসা, অক্সিজেন ও টিকাদান নিয়ে দেশবাসী বেশি করে লুটতরাজের শিকার হয়েছেন। সরকারী ব্যবস্থা লাটে উঠেছে। তাই বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের উপর নূন্যতম নির্ভরতা ত্যাগ করতে হবে। একটি যুক্তিপূর্ণ টিকা-নীতি তৈরি করা এবং জোরালোভাবে একে বাস্তবায়ন করার জন্য মোদী সরকার এখনো পর্যন্ত দেশবাসীর মধ্যে কোন আত্মবিশ্বাস জাগ্রত করতে পারেনি।
আমরা এখনো পর্যন্ত জানিনা গুজরাট কেন তামিলনাড়ু থেকে বেশি ভ্যাক্সিন পায়। কিসের ভিত্তিতে রাজ্যগুলিকে টিকা সরবরাহ করা হয়ে থাকে। গত আট জুন টিকা প্রদানের গাইডলাইন প্রকাশিত হয়েছে। রাজ্যের জনসংখ্যা, রোগের প্রাদুর্ভাব এবং ভ্যাক্সিন প্রদান কর্মসূচীর প্রবণতার ভিত্তিতে বন্টন করা হবে ভ্যাক্সিন। এখানে সময়ের দাবি অনুসারে সবচেয়ে কম সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় টিকাকরণ করার নীতি গ্রহণ করা হয়নি। রাজ্যগুলিকে দাবিয়ে রাখার, খুশীমতো যেকোন অজুহাতে বঞ্চিত করার কৌশল চতুরভাবে হাতে রাখা হয়েছে। রাজ্যগুলিকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে টিকার দাবি উপস্থাপিত করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সরাসরি টিকা সরবরাহ করার জন্য নীতি গ্রহণ করা হয়নি। ডিজিটাল রেজিস্ট্রেশন করা বাধ্যতামূলক। কিন্তু কোনভাবেই তা স্বচ্ছ নয়। কাজেই দ্রুত সার্বজনীন গণ-টিকাকরণ সুনিশ্চিত করার জন্য দেশব্যাপী প্রচারাভিযান সংগঠিত করবে সিপিআই(এমএল)। এটাই সময়ের দাবি। মোদীর টিকা-নীতি ও ভাষণ এই দিশা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ অন্ন যোজনা আগামী দীপাবলী উৎসব পর্যন্ত অব্যাহত রাখার বড় কথা বাস্তবে কতটা সত্য। পিএমজিকেএওয়াই-এর অর্থ মাথাপিছু পাঁচ কেজি চাল বা আটার সাথে এক কেজি চানাবুট (যা বেশিরভাগ সময়ে সরবরাহ করা হয় না) রেশনে গরিবদের জন্য বরাদ্দ করা। আমাদের রাজ্যে সবার জন্য এক কেজি করে ডাল বরাদ্দ অনিয়মিত ও কার্যত বন্ধ অবস্থায় আছে। বাস্তবে পাঁচ কেজি করে মাথাপিছু চাল বা আটা দেওয়া হয় মাত্র। আমরা কি একে গরিবদের সমগ্র খাদ্য নিরাপত্তা দেওয়ার কথা বলতে পারি? প্রয়োজনমতো ডাল, ভোজ্য তেল ও মশলা ছাড়া তা কি করে সম্ভব। তাছাড়া মাথাপিছু পাঁচ কেজি চাল বা আটা যথেষ্ট নয়। তাই মাথাপিছু পাঁচ কেজির পরিবর্তে দশ কেজি করে চাল বা আটা এবং এরসাথে প্রয়োজন মতো ডাল, ভোজ্যতেল ও মশলা সরবরাহ করতে হবে। এই দাবিতে প্রচারাভিযান সংগঠিত করবে সিপিআই(এমএল), ত্রিপুরা রাজ্য কমিটি।
পার্থ কর্মকার,
রাজ্য সম্পাদক, সিপিআই(এমএল), ত্রিপুরা রাজ্য কমিটি,
৯ জুন ২০২১
গত ৪ জুন ধর্মদায় শহীদ কমরেড বাণীব্রত বসুর প্রয়াণ দিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করা হয়। ধর্মদা বাজার ও হাইস্কুলের পার্শ্ববর্তী বাণীব্রত বসুর বাসস্থানের লাগোয়া একটি জায়গা সম্প্রতি পার্টির নামে আইনসঙ্গত স্বীকৃতি পাওয়া গেছে। সেখানে শহীদ বেদীতে মাল্যদান ও লাল পতাকা তুলে প্রয়াত পার্টি নেতা কমরেড সুবোধ মজুমদারকেও স্মরণ করা হয়। উপরোক্ত কর্মসূচীগুলিতে অংশগ্রহণ করেন পার্টি, কৃষক ও কৃষি মজুর সংগঠনের নেতৃবৃন্দ কৃষ্ণ প্রামানিক, কাজল দত্তগুপ্ত, অনিমা মজুমদার, ইয়াদ আলি, বিকাশ মন্ডল, জয়কৃষ্ণ পোদ্দার, রাজীবুদ্দিন মন্ডল ও সন্তু ভট্টাচার্য্য সহ অন্যান্যরা। চাকদার কর্মসূচীতে ছিলেন লিটন কর্মকার, বিজয় সাহা, মল্লার মৈত্র প্রমূখ।