দিল্লীর কৃষক আন্দোলন কৃষকের জমি ও জীবন-জীবিকার অধিকার রক্ষায় বড় মাত্রায় জয় ছিনিয়ে এনেছে। একই সাথে সেটা ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের শক্তিশালী প্রতিরোধ রূপে সামনে এসেছে। পাঞ্জাব হরিয়ানার কৃষকরা দীর্ঘদিন ধরেই ফসলের এমএসপি বা ন্যূনতম সহায়ক মূল্য পেয়ে থাকে। নয়া কৃষি আইনের মাধ্যমে সেই ব্যবস্থা তুলে দিয়ে কৃষিজীবী মানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে নেওয়ার চক্রান্ত কিষাণ আন্দোলন রুখে দিয়েছে। সারাদেশে কৃষক আন্দোলনের ময়দানে জন্ম নিয়েছে নতুন উদ্দীপনা, একতা। কিন্তু এমএসপি গ্যারান্টি আইন চালু করার দাবি পূরণ হয়নি। এর ফল ভুগতে হচ্ছে বিভিন্ন রাজ্যের কৃষকদের। ফসলের অভাবী বিক্রি যেন তাদের ভবিতব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের কৃষকরা ত্রিমুখী কৃষি-সংকটের মধ্যে রয়েছেন। ধানের সরকারি দর থেকে তারা বঞ্চিত। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ফসলের ক্ষতিপূরণ তারা পায়নি। অপরদিকে সার-বীজের কালোবাজারি মজুতদারী পরবর্তী চাষের খরচ বিপূল পরিমাণে বাড়িয়ে দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সারা ভারত কিষাণ মহাসভা ও আয়ারলা’র পক্ষ থেকে বিভিন্ন জেলার ব্লকে ব্লকে প্রচার ও বিক্ষোভ ডেপুটেশনের কর্মসূচি সংগঠিত হয়। গত ১৫ ডিসেম্বর পালিত হয় প্রতিবাদ দিবস।
হুগলী জেলায় পান্ডুয়া কৃষি দপ্তরে বিক্ষোভ ডেপুটেশন কর্মসূচি সংগঠিত হয়। কৃষিঋণ মকুবের দাবিতে সমস্ত কৃষক সমাজকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানানো হয়। উপস্থিত এআইকেএম নেতা মুকুল কুমার বলেন, পরপর নিম্নচাপ ও অসময়ে বৃষ্টির কারণে দক্ষিণবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকায় কৃষিক্ষেত্রে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে এসেছে। হুগলী ও বর্ধমান জেলায় আলু চাষের অপরিসীম ক্ষতি হয়েছে। নানাভাবে ঋণ করে, শেষ বৃষ্টির আগে চাষিরা সার কিনতে গিয়ে নাস্তানাবুদ হয়েছেন। সারের যোগান কম থাকায় অস্বাভাবিক বেশি দরে সার কিনতে হয়েছে। এক শ্রেণীর ব্যবসাদার চড়া দামে সার বিক্রির সাথে সাথে, সুযোগ বুঝে চাষির ইচ্ছার বিরুদ্ধে অন্য অপ্রয়োজনীয় জিনিসও গছিয়ে দিয়েছেন। বহু কষ্ট করে চাষিরা জমিতে যে আলু পুঁতেছিলেন, বৃষ্টিতে সে সবই ষোলো আনা নষ্ট হয়ে গেছে। নতুন করে আবার চাষ করার মতো চাষির সম্বল কোথায়? ঘরের বীজ, কেনা বীজ সবই তো শেষ। আলুবীজের জন্য হাহাকার পড়ে গেছে। এত ক্ষতি পূরণ হবে কীভাবে? যাঁরা সমবায় বা ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে চাষ করেছিলেন তাঁরা শস্যবীমার আওতায় হয়ত কিছু ক্ষতিপূরণ পাবেন। কিন্তু সেতো বীমা-রাশির ২৫ শতাংশ মাত্র। আর ওই টাকা পেতেও কত সময় লাগবে কে জানে! দেনা শোধ করতে না পেরে কৃষকদের পথে বসতে হবে। এই বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার একটাই উপায়। সর্বত্র কৃষকদের একজোট হয়ে বলতে হবে সমস্ত কৃষিঋণ মকুব কর।
শুধু তো আলু নয়। ধানেরও ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু আইন বলছে, ধানচাষে ৭০ শতাংশ কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত না হওয়ায় বাকিদের কোনও ক্ষতিপূরণ মিলবে না। এই তুঘলকি আইন বদলাতে হবে, ক্ষতিগ্রস্ত ধানচাষিদেরও উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ঋণের দায়ে কৃষক আর আত্মহত্যা করবেনা। সমস্ত কষিঋণ মকুব এবং আলু ও ধান সহ সব ফসলের ক্ষতিপূরণের দাবিতে ছোট-বড় সমস্ত কৃষককে একতাবদ্ধ হয়ে গড়ে তুলতে হবে আন্দোলন।
বাঁকুড়া জেলার ওন্দায় বিডিও, বিএলএলআরও এবং এডিও’কে ডেপুটেশন জমা দেওয়া হয়। দাবি তোলা হয়, জমিতে দীর্ঘদিন ধরে বসবাসকারী আদিবাদী ও অন্যান্য বনবাসী মানুষের পাট্টা দিতে হবে ও পাট্টা রেকর্ড করতে হবে।
দীর্ঘদিন ধরে পাট্টা পাওয়া সত্ত্বেও আজও পরচা না পাওয়ার ফলে গরিব আদিবাসীরা সরকারি সাহায্য থেকে বঞ্চিত। তাই দ্রুত পরচার ব্যবস্থা করতে হবে। অকাল বৃষ্টিজনিত কারণে ধান, আলু সহ অন্যান্য ফসলের যে ক্ষতি হয়েছে, তার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে সরকারকে। গ্রামে গ্রামে ক্যাম্প করে ১,৯৬০ টাকা দরে ভাগচাষি, লিজচাষিদের থেকেও ধান কিনতে হবে। ওন্দা ব্লকের সান্তোর থেকে নিকুঞ্জপুর হয়ে মাঝডিহা পর্যন্ত দ্বারকেশ্বর নদীতে বেআইনিভাবে বালি তোলার ফলে যে ব্যাপক চড়া তৈরি হয়েছে তার দরুণ নদীর গতিপথ ঘুরে যেতে বসেছে। এই ক্ষতির দ্বারা প্রভাবিত হবে ১৫টির অধিক গ্রাম। দ্রুত মাস্টার প্ল্যান তৈরি করে এই ভাঙন রোধ করতে হবে। ওন্দা ব্লকের কল্যাণী অঞ্চল ও নিকুঞ্জপুর, এলাটি মৌজাতে পাকা রাস্তা তৈরি করতে হবে। এই কর্মসূচির নেতৃত্বে ছিলেন বৈদনাথ চীনা, আদিত্য ধবল ও রবিদাস মুর্ম্মু।
নদীয়া জেলার নাকাশীপাড়া, ধুবুলিয়া ও চাপড়া ব্লকে বিক্ষোভ কর্মসূচি সংগঠিত হয়। অংশগ্রহণ করেন এআইকেএম নেতা ধনঞ্জয় গাঙ্গুলি, কৃষ্ণ প্রামানিক, ইনসান সেখ, সেলিম সেখ, জয়তু দেশমুখ প্রমূখ। নেতৃবৃন্দ বলেন, এরাজ্যের তৃণমূল সরকার ধান উৎপাদনের তিন বা চারভাগের একভাগ কেনার কথা বলে থাকে। কাগজে কলমে কেনা হয়। কিন্তু গরিব মাঝারি চাষিরা সেই দর পায় না। বর্তমানে কোনও কোনও মহল থেকে এমএসপি তুলে দেওয়ার ওকালতি করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, ধানের বাজারদরে যদি কোনও প্রভাব না পড়ে তাহলে এমএসপি’র পরিমাণ বাড়িয়ে লাভ কি? কিন্তু এটা বাস্তব সত্য যে আংশিকভাবে হলেও এমএসপি’র একটা উপযোগিতা রয়েছে। সরকার নির্ধারিত দর থাকলে চাষিদের ফসল বিক্রির দাম একেবারে নীচে নেমে যায় না। এমএসপি আছে এবং নেই এমন কৃষিপণ্যর দামের তুলনামূলক বিচার করলে দেখা যায় ধানের সরকারি দর ঘোষিত বলেই বাজার দর একেবারে কম হয়ে যায় না। অথচ আলু বা অন্য সবজির ক্ষেত্রে দেখা যায় উৎপাদক দাম পাচ্ছে কিলো পিছু ২ টাকা। আর বাজারে ১০ গুণ দামে সেটা বিক্রি হচ্ছে। নদীয়ার ধুবুলিয়ায় বিক্ষোভ ডেপুটেশনে দেখা গেল তৃণমূলের রাজত্বে প্রশাসনিক নির্দেশিকা নয়, শেষকথা বলে কায়েমী স্বার্থান্বেষী দলতন্ত্র! পড়ে পড়ে মার খায় ভুক্তভোগী গরিব মানুষ। যেমন কৃষ্ণনগর ২নং (ধুবুলিয়া) ব্লকের বিডিও জানালেন, গ্রামে ক্যাম্প করে ধান কেনার অর্ডার তিনি করেছিলেন, কিন্তু সেটা ফুড ডিপার্টমেন্ট এবং অন্যান্যরা নাকচ করে দেয়। একদা দলীয় ধামাধরা অধুনা ‘অপমানিত’ এই আমলার ইঙ্গিত শাসকদলের বিধায়ক মন্ত্রী ও তার গোষ্ঠীর দিকে। আমন ধানের এই মরসুমে আড়তদার-ব্যবসায়ীরা যে চাষির থেকে কম দামে ধান কিনে মুনাফার যে অবৈধ কারবার চালাচ্ছে, তার মদতদাতা কারা — এ ঘটনায় সেটা স্পষ্ট হয়ে উঠলো।
বিডিও দপ্তরে বিক্ষোভ ডেপুটেশনে যাওয়া কিষাণ মহাসভা ও আয়ারলা’র প্রতিনিধিরা জানালেন, এবার খাদ্য দপ্তরের বিরুদ্ধে কৃষকরা আন্দোলনে নামবে। গ্রামে গ্রামে ক্যাম্প করে ধান কেনার দাবিতে, মধ্যস্বত্বভোগী দালাল চক্রের ফাটকাবাজির বিরুদ্ধে। এরপর জানা গেল ব্লকের ধান উৎপাদনের বড় একটা গ্রাম পঞ্চায়েতে নথিভুক্তির কাজ নাকি শুরু হয়েছে। বিডিও অফিসের গেটে তখন শুরু হয়েছে তুমুল বিক্ষোভ। এবছর এলাকায় একশো দিনের কাজ হয়েছে মাত্র ৬ দিন। অথচ জানা গেল টাকার নাকি কোনও অভাব নেই। এ যেন আর এক ‘পাইপলাইন’! দুর্নীতির চক্রে চালান হয়ে যাচ্ছে গ্রামীণ মজুরের প্রাপ্য টাকা। বিক্ষোভসভা থেকে পঞ্চায়েতের ঘুঘুর বাসার বিরুদ্ধে আন্দোলনের আহ্বান জানালেন নওপাড়া এলাকার নেতা আনসারুল হক। এছাড়াও বক্তব্য রাখেন ঠান্ডু সেখ, সন্তু ভট্টাচার্য, কলম বিশ্বাস প্রমুখ। নাকাশিপাড়া ব্লক উন্নয়ন আধিকারিককে সরাসরি ডেপুটেশন দেওয়া হয়। ভাগচাষি লিজ চাষিদের ক্ষতিপূরণ ও ধান বিক্রি করার অধিকার নিয়ে তিনি একমত হন, এব্যাপারে দু’একজনের আবেদন গ্রহণ করতে পারেন কিন্তু ব্যাপকভাবে করা সম্ভব নয় বলে জানান। সহায়ক মূল্যে ধান কেনার ব্যাপারে কারা দুর্নীতি করছে, তার তথ্য জানতে চান। তখন দুয়ারে ধান কেনার দাবি জানানো হয়। তিনি বলেন এটা সরকারের পলিসি। তিনি কিছু করতে পারবেন না। বিএলআরও দপ্তরে দুর্নীতির কথা তিনি শুনেছেন এবং তা নিয়ে তার পক্ষ থেকে যেটা করার তিনি করবেন। এমজিএনআরইজিএ প্রকল্পে এক-দেড় বছর ধরে অনেকেই টাকা পাচ্ছেন না স্বীকার করেন। কিন্তু তাঁর বক্তব্য উপরের থেকে টাকা না আসলে তারা কিছু করতে পারছেন না। যে সমস্ত কৃষি মজুররা ১০০ দিনের প্রকল্পের কাজ করতে চান তাদের আবেদন অঞ্চল গ্রহণ না করলে ব্লক করবে, ৪ক আবেদন করলে কাজ পাওয়া যাবে। রাজীব উদ্দিন মন্ডল, কমরেড ইয়াদ আলি শেখ সহ মোট পাঁচজন ডেপুটেশনে অংশগ্রহণ করেন। স্থানীয় বেথুয়াডহরী হাট এলাকায়, স্ট্যাচুর মোড়ে, কৃষি আধিকারিকের দপ্তরের সামনে, বিডিও দপ্তরের সামনে বিএলআরও দপ্তরের সামনে বক্তব্য রাখা, লিফলেট বিলি করা হয়। চাপড়া ব্লকের লাগোয়া কয়েকটি গ্রামে এবং ব্লকের সামনে বিক্ষোভসভা সংগঠিত হয়।
সম্পন্ন হয়েছে কলকাতা কর্পোরেশন নির্বাচন।
কেন্দ্রে বিরোধী দল, এরাজ্যে শাসকদল এবং কলকাতা কর্পোরেশন পুনরায় ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল। কেন্দ্রে শাসক, আর রাজ্যে বিরোধী দল ফ্যাসিবাদী বিজেপি।কেন্দ্র থেকে রাজ্যে বিরোধী দল অবস্থায় বিরাজমান দক্ষিণপন্থী কংগ্রেস। পক্ষান্তরে, বামপন্থীরা এরাজ্যের সর্বস্তরে বিরোধী শক্তি। মূলত এহেন বিন্যাসের পরিস্থিতিতে হল কলকাতার পৌর নির্বাচন।
দীর্ঘ বিলম্বিত কলকাতা কর্পোরেশন নির্বাচনে শাসক দল যে ক্ষমতায় ফের ফিরবে এটা প্রায় সব মহলেই মোটামুটি হিসাব ছিল। কিন্তু যেভাবে পেশীশক্তি ফলিয়ে গরিষ্ঠতার রেকর্ড করতে প্রমত্ত হল সেটা অবাধ নির্বাচন করতে যথেষ্ট শঙ্কায় থাকার প্রমাণ দিল। আধিপত্য কায়েম হয়েছে বটে, কিন্তু এ জয় কলঙ্কমুক্ত নয়। তৃণমূল ফের চলতে শুরু করেছে ২০১৫-র পৌর নির্বাচনের ঘরানাতেই। ক্ষমতার শুধু দখলদার হয়ে থাকলেই চলছে না, প্রতিটি ওয়ার্ড ভিত্তিক নির্বাচনকে পরিণত করতে হবে বিশাল সংখ্যার ব্যবধানে ও বিরোধীশূন্য একচেটিয়া দখলদারিতে। এটাই এখন রাজ্য রাজনীতিতে তৃণমূলের দস্তুর। আর এটা আড়াল করতে একে তৃণমূল চিত্রিত করছে ‘জনগণের উৎসব’। যদি অবাধ নির্বাচন হোত তাহলে নিশ্চিত নাগরিক ক্ষোভ যতটা তার বিরুদ্ধে যাওয়ার তার প্রতিফলন অবশ্যই দেখা যেত। দুর্নীতি-দলতন্ত্র আর চরম দুর্ভোগ, অবহেলা ও গাফিলতির শিকার হওয়া এমন অনেক তিক্ত ইস্যু রয়েছে, যা নিয়ে পুরবাসী জনতার এক উল্লেখযোগ্য অংশের গত বিধানসভা নির্বাচনের সময় তত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেনি, কারণ তখন সামনে ছিল রাজ্য বেদখল হয়ে যাওয়ার সবচেয়ে বড় বিপদ বিজেপি। কিন্তু পৌর নির্বাচনে বিজেপি ছিল না দখলদারের বিপদ ঘনিয়ে নিয়ে আসার অবস্থায়। এই অবস্থায় তৃণমূলকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার বহিঃপ্রকাশ ঘটার সম্ভাবনা ছিল। সেই চাপা অসন্তোষের প্রকাশ দাবিয়ে রাখতেই তৃণমূল ফের সন্ত্রাসের আশ্রয় নিল। এটা করল শাসকের ঔদ্ধত্য থেকে তো বটেই, আরও এই উদ্দেশ্যে যে, বিধানসভা নির্বাচনে আসনসংখ্যায় এবং প্রাপ্ত ভোট শতাংশে যে মাত্রায় তার সাফল্য এসেছে, সাত মাসের ব্যবধানে সেই তুলনায় যাতে অবনমন উন্মোচিত হতে না পারে। এই উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে থাকতে লোকদেখানো ‘অনুশাসনের’ কসরৎ প্রদর্শন শুরু করে দেওয়া হয়। আর নির্বাচন চুকে যাওয়ার পর যথারীতি দলনেত্রী ও দল চালানোর ক্ষমতায় উঠে আসা ‘পোস্টার বয়’ মায় পারিষদবর্গ মাতলেন স্বৈর উল্লাসে, বিরোধী মতপ্রকাশের অধিকার প্রসঙ্গে করতে লাগলেন কুৎসিত কদর্য ঠাট্টা, মশকরা, উপহাস। এইভাবে নির্বাচনী গণতন্ত্রকে পরিণত করা হল এক বিচিত্র প্রহসনে।
কলকাতা কর্পোরেশন নির্বাচনে দ্বিতীয় যে পরিঘটনা নজর কেড়েছে তা হল বিজেপি মোটেই হাওয়া তুলতে পারেনি, ব্যর্থই হয়েছে। এটা বিশেষ করে বাম ও গণতান্ত্রিক, উদারনৈতিক ও প্রগতিবাদী ভাবধারার জনমানসের কাছে খুশীর খবর। বিধানসভা নির্বাচনে ধাক্কা খাওয়ার পরে এবার মহানগরের পৌর নির্বাচনে তার ভোট শতাংশ কমেছে বেশ লক্ষ্যণীয় মাত্রায়। এরাজ্যে লোকে এখন ‘বিধানসভায় প্রধান বিরোধীপক্ষ’ হয়ে থাকা কর্পোরেটমুখী সাম্প্রদায়িক দলটিকে প্রত্যক্ষ করছে রোজকার অন্তর্দ্বন্দ্বে জর্জরিত ছন্নছাড়া পায়ের তলায় মাটি সরে যাওয়া, শুকিয়ে যেতে শুরু করেছে। এই পরিণতি যত বেশি হয় ততই ভালো। কিন্তু এটা বিজেপির নিজের পায়ে নিজে কুড়ুল মারার অপেক্ষায় ফেলে রাখলে চলবে না। আপনা আপনি খেয়োখেয়িতে দুর্বল হয়ে শেষ হয়ে যাবে তা ভাবলে চলবে না। কলকাতাই পশ্চিমবঙ্গ নয়, সামনে প্রচুর পৌর নির্বাচন আছে। সেই লড়াইয়ে বিজেপিকে পর্যুদস্ত করার চ্যালেঞ্জ জারি রাখতে হবে।
আর এই লড়াইয়ে সমস্ত দ্বিধাদ্বন্দ্ব হীনমন্যতা ঝেড়ে ফেলে সবচেয়ে সৎ নীতিনিষ্ঠ কার্যকরি বুদ্ধিদীপ্ত প্রত্যয়ী ভূমিকায় নামতে হবে বামপন্থীদের। কলকাতা পৌর নির্বাচনে বিজেপির ভোট শতাংশ কমা আর বামেদের ভোট শতাংশ কিছুটা পুনরুদ্ধার হওয়া, বিজেপিকে পিছনে ফেলে বামেদের উঠে আসা — এই আঁকবাঁক মোড় পরিবর্তন অবশ্যই স্বাগত জানানোর। কিন্তু এ থেকে এখনই ধরে নেওয়া সঙ্গত হবেনা যে, বিজেপির শেষের, আর বিপরীতে বামেদের ঘুরে দাঁড়ানো শুরু হয়ে গেছে। বরং এই পরস্পর বিপরীত প্রবাহকে লাগাতার ত্বরান্বিত করতে মানুষের সাথে থেকে জনমনে আস্থা অর্জনের অগ্নিপরীক্ষা দিয়ে চলতে হবে। সেটা সম্ভব রাস্তায় থাকতে পারলে। নাগরিক জীবনের ইস্যু নিয়ে, জাতীয় ও রাজ্য রাজনীতি নিয়ে।
কর্পোরেট স্বার্থবাহী কৃষি আইন প্রত্যাহারের প্রশ্নে নতিস্বীকার করতে বাধ্য হলেও মোদী সরকার এখন অন্য আরেকটি বুনিয়াদি ক্ষেত্র, ব্যাঙ্ক ব্যবস্থার, জাতীয়করণের ধারাকে উল্টে দেওয়ার আগ্রাসী উদ্যোগে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের ঐতিহাসিক পদক্ষেপের পাঁচ দশক পর এখন সরকারি ব্যাঙ্কে সরকারের ন্যূনতম ৫১ শতাংশ মালিকানাকে ২৬ শতাংশে নামিয়ে আনার মরিয়া প্রচেষ্টা শুরু করেছে। এছাড়া নির্দিষ্ট কয়েকটি সরকারি ব্যাঙ্ককে সরাসরি বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার উদ্যোগ তো আছেই। সরকার অবশ্য ভালো করেই বোঝে যে এই পাঁচ দশকে সরকারি ব্যাঙ্কগুলি নিরাপদ ও সুস্থায়ি হিসেবে সুনাম অর্জন করেছে আর বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবেই জনমানসে প্রতিভাত হয়। বেসরকারিকরণের আগে তাই সরকার “আমানতকারির অগ্রাধিকার”-এর নতুন বুলি আওড়াতে শুরু করেছে, আমানতকারিদের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে যে ব্যাঙ্ক ফেল করলে নব্বই দিনের মধ্যে ৫ লাখ টাকা (সর্বশেষ ১৯৯৩ সালে যা বেড়ে ১ লাখ টাকা হয়েছিল) ফেরত পাওয়া যাবে।
ব্যাঙ্কে সর্বমোট জমার পরিমাণ ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের বিগত পাঁচ দশকে ধারাবাহিকভাবে এবং সাম্প্রতিক কয়েক বছরে দ্রুত হারে বেড়েছে। গত এক দশকে জমার পরিমাণ তিনগুণ হয়েছে, ২০১১-র ফেব্রুয়ারিতে ছিল ৫০ ট্রিলিয়ন, ২০১৬-র সেপ্টেম্বরে হয় ১০০ ট্রিলিয়ন এবং ২০২১-এর মার্চ মাসে এসে তা দাঁড়ায় ১৫০ ট্রিলিয়ন। বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলিকে ক্রমবর্ধমান হারে তোল্লাই দেওয়া সত্ত্বেও ভারতের সর্বমোট আমানতের তিন ভাগের দুই ভাগই জমা আছে সরকারি ব্যাঙ্কগুলিতে। বিমুদ্রাকরণ কালো টাকার ওপর কোনও প্রভাব ফেলতে পারেনি, কিন্তু আরও বেশি সংখ্যক মানুষকে ব্যাঙ্কমুখী হতে বাধ্য করেছিল এবং ডিজিটাল লেনদেনের বৃদ্ধিও সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাঙ্কিং বেড়ে যাওয়ার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে। ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণ করার প্রথম উদ্দেশ্য হল জনসাধারণের সঞ্চয়ের মধ্যে দিয়ে গড়ে ওঠা এই বিপুল আর্থিক সম্পদের ওপর প্রাইভেট কোম্পানিগুলির প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা।
ব্যাঙ্ক শিল্পে ঘনীভূত সংকটের সমাধান হিসেবে ব্যাঙ্ককে বেসরকারিকরণের দিকে ঠেলে দেওয়ার উদ্যোগ হাজির করা হচ্ছে। অথচ এই সংকটের সবচেয়ে বড় কারণ তো যাকে বলে এনপিএ বা নন পারফর্মিং অ্যাসেট। ব্যাঙ্ক ঋণ দেয় একথা ধরে নিয়েই যে কিছু ক্ষেত্রে ফেরত না পাওয়ার ঝুঁকি থাকবেই। কিন্তু, ব্যবসা ও রাজনীতির আঁতাত ও স্যাঙাতি পুঁজির স্বার্থরক্ষার বাধ্যবাধকতায় ব্যাঙ্ক পরিচালনার ন্যূনতম বিচক্ষণতা জলাঞ্জলি দেওয়ার আগে পর্যন্ত ব্যাঙ্ক শিল্পের অন্তর্গত এই অবশ্যম্ভাবি ঝুঁকি এরকম এনপিএ-সংকটের মাত্রায় কোনদিন পৌঁছয়নি। ব্যাঙ্ক পরিচালনার নিয়মনীতির উদারিকরণ এই অস্থিরতাকে বাড়িয়ে দিয়েছে, ইচ্ছে করে ডিফল্টার হওয়া পুঁজিপতিদের ঢালাও ছাড় দেওয়া পরিস্থিতিকে আরও সঙ্গীণ করে তুলেছে।
সংকট কতটা গভীর তা এই সংখ্যাগুলি থেকে সহজেই বোঝা যেতে পারে : ১১,৬৮,০৯৫ কোটি টাকা বা প্রায় ১১.৭ ট্রিলিয়ন টাকা মূল্যের খারাপ ঋণ গত দশ বছরে মকুব লিখে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে যার মধ্যে ১০.৭ ট্রিলিয়ন ছাড়া হয়েছে মোদী জমানায় ২০১৪-১৫ থেকে। টেকনিক্যালি দেখলে এই মকুব লিখে দেওয়া ঋণও পুনরায় আদায় করা সম্ভব হয়। কিন্তু এরকম আদায়ও ১৫ শতাংশের বেশি হয়নি। ইতমধ্যে এনপিএ বেড়েই চলেছে মাঝেমধ্যেই মকুব লিখে ছাড় দিয়ে চলা সত্ত্বেও। গত দশ বছরে ১২ ট্রিলিয়ন টাকা মকুব করার পরও এনপিএ’র অর্থমূল্য দাঁড়ায় বিপুল, ৬ ট্রিলিয়নেরও বেশি!
যখন ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের সঙ্গে এসেছিল অগ্রাধিকার ক্ষেত্রে ঋণ দেওয়ার ওপর জোর — কৃষি, মাঝারি ক্ষুদ্র ও অতিক্ষুদ্র উৎপাদন ক্ষেত্র, গৃহ নির্মাণ, শিক্ষা, সামাজিক পরিকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প ইত্যাদি ক্ষেত্রে ঋণ দেওয়া। এনপিএ'র অধিকাংশটাই অবশ্য অন্য ক্ষেত্র থেকে উদ্ভূত — প্রধানত কর্পোরেট ক্ষেত্রে। বেসরকারিকরণের ফলে অগ্রাধিকার ক্ষেত্রে ঋণ দেওয়ার বিষয়টি ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং ব্যাঙ্কিংকে ঠেলে দেওয়া হবে শেয়ার মার্কেট ও অন্যান্য স্বল্প সময়ে দ্রত মুনাফা লাভের বিনিয়োগের দিকে। একথা নজরে আনা দরকার যে ব্যাঙ্ক শিল্পে সংস্কারের সাথে সাথে সমান্তরাল ভাবে চলছে পেনশন সংস্কার, যেখানে পেনশন ক্ষেত্রে বিদেশী বিনিয়োগের ভাগ ৪৯ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭৪ শতাংশ করা হচ্ছে। পেনশন ফাণ্ডকে শেয়ার মার্কেটের তুরন্ত্ মুনাফার দিকেও ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। এটা হল ভারতের লগ্নিক্ষেত্রকে অস্থির করে দেওয়ার আদর্শ ব্যবস্থাপনা। বিগত বছরগুলি ধরে ভারত বৈশ্বিক লগ্নী সংকটের স্পর্শ থেকে গা বাঁচিয়ে চলতে সক্ষম হয়েছে। ভারতের লগ্নীক্ষেত্রের এই স্থিতিশীলতা ও সহনশীলতা ধ্বংস করে এবার ক্রমবর্ধমান অস্থিরতা ও সংকটের দিকে যাত্রা শুরু হবে।
সাধারণ মানুষ কেবলমাত্র নিজেদের আমানতের নিরাপত্তা নিয়েই চিন্তিত নয়। তাঁরা ব্যাঙ্ক ব্যবস্থার সামগ্রিক দিশা ও পারদর্শিতা সম্পর্কেও সমান উদ্বিগ্ন। ব্যাঙ্ককে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কথা শুনিয়ে মোদীর বহুবিধ বাচন নিয়ে বললে বলতে হয়, সাধারণ মানুষের জন্য ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা ক্রমাগত ব্যয়বহুল হয়ে পড়ছে, ব্যাঙ্কে নিজের টাকা জমা রাখতেও ইউজার চার্জ দিতে হচ্ছে। বৃহৎ কর্পোরেট খাতকেরা ইচ্ছে করে ডিফল্টার হয়েও ছাড় পেয়ে যায় কিন্তু কৃষকেরা, ক্ষুদ্র লগ্নিকারী ঋণগ্রহিতারা বা ছাত্রছাত্রী, কর্মপ্রার্থী ও ব্যবসায়ী সহ ছোট ঋণ গ্রহিতারা চরম হয়রানির শিকার হন, সময় মতো ঋণ শোধ করতে না পারায় কখনও কখনও এমনকি আত্মহত্যা করতেও বাধ্য হন। পেনশন প্রাপকেরা এবং মধ্যবিত্ত গ্রাহকেরা যারা তাঁদের সঞ্চয় থেকে স্থায়ী আয় পেতে ব্যাঙ্কের ওপর নির্ভরশীল তাঁরা ব্যাঙ্কের ক্রমহ্রাসমান সুদের ফলে কঠিন অবস্থার সম্মুখীন হচ্ছেন।
কেবলমাত্র ব্যাঙ্ক ফেল করলেই আমানতকারীদের স্বার্থে আঘাত পড়ে তা তো নয়, সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাঙ্ক লেনদেন অ-নিরাপদ ও ব্যয়বহুল হয়ে পড়লে এবং কঠোর যৌথ শ্রমে গড়ে ওঠা সম্পদ ব্যক্তি মুনাফার স্বার্থে ব্যবহারের দিকে ঠেলে দিলে আমানতকারীদের স্বার্থে সমানভাবেই আঘাত পড়ে। সকল সাধারণ মানুষকে তাই ব্যাঙ্ক কর্মচারীদের সাথে অভিন্ন এক তাগিদে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণকে প্রতিরোধ করতে হবে। যেভাবে কৃষকেরা নিজেদের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম ও জনতার সমর্থনের মধ্যে দিয়ে বিজয় লাভ করেছে, তেমনই ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণ প্রতিহত করে ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা ও লগ্নীক্ষেত্রকে বাঁচানোর সংগ্রামে ব্যাঙ্ক কর্মচারিদেরও সাধারণ মানুষের ব্যাপক সমর্থন ও সহযোগিতা প্রাপ্য।
(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয় ১৪ ডিসেম্বর ২০২১)
প্রকৃতি, পরিবেশ, জীবন ও জীবিকা বিনষ্টকারী দেউচা-পাঁচামী কয়লা উত্তোলন প্রকল্প বাতিল কর
বেসরকারি মুনাফার লক্ষ্যে স্থানীয় বাসিন্দাদের উচ্ছেদ করা চলবে না
সম্প্রতি বীরভূমের মহম্মদবাজার সংলগ্ন দেউচা-পাঁচামী এলাকায় মাটির অনেক গভীরে থাকা নিম্নমানের কয়লার বিস্তৃত স্তর ভেঙে কয়লা উত্তোলন ‘শিল্প’ গড়ার জন্য তোড়জোড় শুরু করেছে রাজ্য সরকার। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী তাঁর উচ্চকিত ভাষণে উচ্ছেদের মুখে দাঁড়ানো স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য বিঘা প্রতি দশলক্ষ টাকা ও অন্যত্র বাস্তুভিটের জমির পাট্টা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি জানিয়েছেন। কৃষিমজুর, ভাগচাষি, খাস জমিতে বসবাসকারী মানুষ সর্বদাই ক্ষতিপূরণের আওতার বাইরে। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে বামফ্রন্টের করুণ পরিণতির কথা স্মরণ থাকাতে সম্ভবত মাননীয়ার এই সতর্ক উচ্চারণ। এমত প্রতিশ্রুতির কোনও ভিত্তি এখনো নেই, কারণ অদ্যাবধি এই মর্মে কোনও সরকারি গেজেট নোটিফিকেশন নেই। বলা হয়েছে, রাজ্যে বিদ্যুতের ঘাটতি মোকাবিলায় এই কয়লা সম্ভার বিপুল শক্তির যোগান নিশ্চিত করবে। অথচ বর্তমানে রাজ্যে বিদ্যুতের কোনও ঘাটতি নেই।
দেখা যাচ্ছে পিডিসিএল তাদের ওয়েব সাইটের মাধ্যমে এই মেগা প্রকল্পটির সামাজিক প্রভাবজনিত সমীক্ষা সমাপ্ত হয়েছে বলে বিজ্ঞাপিত করছে, অথচ সেইলক্ষ্যে স্থানীয় আদিবাসী, মূলবাসী, দলিত ও সংখ্যালঘু শ্রমজীবী মানুষদের জনশুনানী থেকে বিরত রাখার জন্য পুলিশ প্রশাসন ও শাসক দলের পান্ডারা সচেষ্ট থেকেছে। খোলামুখ খনির মাধ্যমে কয়লা উত্তোলন পরিবেশের কতটা ক্ষতিসাধন করতে পারে, তা রাণীগঞ্জ-আসানসোলের বিস্তীর্ণ খনি এলাকায় বসবাসকারী মানুষদের তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। এই প্রকল্পে উচ্ছেদ হবে হাজার হাজার গ্রামবাসী, যাদের পরম্পরাগত জীবিকা হল কৃষিকাজ আর পাথর ভাঙার কাজ। তথাকথিত বিকল্প কর্মসংস্থান ও পুনর্বাসনের মৌখিক আশ্বাসে প্রলুব্ধ না হয়ে, আদিবাসী বাসিন্দাদের এক বৃহৎ অংশ উচ্ছেদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের ডাক দিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর প্রকল্প ঘোষণার পরে পরেই দেশের এনার্জী সেক্টরের বেসরকারিকরণের মাধ্যমে মুনাফার প্রধানতম খাতক গৌতম আদানির কলকাতায় এসে মুখ্যমন্ত্রী সকাশে রুদ্ধদ্বার আলোচনা পিডিসিএল নয়, আদানি পাওয়ারের হাতে এই রাষ্ট্রীয় সম্পদ হস্তান্তরের আশঙ্কাকে মান্যতা দিচ্ছে। জীবাশ্ম জ্বালিয়ে শক্তি উৎপাদনের এই ক্ষতিকর প্রকল্পের পরিবেশের ওপর প্রভাব সংক্রান্ত প্রক্রিয়াকে পাশ কাটিয়ে বাসিন্দাদের ওপর পুলিশ ও তৃণমূলী গুন্ডাদের মারফৎ ত্রাস ছড়িয়ে চটজলদী কয়লা তোলার ছাড়পত্র দিতে চাইছে রাজ্য প্রশাসন।
পরিবেশের হানি ঘটিয়ে, হাজারো মানুষকে তাঁদের ভিটেমাটি-জীবিকা ও সংস্কৃতি থেকে সম্পূর্ণভাবে উচ্ছেদ করে, ব্যয়বহুল খোলামুখ কয়লাখনি স্থাপনের সরকারী জবরদস্তির বিরোধিতা করে সিপিআই(এমএল)। একইসঙ্গে দাবি জানাচ্ছে রাজ্য সরকারকে অবিলম্বে পরিবেশ ও সামাজিক প্রভাব সম্পর্কিত সমীক্ষা রিপোর্ট এবং পুনর্বাসন সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য শ্বেতপত্র আকারে প্রকাশ করে রাজ্যবাসীকে জানাতে হবে। জমি নেওয়ার ক্ষেত্রে জমি অধিগ্রহণ আইন ২০১৩-কে মান্যতা দিয়ে স্থানীয় গ্রামসভা ও পঞ্চায়েতের পূর্ণ সম্মতি নেওয়া হয়েছে কিনা তাও জানাতে হবে।
পরিবেশ প্রকৃতির দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি ও স্থানীয় মানুষদের উচ্ছেদ ও ভীতি প্রদর্শনের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে সিপিআই(এমএল) সচেষ্ট থাকবে। অতি দ্রুত কলকাতা শহরে প্রথমে ও পরে কয়েকটি জেলা শহরে দীক্ষিত পরিবেশবিদ, খনি বিজ্ঞানী ও বিশিষ্ট সমাজকর্মীদের নিয়ে গণকনভেনশন সংগঠিত করার প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে।
সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পক্ষ থেকে গত ১৫ ডিসেম্বর এই ঘোষণা করা হয়েছে।
সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পক্ষ থেকে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার কলকাতা কর্পোরেশন নির্বাচনের ফল ঘোষণার পরদিন এক প্রেস বিবৃতিতে বলেন —
অবাধ ও শান্তিপূর্ণ কলকাতা কর্পোরেশন নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি রাজ্য নির্বাচন কমিশন, রাজ্য পুলিশ-প্রশাসন, রাজ্য সরকার ও শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস যে রক্ষা করেনি এবং ব্যর্থ হয়েছে তা জলের মতো পরিস্কার। অন্তত বেশ কিছু কেন্দ্রে ভোটের ফলাফল দেখলেই পরিস্কার হয়ে যাবে যে ভোট লুঠ ও সন্ত্রাস এইসব কেন্দ্রে বিরাট ভূমিকা নিয়েছে। অন্তত ৭টি পৌর ওয়ার্ডে শাসক দলের প্রার্থীদের প্রদত্ত ভোটের ৯৩ শতাংশের বেশি ভোট প্রাপ্তি বা কোনও একটি পৌর ওয়ার্ডে ৬২ হাজার বা ৩৭ হাজারের বেশি ভোটে তৃণমূল প্রার্থীর জয়লাভ ‘অবাধ ভোটের’ নমুনা কিনা তা সকলেই বুঝতে পারবেন। একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের এই অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপকে আমরা তীব্র নিন্দা করি।
এই নির্বাচনের ফলাফলের অন্য যে দিকটি সকলের নজরে পড়েছে তা হল, মাত্র কয়েক মাস আগে রাজ্য দখলের স্বপ্ন চূর্ণ হবার পর থেকে দলীয় কোন্দলে জর্জরিত ভারতীয় জনতা পার্টির ছোট লালবাড়ি দখলের জন্য সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও উস্কানি (কলকাতার জনবিন্যাসে বড় ধরনের পরিবর্তন ও ৮০ শতাংশ ‘তথাকথিত সংখ্যালঘু’ মানুষের উপস্থিতির মিথ্যাচার) কলকাতার নাগরিকরা ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেছে। শুধু আসন সংখ্যায় নয়, বিজেপির প্রাপ্ত ভোট অন্তত ২০ শতাংশের বেশি হ্রাস পেয়েছে।
অন্যদিকে কংগ্রেস ও বামফ্রন্ট আলাদা আলাদা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ২টি করে আসনে জয়লাভ করেছে। সামগ্রিকভাবে বামফ্রন্টের প্রাপ্ত ভোট প্রায় ১২ শতাংশের মতো। অন্তত ৬৫-৬৬টি পৌর ওয়ার্ডে বামফ্রন্টের প্রার্থীরা দ্বিতীয় স্থানে রয়েছেন। বিজয়ী প্রার্থীর তুলনায় বামফ্রন্ট প্রার্থীদের ভোটের মার্জিনে বিরাট দূরত্ব থাকলেও বিজেপিকে তৃতীয় স্থানে সরিয়ে দেওয়া অবশ্যই উল্লেখযোগ্য।
আগামী দিনগুলোতে পৌর পরিষেবা নিয়ে জনগণের দাবিদাওয়া ও আশা আকাঙ্খাকে মূর্তরূপ দেবার জন্য বাম গণতান্ত্রিক শক্তিকেই অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। হাওড়া কর্পোরেশন সহ রাজ্যের অন্যান্য পৌরসভাগুলোর নির্বাচন অবিলম্বে ঘোষণা করার দাবি আমাদের তুলতে হবে।
গত ১৮-১৯ ডিসেম্বর সম্পন্ন হল এআইকেএম’এর জাতীয় কার্যকরী সমিতির দু’দিনব্যাপী অধিবেশন। অধিবেশনের পূর্বাহ্নে আরার ‘ক্রান্তি পার্কে’ কমরেড বিনোদ মিশ্রের ২৩তম মৃত্যুবার্ষিকীতে আহূত সংকল্পসভায় কৃষক নেতারা অংশগ্রহণ করেন এবং শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করেন। এরপর শহরের কেন্দ্রস্থলে ‘নাগরী প্রচারিণী সভাগারে’ ‘কৃষক আন্দোলনের ঐতিহাসিক জয়কে আরও মজবুত করুন’ শীর্ষক এক নাগরিক কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়। কনভেনশনে প্রধান বক্তা ছিলেন এআইকেএম’এর অন্যতম সহ সভাপতি সুখদর্শন সিং নাট। তিনি বক্তব্যে দিল্লী সীমান্তে চলা বর্ষব্যাপী ঐতিহাসিক গণঅবস্থানের এক জীবন্ত ধারাভাষ্য রাখেন এবং বলেন, “অন্নদাতাদের এই আন্দোলন হল আসলে কর্পোরেট লুট ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ভারতীয় জনগণের সম্মিলিত সংগ্রামেরই এক ঊজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি।” কনভেনশনে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের বিহার রাজ্য সম্পাদক কুনালও বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, “বিহারের গ্রামাঞ্চলের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যগুলিকে আয়ত্ত করে বিস্তীর্ণ এলাকায় কৃষক সংগ্রামের নতুন জোয়ার সৃষ্টির জন্য পার্টি তার সর্বশক্তি নিয়োগ করবে এবং এজন্য পার্টি সদস্যের সংখ্যা এক লক্ষের সীমানাকে অতিক্রম করার কঠিন চ্যালেঞ্জকে ভুললে চলবে না।”
কনভেনশন শেষ হওয়ার পর সন্ধ্যা থেকে শুরু হয় এআইকেএম’এর জাতীয় কার্যকরি সমিতির অধিবেশন। অধিবেশনে দিল্লী সীমান্তের ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনে এক জোরদার ছাপ ফেলা ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের ক্ষেত্রে এআইকেএম’এর উদ্যোগ কেমন থেকেছে তার বিস্তৃত পর্যালোচনা করা হয়। এর সাথে সাথে আন্দোলনের ঐতিহাসিক বিজয়ের ফলে রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যে বদল ঘটছে তারসঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ রণনীতি ও পদক্ষেপ নির্ধারণের বিষয়েও ব্যাপক চর্চা হয়। অধিবেশনে বীজ, সার, কীটনাশক, সেচ ব্যবস্থা, কৃষিবাজার — সমস্ত ক্ষেত্রেই আমেরিকার প্রভাব বৃদ্ধির বিপদকে প্রতিহত করা এবং আমেরিকার সাথে ভারতের কৃষি বিষয়ক জ্ঞান-চুক্তি বাতিল করার প্রয়োজনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। আলোচনায় উঠে আসে, কৃষিকে লাভজনক করে তোলা, সেচ ও জলসম্পদ ব্যবহারে কৃষিজমির সুরক্ষাকে প্রাধান্য দেওয়া, কৃষক, কৃষি, পশুপালনকারী সহ আদিবাসীদের জীবনযাত্রার বিকাশ ঘটানোকেও কৃষক আন্দোলনের অন্যতম অন্তর্বস্তু করে তুলতে হবে। এআইকেএম’এর সাংগঠনিক শক্তির বিস্তার ঘটানোর জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। স্থির হয়, জানুয়ারী থেকে জুলাই ২০২২’র মধ্যে সারাদেশে সাতলক্ষ সদস্য সংগ্রহের জন্য অভিযান চালানো হবে। এই সময়পর্বে সংগঠনের ব্লক, জেলা ও রাজ্য সম্মেলনগুলি সম্পন্ন করতে হবে। ২৪টি রাজ্যের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে অক্টোবর ২০২২এ এআইকেএম’এর জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে।
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, ঝাড়খন্ডের পালামৌ জেলায় সামন্তশক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলনে মিথ্যা মামলায় ১৮ বছরের সাজাপ্রাপ্ত কমরেড বিশ্বনাথ সিং কারামুক্ত হওয়ার পর এআইকেএম’এর অধিবেশনে যোগদান করেন। এছাড়া বিহারে কৃষক আন্দোলনের বর্ষীয়ান নেতা, প্রাক্তন সিপিআই(এম) বিধায়ক রামদেও বর্মা ও তাঁর স্ত্রী মঞ্জুপ্রকাশ (ইনিও প্রাক্তন বিধায়ক) অধিবেশন চলাকালীন উপস্থিত হয়ে এআইকেএম নেতাদের অভিনন্দন জানান। জনসাংস্কৃতিক মঞ্চের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে অধিবেশনের পরিসমাপ্তি ঘটে।
পাপিয়া মাণ্ডির লড়াইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে ২১ ডিসেম্বর রাজ্যের কয়েকটি জায়গায় বিক্ষোভ কর্মসূচি সংগঠিত হয়। পশ্চিম মেদিনীপুরের সবং ও চন্দ্রকোনা, পূর্ব বর্ধমানে বোহার গদাইতলা বাজার, হুগলির ধনেখালি বিডিও অফিস এবং কলকাতায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে প্রতিবাদী কর্মসূচি সংগঠিত হয়। পাপিয়া মাণ্ডির পাশে দাঁড়িয়ে জাতিবিদ্বেষের বিরুদ্ধে সুবিচারের জোরালো আওয়াজ তোলা হয়।
মূল বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচিটি ছিল সবংএ। ভারত জাকাত মাঝি পারগাণা মহল (ভাজামাপাম) সবং ও পিংলা মুলুকের ডাকে সবং তেমাথানি মোড়ে কয়েকশ আদিবাসী নরনারী প্রথাগত পোশাকে, টুণ্ডা-টমক ও অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে জমায়েত হন এবং প্রতীকী বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে প্রকৃতি আরাধনা করে এক সুশৃঙ্খল মিছিল সমগ্র এলাকা পরিক্রমা করে সবং সজনীকান্ত মহাবিদ্যলয়ের দরজায় হাজির হয়। দরজা বন্ধ দেখে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন সকলে, বিশেষত মহিলারা। কলেজের সামনে ব্যাস্ত হাইরোড অবরোধ করে বসে পড়েন সবাই। বিশাল পুলিশ বাহিনী দফায় দফায় আলোচনা চালায় নেতৃত্বের সাথে। প্রায় ৪৫ মিনিট অবরোধ চালিয়ে রাস্তা জুড়ে মিছিল করে ফিরে আসা হয় তেমাথানি সভাস্থলে। সভা চলে সন্ধ্যা অবধি। প্রথমে বক্তব্য রাখেন ফুলো-ঝানো তিরলো গাঁওতার নেত্রী স্বরস্বতী হাঁসদা ও সব শেষ বক্তা ছিলেন পাপিয়া মাণ্ডির ছোট ভাই পূর্ণেন্দু মাণ্ডি। তার মাঝে একে একে বক্তব্য রাখেন বিক্ষোভ কর্মসূচির অন্যতম প্রধান উদ্যোক্ত মিঠুন মর্মু, বাবলু হাঁসদা, সনাতন হেমব্রম, বিশ্বনাথ হেমব্রম, মনোরঞ্জন মুর্মু, রবি সিং সহ বিভিন্ন নেতৃত্বস্থানীয় পারগাণা মহল। আমন্ত্রিতদের মধ্যে থেকে বক্তব্য রাখেন মলয় তেওয়ারি ও ডিডি মুর্মু। সভা পরিচালনা করেন খড়গপুর তল্লাটের গোডেৎ পারগানা অলোক বেসরা।
তেমাথানির সভায় বক্তারা যে বিষয়গুলি তুলে ধরেন সেগুলি খুব সংক্ষেপে নিম্নরূপ—
অধ্যাপিকা পাপিয়া মাণ্ডি অনেক দিন ধরে বিভিন্নভাবে হেনস্থা ও অবমানিত হয়েছেন। গত সেপ্টেম্বর মাসে তিনি রুখে দাঁড়িয়ে লিখিত অভিযোগ জানানোর পর থেকে প্রত্যক্ষ লড়াই শুরু হয়। ভাজামাপাম সবং মুলুকে আন্দোলন শুরু করে। এফআইআর দায়ের হয়। ধারাবাহিক চাপ তৈরি করার ফলে ছোট ছোট জয় আসে। ছুটির পর পাপিয়া মাণ্ডিকে কলেজে বিধিবদ্ধভাবে পুনরায় যোগদান করতে যে বাধা দিচ্ছিল অধ্যক্ষ, তা থেকে পিছু হটতে বাধ্য হয়। এবং এবার অভিযুক্ত অধ্যাপককে সাসপেণ্ডও করেন তিনি। কিন্তু অধ্যক্ষ নিজেই তো একই অভিযোগে অভিযুক্ত। ওই অধ্যাপকের মতই পোয়া আইনের একই ধারাগুলিতে অধ্যক্ষও অভিযুক্ত। তাহলে অধ্যক্ষকে সাসপেণ্ড করা হচ্ছে না কেন? অধ্যক্ষকে সাসপেণ্ড করে স্বচ্ছ তদন্ত ও সুবিচার পাওয়ার লড়াই চলবে। কলেজের জিবির সভাপতি তথা এলাকার বিধায়ক ও মন্ত্রী মানস ভুঁইয়া কোন অধিকারে বলতে পারেন যে পাপিয়াকে কেউ অপমান করেনি? তিনি অপরাধীদের আড়াল করতে নামলে তাঁকেও ছেড়ে দেওয়া হবে না। সবে তো কান ধরে টান দেওয়া হয়েছে, এবার মাথা আসবে। সবে ট্রেলার চলছে, পুরো সিনেমা এখনও বাকি আছে। আন্দোলনের নির্দিষ্ট প্রশ্নে এইসব বিষয়গুলির সাথে সাথে বক্তাদের কথায় উঠে আসে এই সমাজে আদিবাসীদের ওপর চলা সুব্যবস্থিত ব্যবস্থাগত বৈষম্য ও অবমাননার নানা দিক। আদিবাসীদের খাটো করে দেখানো ও আদিবাসীদের আত্মপরিচিতিকে হেয় প্রতিপন্ন করার মানসিকতাকে ধিক্কার জানিয়ে অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যতের নিরিখে আদিবাসীদের গৌরবময় ইতিহাস ও প্রথাকে তুলে ধরা হয়। সভ্যতার আদি বনিয়াদের ধারক হিসেবে আদিবাসীদের ইতিহাস উঠে আসে। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে আদিবাসীদের সর্বাগ্রগামী গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের কথা উঠে আসে। এবং বর্তমান জলবায়ু সংকটের পরিস্থিতিতে ধরতি মাতাকে বাঁচাতে প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে জীবনকে বোঝা ও প্রকৃতি আরাধনায় আদিবাসী ঐতিহ্য থেকে শিক্ষা নেওয়ার কথা আসে। সব মিলিয়ে লড়াইয়ের দৃঢ় অঙ্গীকার ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে সবংএর সভা সমাপ্ত হয়।
এছাড়া ভাজামাপামের ডাকে চন্দ্রকোনাতে পথ অবরোধ চলে। কর্মসূচিগুলির আগে দুদিন ধরে বিস্তীর্ণ এলাকায় অটো-মাইক প্রচার করা হয়।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অল ইণ্ডিয়া স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন (আইসা) প্রতিবাদসভার ডাক দিয়েছিল। এই পর্বে পাপিয়া মাণ্ডির লড়াইয়ের বিষয়টি তুলে ধরে দুটি প্রচারপত্র বিলি হয়। আইসার পক্ষে বর্ষা বড়াল, রুদ্র প্রভাকর দাস ও সৈকত, সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির পক্ষে চন্দ্রাস্মিতা চৌধুরি, ক্যুয়ার/ট্রান্স/ফেমিনিস্ট ফেবুলেশনের উদ্দীপ্ত, প্রাক্তন অধ্যাপক অমিত দাশগুপ্ত সহ বিভিন্ন বক্তারা এরাজ্যের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে এসসি-এসটিদের ওপর চলা বিভিন্নরূপ বৈষম্য ও অপমানের কথা তুলে ধরেন। বিভিন্ন আদিবাসি জাতির ভাষাগুলির প্রতি সরকারি বঞ্চনার কথা উঠে আসে। সমস্ত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জাতিবিদ্বেষ মোকাবিলায় “রোহিথ আইন” প্রণয়নের দাবি তোলা হয়। সভাটি পরিচালনা করেন সায়নি। প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী অনুপম রায় বড় ক্যানভাসে সভার প্রেক্ষাপট এঁকে দেন। সমবেত সঙ্গীতের মধ্যে দিয়ে রোহিথ বেমুলাকে স্মরণ করে এবং সুবিচারের লড়াই চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার নিয়ে প্রতিবাদসভা সমাপ্ত হয়।
পূর্ব বর্ধমানের বোহার গদাইতলা বাজারে অল্প সময়ের জন্য পথ অবরোধ করে তারপর প্রতিবাদ সভা সংগঠিত করে দিশম আদিবাসী সুসৌর গাঁওতা ও ফুলোঝানো সাঁওতা সুসৌর গাঁওতা। মেমারি২ ও কালনা ব্লকের নেতৃত্ব বিপিন মাণ্ডি, সনাতন হাঁসদা, দিলীপ হাঁসদা ও রাজ্য সভাপতি লবান হাঁসদা সহ কর্মী-সমর্থকেরা অংশ নেন। প্রতিবাদী সভা বাজারের বহু মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। লবান হাঁসদা বলেন, অধ্যাপক, স্কুল শিক্ষক হোন বা সরকারী কর্মচারী -- সর্বত্র আদিবাসীকে বহুবিধ হয়রানি, হেনস্থা ও অপমান সহ্য করতে হচ্ছে কেন? এরাজ্যে পরপর এরকম ঘটনা সামনে আসছে। অবিলম্বে সবং কলেজের দুই অপরাধী অধ্যক্ষ তপন দত্ত ও অধ্যাপক নির্মল বেরাকে গ্রেপ্তার ও বহিস্কারের দাবি তুলে ধরা হয়। প্রয়োজনে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে বিষয়টি পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে জানানো হয়। জাতিবিদ্বেষের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ লড়াইএর আহ্বান নিয়ে সভা সমাপ্ত হয়।
হুগলির ধনেখালি ব্লকে “আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চ” সুপরিচিত সংগঠন। হাসা-ভাষা-লায়লাকচার প্রশ্নে ও গরিব শ্রমজীবী আদিবাসীদের কাজ ও মজুরির প্রশ্নে আন্দোলন চালিয়ে আসছেন তাঁরা। ২১ ডিসেম্বর তাঁরা বিডিও অফিসের সামনে বিক্ষোভ দেখান পাপিয়া মাণ্ডির জন্য সুবিচার চেয়ে। প্ল্যাকার্ড ও ব্যানারে দাবিগুলি তুলে ধরে শ্লোগান ও বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে সমগ্র বিষয়টি মানুষের মাঝে তুলে ধরা হয়।
এই সবক'টি কর্মসূচি পারস্পরিক কথাবার্তার ভিত্তিতে একইদিনে সংগঠিত করা হয়েছিল জাতিবিদ্বেষ ও আদিবাসী বিদ্বেষের বিরুদ্ধে সর্বস্তরে ঐক্যের বার্তা দিতে এবং পাপিয়া মাণ্ডির পাশে দাঁড়িয়ে এই লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। এই সমস্ত প্রতিবাদ সভাগুলি থেকে পাপিয়া মাণ্ডিকে অভিনন্দন জানানো হয় দৃঢ়ভাবে তাঁর রুখে দাঁড়ানোর জন্য। বহু ক্ষেত্রেই এই দৈনন্দিন অপমানগুলি অনেকেই মুখ বুজে সহ্য করে নেন। পাপিয়ার লড়াই তাঁদের প্রতিবাদ করতে সাহস জোগাবে। ইতিমধ্যেই ওই সবং কলেজেরই আরও একজন অধ্যাপিকা, প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সম্পা পাত্র, অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন তাঁর ওপর চলা দীর্ঘ দৈনন্দিন হয়রানির বর্ণনা দিয়ে।
জেলা আদালতের বিশেষ বেঞ্চে পাপিয়া মাণ্ডির জন্য সুবিচারের লড়াই শুরু হয়েছে। আন্দোলনের ফলে প্রশাসনও কিছুটা নড়েচড়ে বসেছে। আগামি ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ আদালতে শুনানি আছে। মন্ত্রী ও বিদ্যমান ক্ষমতাতন্ত্রের সমস্ত বাধাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে এই লড়াই আরও বহু মানুষকে জাতিবিদ্বেষ ও আদিবাসী-বিদ্বেষের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করুক এবং হাসা-ভাষা, লায়-লাকচার, অরণ্যের অধিকার ও পঞ্চম তপশিল সহ সংবিধানস্বীকৃত স্বায়ত্তশাসনের বুনিয়াদি প্রশ্নগুলিকে জোরালোভাবে সামনে আনুক।
গ্রামে ক্যাম্প করে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে ধান ক্রয় ও ন্যূনতম সহায়ক মূল্য আইন প্রণয়নের দাবিতে ব্লকে ব্লকে ডেপুটেশন কর্মসূচি নেয় এআইকেএম। দিল্লীর সীমান্তে একবছরের মরণপণ লড়াইয়ের পর কৃষক আন্দোলনের ঐতিহাসিক জয় হল। কেন্দ্রীয় সরকার তিন কৃষি আইন বাতিল করতে বাধ্য হল, অন্যান্য দাবিসমুহ লিখিতভাবে মেনে নিতে বাধ্য হল। ন্যূনতম সহায়ক মূল্য আইন প্রণয়নের দাবি করেছে মেনে নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে কমিটি গঠনের শর্ত স্বীকার করেছেন। তখন পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের ধান সংগ্রহ নিয়ে সরকারের দীর্ঘসূত্রিতা ও অব্যবস্থার জন্য কৃষকদের কম দামে ফড়ে ব্যাপারীদের মাধ্যমে ধান বিক্রি করে লোকসান দিতে হচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত ফসলের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কোনও পদক্ষেপ নেই। এই পরিস্থিতিতে সারা ভারত কিষাণ মহাসভা ও সারা ভারত কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতির পক্ষ থেকে সপ্তাহব্যাপী প্রচার ও ১৫ ডিসেম্বর ব্লকে ব্লকে ডেপুটেশন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। কর্মসূচির অংশ হিসেবেই পুর্ব বর্ধমান জেলার বিভিন্ন ব্লকে ডেপুটেশন সংগঠিত করা হল। দাবি ছিল,
১) সাম্প্রতিক প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত ধান, আলু ও অন্যান্য ফসলের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
২) গ্রামে গ্রামে ক্যাম্প করে সরকারি সহায়ক মূল্য ১৯৪০+২০ টাকা কুইন্টাল দামে ধান কিনতে হবে।
৩) সারের কালোবাজারি বন্ধ করতে হবে। পর্যাপ্ত সারের যোগানের ব্যবস্থা করতে হবে।
৪) কর্মনিশ্চয়তা প্রকল্পে পর্যাপ্ত কাজ দিতে হবে। দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। মজুরি কম দেওয়া চলবে না।
৫) বছরে ২০০ দিন কাজ ও দৈনিক ৬০০ টাকা মজুরি দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
৬) অনতিভুক্ত ভাগচাষি, লিজচাষি ও পাট্টাহীন গরিব চাষিদের সমস্ত ধরনের সরকারি প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
৭) কৃষকের ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য করার জন্য আইন প্রণয়নের ব্যবস্থা করতে হবে।
পুর্ব বর্ধমান জেলার কালনা ২নং ব্লকের এডিও, পুর্বস্থলী ২নং ব্লকের বিডিও এবং সদর ২নং ব্লকের বিডিও’কে ডেপুটেশন দেওয়া হয়। ৫০ জনের বেশি কৃষক মিছিল করে কালনা ২নং ব্লক কৃষি উন্নয়ন আধিকারিক দপ্তরের সামনে বিক্ষোভ দেখান এবং ডেপুটেশন দেন। রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে এআইকেএম ও আয়ারলার ব্লক নেতৃবৃন্দ ডেপুটেশনে সামিল হন। এডিও সাহেব সাম্প্রতিক প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসলের ক্ষতিপূরণ সম্পর্কে বিস্তারিত একমত হন এবং বলেন কালনা ২নং ব্লককে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা হিসাবে ঘোষণার প্রস্তাব তিনি সরকারের উচ্চতর দপ্তরে পাঠিয়েছেন। অন্যান্য দাবি বিডিওকে জানাবেন। পুর্বস্থলী ২নং ব্লকের বিডিও অফিসের সামনে বিক্ষোভ অবস্থান সংগঠিত করা হয়। সভায় শ্লোগান এবং বক্তব্য রাখেন আয়ারলার জেলা সম্পাদক আনসারুল আমন মন্ডল ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। ডেপুটেশনে প্রতিনিধিত্ব করেন সজল পাল, শিবু সাঁতরা ও কাওসার আলি সেখ। বিডিও না থাকার ফলে ডেপুটেশন গ্রহণ করেন জয়েন্ট বিডিও। ডেপুটেশনে দাবি অনুযায়ী সেই সব দপ্তরের ব্লক আধিকারিকের সাথে স্পিকার ওপেন করে কথা বলার ব্যবস্থা করেন। তিনি বলেন, এডিও প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত ফসলের রিপোর্ট উপরে পাঠিয়েছেন। ধান কেনার ব্যাপারে বলেন, এই ব্লকে একটি কেন্দ্র থেকে ধান কেনা হচ্ছে। সমবায় বা অন্যান্য সংস্থা মারফত ধান কেনার সংস্থান থাকলেও এই ব্লকে কোন ব্যবস্থা নেই। এই পর্যন্ত ৩০ জন চাষি নাম নথিভুক্ত করেছেন। ধান পরে কিনবেন। প্রতিনিধিরা প্রতিবাদ করে বলেছেন এই পদ্ধতির ফলেই গরিব কৃষকরা অভাবী বিক্রি করতে বাধ্য হয়ে কুইন্টাল প্রতি ৬০০/৭০০ টাকা কম দামে ধান বিক্রি করে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। সারের কালোবাজারি বন্ধ করার ব্যাপারে বলেন, কিছুদিন সারের সরবরাহের সমস্যা ছিল। বর্তমানে সংকট নেই। কোনও সারের দোকান বেশি দাম চাইলে এডিওকে ফোন করলে ব্যবস্থা নেবেন। ১০০ দিনের কাজের দুর্নীতি ও কম মজুরি দেওয়ার প্রশ্নে নির্দিষ্ট অভিযোগ জানালে ব্যবস্থা নিবেন। অন্যান্য দাবি ঊর্ধ্বর্তন কর্তৃপক্ষকে পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন।
গত ১৭ ডিসেম্বর বাঁকুড়া জেলার ওন্দায় বিডিও, বিএলআরও ও এডিও’কে একই ডেপুটেশন দেয় এআইকেএম ও সিপিআই(এমএল) লিবারেশন যুগলে। উপরোক্ত স্মারকলিপিতে নিম্নলিখিত দাবিগুলি জানানো হয়।
১) বনের জমিতে দীর্ঘদিন ধরে বসবাসকারী আদিবাদী ও অন্যান্য বনবাসী মানুষদের পাট্টা দিতে হবে ও পাট্টা রেকর্ড করতে হবে।
২) দীর্ঘদিন ধরে পাট্টা পাওয়া সত্ত্বেও আজও পরচা না পাওয়ার ফলে গরিব আদিবাসীরা সরকারি সাহায্য থেকে বঞ্চিত। তাই দ্রুত পরচার ব্যবস্থা করতে হবে।
৩) অকাল বৃষ্টিজনিত কারণে ধান, আলু সহ অন্যান্য ফসলের যে ক্ষতি হয়েছে, তার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে সরকারকে।
৪) গ্রামে গ্রামে ক্যাম্প করে ১,৯৬০ টাকা দরে ভাগচাষি, লিজচাষিদের থেকেও ধান কিনতে হবে।
৫) সান্তোর থেকে নিকুঞ্জপুর হয়ে মাঝডিহা পর্যন্ত দ্বারকেশ্বর নদীতে বেআইনিভাবে বালি তোলার ফলে যে ব্যাপক চড়া তৈরি হয়েছে তার দরুণ নদীর গতিপথ ঘুরে যেতে বসেছে। এই ক্ষতির দ্বারা প্রভাবিত হবে ১৫টির অধিক গ্রাম। দ্রুত মাস্টার প্ল্যান তৈরি করে এই ভাঙন রোধ করতে হবে।
৬) ওন্দা ব্লকের কল্যাণী অঞ্চল ও নিকুঞ্জপুর, এলাটি মৌজাতে পাকা রাস্তা তৈরি করতে হবে।
ডেপুটেশনে নেতৃত্বে ছিলেন বৈদনাথ চীনা, আদিত্য ধবল ও রবিদাস মুর্মু।
দিল্লীর কৃষক আন্দোলনের জয়কে সংহত করার জন্য পশ্চিমবঙ্গের কৃষক নেতারা কৃষকদের দুয়ারে। এআইকেএসসিসি’র নেতৃত্ব প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সাথে দেখা করতে কালনা ২নং ব্লকের গ্রামে আসেন।
সাম্প্রতিক নিম্নচাপের ফলে অকাল বৃষ্টিতে পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের ফসল ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাকা আমন ধান বৃষ্টির জলে জমিতে নষ্ট হয়ে গেছে। আলু লাগানো জমিতে জল জমে গিয়ে আলু নষ্ট হয়ে গেছে। মসুর, সরিষা ও অন্যান্য রবি ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সরকার নিম্নচাপের আগে সতর্কতার প্রচারের জন্য সমস্ত প্রচারমাধ্যম ও প্রশাসনিক স্তরে জরুরিভিত্তিক ব্যাপক যুদ্ধকালীন প্রচার করেছে। দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি ঘোষণা করেছে। কিন্ত বাস্তবে কৃষকদের যখন ব্যাপক ক্ষতি হয়ে গেল, তখন সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণের ব্যাপারে কোনওরকম ঘোষণা করছেন না। কোনও এলাকাকে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ঘোষণা করলেন না। গত ১৫ ডিসেম্বর সারা ভারত কৃষক সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির নেতৃবৃন্দ কালনা ২নং ব্লকের অকালপৌষ গ্রাম পঞ্চায়েতের আগ্রাদহ গ্রামে উপস্থিত হন। আগ্রাদহ, ঝিকড়া, বাজিতপুর সহ ৬/৭টি গ্রামের ১০০’র মত চাষি কৃষক নেতাদের সাথে দেখা করেন এবং ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানেন। তাতে মোটামুটি জানা যায় কালনা ২নং ব্লকের ৩০ শতাংশ ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঐ পর্যন্ত ৪০ শতাংশ আলু লাগানো হয়েছিল। তা প্রায় সম্পূর্ণতই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। উৎপাদন খরচ ও লাভজনক দাম না পেয়ে লোকসানের কথাও কৃষকরা তুলে ধরেন। কৃষক নেতারা এই নিয়ে এডিও’তে আবেদন করেন এবং ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানান। দেশজুড়ে কৃষক আন্দোলনের জয়ের পরিস্থিতিতে কৃষক নেতাদের গ্রামে তাদের কথা শুনতে আসায় কৃষকরা উৎসাহ প্রকাশ করলেন। এই প্রতিনিধিদলে উপস্থিত ছিলেন এআইকেএসসিসি’র রাজ্য সাংগঠনিক সম্পাদক কার্তিক পাল, অভিক সাহা, সমীর পুততুণ্ড সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।
কমরেড লালু ওঁরাও নগর ও কমরেড অপু চতুর্বেদী সভাগৃহ নামাঙ্কিত রানীডাঙা ভতনজোত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের দার্জিলিং জেলার ১২তম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ১৯ ডিসেম্বর। মোট প্রায় ৭০ জন প্রতিনিধি এবং দর্শক প্রতিনিধির উপস্থিতিতে সম্মেলনের শুরুতে রক্তপতাকা উত্তোলন করেন রাজ্য সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার। শহীদস্মরণ শেষে সম্মেলনের শুরুতে বক্তব্য রাখেন রাজ্য পর্যবেক্ষক (জলপাইগুড়ি জেলা সম্পাদক) ভাস্কর দত্ত। উপস্থিত ছিলেন জলপাইগুড়ি জেলা কমিটি সদস্য শ্যামল ভৌমিক এবং কোচবিহার জেলা কমিটি সদস্য বাবুন দে। বিদায়ী কমিটির পক্ষ থেকে প্রতিবেদন রাখেন পবিত্র সিংহ। জেলা, রাজ্য এবং জাতীয় পরিস্থিতি সম্পর্কে বক্তব্য রাখেন অভিজিৎ মজুমদার। প্রতিবেদনের ওপর সুচিন্তিত মতামত রাখেন ১৩ জন প্রতিনিধি। পাশাপাশি বক্তব্য রাখেন নকশালবাড়ি আন্দোলনের অন্যতম নেতৃত্ব ধাদু মুন্ডা। জবাবী ভাষণে জেলা সম্পাদক উত্থাপিত কিছু বিষয় প্রতিবেদনে সংযোজিত করে নেন। রিপোর্ট প্রতিনিধিদের দ্বারা গৃহীত হওয়ার পরে পবিত্র সিংহ জেলা সম্পাদক হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হন। ৪ জন মহিলা সদস্য মীরা চতুর্বেদী, সুমন্তি এক্কা, মুক্তি সরকার (নতুন), শাশ্বতী সেনগুপ্ত (নতুন) সহ ১৭ জনের কমিটি গঠিত হয়। নকশালবাড়ি আন্দোলনের অন্যতম প্রবীণ কৃষক সংগ্রামী প্রতিনিধি খেমু সিংহকে স্থায়ী আমন্ত্রিত সদস্য হিসেবে বেছে নেওয়া হয়। শেষে বিপ্লবী স্পর্ধা বজায় রেখে আগামীদিনে দার্জিলিং জেলায় বিস্তৃত গণভিত্তি গড়ে তোলার এবং মানুষের আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার শপথ নিয়ে ইন্টারন্যাশনাল গানের মধ্য দিয়ে সফলভাবে সম্মেলনের পরিসমাপ্তি ঘটে।
গত ১৭ ডিসেম্বর নদীয়া জেলার ধুবুলিয়ায় সংগ্রামী বিড়ি শ্রমিক ইউনিয়নের শতাধিক শ্রমিকদের এক সাধারণ সভা থেকে মজুরি বৃদ্ধির জন্য আন্দোলনের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। মজুরি না বাড়া পর্যন্ত লাগাতার আন্দোলনের এক মনোভাব উঠে এসেছে। এই ব্লকে দীর্ঘ কয়েকবছর ধরে মজুরি একই জায়গায় রয়ে গেছে। বর্তমানে বিভিন্ন জেলায় মজুরি আংশিক বেড়েছে। নদীয়া জেলার কয়েকটি স্থানে মালিকপক্ষের সাথে আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা ফলপ্রসু হয়নি। তাই চরম সংকটের মধ্যে থাকা শ্রমিকরা অনমনীয় মনোভাব নিয়ে আন্দোলনের পথে রয়েছেন। বিশেষত কৃষ্ণনগরে বড় সংখ্যায় বিড়ি শ্রমিকদের এলাকা শিমূলতলায় এআইসিসিটিইউ অনুমোদিত ইউনিয়ন যৌথভাবে লাগাতার কর্মসূচি গ্রহণ করে চলেছে। তারসাথে সঙ্গতি রেখে ধুবুলিয়ার বুকেও মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনকে তীব্র করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সম্প্রতি রাজ্য সরকার কয়েকটি জনমোহিনী সহায়তা প্রকল্প চালু করেছে। কিন্তু শ্রমজীবী মানুষের জন্য ইতিপূর্বেই চালু থাকা সমস্ত প্রকল্পগুলিকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যেমন বিড়ি শ্রমিকদের জন্য গৃহনির্মাণ অনুদান, ছেলে মেয়েদের শিক্ষা স্টাইপেন্ড, চিকিৎসার জন্য সাহায্য, বিশেষত টিবি রোগে বিশেষ সহায়তা — এসব বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। রাজ্য সরকারের এই দ্বিচারিতার বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এই সাধারণ সভায় ছিলেন ধুবুলিয়া বিড়ি ইউনিয়নের সম্পাদিকা বেলা নন্দী, এআইসিসিটিইউ জেলা সম্পাদক জীবন কবিরাজ, ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠক সন্তু ভট্টাচার্য, সুব্রত রায়, যুব কর্মী অমিত মন্ডল প্রমুখ।
গ্রামীণ গরিব মেহনতিদের পরিবার পরিজন ঋণফাঁদে জর্জরিত। তার ওপর বিগত লকডাউনের চরম সংকট অবস্থার মধ্যে মাইক্রোফিনান্স সংস্থার এজেন্টদের জুলুম নির্যাতনের ফলে পশ্চিমবঙ্গের অনেক জেলার মেহনতি পরিবারের হাজার হাজার মহিলাদের সংগঠিত হয়ে লকডাউনের বিধিনিষেধ উপেক্ষা করেই প্রতিবাদ আন্দোলনে রাস্তায় নামতে হয়েছিল। ঐ আন্দোলনের চাপে এবং হাইকোর্ট সুপ্রিম কোর্টের বিভিন্ন ঘোষণায় ওই ঋণ আদায়ের জুলুম নির্যাতন কমেছিল। কিন্তু আবার মাইক্রোফিনান্স সংস্থাগুলো লাফাতে শুরু করেছে। তাদের ঋণ ব্যবসার মহাজনী কারবার চালিয়ে যাওয়ার জন্য হাজার হাজার গরিব মানুষের নামে তাদেরকে না জানিয়ে পুরনো ঋণ পরিশোধ দেখিয়ে নতুন করে ঋণ অনুমোদন করে নতুন করে কিস্তি শোধ করার জন্য চাপ দিতে শুরু করেছে। যেমন ধরুন কোনও ঋণগ্রহিতা কোনও মাইক্রোফিনান্স সংস্থা থেকে একলক্ষ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। তিনি কিছু কিস্তি শোধ করেছেন। আর হয়ত ৫,০০০ টাকা বকেয়া আছে। এই বকেয়া শোধ দেখিয়ে নতুন করে এক লক্ষ টাকা ঋণ দেখিয়ে নতুন কিস্তির টাকা শোধ করার চাপ দিচ্ছেন। অনেক গরিব মহিলা দ্বিগুণ ঋণে দায়গ্রস্ত হলেন। অথচ তাদের আয় বাড়ল না। উল্টোদিকে লকডাউন উঠে গেলেও কাজ না পাওয়া, সরকারি ১০০ দিনের কাজও কম হওয়া, মজুরির দীর্ঘসূত্রিতা ও কম মজুরি দেওয়া, তার উপর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে গরিব মানুষের জীবনধারণই কষ্টকর হয়ে উঠেছে। উপরন্তু আবার ঋণ না পেয়েই ঋণের কিস্তি শোধ করার চাপ সৃষ্টি গ্রামীণ গরিব মেহনতিদের পরিবারের মহিলাদের দুর্বিসহ অবস্থায় ফেলছে। গত ১৯ ডিসেম্বর বর্ধমান জেলার জামালপুর ব্লকের নন্দনপুর গ্রামে কয়েকটি ঋণগ্রস্ত মহিলাদের বৈঠকে তাদের দুর্দশার ও ক্ষোভের কথা শোনা গেল। ঠিক হল আগামী বছরের শুরুতেই ব্লক ডেপুটেশন সংগঠিত করার মধ্যে দিয়েই আন্দোলন শুরু হবে। এজেন্টদের জুলুম নির্যাতনের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ প্রতিরোধ শুরু হবে।
১৮ বছর বয়সীরা সরকার বেছে নিতে পারেন — অথচ, তারা বিয়ে করবেন কিনা, কখন করবেন এবং কাকে করবেন এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না, কেন?
মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ থেকে বাড়িয়ে ২১ করার জন্য কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার প্রস্তাবটি একটি কুপরামর্শ এবং তা অবিলম্বে বাতিল করা উচিত।
সকল প্রাপ্তবয়স্কদের বিয়ের বয়স ১৮ বছর হওয়া উচিত। একইভাবে পুরুষদেরও বিয়ের বয়স কমিয়ে ১৮ বছর করা উচিত। আমরা ১৮ বছর বয়সীদের সরকার বেছে নেওয়ার জন্য এবং দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করার জন্য সক্ষম মনে করি। তাই আমাদের অবশ্যই মেনে নিতে হবে যে তারা তাদের নিজেদের ভবিষ্যৎ সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য এবং বিয়ে করবেন কিনা, কখন বা কাকে বিয়ে করবেন তা বেছে নিতেও যথেষ্ট সক্ষম।
অল্পবয়সে মাতৃত্বের কারণে অল্পবয়সী মেয়েদের ও শিশুদের স্বাস্থ্যে বিরূপ প্রভাব পড়ার পাশাপাশি যুবতী মহিলাদের শিক্ষায় অন্তর্ভুক্তির সুযোগ কমায়। পরিবার ও অভিভাবকরাও অনেক সময়, ইচ্ছার বিরুদ্ধে, জোর খাটিয়ে মেয়েদের বাল্যবিবাহ করতে বাধ্য করে। কিন্তু বিয়ের বয়স ২১এ উত্তীর্ণ করার মাধ্যমে নারীদের দীর্ঘস্থায়ী রক্তাল্পতা, অপুষ্টি এবং শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়াকে রোখা সম্ভব নয়। দারিদ্রের অবসানেই এই সমস্যাগুলির সমাধান রয়েছে।
বাস্তবে, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ-মূলক আইনের বাস্তবায়নে সরকার ব্যর্থ। বাল্যবিবাহ আটকাতে কিশোরী বয়স থেকেই মেয়েদের স্বাধিকার ও স্বায়ত্ত্বতার প্রতি শ্রদ্ধা ও সমর্থন গড়ে তোলা জরুরি। অন্য কথায়, যাদের পরিবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়েতে বাধ্য করছে, সেই মেয়েদের জন্য সরকারের প্রাথমিকভাবে উচিত হেল্পলাইন এবং সহায়তা প্রদান করা। সরকারের সামাজিক প্রচারাভিযানে বিনিয়োগ করা উচিত যাতে নারীদের নিজেদের জীবন নিয়ন্ত্রণ করার এবং নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারের বিষয়ে সচেতনতা গড়ে ওঠে। ১৮ বছরের বেশি বয়সী সকল প্রাপ্তবয়স্কদের, লিঙ্গ নির্বিশেষে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার থাকতে হবে যে তারা কাকে, কীভাবে ও কখন জীবনসাথী হিসাবে বেছে নেবেন।
২০১৩-১৪ সালে ‘দ্য হিন্দু’ পত্রিকার একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে দিল্লীর ট্রায়াল কোর্টে রুজু করা ৪০ শতাংশ ধর্ষণের মামলা আদপে ধর্ষণের মামলাই নয় বরং সম্মতিক্রমে বিয়ে করার ঘটনা। যেখানে যুবতী মেয়েরা নিজের পছন্দের সাথীকে বিয়ে করার জন্য তাদের পরিবার এবং সম্প্রদায়ের হিংসা ও জোর-জবরদস্তির থেকে পালাতে বাধ্য হয়েছিল। ভারতে খাপ পঞ্চায়েত, সম্প্রদায়ের হর্তাকর্তা ব্যক্তি, প্রভাবশালী গোষ্ঠী ও সঙ্ঘী গুন্ডারা আন্তঃবর্ণ এবং আন্তঃধর্মীয় দম্পতিদের বিশেষত তরুণ দম্পতিদের আক্রমণ করার জন্য কুখ্যাত। এক্ষেত্রে, প্রাপ্তবয়স্ক মহিলাদের প্রায়শই অনৈতিকভাবে ‘অপ্রাপ্তবয়স্ক’ বলে অভিহিত করা হয় এবং ‘শেল্টার হোম’এ বন্দী করা হয়। শেল্টার-হোমের বন্দী জীবন থেকে এই মেয়েরা তখনই স্বাধীনতা পেতে পারে যখন তারা আন্তঃবর্ণ বা আন্তঃবিশ্বাসের সম্পর্ক ত্যাগ করতে এবং পরিবারে ফিরে যেতে সম্মত হয়। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বিবাহের আইনি বয়স বাড়ানোর প্রস্তাবটি আসলে পারিবারিক নীতি-পুলিশী ও জবরদস্তির হাত শক্ত করবে। সেক্ষেত্রে, প্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের স্ব-নিয়ন্ত্রণের অধিকারকে খারিজ করতে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধমূলক আইনকে ব্যবহার করেই পরিবার ও সম্প্রদায়ের গা-জোয়ারি চলবে।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার প্রস্তাব আদপে নারীর ক্ষমতায়নের পক্ষে নয়, এটি শুধুমাত্র সেই শক্তিগুলির ক্ষমতায়ন করবে যারা নারীর আত্মমর্যাদা আর স্বাধিকারকে পিষে ফেলতে হিংসা সংগঠিত করে।
সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার নারীর স্বাধিকার বিরোধী এই প্রস্তাব অবিলম্বে ফিরিয়ে নেওয়ার দাবি জানায়; পরিবর্তে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধমূলক বর্তমান আইনটি সংশোধন করে সমস্ত প্রাপ্তবয়স্কদের স্বাধিকারের মর্যাদা দেওয়ার দাবি করে — যাতে ১৮ বছর ও তার বেশি বয়সী সমস্ত ব্যক্তি তাদের জীবনের সমস্তক্ষেত্রে পূর্ণ স্বায়ত্ততা উপভোগ করতে পারেন।
সভাপতি রতি রাও, সাধারণ সম্পাদক মীনা তেওয়ারি, সম্পাদক কবিতা কৃষ্ণান স্বাক্ষরিত এই বিবৃতি প্রকাশ করেছে সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি।
ভারতের নারীসমাজ চায় স্বাধীনতা মর্যাদা সমানাধিকার। চায় স্বাধিকার, ক্ষমতায়ন। তারজন্য প্রয়োজন নারীশিক্ষার হার বাড়ানো, প্রয়োজন সামাজিক, শিক্ষাগত ও আর্থিকভাবে মহিলাদের আত্মনির্ভর করে তোলা; প্রয়োজন নির্ভয় স্বাধীনতা; নিজের শরীর, মন ও মননের উপর নিজের নিরঙ্কুশ অধিকার, অন্যের দখলদারি নয়। প্রয়োজন সামাজিক উন্নয়ন তথা সামগ্রিক অর্থনৈতিক বিকাশ। সেসব প্রশ্নকে বিশবাঁও জলের তলায় ফেলে রেখে হঠাৎ মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮ থেকে বাড়িয়ে ২১ বছর করা হচ্ছে। এই সিদ্ধান্ত কতটা যুক্তিযুক্ত? আসুন খতিয়ে দেখা যাক।
প্রথমে দেশের শিক্ষার হাল হকিকত দেখা যাক। অ্যান্যুয়াল স্টেটাস অব এডুকেশন রিপোর্ট অনুযায়ী দেশের ৩৫ শতাংশ পড়ুয়ার বাড়িতে মোবাইল নেই। অনলাইন শিক্ষার দরুণ দেশের মাত্র ৩৬.২ শতাংশ পড়ুয়ার কাছে পৌঁছানো গেছে স্টাডি মেটিরিয়াল। অনলাইন পড়াশুনার অবস্থা তথৈবচ। বেড়েছে স্কুলছুটের সংখ্যা। যেখানে মেয়েদের ‘পরিবারের বোঝা’ হিসেবে ভাবা হয়, কন্যাভ্রূণ হত্যা করা হয় সেখানে এই পরিস্থিতিতে সবথেকে বেশি স্কুলছুট হবে মেয়েরাই। আর তাদের ঘাড় থেকে নামানোর জন্য দিয়ে দেওয়া হবে বিয়ে। কেন্দ্রীয় সরকারের ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’ প্রকল্প সম্পর্কে সরকারি তরফে ধুমধাম করে ঘোষণা করা হয়েছিল যে কন্যাভ্রূণ হত্যা ও লিঙ্গবৈষম্যের বিরুদ্ধে কাজ করবে এই প্রকল্প। কিন্তু কাজ করা তো দূরের কথা, সম্প্রতি প্রকাশিত সংসদীয় কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী এই প্রকল্পের ৮০ শতাংশ বরাদ্দই খরচ হয়েছে বিজ্ঞাপনে। ভাবুন একবার!
সরকারি ও সরকার পোষিত স্কুলগুলিতে পড়ুয়াদের স্কুলে আনা ও যথাযথ পুষ্টিবিধানের জন্য মিড-ডে-মিল প্রকল্পের সূচনা হয়েছিল। মেয়েদের ক্ষেত্রে বাড়িতে সবসময়ই শেষে যেটুকু খাবার বেঁচে থাকে সেটুকুই জোটে। স্বাস্থ্য এবং পুষ্টির ক্ষেত্রে মেয়েরা সবসময়েই পরিবারে সবচেয়ে অবহেলিত। কোভিডকালে স্কুল বন্ধ। গৃহবন্দী সব বয়সী মেয়েদের উপর অস্বাভাবিক হারে বেড়েছিল নির্যাতন।
অন্যদিকে জিনিসপত্রের দাম আকাশ ছুঁলেও বাড়েনি মিড-ডে-মিলের বাজেট। ফলে একে একে তালিকা থেকে বাদ পড়েছে ডিম, সয়াবিন ইত্যাদি। ২০০৪ থেকে ২০১৪-১৫ অর্থবর্ষ পর্যন্ত প্রতি বছর কেন্দ্রীয় সরকার মিড-ডে-মিল খাতে সাত শতাংশ হারে বরাদ্দ বাড়িয়েছে। ২০১৫-১৬ আর্থিক বছরে সামান্য বরাদ্দ বৃদ্ধির পরে আর তা বাড়েনি, উল্টে রেকর্ড হারে কমানো হয়েছে। আগে পড়ুয়া পিছু যেখানে বরাদ্দ ছিল ১৪৯ টাকা, এবছর সেপ্টেম্বরে সেই বরাদ্দ দাঁড়ায় ৭৮ টাকায়। বাংলাদেশের মতো ছোট দেশে যখন শিক্ষায় প্রায় ৬৪,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকে বাজেটে, সেখানে ভারতের মতো দেশে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ গত বাজেটের ৯৯,৩১২ কোটি টাকা থেকে ৬,০৮৪ কোটি টাকা কমিয়ে ৯৩,২২৪ কোটি টাকায় নিয়ে আসা হয়েছে। আরও বুজরুকি চলছে আইসিডিএস’এ। এই সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্পটি মূলত শিশু ও প্রসূতি মায়েদের জন্য সার্বিক পুষ্টি, স্বাস্থ্য ও মহিলাদের আত্মনির্ভরতার কথা মাথায় রেখে চালু হয়েছিল। সেই ক্ষেত্রেও ক্রমাগত চলছে বরাদ্দ ছাঁটাই। পূর্বে আইসিডিএস ও সহযোগী খাতে বরাদ্দ ছিল ২৮,৫৫৭ কোটি টাকা; তাকে ২০,১০৫ কোটি টাকায় কমিয়ে আনা হয়েছে। সামগ্রিকভাবে নারীদের জন্য নির্দিষ্ট যে বাজেট বরাদ্দ তা গত বছরের বাজেট বরাদ্দ ২৮,৫৬২ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ২৫,২৬০ কোটি টাকা করা হয়েছে। মহিলারা যদি শিক্ষা, পুষ্টি, স্বাস্থ্য থেকে বঞ্চিত হন তাহলে আর্থিক ও সামাজিক দিক থেকে প্রতিষ্ঠিত হবেন কীভাবে, কীভাবে নিজেদের স্বর তুলে ধরবেন, কীভাবে নেবেন নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরা? তারা ‘বোঝা’ হিসেবেই চিহ্নিত হবেন বারবার এবং উল্টে বাড়বে আইন ভেঙ্গে লুকিয়ে বিয়ে দেওয়ার প্রবণতা। ১৮ বছর যখন বিয়ের বয়স তখনই আখছার ঘটছে এই ঘটনা। শুধু ২০২০ সালেই ৫০ শতাংশ বেড়েছে বাল্যবিবাহের ঘটনা — বলছে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর রিপোর্ট।
দ্বিতীয়ত মহিলাদের উপর দিনের পর দিন বেড়েই চলছে অকথ্য নির্যাতন। একজন যুবতী নির্যাতিতা হওয়া মানে ‘তাকে আর বিয়ে করবে না কেউ’ — এই ধারণাই প্রতিষ্ঠিত এই সমাজে। ‘যদি কিছু হয়ে যায়’ এই ভয়ে মেয়েদের স্বাধীন চলাফেরাতেও আছে বেড়ি। সেখানে বোঝা বিদায় করাটাই দস্তুর পরিবারগুলোতে। আছে পণের মতো প্রথা যা এই বোঝাটাকে আরও ভারী করে।
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর ২০২০ রিপোর্ট অনুযায়ী,
১) প্রতিদিন ভারতে ২৫৮ মহিলা যৌন নির্যাতন ও হেনস্থার শিকার হন।
২) প্রতিদিন ভারতে ৭৭ জন মহিলা ধর্ষণের শিকার হন।
৩) প্রতিদিন ভারতে ৩০৮ জন মহিলা তাদের সঙ্গী ও তার পরিবার দ্বারা নির্যাতিত হন।
৪) প্রতিদিন ভারতে ১৯ জন মহিলা তার সঙ্গী বা তার পরিবার দ্বারা পণজনিত কারণে খুন হন।
কী করেছে দেশের এই অপদার্থ সরকার এইসব সমস্যা সমাধানে? হাজার হাজার মাইল জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অন্ধকারাচ্ছন্ন গ্রামগ্রামান্তরে নাবালিকা বিবাহ রুখতে এই আইন আদৌ কৃতকার্য হবে? পারবে কি নিজের মতামত অনুযায়ী কোনো একজন ভারতীয় নারীর অবিবাহিত থেকে জীবন এবং যৌনজীবন উপভোগের সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে? একটি মেয়ের নিজের শরীরের উপর অধিকার, যৌনতা এক্সপ্লোর করার, কনসেন্ট দেওয়ার বয়স কী করে মাপবেন ২১’র মাপকাঠিতে? সেটা ঠিক করে দেওয়ার রাষ্ট্র কে? কিশোর কিশোরীদের যৌন আকাঙ্ক্ষা, এক্সপ্লোরেশন, প্রেম করাকে রক্তচক্ষুর মুখে পড়তে হয় সমাজে। আর প্রেমের ক্ষেত্রে এখন জোর করেই যেখানে ফতোয়া জারি করে আরএসএস-বিজেপি, ভিন্ন ধর্ম বা জাতের কাউকে বিয়ে করলে জোর করে বিয়ে ভাঙা, গর্ভপাত করানো আকছার ঘটে চলেছে দেশে। বিয়ের বয়স ২১ করার আগে মেয়েদের জীবন ও নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়ার এই দিকগুলো নিয়ে কি কিছু করেছে সরকার? উল্টে খাপ পঞ্চায়েত বাহিনী খুলে রেখেছে হেনস্থা করার জন্য, প্রেম করলে খুন করার জন্য। যার নজির আমরা দেখেছি বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশ সহ গোটা দেশেই। পরিবারের সম্মান রক্ষার নামে তো গত ২০১৭ থেকে ২০১৯’র মধ্যে খুনই করা হয়েছে ১৪৫ জন ছেলে-মেয়েকে (ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো)। মনে রাখবেন এগুলো রেজিস্টার্ড কেস। এইসব ক্ষেত্রে বেশিরভাগ কেসই নথিভুক্ত হয় না।
সারা দেশ জুড়ে বাচ্চাদের যৌন শিক্ষা দেওয়া তো দূর বরং সিলেবাস জুড়ে ঢোকানো হচ্ছে পৌরাণিক, ধর্মীয় নানা উপাদান, মেয়েদের আরও শিকলবন্দী করার নানা উপকরণ। আর তার মাঝে, হঠাৎ, কিছুর মধ্যে কিছু নেই, নিয়ে আসা হল এই হঠকারী আইন! মহিলা ক্ষমতায়ন কোনও আইনের ছিপের জোরে অলীক নিয়মে ঘটানো যায় না, তারজন্য প্রয়োজন সামাজিক সংস্কার, সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পগুলো জোরদার করা, অর্থনৈতিক ও সামগ্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। উপরোক্ত প্রক্রিয়া ছাড়া এই হঠকারী সিদ্ধান্তের ফলে একদিকে যেমন নারী নির্যাতন বাড়বে তেমনই এই রকমভাবে দিনের পর দিন আইন ভেঙে, নাবালিকা মেয়েদের জোর করে হস্তান্তরকরণ প্রক্রিয়ার (বিয়ে দেওয়ার) পথই প্রশস্ত হবে, ক্ষমতায়ন নয়!
- সৌমি জানা
গার্হস্থ্য হিংসা সংক্রান্ত ভূয়ো পরিসংখ্যানও সংসদীয় আলোচনা ও সংসদীয় প্রতিবেদনের ভিত্তি হয়ে উঠেছে। সর্বোপরি এই পরিসংখ্যানের পিছনে সরকারি উদ্দেশ্যটি শুধুমাত্র পরিসংখ্যানেই সীমাবদ্ধ নয়, বিষয়টি তার থেকেও গুরুতর।
এনসিআরবি’র রিপোর্ট অনুসারে গার্হস্থ্য হিংসার পরিসংখ্যান ব্যাপক হ্রাস পেয়েছে, কিন্তু পারিবারিক হিংসার ঘটনা প্রকৃত অর্থে বেড়েইছে। এনসিআরবি রিপোর্ট অনুযায়ী গার্হস্থ্য হিংসা সুরক্ষা আইনের অধীনে ২০১৮ সালে মোট ৫৭১টি মামলা নথিভুক্ত করা হয়েছিল। এই আইনে মামলা নথিভুক্ত করা হয়েছিল ২০১৯ সালে ৫৫৩টি এবং ২০২০ সালে ৪৪৬টি। ২৮টি রাজ্য ও ৮টি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে অর্থাৎ মোট ৩৬টির মধ্যে ২৬টিতে গার্হস্থ্য হিংসা আইনে মামলার সংখ্যা উল্লেখ হয়েছে শূন্য। মধ্যপ্রদেশে মামলার সংখ্যা সর্বাধিক রেকর্ড করেছে, মামলা গড়িয়েছে ১৮০টি। যদি উপরোক্ত রিপোর্ট বিশ্বাস করতে হয় তাহলে তো বুঝতে হয় ভারত থেকে গার্হস্থ্য হিংসা দ্রুত বিদায় নিচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন জাগে এই পরিসংখ্যানের সত্যতা নিয়ে।
এই পরিসংখ্যানের সত্যতা যাচাই করার জন্য ঘটনা ধরে ধরে তালাশ করার অতিরিক্ত প্রচেষ্টার প্রয়োজন নেই। আপনি আপনার সাধারণ বোধ থেকেই বলতে পারেন যে এই পরিসংখ্যান ভুলে ভরা। তবু নারী ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রকের ২০২০’র ২২ সেপ্টেম্বরের প্রেস বিবৃতি ফিরে দেখতে পারেন। সেখানে গার্হস্থ্য হিংসার তথ্যের উল্লেখ রয়েছে। এনসিআরবি রিপোর্ট শুধুমাত্র ফৌজদারি মামলার রিপোর্ট নয়। তাতে গার্হস্থ্য হিংসা আইন ২০০৫ অনুসারে নথিভুক্ত মামলাগুলির জন্য এনসিআরবি’র রিপোর্টে একটি আলাদা বিভাগ তৈরী করা হয়েছে। তবে সেখানে শুধুমাত্র পরিসংখ্যান লিপিবদ্ধ করা হয়।
ভূয়ো পরিসংখ্যান নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। ২০২০ সালের ২০ মার্চ লোকসভায় নারী ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রকের কাছে একটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল গার্হস্থ্য হিংসার অবস্থা সম্পর্কে। জানতে চাওয়া হয়েছিল ২০১৫, ২০১৬, ২০১৭ ও ২০১৮ সালে মোট নথিভুক্ত গার্হস্থ্য হিংসা বিষয়ক মামলার বৃত্তান্ত প্রসঙ্গে। প্রশ্নের উত্তরে নারী ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি বলেছিলেন, গার্হস্থ্য হিংসাজনিত মামলা নথিভুক্ত হয়েছে ২০১৬ সালে ৪৩৭টি, ২০১৭ সালে ৫১৫টি এবং ২০১৮ সালে ৫৭৯টি। এইসমস্ত তথ্য পরিসংখ্যান নেওয়া হয়েছে এনসিআরবি রিপোর্ট থেকে। কিন্তু এই পরিসংখ্যান প্রকৃত বাস্তবতা থেকে বহু দূরে এবং প্রশ্নোত্তরের ও আলোচনার অংশ হয়ে উঠেছে।
বিষয়টি শুধু এটুকুতেই সীমাবদ্ধ নয়। ২০২১’র ১৫ মার্চ সংসদীয় স্থায়ী কমিটি লোকসভা ও রাজ্যসভায় নারী ও শিশুদের প্রতি অপরাধ সংক্রান্ত প্রতিবেদন পেশ করে। ঐ রিপোর্টে ব্যবহৃত তথ্য নেওয়া হয়েছে এনসিআরবি’র রিপোর্ট থেকে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে এই পরিসংখ্যান সঠিক নয়। এটি একটি গুরুতর ব্যাপার। কারণ তথ্য ও প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ভবিষ্যতের নীতি ও অগ্রাধিকার নির্ধারণ করা হয়।
গার্হস্থ্য হিংসা সুরক্ষা আইনের কার্যকরী রূপায়ণের প্রশ্নে সরকারের দুর্দশার কারণ হল পর্যাপ্ত তথ্যের অভাব। মহিলা আন্দোলনের দীর্ঘ ধারায় এই আইনটি অর্জিত হয়েছে। কিন্তু গত ১৫ বছর ধরে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার এই আইনের দুর্দশাই করেছে। আইনে সুরক্ষা প্রদানের কর্মকর্তা নিয়োগের বিধান রয়েছে। নির্যাতিতা নারীর ন্যায়বিচারের পুরো বিষয়টি নির্ভর করে প্রটেকশন অফিসারকে কেন্দ্র করে। সুরক্ষা প্রদানের ভারপ্রাপ্ত অফিসারই আইনানুগ সবকিছু করে ওঠার মূল চালিকাশক্তি। কিন্তু কয়েকটি রাজ্য ছাড়া বাকি সব রাজ্য সুরক্ষা অফিসার নিয়োগ করেনি। যেখানে স্বতন্ত্র সুরক্ষা অফিসার নিয়োগ করা হয়েছে, তাদের বিভিন্ন জেলায়ও দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। যেমন ধরুন, হরিয়ানায় স্বাধীন সুরক্ষা কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে, কিন্তু তাদের সংখ্যা খুবই অপ্রতুল। ফলে অনেক সংরক্ষিত কর্মকর্তাকে দুটি করে জেলার দায়িত্ব নিতে হচ্ছে। কিছু কিছু জায়গায় আবার অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে সুরক্ষা দেখার দায় সারা হচ্ছে বিডিও’দের মাধ্যমে।
মহারাষ্ট্রের শিবসেনা সাংসদ ডঃ শ্রীকান্ত একনাথ শিন্ডে লোকসভায় নারী ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রকের প্রতিনিধির উদ্দেশে প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন সুরক্ষা অফিসার নিয়োগের ব্যাপারে। তিনি জানতে চেয়েছিলেন রাজ্য ও কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলগুলি দ্বারা পর্যাপ্ত সুরক্ষা অফিসার নিয়োগ করা হয়েছে কিনা? তা না করা হয়ে থাকলে কেন্দ্রের তরফে এবিষয়ে রাজ্য সরকারগুলির কাছে উত্তর জানতে চাওয়া হয়েছে কিনা? রাজ্য সরকারগুলি কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে? কেন্দ্র কি রাজ্য সরকারগুলিকে সংরক্ষণ আধিকারিকদের সুস্পষ্টভাবে কাজ করার জন্য বাজেট বরাদ্দ করতে বলেছে? এই প্রশ্নের উত্তরে নারী ও শিশু উন্নয়ন দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী ডঃ বীরেন্দ্র কুমার উত্তর দেন, সমস্ত রাজ্যে সুরক্ষা অফিসার নিয়োগ করা হয়েছে। তাছাড়া বেশিরভাগ রাজ্যে অন্যান্য অফিসারদের এবিষয়ে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
অর্থাৎ বেশিরভাগ রাজ্যে সেই অফিসাররা সুরক্ষা অফিসারের দায়িত্ব পাচ্ছেন যারা ইতিমধ্যেই কাজের চাপে ভারাক্রান্ত। যেখানে সবাই বোঝেন যে, গার্হস্থ্য হিংসা বিষয়ে ভূমিকা পালনের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের অতিরিক্ত সংবেদনশীলতা এবং শান্ত থাকা দরকার। যাতে তিনি সহানুভূতির সাথে ভিক্টিমদের কথা শুনতে পারেন। ভিক্টিম তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী অনুযায়ী বর্ণনা রাখার সময় অনেক সময় অনেক মানসিক অশান্তির মধ্যে দিয়ে যান, কান্নায় ভেঙে পড়েন। সেখানে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনের জন্য ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের কি সংবেদনশীলভাবে ভিক্টিমের কথা শোনার ধৈর্য্য থাকে? এনসিআরবি’র রিপোর্টে গার্হস্থ্য হিংসা সুরক্ষা আইন মোতাবেক প্রচেষ্টার অভাব থেকে যাওয়ার পিছনে কারণ হল সরকারি দুর্দশা।
- মূল হিন্দী প্রতিবেদন সূত্রঃ hindi.newsclick.in, ভাষান্তরঃ শুক্লা সেন
কিছুদিন পূর্বেই ‘বিশ্ব ক্ষুধা সূচক’ প্রকাশিত হয়েছিল যাতে ভারতের স্থান ছিল ১১৬টি দেশের মধ্যে ১০১। আরও লজ্জাজনক আফগানিস্তান ছাড়া প্রতিবেশি সমস্ত দেশের স্থান ছিল ভারতের থেকে উন্নত। এবার প্রকাশিত হল ‘বিশ্ব অসাম্য সূচক’ (গ্লোবাল ইনিকোয়ালিটি ইনডেক্স) যেটি বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ টমাস পিকেটি ও তাঁর সহযোগীদের দ্বারা প্রস্তুত করা হয়েছে। রিপোর্টের মুখবন্ধে গতবছরের দুই নোবেল বিজয়ী অভিজিত ব্যানার্জি এবং এস্থার ডাফলো ভারতকে বিশ্বের সবচেয়ে অসাম্যের দেশগুলির একটি হিসাবে বর্ণনা করছেন। দেখা যাচ্ছে ২০২১’র জাতীয় আয়ের ৫৭ শতাংশের মালিকানা রয়েছে দেশের জনসংখ্যার ১০ শতাংশ লোকের হাতে এবং নিম্নতম ৫০ শতাংশ মানুষ বছরে মাত্র ৫৩,৬১০ টাকা উপার্জন করেন। দেশের মোট সম্পদের ৩৩ শতাংশ রয়েছে অতি ধনী ১ শতাংশের হাতে। জাতীয় আয়ের মাত্র ১৮ শতাংশ থাকে নারীদের ভাগে, যেটা এশিয়ার ক্ষেত্রে ২১ শতাংশ।
এটা নতুন কিছু নয়। প্রায় একবছর পূর্বে অক্সফ্যাম দ্বারা প্রকাশিত অসাম্য সূচকে দেখা গিয়েছিল যে অতিমারীর সময় একঘন্টায় মুকেশ আম্বানি যত অর্থ উপার্জন করেছেন, একজন অদক্ষ শ্রমিককে তা উপার্জন করতে ১০,০০০ বছর লেগে যাবে; আর আধুনিক যুগের এই কুবের একসেকেন্ডে যা আয় করেছেন তা আয় করতে ঐ অদক্ষ শ্রমিকের ৩ বছর লেগে যাবে। এই রিপোর্ট অনুযায়ী আদানি, শিব নাদার, উদয় কোটাক, কুমারমঙ্গলম বিড়লা, আজিম প্রেমজিদের মতো অর্বুদপতিদের সম্পদ ২০২০’র মার্চের পর থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। অপর দিকে শুধুমাত্র ২০২০’র এপ্রিলে প্রতি ঘন্টায় ১,৭০,০০০ লোক চাকরি হারিয়েছেন। এই রিপোর্ট অতিমারীর সময়ে অর্থ, লিঙ্গ ও শিক্ষায় অসাম্যর কীভাবে উল্লম্ফন ঘটেছে তা উন্মোচিত করেছে। ভারতে লকডাউনের সময়ে বিলিওনিয়ারদের সম্পদ বৃদ্ধি পেয়েছে ৩৫ শতাংশ এবং ২০০৯ থেকে তা বেড়েছে ৯০ শতাংশ।
বাস্তবে লকডাউনের সময় থেকে করোনা ছাড়াও আরও একটি ভাইরাস দ্বারা সমাজ বিদীর্ণ হয়েছে, সেটি হল ‘অসাম্যের ভাইরাস’। রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতের সবচেয়ে সচ্ছলতম অংশ অতিমারীর এই মারণ কামড় থেকে রক্ষা পেয়েছে, এমনকি সেটার ফায়দা তুলতে পেরেছে কিন্তু বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এর ধাক্কায় বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। এর কারণ সরকার লকডাউনের সময় যাঁরা জীবিকা হারিয়েছেন (১২.২ কোটি, যাঁদের মধ্যে অসংগঠিত শ্রমিকের সংখ্যা হচ্ছে ৯.২ কোটি) তাঁদের সাহায্যের জন্য যথেষ্ট অর্থ ব্যয় করেনি।
লকডাউনের কারণে শিক্ষাব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়েছে। স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে ড্রপ-আউটের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। সরকার অনলাইন শিক্ষার ঢক্কানিনাদ শুনিয়েছে। কিন্তু সেটা শুধুই ফাঁপা আওয়াজ। যে দেশের গ্রামাঞ্চলে মাত্র ৪ শতাংশ মানুষের কম্পিউটার আছে এবং ১৫ শতাংশের আছে নেট কানেকশন, সেখানে অনলাইন শিক্ষা একটা নির্মম মজা ছাড়া আর কিছু না। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে দরিদ্রতম ২০ শতাংশ মানুষের মধ্যে মাত্র ৬ শতাংশের মোটামুটি একটা শৌচালয় আছে এবং জনসংখ্যার ৫৯.৬ শতাংশ একটি ঘরে বা সেটার থেকেও কম পরিসরে দিন গুজরান করতে বাধ্য হয়।
তবুও বলতে হয় এতে আশ্চর্য হওয়ার কী আছে। দারিদ্র, অসাম্য তো প্রায় ভারতের নিয়তি। আশির দশকে কি ভারতে দারিদ্র ছিল না? দারিদ্র তখনো অবশ্যই প্রকট ছিল, কিন্তু অসাম্য এতো লাগামছাড়া ছিল না। কারণ তখন হাতেগোনা কোটিপতি, মিলিয়োনিয়ার ছিল, বিলিয়োনিয়ার কথাটা তখনো অশ্রুত, কল্পনার ধরাছোঁয়ার বাইরে; মধ্যবিত্ত শ্রেণীও অনেক সংকুচিত ছিল। সেইঅর্থে অভাব অনেক সমবন্টিত ছিল। ১৯৯১য়ে মনমোহন সিংয়ের হাত ধরে আর্থিক সংস্কার সূচিত হওয়ার সাথে সাথে জাতীয় অর্থনীতি এক নির্ণায়ক মোড় নিল। বাজারের গুরুত্ব বাড়ল, অর্থনীতিতে সরকারের অংশগ্রহণ সীমিত করার প্রচেষ্টা শুরু হল। শিল্পপুঁজি ধীরুভাই হয়ে মুকেশ আম্বানির পরিষেবা (মূলত টেলেকম) পুঁজিতে রূপান্তরিত হল। মধ্যবিত্ত শ্রেণী ধীরে ধীরে ফুলে ফেঁপে উঠতে লাগলো, অর্বুদপতির সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে শুরু করলো। তবুও লাগামছাড়া বাজার অর্থনীতি তখনো অধরা। প্রায় পঁচিশ বছর ধরে, যে সরকারই ক্ষমতায় এসেছে তারা দোলাচলে থেকেছে, অর্থনীতি জনমোহিনী হবে না বাজার আরও উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। প্রায় প্রতিটি বাজেট এই দুটিকে ব্যালান্স করার চেষ্টা করেছে, আর বাজার অর্থনীতির খ্যাতনামা প্রবক্তরা, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ’এর শকুনেরা চিল চিৎকার করেছে যে অর্থনৈতিক সংস্কার ত্বরান্বিত করার জন্য সরকার যথেষ্ট সাহস দেখাতে পারছে না। অবশেষে এলো আর একটি মাইলফলক ‘২০১৪’। এমন একটি সরকার ক্ষমতায় এলো যাঁরা শুধুমাত্র বাজার অর্থনীতিতে বিশ্বাস করে এমনটা নয়, তারা সেটা যেন তেন প্রকারণে প্রয়োগ করতে বদ্ধপরিকর।
এরপর থেকে সরকারের মূলমন্ত্র হয়ে গেল মিনিমাম গভর্ণমেন্ট, ম্যাক্সিমাম গভর্ণন্যান্স। বাস্তবে এর পরিণতি হল বাজার অর্থনীতিকে পরিচালিত করবে, যেমন খুশি নিয়ন্ত্রণ করবে, ছাড় দেবে; সরকারের ভূমিকা হবে নগণ্য। সরকার শুধুমাত্র ব্যবসা, বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ গড়ে দেবে, এবার তুমি করে খাও। এই পরিস্থিতিতে সচ্ছল মানুষেরা তাঁদের প্রভাব প্রতিপত্তি খাটিয়ে আরও বিত্তশালী হয়ে উঠলো; সমাজের দুর্বল মানুষ এই অসম প্রতিযোগিতায় আরও পিছিয়ে পড়তে লাগল। দেখা গেছে আর্থিক সংস্কার শুরু হওয়ার পর থেকে অসাম্য বৃদ্ধির হার বেড়েছে, ২০১৪’র পর তা আরও ত্বরান্বিত হয়েছে, অতিমারীর সময়ে তা লাগামছাড়া হয়ে গেছে।
এই অসাম্য রোধ করতে পিকেটি ধনীদের ওপর সম্পদ কর বসানোর নিদান দিয়েছেন। ভারতে অতীতে এটা হয়েছে। কিন্তু আইনের নানা ফাঁকফোকরের কারণে তাতে সামান্যই কাজ হয়েছে। যে দেশের জনসংখ্যা ১৪০ কোটি সেখানে কি শুধুমাত্র সম্পদ কর বসিয়ে অসাম্য রোধ করা সম্ভব? সরকার যত বিলগ্নিকরণ, বেসরকারিকরণ করবে, রেল, সড়কপথ, বিমান, ব্যাংক, বিমার মতো অত্যাবশ্যকীয় ক্ষেত্রগুলো আম্বানি-আদানিদের হাতে তুলে দেবে ততো এই অসাম্য বাড়বে। যেখানে সমাজের একটি বিপুল অংশ এখনো দারিদ্রে নিমজ্জিত সেখানে সরকার সমাজ-অর্থনীতি থেকে নিজেকে এভাবে সরিয়ে নিতে পারে না। এয়ার ইন্ডিয়া বিক্রি হয়ে যাওয়া একটা অশনি সংকেত। সাংসদ মালা রায়ের একটি প্রশ্নের উত্তরে অর্থমন্ত্রক পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে যে ৩৫টি রাষ্টায়ত্ত সংস্থা বিলগ্নকরণের পরিকল্পনা রয়েছে। এরমধ্যে স্টিল প্ল্যান্ট, পেট্রোলিয়াম, শিপিং সব আছে। এ যেন চৈত্রের সেল!
করোনার ক্রমাগত ঢেউ, বেসরকারিকরণ-বিলগ্নিকরণ এবং কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার ত্রহ্যস্পর্শে সমাজজীবন আরও বিপর্যস্ত হবে। যাঁদের চাকরি চলে গেছে তাঁদের অল্প অংশই চাকরি ফিরে পাবে। এছাড়া আরও বহু লোকের রোজগার প্রতিনিয়ত বিপন্ন হবে। ডিজিটাল অর্থনীতির কারণে নতুন কাজের উদ্ভব হবে কিন্তু তা পুরানো কাজের শূন্যপূরণ করার জন্য যথেষ্ট হবেনা। সরকারি অনুদান বিশেষ করে সর্বজনীন ন্যূনতম আয় এখন অপরিহার্য। নাহলে আরও অসাম্য, দারিদ্র, গভীর অর্থনৈতিক সংকট অবশ্যম্ভাবী।
- সোমনাথ গুহ
কোভিড মহামারী চলাকালীন দীর্ঘায়িত লকডাউন এবং বর্ধিত অর্থনৈতিক শাটডাউন ভারতের জনসংখ্যার প্রতিটি অংশকে আঘাত করেছে, তবে দরিদ্ররা হয়েছে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। কারণটি শুধু যে উৎপাদনশীল কর্মকাণ্ড কয়েক মাসের জন্য বন্ধ ছিল তা নয়, এটা গত তিন দশকের একটি পূর্ব-বিদ্যমান প্রবণতাকে বাড়িয়ে তুলেছে, ‘ক্রমবর্ধমান বৈষম্য’।
ইউএনডিপি’র সাম্প্রতিক বহুমাত্রিক দারিদ্র্য প্রতিবেদনে দেখা গেছে যে বিশ্বের ১৩৯ কোটি দরিদ্রের মধ্যে ভারতেই রয়েছে ২২.৭ কোটি, প্রায় ১৬ শতাংশ। প্রতিবেদনে দেখা গেছে যে ছয়টি বহুমাত্রিক দরিদ্রের মধ্যে পাঁচটি তপশিলি জাতি, তফসিলি উপজাতি এবং অন্যান্য অনগ্রসর জাতি এর অন্তর্গত। তাই, ভারতে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক দরিদ্রের বাসস্থান যারা ক্ষুধা ও অপুষ্টির বিরুদ্ধে লড়াই করে, শিক্ষা থেকে বঞ্চিত এবং বর্ণের ভিত্তিতে বৈষম্যের মোকাবিলা করে। পিউ রিসার্চ সেন্টারের ২০২১ সালের মার্চের একটি প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হয়েছিল যে কোভিড মহামারীর প্রভাব তীব্র হওয়ার সাথে সাথে অতিরিক্ত ৭.৫ কোটি ভারতীয়কে দারিদ্র্যের মধ্যে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল এবং মধ্যবিত্ত ৩.২ কোটি হ্রাস পেয়েছে।
যদিও ভারতে মূলধারার আলোচনা এখন জিডিপি বৃদ্ধির হার নিয়ে, কিন্তু প্রশ্ন হল “এটি দরিদ্রদের অর্থনৈতিকভাবে পুনরুদ্ধার করতে সাহায্য করবে কিনা?” বৈষম্যের কারণে মহামারী চলাকালীন ভারতে ৬০ শতংশ দারিদ্র্য বৃদ্ধি হয়েছে, তবুও ভারতে এখন বিশ্বর তৃতীয় বৃহত্তম সংখ্যক বিলিয়োনিয়ার রয়েছে। সুতরাং, দেখাই যাছে জিডিপি বৃদ্ধির হার এবং দারিদ্র্যের ঘটনা হ্রাসের সাথে সংযোগ খুবই দুর্বল।
ভারতীয় অর্থনীতিতে বৈষম্য রেকর্ড পরিমাণে। নীচের ২০ শতাংশ ভারতীয়র কাছে জাতীয় সম্পদের মাত্র ৩ শতাংশ। যখন আমরা সর্বনিম্ন আয়ের জনসংখ্যার ৫০ শতাংশ বিবেচনা করি, তাদের কাছে রয়েছে জাতীয় সম্পদের মাত্র ১৫ শতাংশ। যেখানে শীর্ষ ১ শতাংশ আয়ের ভারতীয়র অংশ ১৫ শতাংশের বেশি। এছাড়াও, শীর্ষ ১ শতাংশ গত ত্রিশ বছরে জাতীয় আয়ে তাদের অংশ প্রায় তিনগুণ করেছে। ভারত এখন অসম অর্থনীতিতে বিশ্বের এক নম্বর।
সাম্প্রতিক দশকগুলিতে, গ্রামীণ এলাকায় জমির পুনর্বন্টন প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। জমির সিলিং আইন ক্রমবর্ধমান ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে। পরিবর্তে, সরকারগুলি শিল্প এবং নগরায়নের জন্য জমি সুরক্ষিত করার দিকে মনোনিবেশ করে। ক্ষুদ্র কৃষকরা ক্রমবর্ধমান চাপের মধ্যে রয়েছে, বিশেষ করে ঋণের কারণে। ২০০১ সালের শুরুর দশকে প্রতি ঘন্টায় ১০০ কৃষক ভূমিহীন হয়ে পড়ে।
অক্সফ্যামের ‘দ্য ইনইকোয়ালিটি ভাইরাস’ নামে একটি প্রতিবেদনের ইন্ডিয়া সাপ্লিমেন্টে বলা হয়েছে যে মহামারী চলাকালীন বিলিয়োনিয়ার মুকেশ আম্বানি এক ঘন্টায় যা আয় করেছিলেন, তা করতে একজন অদক্ষ কর্মীর ১০,০০০ বছর সময় লাগবে। তিনি প্রতি সেকেন্ডে যে আয় করেছিলেন, তা করতে একজন শ্রমিকের তিন বছর সময় লাগে।
ইন্ডিয়া সাপ্লিমেন্ট দেখায় যে মহামারী চলাকালীন সবচেয়ে ধনী বিলিয়োনিয়াররা যা আয় করেছে তার একটি ভগ্নাংশ দিয়ে দারিদ্র্যের মধ্যে পড়ার ঝুঁকিতে থাকা ৪০ কোটি অস্থায়ী কর্মী কমপক্ষে পাঁচ মাস দারিদ্র্যসীমার উপরে থাকতে পারত। ভারতের দরিদ্রদের জন্য দীর্ঘমেয়াদী প্রতিকূল প্রভাব থাকবে এবং এভাবেই চললে বৈষম্য বাড়তে বাধ্য।
- নিউজ ক্লিক, ২৬ নভেম্বর ২০২১
মহাত্মা গান্ধীর ‘বাবুয়া’বা বরুণ দাশগুপ্ত সম্প্রতি প্রয়াত হয়েছেন। তাঁর স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয় গত ১৯ ডিসেম্বর। তাঁর কৈশোর এবং যৌবনে জ্যাঠামশায় সতীশচন্দ্র দাশগুপ্তের সোদপুর গান্ধী আশ্রমের পরিমন্ডলে শিক্ষা ও বড় হয়ে ওঠা, পিতা ক্ষিতীশ দাশগুপ্ত ছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ভাবধারার অনুসারী, পরবর্তী সময়ে মার্কসীয় দর্শনে আকৃষ্ট হয়ে, সেই রাজনৈতিক পরিচয়ে ছয় দশক ধরে এক আদর্শ সাংবাদিকের দায়িত্ব পালন করে গেছেন, এভাবেই স্মৃতিচারণা করেন প্রখ্যাত সাংবাদিক শঙ্কর রায়। তিনি বলেন, মনে পড়ছে ৩০ জুলাই ২০১৯এ নেতাজী ইন্ডোর স্টেডিয়ামে সিপিআই(এমএল)-এর চারু মজুমদার জন্মশতবর্ষ সমাবেশে বরুণদা, তপন বন্দ্যোপাধ্যায় ও আমি ছিলাম। মার্ক্স-চর্চাবিদ ও সাহিত্যশিল্পকলাবিদগ্ধ তপন, আমার মতো যার মার্ক্স-লেনিনপাঠ নরহরি কবিরাজ ও সত্যেন্দ্র নারায়ণ মজুমদারের কাছে। কিশোর বয়সে চারুবাবু, সৌরেন বসু প্রভৃতিদের বিপ্লবী কাজকর্মে আইডল ছিলেন শিলিগুড়িবাসী সত্যেনদা, আন্দামানে সেলুলার জেলে দীর্ঘতম নির্বাসিতদের একজন, যে কারণে তিনি কমিউনিস্ট কনসলিডেশনে যোগদানকারীদের মধ্যে সবশেষে ছাড়া পেয়ে অবিভক্ত সিপিআই’এ যোগ দিয়েছিলেন। তপন ছিল বরুণদার অতি প্রিয়, যদিও ওদের বারদশেকের বেশি মুখোমুখি মোলাকাত হয়নি, দূরভাষে কখনো কখনো কথা হত। সেদিন ছিল দুজনের শেষ দেখা। নিত্যানন্দ ঘোষ ও দিলীপ সেনের উদ্যোগে সেদিন গাড়ী করে যাওয়া সম্ভব হয়েছিল। সেদিন দুজনেই (আমিও) সিপিআই(এমএল)-এর সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের ভাষণ শুনে খুব তৃপ্ত হয়েছিলাম। ভারতে ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি ও দৌরাত্ম্যের বিষময়তার কথা দীপঙ্করের বক্তব্যে ফুটে উঠেছিল। তিনি আরও বলেন, বরুণদা ছিলেন ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শ্রম বিষয়ক সাংবাদিক, বিশেষজ্ঞ ছিলেন রণনীতি ও বিদেশনীতি বিষয়ে। অসম বিষয়ে তিনি প্রচুর কাজ করেছেন। শেষের দিকে শ্রীলঙ্কা নিয়েও অনেক লিখেছেন।
কবি মনোতোষ চক্রবর্তী ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ করেন। অধ্যাপক নিত্যানন্দ ঘোষ ঘনিষ্ঠ দু’দশকের স্মৃতিচারণায় বলেন, বরুণদাকে দেখে কেউ বুঝতে পারতেন না তাঁর কোনো প্রথাগত শিক্ষা ছিলনা, অথচ যেকোনো বিষয়ে তাঁর ছিল গভীর বোধ। অসমে কর্মজীবনের প্রথমদিকে তিনি কমলা মজুমদারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হন এবং কমলা মজুমদার তাকে প্রতিষ্ঠিত হতে অনেক সাহায্য করেছেন। তিনি শুধু বড় পত্রিকাতেই লিখতেন তা নয়, ছোট পত্রিকাতেও লিখেছেন। এছাড়াও বক্তব্য রাখেন ‘সপ্তাহ’ পত্রিকার দিলীপ চক্রবর্তী। তিনি বলেন, প্যারেলালের গান্ধীর জীবনচরিত রচনার সময় তাঁর লাইব্রেরীতে মার্ক্সীয় দর্শনের একটি বই তাকে আকৃষ্ট করে। এরপর পান্নালাল দাশগুপ্তের প্রভাবে যুক্ত হন কমিউনিস্ট আন্দোলনে। ‘সপ্তাহ’ পত্রিকা শুরুর সময় থেকেই তিনি ছিলেন। এমন নির্ভীক নিরপেক্ষ সাংবাদিক পাওয়া কঠিন।
- দীপা জোয়ারদার
পানিহাটি আগরপাড়া অঞ্চলের সমাজবাদী ধারার আন্দোলনের নেতা হিসেবে ডাক্তার সন্মথনাথ ঘোষ ছিলেন এক সর্বজনশ্রদ্ধেয় মানুষ। ৯৩ বছর বয়সে কিছুদিন রোগভোগের পর তিনি প্রয়াত হলেন গত ১০ ডিসেম্বর। তাঁর শেষযাত্রায় উপস্থিত ছিলেন এলাকার অসংখ্য মানুষ ও বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিরা।
ডাক্তার সন্মথনাথ ঘোষ সমাজবাদী আন্দোলনের এক নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তি হলেও অন্যান্য নানা সংগঠনের মানুষের কাছেও ছিলেন শ্রদ্ধা ভালোবাসার এক মানুষ। পানিহাটি ও সংলগ্ন বিভিন্ন অঞ্চলের নানা ধরনের গণআন্দোলনে কয়েক দশক ধরে তিনি ছিলেন মূল স্তম্ভ। উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য এলাকার মানুষ যেমন তাঁকে শ্রদ্ধা করতেন, তেমনি চিকিৎসক হিসেবেও দরদী ভূমিকার জন্য তিনি বিখ্যাত ছিলেন। বিনাপয়সায় বা যৎসামান্য অর্থের বিনিময়ে দশকের পর দশক জুড়ে গরিব মানুষদের চিকিৎসা করে তিনি হয়ে উঠেছিলেন গরিবের পরম বন্ধু।
নব্বই অতিক্রমের পরেও বিভিন্ন গণআন্দোলনের মঞ্চে তাঁর উপস্থিতি সবাইকে প্রাণিত করত। বুঝিয়ে দিত বয়স তাঁর মন মানসিকতায় কোনও প্রভাব ফেলতে পারেনি।
ডাক্তার সন্মথনাথ ঘোষের প্রয়াণের সংবাদ পেয়ে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের উত্তর ২৪ পরগণা জেলা কমিটির পক্ষ থেকে তাঁর বাড়িতে গিয়ে শোকবার্তা তুলে দেওয়া হয় তাঁর ভাই রবীন্দ্রনাথ ঘোষ ও পুত্র সন্দীপ ঘোষের হাতে।
ডাক্তার সন্মথনাথ ঘোষ অমর রহে।
কমরেড মলয় ভট্টাচার্য প্রয়াত
বেলঘরিয়া অঞ্চলের কমরেড মলয় ভট্টাচার্য গত ২০ ডিসেম্বর প্রয়াত হন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৭ বছর। কমরেড মলয়ের বাবা ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং মা ছিলেন প্রগতিশীল প্রতিবাদী সাহসী মহিলা। মলয় স্কুলে বিপিএসএফ করতেন। ১৯৭৪ সালে মুর্শিদাবাদের কমরেড তপন ভট্টাচার্যের সংস্পর্শে আসেন এবং ঐবছর ২৮ জুলাই পুনর্গঠিত সিপিআই(এমএল)-এর সাথে যুক্ত হয়ে যান।
১৯৭৭ সালে জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার ও সাধারণ নির্বাচনে এরাজ্যেও কংগ্রেস পরাজিত হয় এবং বামফ্রন্ট আসে ক্ষমতায়। ঐসময় মলয়দের বাড়ি ছিল পার্টির আশ্রয়স্থল। বিশেষ করে মলয়ের মা — আমাদের সবার মাসিমা ছিলেন এই কর্মকাণ্ডের মধ্যমনি। ওদের পরিবারের সবাই পার্টির সেই সময়কার আশ্রয় দেওয়ার গুরুত্বপূর্ণ কাজ নিঃশব্দে করে গেছেন। প্রয়াত পার্টি নেতৃবৃন্দ যেমন বিনোদ মিশ্র, ধূর্জটি প্রসাদ বক্সী, সুদর্শন বসু সবাই আশ্রয় নিয়েছেন। এমনকি বর্ধমান, পুরুলিয়া, বাঁকুড়ায় জেল ভেঙে আসা কমরেডরাও আশ্রয় নিয়েছেন।
মলয় প্রথম জীবনে স্থানীয় এক চিকিৎসকের কম্পাউন্ডার হিসাবে কাজ করেছেন। এই সময় পুলিশের চোখ এড়িয়ে বহু জখম কমরেডকে চিকিৎসকের সহযোগিতায় সুস্থ করে তুলেছিলেন।
১৯৯০ সালে মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে ব্যারাকপুর কোর্টে ১২ দলের আইন আমান্য আন্দোলনে পুলিশের লাঠির ঘায়ে মলয়ের হাত ভেঙে যায়, সুস্থ হয়ে আবার মিছিল মিটিংয়ে অংশ গ্রহণ করতেন। পেশাগত জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু হয় সিইএসসি’তে ঠিকা শ্রমিক হিসাবে। ইতিমধ্যে ওর শরীরে মধুমেহ রোগ দানা বাঁধে। অবসরের পর প্রায়ই অসুস্থ থাকতেন। তা সত্ত্বেও পার্টির প্রতিটি মিটিংয়ে উপস্থিত থাকার চেষ্টা করতেন। বিগত কয়েকমাসে শরীর আরও ভেঙে গেলে, পানিহাটি হাসপাতালে ভর্তি হন। তারপরে বাড়িতেই চিকিৎসা চলছিল, অবশেষে চিরবিদায় নিলেন। কমরেড মলয়কে পার্টির বেলঘরিয়া পার্টি কমিটি রক্তপতাকা, ফুল ও লাল সেলাম জানিয়ে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করে এবং ওঁর পরিবারকে সমবেদনা জানায়। মলয় রেখে গেছেন স্ত্রী, কন্যা, জামাতা ও একজন দৌহিত্রী।
কমরেড মলয় ভট্টাচার্য লাল সেলাম।
কমরেড নবকুমার হাজরা প্রয়াত
গত ৫ ডিসেম্বর পুর্ব বর্ধমান জেলার মেমারী ১নং ব্লকের কাকডাঙ্গা গ্রামের দীর্ঘদিনের পার্টি সদস্য নবকুমার হাজরা ৬০ বছর বয়সে অসুস্থ অবস্থায় প্রয়াত হয়েছেন। তিনি কৃষিমজুর ছিলেন। এলাকার বিভিন্ন সময়ে মজুরি আন্দোলন ও অন্যান্য আন্দোলনে সক্রিয় ভুমিকা নিয়েছিলেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি পার্টির প্রতি অনুগত ছিলেন। এই কমরেডের মৃত্যুতে পার্টির জেলা কমিটির পক্ষ থেকে গভীর শোকপ্রকাশ এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের ও শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করা হয়। কমরেড নবকুমার হাজরা লাল সেলাম।